পার্থ টু জোহানেসবার্গ
বড় প্লেনের পেছনের দিকে সিট পড়ার একটা সুবিধা মাঝে মাঝে পাওয়া যায়। সুবিধাটা হলো প্লেনে ওঠার সময় আগে ওঠা যায়। সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজ
ফ্লাইট নম্বর SA281 এর বোর্ডিং শুরু হলো রাত এগারোটা দশ-এ। বিজনেস ক্লাস আর
বৃদ্ধ ও শিশুদের পর ইকোনমি ক্লাসের বোর্ডিং শুরু হতেই আমি উঠে গেলাম। আমার সিট 69A। আমার পেছনেও আরো প্রায় ৭-৮ টি রো আছে।
সিটে বসার পর বেশ আরাম লাগলো। প্রায় দশ ঘন্টা থাকতে হবে এই জায়গায়।
দীর্ঘ আকাশভ্রমণ খুবই উপভোগ্য আমার কাছে। টেক অফ করলেই মনে হয় পরবর্তী দশ-বারো
ঘন্টা কোন চিন্তা ছাড়াই পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। যদিও মাধ্যাকর্ষণের
বাঁধন থাকে, কিন্তু সে বাঁধন তো দেখা যায় না। একবার যাত্রা শুরু করলে মাঝখানে আর
থামার সুযোগ নেই। বড় রকমের দুর্ঘটনা হলে বাঁচার সম্ভাবনাও প্রায় নেই। তাই ভয় পাবারও
কিছু নেই।
সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজের কেবিন-ক্রুদের
বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ। যখন হাসে ঝকঝকে দাঁতগুলোতে আলোর ঝলকানি লাগে।
ইনফ্লাইট সেবাযত্নের কোন কমতি নেই। আফ্রিকানরা
উজ্জ্বল রঙ পছন্দ করে। প্লেনের ফ্লোরগুলোতে গাঢ় নীল কার্পেট, সিটকভারেও নীল। গাঢ়
নীল রঙের সুবিধা হলো ময়লা হলেও প্রকটভাবে দেখা যায় না।
পাশের সিটে এসে বসলেন একজন প্রৌঢ়া। একই
সারিতে প্যাসেজের ওদিকে বসলো দুটো বাচ্চা নিয়ে একজন তরুণী-মা। একটা বাচ্চার বয়স
তিন-চার বছর হবে। অন্যটি একেবারে শিশু; মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে আছে। একটু পরেই
প্রৌঢ়া এবং তরুণী মায়ের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেলো।
বুঝতে
পারলাম তারা মা-মেয়ে। ইংরেজিতেই কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু একটা বিশেষ টান। আমেরিকা,
কানাডা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের পর দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রচুর
শ্বেতাঙ্গ ইংরেজিভাষীর বাস। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে
গণতান্ত্রিক শাসন - যাকে শ্বেতাঙ্গরা বলে কৃষ্ণাঙ্গদের শাসন - প্রতিষ্ঠিত হবার পর
শ্বেতাঙ্গদের দাপট অনেকটাই কমে গেছে সেখানে। তার কিছুটা প্রমাণ এই ফ্লাইটেই দেখতে
পাচ্ছি। কেবিন-ক্রুদের বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু যাত্রীদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গের সংখ্যা
তুলনামূলকভাবে খুব কম। প্রচুর ভারতীয় আছে যাত্রীদের মধ্যে। দক্ষিণ
আফ্রিকায় ভারতীয়দের সংখ্যা বেশ বড়।
টেক-অফ করার একটু পরেই কোমল পানীয় চলে
এলো। তারপর রাতের খাবার যখন এলো তখন রাত দুটো বেজে গেছে। মেলবোর্নে তখন ভোর চারটা।
এটাকেই ডিনার ধরে নিতে হবে। কারণ কেইপ টাউনে এখন রাত ৮টা।
চিকেন আর রাইস। ভাত আর মুরগি সব দেশেই প্রায়
একই রকমের হয়। কিন্তু মসলায়- কোনটা হয় ইন্ডিয়ান, কোনটা মালয়েশিয়ান, আবার কোনটা
আফ্রিকান। যেমন এটা। আফ্রিকান খাবারের স্বাদ একটু অন্যরকম। মসলায় কড়া গন্ধ। এই
গন্ধটাই হয়তো মিস করে আফ্রিকানরা - যখন আফ্রিকার বাহিরে থাকে।
ফ্লাইট
স্ট্যাটাস দেখলাম। আরো প্রায় নয় ঘন্টার দূরত্ব বাকি। একটা দীর্ঘ গভীর ঘুম দেয়া
যাক। তার আগে ঘড়ির সময়টা আরেকবার বদলানো দরকার। দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে পার্থের
সময়ের পার্থক্য ছয় ঘন্টা। তার মানে এখন সেখানে রাত সাড়ে আটটা। একদিনের মধ্যেই
অনেকগুলো টাইম জোন পার হতে বেশ মজাই লাগছে।
ঘুমানোর জন্য আমার কোন আয়োজনের দরকার হয়
না। হাতে পাঁচ-ছয় ঘন্টা সময় আর পিঠ পাতার একটু জায়গা হলেই আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারি। যথাসম্ভব
জানালার দিকে সরে এসে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কানের কাছে বাজতে লাগলো দক্ষিণ
আফ্রিকান ইংরেজি কথোপকথন।
মা-মেয়ের মধ্যে যে একটা স্বাভাবিক
বন্ধুত্ব থাকে তার কোন তুলনাই হয় না। এই
বন্ধুত্বের রসায়ন আমি ঠিক বুঝি না। কিন্তু আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় দেখেছি মা-মেয়ের
মধ্যে যেরকম বন্ধুত্ব হয়, মা ও ছেলের মধ্যে ঠিক সেরকম বন্ধুত্ব হয় না। বাবা ও
ছেলের মধ্যে কিছুটা বন্ধুত্ব হয়, কিন্তু তা কোনভাবেই মা ও মেয়ের বন্ধুত্বের মতো অতটা
নিঃসংকোচ হয় না। দুজন মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কই আমার কাছে
সবচেয়ে নিঃস্বার্থ সম্পর্ক বলে মনে হয়। বন্ধু বন্ধুর স্বার্থ রক্ষা করে ঠিক - কিন্তু প্রকৃত বন্ধুত্ব পরস্পরের স্বার্থরক্ষার
উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠে না। স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাকে প্রকৃত
বন্ধুত্ব বলা চলে না।
এরকম দার্শনিক চিন্তার একটা ভালো দিক
হলো - এটা নিদ্রা সহায়ক। ঘুম ভাঙলো সাড়ে ছয় ঘন্টা পর।
প্লেনের ভেতর আলো-আঁধারী চলছে। প্রায় সবাই ঘুমাচ্ছে। এরই মাঝে কেউ কেউ সিনেমা
দেখছে। তাদের মনিটরের আলোতে নীলচে আলো-আঁধারী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আমার বাথরুমে
যাওয়া দরকার। উইন্ডো সিটে বসার সুবিধা হলো- কেউ ডিস্টার্ব করে না। আর অসুবিধা হলো
সিট ছেড়ে উঠতে হলে অন্যকে ডিস্টার্ব করতে হয়। পাশের ভদ্রমহিলা ঘুমাচ্ছেন। তাঁকে
জাগাতে সংকোচ হচ্ছিলো। কিন্তু আর বসে থাকা যাচ্ছে না।
“এক্সকিউজ মি” -
ভদ্রমহিলার
ঘুম ভাঙলো না। কিন্তু তাঁর মেয়ের ঘুম ভেঙে গেলো। সে হাত বাড়িয়ে তার মাকে ধাক্কা
দিয়ে তুলে দিলো। তিনি উঠে দাঁড়াতেই আমি দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম।
ফিরে আসার সময় দেখলাম কেবিন-লাইট জ্বলে
উঠেছে। অনেকেই দাঁড়িয়ে হাত-পা নাড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন সিটের
কাছে। তাঁর কোলে শিশু-নাতনী হাত-পা ছুঁড়ছে। তাঁর কন্যা সিটে নেই। হয়তো বাথরুমে
গেছে বা শিশুর খাবার তৈরি করে আনতে গেছে।
ব্রেকফ্রাস্ট টাইম। চয়েজ দুটো। হট অ্যান্ড কোল্ড। হট ব্রেকফাস্টে আছে ডিম, সসেজ আর সীমের বিচি। আর কোল্ড হলো ঠান্ডা মাংসের
বার্গার, দই ইত্যাদি। ক্ষুধার মুখে হট ব্রেকফাস্ট - কী যে মজা!
প্লেন
আফ্রিকার সীমানায় ঢুকে গেছে। এই প্রথম আফ্রিকা মহাদেশে পা রাখতে যাচ্ছি। একটা চাপা
উত্তেজনা কাজ করছে।
দক্ষিণ
আফ্রিকার এয়ারপোর্টে কোন কাস্টমস ফরম বা ইমিগ্রেশান ফরম পূরণ করে জমা দিতে হয় কিনা
জানা দরকার। ফরম পূরণ করার থাকলে তা সাধারণত প্লেনে সরবরাহ করা হয়। আমি কোন ফরম
পাইনি।
পার্শ্ববর্তিনীকে জ্ঞিজ্ঞেস করলাম
ফর্মের ব্যাপারে। তিনি ঠিক জানেন না। বললেন, “আমাদের তো করতে হয় না। কিন্তু তোমার লাগবে কিনা ঠিক জানি না।
“থ্যাংক ইউ ম্যাডাম। আই উইল ফাইন্ড ইট আউট।”
কিন্তু ‘ম্যাডাম’ হাল ছেড়ে দিলেন না। তিনি একজন কেবিন-ক্রূকে থামিয়ে জ্ঞিজ্ঞেস করলেন
ট্যুরিস্টদের কোন ফর্ম পূরণ করতে হয় কিনা।
ছোট খাড়া চুল আর বিশাল বড় কানের দুলপরা
কেবিন ক্রূ বললো, “দক্ষিণ আফ্রিকার এয়ারপোর্টে এখন কোন ফরম পূরণ করতে হয় না।”
জানালার পর্দা তুলে দিলাম। আকাশ
কুয়াশাচ্ছন্ন। ভোরের আলোর ক্ষীণ একটা রেখা দেখা যাচ্ছে। ল্যান্ডিং এর প্রস্তুতি
চলছে। সকাল সাড়ে পাঁচটায় জোহানেসবার্গের ও-আর-ট্যাম্বো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে
নেমে এলো আমাদের বিমান।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো প্লেনের পেট
থেকে বের হতে। পেছনের দিকে সিট হলে যেমন আগে ওঠা যায়, নামার সময় সেরকমই শেষে নামতে
হয়। পার্শ্ববর্তী মহিলা ও শিশুদের পশ্চাৎবর্তী হয়ে পা রাখলাম জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টে।
বেশ বড় এয়ারপোর্ট বলে মনে হচ্ছে।
আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ত এয়ারপোর্ট জোহানেসবার্গ। আমার পরবর্তী ফ্লাইট ন'টায়।
সুতরাং ব্যস্ত হবার কিছু নেই। ধীরেসুস্থে দেখতে দেখতে চললাম ইমিগ্রেশানের দিকে।
এয়ারপোর্টে
আলো একটু কম বলে মনে হচ্ছে। বাইরের আলো এখনো তেমন করে ফোটেনি। আকাশ মাত্র ফর্সা
হচ্ছে। এয়ারপোর্টের ভেতর দিয়ে কিছুটা দেখা যাচ্ছে।
চলমান সিঁড়ি দিয়ে ইমিগ্রেশান এলাকায় যাবার মুখে বড় বড় অক্ষরে লেখা “ওয়েলকাম টু সাউথ আফ্রিকা"। দেখতে দেখতে নিচে নেমে ইমিগ্রেশান এরিয়ায় ঢুকলাম। জায়গাটা বড় কিন্তু বৈদ্যুতিক আলোর পরিমাণ খুবই কম। কম
আলোর কারণে সবকিছু একটু স্যাঁতস্যাঁতে মনে হচ্ছে।
সারি সারি কাউন্টারে সব অফিসারই
কৃষ্ণাঙ্গ। যাদের ভিসা লাগে না তাদের জন্য আলাদা একটা পথ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে ঢুকে
দেখলাম কাউন্টারগুলো বন্ধ। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে সবার সাথে লাইনে দাঁড়ালাম। একটু
ঢিমেতালা অগোছালো ভাব এখানে। একটাই ফ্লাইট এসেছে এই সময়। তাই খুব বেশি ভিড় বলা
যাবে না। বেশ কিছু অফিসার জটলা পাকিয়ে গল্প করছেন। এই পরিবেশ কেমন যেন পরিচিত মনে
হচ্ছে।
কোনরকম
প্রশ্ন ছাড়াই ৯০ দিন থাকার অনুমতিসহ পাসপোর্টে সিল দিলেন তরুণী অফিসার। এই ভোরের
শিফটেও পুরুষের পাশাপাশি নারী অফিসাররা সমানে কাজ করছেন দেখে ভালো লাগলো। তবে
দক্ষিণ আফ্রিকা – আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত দেশ
এটাও মনে রাখতে হবে। কিন্তু এই দেশ পুরো মহাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে না।
ব্যাগেজ এরিয়ায় যাবার আগে মানি
এক্সচেঞ্জ থেকে কিছু ডলার ভাঙিয়ে নিলাম। দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রার নাম র্যান্ড। দশ, বিশ, পঞ্চাশ, একশ আর দুইশ র্যাল্ডের নোট আছে। আর ৫, ২
ও ১ রাল্ডের কয়েন। ১০, ২০, ও ৫০ পয়সার কয়েনও আছে। সবগুলো নোটে দক্ষিণ আফ্রিকার
জাতির পিতা নেলসন ম্যান্ডেলার ছবি। এত বছরের দীর্ঘ সংগ্রাম বিফলে যায়নি দক্ষিণ
আফ্রিকার।
অস্ট্রেলিয়ান ডলার-প্রতি এগারো র্যাল্ডের
কিছু বেশি পাওয়া গেলো। এক র্যান্ড বাংলাদেশি টাকায় পাঁচ টাকার কিছু বেশি।
ব্যাগ আসতে বেশ সময় নিলো। কাস্টমস
অফিসারদের দেখলাম। কিন্তু তাদের উল্লেখযোগ্য কোন কাজকর্ম চোখে পড়লো না। তাদের
চোখের সামনে দিয়ে ব্যাগ টানতে টানতে বের হয়ে এলাম। কেউ কিছু জ্ঞিজ্ঞেসও করলো না।
টার্মিনালের শেষ মাথায় সাউথ আফ্রিকান
এয়ারওয়েজের দুটো কাউন্টার। ট্রানজিট-যাত্রীদের ব্যাগ জমা নিচ্ছে এখানে। কেইপ টাউন
যাবার বোর্ডিং পাস বের করে কাউন্টারে যেতেই কাজ হয়ে গেলো। তারা আমার ট্যাগ লাগানো
ব্যাগ জমা করে নিলো। এবার গন্তব্য টার্মিনাল-বি।
জোহানেসবার্গ টু কেইপ টাউন
ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল থেকে বেরিয়েই
বেশ বড় গোলচত্বর। প্লাকার্ড হাতে অভ্যর্থনাকারীদের দল দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়জনদের
জন্য অপেক্ষা করছেন অনেকে।
বাম পাশে টার্মিনাল-বি’র প্রবেশ পথ। দোতলায় উঠে এলাম। অনেক দোকানপাট। খাবারের দোকানগুলোর বেশিরভাগই
ওয়ার্ল্ড-চেইন ম্যাকডোনাল্ডস, কে-এফ-সি, গ্লোরিয়া কফি। টার্মিনালে জায়গা আছে অনেক
কিন্তু আলো খুব কম। আর ফ্লোর-প্ল্যান একটু অগোছালো বলে মনে হলো।
আমার বোর্ডিং-গেট নম্বর কত তা এখনো জানি
না। ডিসপ্লে বোর্ডে শুধু আটটা পর্যন্ত যে ফ্লাইটগুলো ছাড়বে তা দেখাচ্ছে। কয়েক
মিনিট পর পর ফ্লাইট সিডিউল দেখে বুঝতে পারছি জোহানেসবার্গ খুব ব্যস্ত এয়ারপোর্ট।
দোতলা
থেকে তিনতলায় উঠে এলাম। টার্মিনালের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে
দেখলাম। তেমন কোন নতুনত্ব নেই। ডিসপ্লে বোর্ডে ডিপার্চার লিস্ট দেখছি - এমন সময়
তিন চারজন লোক একসাথে এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। আফ্রিকানদের
অপরাধপ্রবণতা বিষয়ে প্রচুর ‘সাবধান বাণী’ পড়ে এসেছি বলে মাথার ভেতর ভয় ঢুকে গেছে। একজন প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা বিশাল কৃষ্ণমূর্তি জ্ঞিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাবে?
এদের
ইংরেজি বুঝতে আমার সামান্য একটু কষ্ট হচ্ছে। বললাম, “কেইপ টাউন, কিন্তু আমার গেট নম্বর দেখতে পাচ্ছি না এখানে।”
“দেখি তোমার বোর্ডিং পাস”
আমার একটু অস্বস্তি লাগছে। একবার ভাবলাম
বোর্ডিংপাস দেবো না। আবার মনে হলো এয়ারপোর্ট হলো একটা দেশের সবচেয়ে নিরাপদ এলাকা।
এখানেই যদি ভয় পাই তাহলে বাইরে কী অবস্থা হবে?
পকেট থেকে বোর্ডিং পাস বের করলাম। লম্বা
লোকটি প্রায় ছোঁ মেরে আমার বোর্ডিং পাস নিয়ে হন হন করে হাঁটা দিলো। আমিও প্রায় দৌড়
দিলাম। বাকি তিনজনও আছে পেছনে। কিছুদূর গিয়ে একটা প্রায়-অন্ধকার জায়গায় self check-in মেশিনের সামনে এসে আমার বোর্ডিং
পাস স্ক্যান করে আরেকটা বোর্ডিং-পাস প্রিন্ট করে হাতে দিয়ে বললো, “তোমার গেট নম্বর নাইন। দোতলায় গিয়ে সিকিরিউটি চেক পার হয়ে গেটে চলে যাও।”
“অনেক ধন্যবাদ”
লোকগুলো একসাথে চলে গেলো সবাই। এরা মনে
হয় এয়ারপোর্টের কর্মী। লোকজনকে সহায়তা করে এরা। কিন্তু সহায়তা করার ভঙ্গিটা জোর
খাটানোর মতো হয়ে গেলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়, মাঝে মাঝে ভীতিকরও।
তিনতলা থেকে দোতলায় নেমে সিকিউরিটি
চেকিং পেরিয়ে আবার তিনতলায় উঠতে হলো বোর্ডিং গেটে যাবার জন্য। এক থেকে নয় নম্বর
পর্যন্ত বোর্ডিং গেট- একটার পর একটা। আয়তনে খুব বেশি বড় নয়। একপাশটা
পুরো কাচের প্যানেলের আবরণ। রানওয়েসহ থেমে থাকা প্লেনগুলো দেখা যাচ্ছে।
সবে সকাল
হয়েছে। এখনো তেমন ভিড় নেই। কয়েকটি রেস্টুরেন্ট,
চকলেট আর স্যুভেনির শপ আর কয়েকটা কনভেনিয়েন্ট শপ। কফি শপে কিছুটা ভিড় আছে এসময়। সাত,
আট, ও নয় নম্বর গেটে একজন লোকও নেই। ছয় নম্বর গেটের কাছে দশ বারোজনের একটা ভারতীয়
গ্রুপ। কিশোর কিশোরীরা হিন্দিতে খুব হৈ চৈ করছে। টুকরো কিছু কথাবার্তা কানে ভেসে
আসছে। সবাই ইন্ডিয়া থেকে আসছে, এখান থেকে যাচ্ছে ডারবান। ডারবানে প্রচুর ইন্ডিয়ান।
মহাত্মা গান্ধীর প্রথম পেশাজীবন কেটেছে সেখানে। শুনেছি ওখানকার গান্ধী আশ্রম নাকি
খুব বিখ্যাত। আশ্রম হলেই কোন না কোনও ভাবে খ্যাতি জুটে যায় পৃথিবীর যে কোন জায়গায় – সে গান্ধীই হোক কিংবা রজনীশ।
আমার ক্ষুধা লেগে গেছে। দোকান থেকে একটা
সিংহ-মার্কা পটেটো চিপস আর এক বোতল কোকাকোলা কিনে নিয়ে এলাম। পটেটো চিপস এর সাথে
সিংহের কী সম্পর্ক তা জানি না। সিংহ আলু খায় বলে শুনিনি কখনো।
পেপারস্ট্যান্ডে
ফ্রি পেপার রাখা আছে। SATURDAY STAR পত্রিকা নিয়ে এদেশের কিছু দৈনন্দিন
খবর জানার চেষ্টা করলাম। রাজনৈতিক খবরের প্রাধান্য এখানেও। খুন
রাহাজানির খবর অনেকগুলো। আফ্রিকার সাথে আমাদের অনেক মিল। আবার অ্যাপার্টমেন্ট আর
বাড়ির দাম দেখলাম প্রায় মেলবোর্নের মতই। তিন বেডরুম তিন বাথরুম বাড়ির দাম প্রায়
সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন র্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে সাড়ে
পাঁচ লাখ ডলারের মতো। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সোয়া তিন কোটি। এসব খবরে
অবশ্য আমার কোন আগ্রহ নেই। কেবল একটু জেনে রাখা তুলনামূলক চিত্রটা কেমন।
ওয়াশরুমে ঢুকে একটু অবাক হয়ে গেলাম।
একটা আফ্রিকান কিশোর রাজকীয় অভ্যর্থনার কায়দায় মাথা ঝুঁকিয়ে বললো, “আসুন, আসুন, এদিকে চলে আসুন, আপনার জন্য আমি এই টয়লেটটি এই মাত্র পরিষ্কার করে রেখেছি।”
টয়লেট থেকে বেরিয়ে হাত ধোবার পর দেখি সে
পেপার-টাওয়েল নিয়ে হাজির। খুবই করিৎকর্মা সন্দেহ নেই। কিন্তু সে যেরকম ব্যক্তিগত
সেবা দিচ্ছে তার পুরোটাই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু পকেট থেকে পাঁচ র্যাল্ডের
একটা কয়েন তার হাতে দেয়ার পর তার মুখে যে হাসিটি ফুটলো - তাতে মনে হলো সে যা করছে
তা আক্ষরিক অর্থেই অর্থপূর্ণ কাজ।
আস্তে আস্তে যাত্রীর সংখ্যা বাড়তে শুরু
করেছে। বাইরে তাকিয়ে দেখি প্লেন নয় নম্বর গেটে দাঁড়িয়ে আছে।
টার্মিনাল থেকে অন্যদিকে তাকিয়ে দেখলাম।
প্রশস্ত রাস্তা চলে গেছে জোহানেসবার্গ শহরের দিকে। এবার জোহানেসবার্গ দেখা হবে না।
আবার যখন আসবো তখন জোহানেসবার্গ দেখার জন্যই আসবো।
পৌনে নয়টায় বোর্ডিং শুরু হলো - লাইনে
আগে দাঁড়ালে আগে উঠবেন ভিত্তিতে। এবারের প্লেনটি অনেক ছোট। আমার সিট প্লেনের
মাঝামাঝি জায়গায়। পাশের দুটো সিটে এক
জোড়া তরুণ-তরুণী। গভীর নীল চোখ, সোনালী চুল, সাদা ইউরোপিয়ান। দুটো মুখ সারাক্ষণ এত
কাছাকাছি পরস্পর - মনে হচ্ছে কথা না বলেই বুঝে নিচ্ছে একে অপরের ভাষা। মেয়েটির
অনামিকায় হীরের আংটি ঝকমক করছে। মনে হয় সদ্য বাগদান বা বিয়ে হয়েছে তাদের। একে
অন্যের গায়ে ঢলে পড়া আর চুমুর ফ্রিকোয়েন্সি থেকে বোঝা যাচ্ছে তাদের অস্থিরতা।
কেবিন-ক্রুদের সবাই কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু
যাত্রীদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ নেই বললেই চলে। তার মানে এদেশের অবস্থাও উন্নয়নশীল
দেশের মতোই - কিছু মানুষ প্রচন্ড ধনী, আর বেশিরভাগ মানুষ হতদরিদ্র।
সোয়া ন’টায় প্লেন উড়লো। জোহানেসবার্গ থেকে কেইপ টাউনের দূরত্ব ১২৬০ কিলোমিটার। সিডনি থেকে মেলবোর্নের দূরত্বের চেয়ে সামান্য বেশি। দু’ঘন্টা দশ মিনিট ফ্লাইট টাইম। এই দু’ঘন্টা তেমন কিছু করার নেই।
কিশোর ফ্লাইট-অ্যাটেন্ডেন্ট হাসিমুখে একটা
মাফিন এগিয়ে ধরে বললো, “মে আই অফার ইউ আ মাফিন প্লিজ?”
ভদ্রতার
কত রূপ! বলছে দয়া করে একটা মাফিন খাবেন? তাও আবার ফ্রি। আর বলার ভঙ্গিটা এতই চমৎকার যে আমার পাশের ইউরোপীয় যুগলও চুমু খাওয়া কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়ে মাফিন খেলো।
মাফিনের পর কফি। আফ্রিকান কফির একটা আলাদা আবেদন আছে বিশ্বজুড়ে। আমি কিন্তু আমার পরিচিত স্বাদের সাথে
কোন পার্থক্য খুঁজে পেলাম না। আবেদন বোঝার যোগ্যতা মনে হয় নেই আমার।
জানালা জুড়ে ঝকঝকে নীল আকাশ। অনেক নিচে
ভেসে বেড়াচ্ছে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘের ভেলা। তারও অনেক নিচে আবছা ভূমির রেখা - আফ্রিকা।
বাইরের দৃশ্যের কোন পরিবর্তন নেই
অনেকক্ষণ। প্লেনের ভেতরেও একপ্রকার শান্ত নিরবতা। কেবল আমার পাশের সিটের কপোত-কপোতী
চারপাশ উপেক্ষা করে ভালোবাসায় মগ্ন।
সাথে থাকা SATURDAY
STAR এর
পাতা খুললাম। কেইপ টাউনের সহিংসতা নিয়ে একটা বিরাট প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছে। পড়তে
পড়তে ভয়ে শিউরে উঠছিলাম।
প্রতিবেদক কেভিন রিটচি ‘Beautiful Cape Town is also one of the world’s deadliest cities’[1] প্রবন্ধে জানাচ্ছেন কেইপ টাউনে গড়ে প্রতিদিন ৬টা খুন, ৭টা খুনের চেষ্টা এবং
৮৪টি শারীরিক আক্রমণের ঘটনা ঘটে। গত সোমবার কেইপ টাউনের শহরতলীতে দাদীর বাড়িতে
বেড়াতে গিয়ে দু’পক্ষের গোলাগুলির মাঝে মারা গেছে ছ’ বছরের বাচ্চা মেয়ে সাদিকা লিপার্ড। মাসখানেক আগে কেইপ টাউনের আরেকটা সাবার্ব নায়াগোতে ঠিক এভাবেই গুলি খেয়ে মারা গেছে ৮ বছরের শিশু মরুলেলু
আর ১৫ বছরের কিশোরী লিয়ানমি নাগোয়াংগা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পৃথিবীর সবচেয়ে
সুন্দর শহরগুলোর একটি কেইপ টাউন এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক শহরও বটে।
এর কারণ
কী? রোডস ইউনিভার্সিটির গবেষক সাংবাদিক ডন পিনোক কেইপ টাউনের অপরাধজগত নিয়ে অনেক
গবেষণা করেছেন। একাধিক বইও লিখেছেন তিনি। তাঁর সাম্প্রতিক বই “GANG TOWN”-এ তিনি দেখিয়েছেন কেইপ টাউনে এখন প্রচুর
সংঘবদ্ধ অপরাধচক্র কাজ করছে। এসব গ্যাং এর সদস্যদের বেশিরভাগই কিশোর। এরা যে শুধুমাত্র
কর্মহীন তা নয়, এদের কাজ দেয়ার ইচ্ছা থাকলেও এদের কাজ করার মতো শিক্ষা বা
প্রশিক্ষণ কিছুই নেই। এরা unemployed শুধু নয়, এরা unemployable.
১৯৭০-৮০ সালে কেইপ টাউনের ডিস্ট্রিক্ট-সিক্স থেকে প্রায় ষাট হাজার কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিককে জাতীয়-শুদ্ধির দোহাই দিয়ে উৎখাত করা হয় নিজেদের ভিটেমাটি থেকে। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় Cape
Flat নামে সরকারি বস্তিতে। এতগুলো মানুষ ছিন্নমূল হয়ে যায়
রাতারাতি। প্রচন্ড মান্সিক যন্ত্রণা এবং দুঃসহ পরিবেশের মধ্যে যাদের জন্ম হয়েছে
তাদের মধ্যে ড্রাগ নেয়া, নেশা করা, অপরাধী হওয়ার হার খুবই বেশি। এখন যারা কিশোর-কিশোরী
তাদের জন্ম কিন্তু স্বাধীন গণতান্ত্রিক কৃষ্ণাঙ্গ শাসিত কেইপ টাউনে। তারা কেন এরকম
হচ্ছে?
ডন পিনোক তাঁর দীর্ঘদিনের গবেষণায়
দেখেছেন কেইপ টাউনের এসব কিশোর-কিশোরীদের তিনভাগের একভাগ বেড়ে উঠেছে পিতৃহীন
অবস্থায়, শুধুমাত্র মায়ের তত্ত্বাবধানে। ১০ লাখেরও বেশি ছেলেমেয়ে জানে না তাদের
বাবা কে। শতকরা ২৫ জনের কোন না কোন ভাই জেল খাটছে বা জেল খেটে এসেছে। শতকরা ২৫ ভাগ ছেলেমেয়েকে বাস করতে হচ্ছে সংঘবদ্ধ
অপরাধীদের সাথে। শতকরা ১৫ ভাগ বাড়িতে কোন বয়স্ক মানুষই নেই। তাদের মা-বাবা তাদেরকে
পথে ফেলে চলে গেছে। লেখাপড়া, প্রশিক্ষণ কোন কিছুর প্রতি তাদের কোন আকর্ষণ নেই।
ড্রাগের নেশায় চুর হয়ে থাকে, আর নেশার জন্য চুরি, রাহাজানি এমনকি খুন পর্যন্ত করে
ফেলে। তবে যত খুন হয় তার মাত্র শতকরা ১১ ভাগ হয় গ্যাং ফাইটিং-এ। বাকি ৮৯ ভাগ হয়
পারিবারিক সংঘর্ষে। প্রচুর মদ খায়, ড্রাগ নেয় আর পরস্পর মারামারি করে মেরে ফেলে যে
যাকে পারে।
আড়াই হাজার বর্গকিলোমিটার ক্ষেত্রফলের কেইপ
টাউনে মাত্র আটত্রিশ লক্ষ মানুষের বাস। অথচ বছরে প্রতি লাখে ৫৫ জন মানুষ এখানে খুন
হয়ে যায়। সারা পৃথিবীতে প্রতি লাখে বছরে গড় খুনের সংখ্যা ৩০ জন। কেইপ টাউনের সবচেয়ে
দরিদ্র এলাকা নায়াংগায় প্রতি লাখে বছরে ২০০ জন খুন হয়। পৃথিবীর কোন কোন দেশে
যুদ্ধের সময়ও এত খুন হয় না।
বাইরের দিকে তাকালাম। প্লেনের গতি মনে
হয় একটু কমে আসছে। সময় হয়ে আসছে ভয়ংকর সুন্দর কেইপ টাউনের মুখোমুখি হবার।
সোয়া এগারোটার দিকে প্লেন আস্তে আস্তে
নিচে নেমে আসতে শুরু করলো। কেইপ টাউনের ভূমি স্পর্শ করার আগেই দেখলাম আকাশ ঘন নীল।
টুকরো টুকরো সাদা মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতস্তত। ঝলমলে রোদ আর ঝকঝকে নীল দেখেই ভালো
লেগে গেলো কেইপ টাউন, ল্যান্ডিং এর আগেই। হোক না সে যতই ভয়ংকর। সাড়ে এগারোটায়
বেরিয়ে এলাম প্লেনের পেট থেকে। পা রাখলাম কেইপ টাউন এয়ারপোর্টে।
[1] Kevin Ritchie, Gang Violence bares the truth of a
lost generation, Saturday Star, page 18, may 7, 2016, South Africa.
No comments:
Post a Comment