ষোড়শ অধ্যায়
সঙ্গীত সাহিত্য আড্ডা
অনেকে বলে থাকেন বাঙালি আর আড্ডা সমার্থক। সে হিসেবে বলা চলে সত্যেন বসু
ছিলেন প্রকৃত বাঙালি। অনেকে আবার তাঁর সম্পর্কেও এটাও বলে থাকেন যে তিনি যদি আড্ডা
দিয়ে সময় নষ্ট না করতেন তাহলে বিজ্ঞানে আরো অনেককিছু করতে পারতেন। সত্যেন বসু
জীবনে যা কিছু করেছেন সে বিজ্ঞান হোক, সাহিত্য, সঙ্গীত কিংবা আড্ডা সবই করেছেন
নিজের ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা থেকে। সাহিত্য আর সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা থেকেই
তিনি গিয়েছেন বন্ধুদের সাথে সেসব জায়গায়, কিংবা নিজেরাই গড়ে তুলেছেন সেসব স্থান
যেখানে গান হতো, সাহিত্য আলোচনা হতো এবং বিজ্ঞান হতো। বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের
নানা দিকপাল ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ছেলে দিলীপকুমার
রায়, কুমার হারীতকৃষ্ণ দেব, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রমথ চৌধুরী, অন্নদাশংকর রায়,
মানিকলাল দে, গিরিজাপতি ভট্টাচার্য, বিষ্ণু দে, যামিনী রায় - আরো অনেকের সাথেই
সত্যেন বসু সময় কাটিয়েছেন আড্ডা, গান, সাহিত্যে।
সত্যেন বসুর বাবা গান-বাজনা
পছন্দ করতেন না। কিন্তু তাঁর নিজের খুব শখ গান শোনার। তাঁর বন্ধু গিরিজাপতি ভট্টাচার্যের
বাড়ি তাদের বাড়ির কাছেই। প্রেসিডেন্সি কলেজের দিনগুলিতে ধরতে গেলে কলেজের বাইরে
সারাক্ষণই গিরিজাপতিদের বাড়িতে কাটতো সত্যেন বসুর। গিরিজাপতির ভাই পশুপতির সাথেও
তার বন্ধুত্ব। গিরিজাপতিদের বাড়িতে ছিল গান-বাজনার চল। পশুপতি খুব ভালো গান করতেন।
সেখানে গান শুনতে শুনতে সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা। হারীত বাজানোর চেষ্টা করেন
সেখানে। শিখেও ফেলেন চেষ্টা করতে করতে। কলেজে তাঁর জুনিয়র ছিলেন দিলীপকুমার রায়।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সন্তান এবং সুগায়ক হিসেবে দিলীপকুমার রায় তখনই খুব বিখ্যাত
শিল্পী। তাঁর কন্ঠে 'ধনধান্য পুষ্পভরা' দেশার্থবোধক গানের রেকর্ড বের হয়েছে।
সত্যেন বসুর সাথে পরিচয় কলেজে। সেখান থেকে বন্ধুত্ব হতে দেরি হয়নি। সত্যেন বসুর
আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু শোভাবাজারের রাজবাড়ির সন্তান কুমার হারীতকৃষ্ণ দেব। হারীতকৃষ্ণ
খুব ভালো গায়ক ছিলেন। যত্ন করে গান শিখেছিলেন। তাঁদের রাজবাড়িতে প্রায়ই গানের জলসা
বসতো। বিখ্যাত সব সঙ্গীতগুরুরা সেখানে আসতেন। সত্যেন বসুর সুযোগ হতো সেসব
অনুষ্ঠানের শ্রোতা হবার। আরেক বন্ধু মানিকলাল দে'র মাধ্যমে সত্যেন বসু গিয়েছিলেন
জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
কবিতার নতুন ছন্দ তাঁর ভালো লেগেছে তারুণ্যে। ভালো লাগেছে তাঁর ছোটগল্প। বন্ধু
পশুপতি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প 'মেঘ ও রৌদ্র' পড়ার পর একটা ছোট্ট প্রতিক্রিয়া লিখে
সত্যেন বসুকে পড়তে দেন। সেটা পড়ার পর সত্যেন বসুর মনে হলো তাঁরও লিখতে ইচ্ছে করছে
বিভিন্ন বিষয়ে। নিয়মিত লেখার জন্য তাঁরা একটা হাতেলেখা সাহিত্যপত্র প্রকাশ করতে
শুরু করলেন। নাম দিলেন 'মনীষা'। সত্যেন বসু হলেন তার সম্পাদক। বলা চলে বৈজ্ঞানিক
গবেষণাপত্র লিখতে শুরু করার আগেই তিনি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন। সত্যেন
বসু তাঁর পত্রিকায় আসামের জঙ্গলের অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন। স্কুলে থাকতে তাঁর বাবার
সঙ্গে আসামে যাওয়ার স্মৃতিকথা। কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর মনীষার বিলুপ্তি
ঘটে।
কর্নওয়ালিস স্কয়ার বা
হেদুয়া - যার বর্তমান নাম আজাদ হিন্দ বাগ - সেখানে আড্ডা দিতেন সত্যেন বসু তার
বন্ধুদের সাথে। কুমার হারীতকৃষ্ণ একটার পর একটা গান গেয়ে শোনাতেন তাদের।
চিত্র: পরিণত বয়সে বন্ধু শিল্পী যামিনী রায় ও কবি বিষ্ণু দে'র সঙ্গে সত্যেন বসু |
তারপর পরিচয় প্রমথ চৌধুরীর সাথে। বীরবল ছদ্মনামে তিনি চলিত ভাষায় সাহিত্য
রচনা করছেন। সত্যেন বসু সেগুলো পড়ে খুব পছন্দ করেছেন গদ্যরীতিতে লেখার স্টাইল।
প্রমথ চৌধুরির সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাথে ভিড়ে গেলেন সত্যেন বসু। ব্যাপারটা ঘটেছিল
বন্ধু হারীতকৃষ্ণের মাধ্যমে। হারীতকৃষ্ণ প্রমথ চৌধুরির কাছে খুব প্রশংসা করেছিলেন
সত্যেন বসুর সাহিত্য ও সঙ্গীতানুরাগ প্রসঙ্গে। আসরে যোগ দেয়ার জন্য প্রমথ চৌধুরি
সত্যেন বসুকে একটি চিঠি লিখেছিলেন:
"শ্রীমান হারীতকৃষ্ণ লিখেছেন যে, নানা কারণে তাঁর পক্ষে কাল
(২৫-১১-১৬) বিকেলে এখানে (ব্রাইট স্ট্রিটে প্রমথ চৌধুরীর বাড়িতে) আসার সুবিধে হবে
না। তবে আপনি যদি আসেন তো বড় সুখী হব। যাঁরা লেখাপড়া করেছেন অর্থাৎ মন নামক
পদার্থটির চর্চা করেছেন তাঁদের সঙ্গে আমি মিশতে কথাবার্তা কইতে ভালবাসি। পরস্পরের
ভাবের আদানপ্রদানে যে আনন্দ পাওয়া যায় শুধু তাই নয়, শিক্ষাও পাওয়া যায়। আমাদের
নতুন মনোভাব সব অবশ্য আমরা সকলেই বই থেকে পেয়েছি, কিন্তু সেই সব বইয়ের কথা প্রতি
লোকের ভিতর থেকে অল্পবিস্তর নূতন মূর্তি ধারণ করে বেরিয়ে আসে। যেন মরা জিনিস
জ্যান্ত হয়ে ওঠে। মুখের কথার ভিতর যে প্রাণ ও বৈচিত্র্য আছে তা লেখার কথায় সচরাচর
পাওয়া দুর্ঘট। এই কারণেই আমি নিজে বকতে ও পরের কথা শুনতে ভালবাসি। তাছাড়া যাঁরা
পড়েছেন তাঁদের আমি লেখাতে চাই। কেননা বাঙ্গলা সাহিত্যে জ্ঞানের দিকটে আজ পর্যন্ত
ফাঁক রয়ে গেছে। আর যতদিন বাঙ্গলা সাহিত্য জ্ঞানের ভান্ডার না হবে, ততদিন উঁচুদরের
কাব্য ও সমালোচনার জন্যও আমাদের দু-একটি প্রতিভাশালী লেখকের মুখোপেক্ষী হয়ে থাকতে
হবে। এক বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের লেখা বাদ দিয়ে বাঙ্গলা সাহিত্যে এমন কিছু
থাকে না, যা ভদ্রলোকের পাতে দেওয়া যায় - তা নিয়ে গৌরব করা ত দূরের কথা। আর
বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ যে যুগে যুগে জন্মাতে বাধ্য, প্রকৃতির এমন কোন বাঁধা
নিয়ম নেই। সাহিত্যের গ্লানি হলে এ ভূ-ভারতে প্রতিভাশালী লেখক অবতীর্ণ হতে বাধ্য,
একথা শাস্ত্রেও লেখে না। সুতরাং আমাদের মত প্রতিভাহীন লোকদের পক্ষে আমরা যেটুকু
জ্ঞান-বিজ্ঞান সঞ্চয় করেছি তার ভাগ দেশের লোককে দেওয়াটা কর্তব্য। এই কারণেই আমি
আপনাকে 'সবুজপত্রে'র আসরে নামাতে চাই।"
প্রমথ চৌধুরির ব্রাইট স্ট্রিটের বাড়িতে সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাহিত্য আড্ডায়
নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন সত্যেন বসু। কিন্তু তিনি সবুজপত্রে কখনও লেখেননি। প্রমথ
চৌধুরি ঠাট্টা করে বলতেন, 'সত্যেন ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ
করে।' তবে সবুজপত্রের আঙ্গিকে যখন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ত্রৈমাসিক 'পরিচয়' প্রকাশ
করতে শুরু করেন সেখানে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের কথা লিখতে শুরু করেন সত্যেন বসু।
পরিচয়ের প্রথম সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন, "বিজ্ঞানের সংকট"। তারপর যখনই
সময় পেয়েছেন পরিচয়-এ লিখেছেন।
জার্মান ও ফরাসী ভাষা
শিখেছিলেন সত্যেন বসু। আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি জার্মান ভাষা থেকে
ইংরেজিতে অনুবাদ করা ছাড়াও তিনি অনেক ফরাসী গল্প ও প্রবন্ধ সরাসরি ফরাসী থেকে
বাংলায় অনুবাদ করেছেন।
সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান,
সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি - ইত্যাদি এমন কোন বিষয় নেই যা বাঙালি আড্ডায় আলোচিত হয় না।
সত্যেন বসু যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক - তখন তিনি ঢাকায় একটি নিয়মিত
আলোচনা-চক্রের আয়োজন করেছিলেন। তাঁদের আড্ডার নাম ছিল 'বারো-জনা'। এর বারো জন
সদস্য ছিলেন: রমেশচন্দ্র মজুমদার, চারু বন্দোপাধ্যায়, মাহমুদ
হোসেইন, আর্থার হিউজেজ, পুণ্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, সতীশ রঞ্জন খাস্তগীর, ললিতমোহন
চট্টোপাধ্যায়, আর্তন্দশংকর রায়, সর্বানীসহায় গুহসরকার, হিরেন্দ্রলাল দে, সত্যেন
বসু ও সুশোভন সরকার। এরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৫
পর্যন্ত এই বারো-জনার বৈঠক প্রতি সপ্তাহে বসেছে। প্রতি বৈঠকে পালাক্রমে এক একজনকে
কোনো বিষয়ে প্রবন্ধপাঠ করতে হতো কিংবা বক্তৃতা দিতে হতো। তারপর চলতো সেটা নিয়ে
আলোচনা।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা
সম্মেলনে ডাক পড়তো সত্যেন বসুর। ১৯৫৮ সালে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের
জব্বলপুর অধিবেশনে তিনি মূল সভাপতি পদে মনোনীত হন। একাধিক অধিবেশনে তিনি সভাপতিত্ব
করেন।
চিত্র: বন্ধু প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে ঘরোয়া অনুষ্ঠানে এস্রাজ বাজাচ্ছেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
সত্যেন বসু ঢাকার গান-বাজনার আসরে যেতেন সময় এবং সুযোগ পেলে। নিজেও হারীত
বাজান। নিজের এস্রাজ বাজানো ও গানবাজনা প্রসঙ্গে সত্যেন বসু বলেছেন,
"গানের ব্যাপারে আমার নিজের কোন বর্ণপরিচয়
ছিল না। একটা ছোট এস্রাজ কিনে নিজে নিজে বাজাবার চেষ্টা করা হলো। অবশ্য স্বরলিপি
দেখে বাজাবার অভ্যাস করতে হয়েছিল। তাছাড়া বিজ্ঞানী লোক হিসেবে ইংরেজীতে যাকে বলে harmonics সে সবগুলো অনুসন্ধান করে তার দ্বারা কী করে এ বাজানো যায় এইসব নিয়ে
পরীক্ষা-নিরীক্ষা নানান রকমের করা যেত; এইভাবে এসরাজের সঙ্গে পরিচয়। তারপর, সে হবে
অনেকদিনের কথা। আরম্ভ হয়েছিলো বোধ হয় বয়স কুড়ি-একুশ হবে। কিছুদিন ছোট এস্রাজ
বাজাবার পর ঢাকায় যেতে হল। সেখানে আমার এক ছাত্র ঢাকায় তৈরি বর্তমানের এস্রাজটি
সংগ্রহ করে দিলেন। তারপর থেকে মাঝে মাঝে বাজাই। ঢাকায় তখন গান-বাজনার খুব রেওয়াজ
ছিল। রাসের সময়ে বৈষ্ণবদের বাড়ীতে খুব গান-বাজনা হতো। আলাউদ্দিন খানের দাদা, ভগবান
সেতারী, শ্যাম সেতারী এঁরা সকলে ওখানে প্রায় বাজাতেন। আমার নিজের কথা বলতে গেলে
ধারাবাহিকভাবে কিছু করা হয়নি। তবে বলতে গেলে অনেক বছরই বাজানো হচ্ছে। ওতে যেটুকু
হাত এসেছে ওই আর কি।"[1]
সত্যেন বসু যখন আপনমনে হারীত বাজাতেন তখন তিনি যেন অন্যলোকে চলে যেতেন।
তাঁর ছাত্ররা যখন বাড়িতে আসতো মাঝে মাঝে দেখতে পেতো যে তিনি আপনমনে বাজাচ্ছেন।
চিত্র: বন্ধু দিলীপকুমার রায়ের সাথে সত্যেন বসু |
বন্ধু দীলিপকুমার রায় মাঝে মাঝে ঢাকায় গিয়ে সত্যেন বসুর বাসায় উঠতেন। সত্যেন
বসু দিলীপকুমারকে তাঁর ডাকনাম মন্টু বলেই ডাকতেন। তখন গানের আসর বসতো সেখানে।
দিলীপকুমার গান গাইতেন, সত্যেন বসু এস্রাজ বাজাতেন। দিলীপকুমার রায় বলতেন,
"গানের সে এক খাঁটি সমজদার, ভালো গান শুনবামাত্র এক আঁচড়েই ভালো বলে চিনে
নিতে পারত।"
ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের
রাগরাগিনী সম্পর্কে নিবিড় জ্ঞান ছিল সত্যেন বসুর। অধ্যাপক ধুর্জটিপ্রসাদ
মুখোপাধ্যায় ভারতীয় সঙ্গীত বিষয়ে একটি প্রামাণ্য গবেষণা গ্রন্থ লেখেন (Indian Music An Introduction)। সেটা
লেখার সময় সত্যেন বসুর কাছ থেকে অনেক পরামর্শ নিয়েছেন ধুর্জটিপ্রসাদ।
চিত্র: নিবিষ্টমনে এস্রাজ বাজাচ্ছেন সত্যেন বসু |
ভালো গান শোনার জন্য অন্য সব কাজ বাদ দিতেও আপত্তি করতেন না সত্যেন বসু। ঢাকায়
'ঝঙ্কার' সঙ্গীত চক্রের সভাপতি ছিলেন তিনি। পরে 'ক্যালকাটা আকাডেমি অব ইন্ডিয়ান
মিউজিক'-এর সভাপতি ছিলেন।
একবার ছাত্রদের এক
অনুষ্ঠানে এক ছাত্রের সেতার বাজনা শুনে খুব ভালো লাগলো তাঁর। পরের দিন তিনি
ছেলেটিকে ডেকে পাঠালেন। সত্যেন বসুর ল্যাবে ছেলেটি এলে তিনি তাঁকে বললেন,
"তুই খুব ভালো সেতার বাজাস। আমাকে একবার শোনাবি তো তোর বাজনা।"
ছেলেটি খুশি হয়ে জিজ্ঞেস
করলো, "আপনার বাড়িতে আসবো স্যার?"
সত্যেন বসুর তর সইছিলো না। তিনি বললেন, "তাতে তো দেরি হয়ে যাবে।"
"তুই এক কাজ কর। তোর
সেতার এখানে নিয়ে আয়।"
সেতার নিয়ে আসা হলো ল্যাবরেটরিতে। তবলা নিয়ে আসা হলো। ফ্লোরে বসে বাজানোর
কোন জায়গা নেই। সত্যেন বসুর আদেশে তারা ল্যাবরেটরির বড় টেবিলের উপর উঠে বসে সেতার
ও তবলা বাজালো। সত্যেন বসু চোখ বন্ধ করে শুনলেন। ভালো কোন কিছু উপভোগ করার সময়
তিনি ভীষণ একনিষ্ঠ হয়েই তা করতেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে
১৯৪৭ সালের এক বিকেলে এক মিটিং-এ উপস্থিত থাকার কথা ছিল সত্যেন বসুর। মিটিং-এর সময়
হয়ে গেলে মেঘনাদ সাহা সত্যেন বসুকে ডাকতে এলেন তাঁর অফিসে। এসে দেখেন সেখানে এক
বাঁশিওয়ালা বসে আছে। মেঘনাদ জিজ্ঞেস করলেন, "সত্যেন তুমি মিটিং-এ যাবে
না?"
"না, এই বাঁশিওয়ালা
চমৎকার বাঁশি বাজায়। সে আমাকে বাঁশিতে রাগ বেহাগ বাজিয়ে শুনাবে।"
মেঘনাদ সাহা গান-বাজনা
সহ্যই করতে পারতেন না। তিনি মনে করতেন গান-বাজনা শোনা মানে সময় নষ্ট করা। তিনি
দ্রত চলে গেলেন। আর সত্যেন বসু সব কাজ বাদ দিয়ে চোখ মুদে বাঁশিতে বেহাগ শুনতে
লাগলেন।
কোন কিছু মনযোগ দিয়ে শোনার
সময় চোখ বন্ধ করে ফেলতেন সত্যেন বসু। যাঁরা তাঁকে চেনেন না, তারা ভাবেন তিনি বোধ
হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। সেমিনারে বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা শোনার সময়েও, অনেক সময় সভাপতিত্ব
করার সময়েও তিনি চোখ বন্ধ করে শুনতেন। তারপর বক্তৃতা শেষে চোখ খুলে খুঁটিয়ে প্রশ্ন
করতেন যখন তখন বোঝা যেত যে এতক্ষণ তিনি ঘুমাননি।[2]
বড় বড় সঙ্গীতের আসরে যেমন
তিনি যেতেন, তেমনি ছোট ছোট পাড়ার ক্লাবের গানের অনুষ্ঠানেও তিনি গিয়ে গান শুনতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে ছাত্রদের অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেও কলকাতায়
গিয়ে তাঁর সেই অভ্যাস বদলে গিয়েছিল। সেখানে যে কোন সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে ডাক পেলেই
তিনি উপস্থিত হতেন। আবার ভালো কোন অনুষ্ঠানে ডাক না পেলেও গিয়ে উপস্থিত হতেন গান
শোনার জন্য।
১৯৬১ সালে বঙ্গ সংস্কৃতি
সম্মেলনের রবীন্দ্রশতবার্ষিক অধিবেশনে মূল সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সত্যেন বসু।
অধিবেশনের শেষের দিন দিলীপকুমার রায়ের ভাষণ ও সঙ্গীত পরিবেশনের আয়োজন করা হয়েছিল।
উদ্যোক্তারা সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে সত্যেন বসুকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সভাপতিত্ব
করিয়েছিলেন। তারপর শেষের দিনের সঙ্গীতানুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে ভুলে গেছেন।
এদিকে সত্যেন বসু তাঁর প্রিয় বন্ধু মন্টুর গান না শুনে থাকতে পারবেন না। তিনি
অনুষ্ঠানে গিয়ে উপস্থিত। কোন চেয়ার খালি নেই। তিনি সতরঞ্চির উপর বসে নিবিষ্টমনে
গান শুনতে লাগলেন। আয়োজকদের চোখ পড়লো তাঁর ওপর। তাড়াতাড়ি এসে অনুরোধ করলেন মঞ্চের
উপর উঠে বসতে। সত্যেন বসু বললেন, "আজ আমি তোমাদের সভাপতি নই। আমার বন্ধুর গান
শুনতে এসেছি। গান শুনেই চলে যাবো।"[3]
নাট্যাভিনয় দেখতেও পছন্দ
করতেন সত্যেন বসু। শিশিরকুমার ভাদুড়ির 'মাইকেল মধুসূদন' নাটকের অভিনয় দেখে তিনি
অভিনয়শেষে মঞ্চের উপর উঠে শিশিরকুমারকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, "আজ সত্যকার
মাইকেলকে যেন চোখের সামনে দেখলুম। অভিনয় দেখা সার্থক হলো।"
শক্তিমান অভিনেতা ছবি
বিশ্বাস ছিলেন সত্যেন বসুর প্রতিবেশী ও বন্ধু। ১৯৬২ সালে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায়
ছবি বিশ্বাসের মৃত্যু হলে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন সত্যেন বসু। মহাজাতিসদনে ছবি
বিশ্বাসের স্মরণসভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন।
জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্পকলার
এমন কোন শাখা নেই যার প্রতি সত্যেন বসুর আকর্ষণ ছিল না। প্রায় সব বিষয়েই তাঁর
ব্যাপক পড়াশোনা। সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায় ছিলেন বয়সে সত্যেন বসুর দশ বছরের ছোট।
কিন্তু দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে বয়স কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ছোট বড় অনেক বন্ধু
ছিল সত্যেন বসুর। সত্যেন বসুর জ্ঞানপিপাসা সম্পর্কে অন্নদাশংকর রায় লিখেছেন:
"দেখলুম একদিন আঁদ্রে জিদ সম্বন্ধে ফরাসী বই পড়ছেন। জিদের কথা তিনি যত
জানতেন আমি তত জানতুম না। প্যারিসে শুনেছিলুম। বললেন দরদের সঙ্গে। সমালোচকের মতো
নয়। জার্মান ভাষায় তাঁর দখলের পরিচয় আগেই পেয়েছিলুম। ফরাসী ভাষায় দখলের পরিচয় আরো
কয়েকবার পেলুম। একদিন দেখি মিশলে রচিত মূল ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস পড়ছেন। বললেন
ইংরেজি তর্জমা পড়ে আশ মেটেনি। বহু চেষ্টায় মূল সংগ্রহ করতে পেরেছেন। তাই তন্ময় হয়ে
অধ্যয়ন করছেন। ফরাসী বিপ্লব আমার নিজের প্রিয় বিষয়। অথচ আমি তার জন্যে আয়াস
স্বীকার করিনি। আলোচনাও করলেন কৌতূহলীর মতো। সেরকম কৌতূহল যদি ঐতিহাসিকদের মধ্যে
দেখতুম। আসলে কী হয়েছিল; সেই ভিতরের খবরটাই তিনি জানতে চান। ইতিহাস লেখকেরা সেটা
হয়তো জানেন না কিংবা জানলেও ভেঙে বলেন না। পাছে স্বজাতি বা নায়কদের প্রতিমা ভঙ্গ
হয়। এক্ষেত্রেও সত্যেন্দ্রনাথ দরদী বিবেচক। সমালোচক নন।
এরপর একদিন লক্ষ্য করি
তিনি ফরাসীদের আরো পুরনো ইতিহাসে মগ্ন। বললেন ফরাসী বিপ্লবকে বুঝতে হলে আরো কয়েক
শতক পেরিয়ে যেতে হয়। তাই তিনি পড়ছেন ষোড়শ শতাব্দীর ইতিবৃত্ত।
অন্য একদিন দেখি সংস্কৃত
বই পড়ায় নিবিষ্ট। ভাসের 'চারুদত্ত'। সবটা মনে নেই। যতদূর বুঝলুম পরবর্তী
নাট্যকারের 'মৃচ্ছকটিক' এরই উপর ভিত্তি করে রচিত। কোনটা আগে কোনটা পরে তার প্রমাণ
একই শব্দের বিবর্তন। এর থেকে এলো শব্দতত্ত্ব। সংস্কৃত খুব ভালো জানা ছিল তাঁর।
আমার তেমন নয়। অবাক হয়ে শুনলুম।
আরেক দিন দেখি পিশেল
প্রণীত প্রাকৃত ব্যাকরণের মূল জার্মান গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ তাঁর হাতে। মূলও
তিনি পড়েছেন। আমাকে প্রশ্ন করলেন, আমি যেন কত জানি! এরপরে একদিন সন্ধ্যাবেলা মশারি
খাটিয়ে শুয়েছেন। ভাবলুম অসুখ-বিসুখ করেছে। তা নয়। মশার জ্বালায় মশারির আশ্রয়
নিয়েছেন। সেই অবস্থায় পড়া হচ্ছে আফগানিস্থানে সদ্য আবিষ্কৃত অশোকের আরামাইক লিপিতে
উৎকীর্ণ অনুশাসন। আমার কাছে নতুন।
এমনি অনেক উদাহরণ দিতে
পারি। বিদ্যা- তা কোনো বিভাগেই হোক - সত্যেন্দ্রনাথের নিঃশ্বাসবায়ু। জ্ঞানকে তিনি
বিভিন্ন কক্ষে আবদ্ধ রাখবেন না। তিনি বিজ্ঞানী বলে সেই কক্ষে আবদ্ধ থাকবেন না।
সমস্ত জ্ঞানই অবিচ্ছিন্ন একটা প্রবাহ। যেখানে খুশি যখন খুশি অবগাহন করবেন। তৃপ্ত
হবেন। তাজা থাকবেন। তাঁকে সেইজন্যে এত তাজা লাগে। বিশুদ্ধ বিজ্ঞানী হলে ভাজা ভাজা
লাগত।"
অন্নদাশংকর রায় সত্যেন বসুর জ্ঞানপিপাসাকে ঠিকই চিনেছিলেন, আমাদেরও
চিনিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment