সপ্তদশ অধ্যায়
শিক্ষক সত্যেন বসু
গবেষণা-শিক্ষক হিসেবে সত্যেন বসু ছিলেন খুবই অন্যরকম। তিনি চাইতেন তাঁর
ছাত্ররা সবকিছু নিজে থেকে জেনেবুঝে করবে। এমনকি যেসব তত্ত্ব ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত
হয়ে গেছে - সেসব তত্ত্বও নতুন করে নির্ণয় করতে বলতেন ছাত্রদের। যেসব তথ্য সহজলভ্য
সেগুলো ব্যবহার না করে সব তথ্যই একেবারে গোড়া থেকে জোগাড় করার পরামর্শ দিতেন তিনি।
তিনি বলতেন মূল গবেষণাপত্র পড়তে এবং সেখান থেকে অগ্রসর হতে। কিন্তু যে কোন
বৈজ্ঞানিক গবেষণারই মূল কথা হচ্ছে অগ্রগতি। যেমন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব
যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে সেখানে আইনস্টাইনের তত্ত্ব ব্যবহার করে অন্যকিছু
গবেষণা করার জন্য আইনস্টাইনের তত্ত্বকে আবার প্রমাণ করার দরকার নেই। কিন্তু সত্যেন
বসুর কথা হলো ছাত্র যদি নিজে নিজে সবকিছু প্রমাণ করতে না জানে, তাহলে জানার মধ্যে
ফাঁক থেকে যাবে। কিন্তু সবকিছু একেবারে শুরু থেকে করতে গেলে যে সময়মতো থিসিস জমা
দেয়া যাবে না। সত্যেন বসু সেটাও মানতে চান না। তিনি মনে করেন থিসিস জমা দেয়ার জন্য
কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকা উচিত নয়। এই ব্যাপারটা আদর্শ শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে হয়তো সমর্থনযোগ্য, কিন্তু বাস্তবে নয়। সত্যেন
বসু নিজে কোন থিসিস জমা দেননি, গবেষণা-ডিগ্রি নেননি। তাই তার নিয়মকানুন মেনে চলার
পক্ষপাতিও তিনি ছিলেন না।
তাঁর গবেষক ছাত্র অশোক
বসুর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, সত্যেন বসু কোন পরীক্ষণের প্রতি যতটা আগ্রহী
থাকতেন, ফলের ব্যাপারে ততটা নয়। তিনি কোন কিছু শিখতে পারা, জানতে পারাটাকে যতটা
গুরুত্ব দিতেন জানার পরে সেটার আর তেমন গুরুত্ব থাকতো না। অশোক বসু ছিলেন রসায়নের
ছাত্র। গবেষণা করছেন খয়রা ল্যাবে সত্যেন বসুর তত্ত্বাবধানে। একদিন জিজ্ঞেস করলেন,
"সঠিক তাপমাত্রা কীভাবে মাপবে?" বিদেশ থেকে আসা থার্মোমিটার বা
থার্মোকাপল ব্যবহার করে তাপমাত্রা যে সহজেই মাপা যায় - তা করতে তাঁর উৎসাহ ছিল না।
তাঁর কথা হলো যন্ত্রপাতিও নিজেরা তৈরি করতে শেখো। পরীক্ষা করতে করতে শেখো। একবার
কোনকিছু কাজ না করলে আরেকবার চেষ্টা করো অন্যকিছু দিয়ে। এভাবেই শিখবে। এতে যে
অহেতুক সময় নষ্ট হয়, এবং যেটা ইতোমধ্যেই জানা হয়ে গেছে সেটা যে রেফারেন্স দেখেই
জেনে ফেলা যায় - সে পদ্ধতিতে বিশ্বাস করতেন না সত্যেন বসু। তাই গবেষণা শেখার জন্য
সত্যেন বসু খুবই ভালো শিক্ষক, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে - কিছুটা অবাস্তব।
যখন কোন গবেষণার ফলাফল
বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশের কথা উঠতো সত্যেন বসু তার বিরোধিতা করতেন। তিনি নিজে
যত গবেষণা করেছেন তার শতাংশও প্রকাশ করেননি। তাই এত বছরের শিক্ষা ও গবেষণায় তাঁর
গবেষণাপত্রের সংখ্যা তিরিশেরও কম। কোন সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে তিনি সেই সমাধান
ছিঁড়ে ফেলে দিতেন। তাঁর ছাত্রদেরও তিনি পরামর্শ দিতেন তা করার জন্য। "পেপার
দিয়ে তুমি কী করবে? তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছো কীভাবে হয়? যদি পেরে থাকো তাহলে
তুমি সেটা ফেলে দিতে পারো।"[1] সত্যেন বসুর কাছে গবেষণাটা ছিল এক ধরনের খেলার মত। অজানাকে জানার মধ্যে যে
আনন্দ সে আনন্দের জন্যই গবেষণা করা। তারপর সেটা নিয়ে প্রকাশ করা বা খ্যাতিলাভ করার
প্রতি তাঁর কোন মোহ ছিল না। তিনি যদি কোন কিছুর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতেন দিনরাত কাজ
করে সেই আগ্রহ মেটাতেন। তারপর সেটার কথা প্রায় ভুলেই যেতেন।
তাঁর পিএইচডি স্টুডেন্টদের তিনি তৈরি করতে চাইতেন
অলরাউন্ডার হিসেবে। তিনি বলতেন, 'বইয়ের রেফারেন্স দেবে না। তুমি নিজে সব বের করবে।
মনে কর কোথাও কোন রেফারন্স নেই, তখন কীভাবে সমাধান করবে?" - এরকম চিন্তাভাবনা
ছাত্রের জন্য ভালো। কিন্তু ছাত্রের অবস্থা কাহিল হয়ে যায় তখন। এত বেশি কাজের চাপ
তারা নিতে পারবে কি না সেটা সত্যেন বসু বুঝতে চান না। কারণ তিনি মনে করেন
গবেষক-ছাত্ররা কাজ করবে জ্ঞান লাভের জন্য, ডিগ্রি লাভের জন্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা
তো সবসময় সেরকম নয়। তাঁর পিএইচডি ছাত্র জগদীশ শর্মার থিসিস জমা দেয়ার লাস্ট ডেটেও
তিনি তাঁকে আরো অনেক পরীক্ষণ কাজের নির্দেশ দিলে জগদীশ শর্মা বললেন, "স্যার,
আজ থিসিস জমা দেয়ার শেষ দিন।" শুনে অবাক হয়ে গেলেন সত্যেন বসু। লাস্ট ডে আবার
কী জিনিস? তিনি অনেকটা বাধ্য হয়ে থিসিসে সাইন করেছিলেন। কিন্তু খুব খুশি হতে
পারেননি।[2] কাজের ব্যাপারে তিনি ছিলেন পারফেকশানিস্ট।
সত্যেন বসুর প্রিয় ছাত্রী
অসীমা চ্যাটার্জি ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত পিএইচডি গবেষণা করছিলেন জৈব রসায়নে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন তিনি নিয়মিত পরামর্শ নিতেন সত্যেন বসুর। সত্যেন বসু
তখন ঢাকায়। অসীমা কলকাতায় যেসব জৈবযৌগ জোগাড় করতে পারতেন না, সত্যেন বসু সেসব ঢাকা
থেকে জোগাড় করে কলকাতায় পাঠাতেন তাঁর জন্য। অসীমা চট্টোপাধ্যায় ১৯৪৪ সালে রসায়নে
পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম নারী যিনি
বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। তারপর তিনি লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে যোগ
দিয়ে সেখানে রসায়ন বিভাগ খুলেছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন
বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন। সত্যেন বসু তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। সত্যেন বসুর
সাথে অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্ক ছিল বাবা ও মেয়ের মত। বিভিন্ন কাজে অসীমা যেমন
সত্যেন বসুর পরামর্শ চাইতেন, তেমনি সত্যেন বসুও দরকার হলে নিঃসঙ্কোচে বলতেন
অসীমাকে।
চিত্র: অধ্যাপক অসীমা চট্টোপাধ্যায় (২৩/৯/১৯১৭ - ২২/১১/২০০৬)
অধ্যাপক অসীমা চট্টোপাধ্যায় শুষনি শাক থেকে 'মসলনী' নামে মৃগী রোগ নিরাময়ের
একটি ভেষজ ওষুধ উদ্ভাবন করেছিলেন। ডাক্তারি পরীক্ষায় তাতে সুফল পাওয়া গিয়েছিল।
সত্যেন বসু তাঁর বন্ধু বিশিষ্ট উদ্ভিদবিজ্ঞানী গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদারের নাতির জন্য
সেই ওষুধ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। ২২/৭/১৯৭০ তারিখে সত্যেন বসু অসীমা
চট্টোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন:
মা অসীমা,
শুষনি শাকের নির্যাস থেকে যে ভেষজ বের হয়েছিল, তা নিয়ে গবেষণার কথা মনে
হচ্ছে। সেটি নিয়ে ডাক্তাররা ব্যবহার করেছিলেন Epilepsy-তে, ফল ভালই হয়েছিল বলে তখন শুনেছিলাম।
এখন সবিশেষ জানবার জন্য এই চিঠি। গিরিজা'র নাতির
বয়স অল্প, এদিকে বেশ উজ্জ্বল মেধা, স্কুল পরীক্ষায় ভাল ফল দেখায়। হঠাৎ ২/৩ বার
মৃগীর মত ফিট হয়েছে ৫/৬ মাসের মধ্যে।
খুব মন খারাপ বাড়িশুদ্ধ সকলের। আমায় জিজ্ঞাসা
করছিলেন - তোমার নিষ্কাশিত শুষনি শাক থেকে সার বস্তু নিয়ে বর্তমানে গবেষণার ফল কী
দাঁড়িয়েছে ও Epilepsy-র উপর কেমন সুফল পাওয়া গেছে ইত্যাদি।
কলেজের P.B.X. নষ্ট হয়ে গেছে বলে Tel-এ সব কথা বলা গেল না। তাই চিঠিতে লিখছি।
তোমার বাসায় Tel আছে কি না জানি না। হয়তো তোমার সুবিধা হবে কোথাও থেকে Tel করার - শনিবারের আগে যদি তোমার কাছ থেকে কিছু খবর পাই তো গিরিজাকে জানিয়ে
দেব এই হপ্তার শেষে।
রুশ যাত্রায় বেশ বিপদে পড়েছিলে শুনেছি। কৌতূহল
রইলো সব শোনবার। দেখা হলে শুনব। জুলি কেমন আছে?
ইতি
আশীর্বাদক
সত্যেন বোস
অন্যের উপকারের জন্য সত্যেন বসু যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। আরেকবার তাঁর এক
বন্ধুর ছেলের চাকরির জন্যেও তিনি অনুরোধ করে চিঠি লিখেছিলেন কন্যাসম অসীমা
চট্টোপাধ্যায়কে। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় ছেলেটির চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
৬/২/১৯৭০ তারিখের চিঠিতে সত্যেন বসু লিখেছিলেন:
মা অসীমা,
তোমাকে ইতিপূর্বে একখানা চিঠি লিখেছি শ্রীমান
রামনারায়ণ ভট্টাচার্যের বিষয়ে। আশা করি এবিষয়ে চিন্তা করার সুযোগ হয়েছে।
আজ এই চিঠি নিয়ে তোমার কাছে যাচ্ছেন শ্রী মণীন্দ্রনাথ
- রামনারায়ণের বাবা। বিশেষ উৎকন্ঠায় আছেন সংসারের ঝঞ্জাটে। বড় ছেলে যদি কোথাও কাজ
পায় তাহলে একটু সুরাহা হয়। আমার মনে হয় যে, শ্রীমান রামনারায়ণ ইতিমধ্যে কাজকর্ম
কিছু শিখেছে ও মনযোগ দিয়ে সব কর্তব্য হাসিল করে যাচ্ছে প্রতিদিন। এই সাময়িক
চাকরিতে স্থায়ী হবার সম্ভাবনা আছে কি না শ্রী মণীন্দ্রনাথকে যদি বলতে পারো তো খুব
ভালো হয়। এইখানেই স্থায়ীভাবে টিকে গেলে এঁদের সুবিধা। আমিও ভাবছি যে, সত্যই কাজে
উপযুক্ত দেখলে তুমি নিশ্চয় রামনারায়ণকে সাহায্য করবে।
আশা করি, এখন তোমার শরীর অপেক্ষাকৃত ভাল।
তুমি ও জুলি আমার নিত্য আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা জেনো।
ইতি
মাস্টার মশায়
ছাত্রদের যে কোন সমস্যার সমাধানে আন্তরিক ছিলেন সত্যেন বসু। যে কোন বয়সী
ছাত্রদের সাথে সহজেই মিশে যেতে পারতেন। ছাত্রদের পড়ালেখায় কোন সমস্যা হলে তার
সমাধান করার জন্য তিনি যে আক্ষরিক অর্থেই দিন-রাত পরিশ্রম করতেন তার কিছুটা আমরা
জেনেছি কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিচারণে (এই বইয়ের ৬০ পৃষ্ঠায়)। সত্যেন বসু ছিলেন
ছাত্রঅন্ত প্রাণ। ছাত্রদের প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। আবার অন্যায় আবদারের ব্যাপারে
ছিলেন ভীষণ কঠোর।
একবার যখন কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স ফ্যালাল্টির ডিন ছিলেন তখন এমএসসি ক্লাসের ছাত্ররা এসে
দাবি জানালো পরীক্ষা পেছাতে হবে। ছাত্ররা তাদের ইউনিয়নের লিডারদের নিয়ে এসেছে।
শুরুতে তারা গিয়েছিল উপাচার্য শম্ভুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি খুব নিয়মনিষ্ঠ
ছিলেন। জানতেন যে পরীক্ষা পেছানোর দাবি ন্যায্য দাবি নয়। কিন্তু ছাত্রনেতাদের
মুখের উপর তাদের দাবি নাকচ করে তাদের বিরাগভাজন হতে চাইলেন না। তিনি বললেন পরীক্ষা
পেছাতে হলে তো মাস্টার্সের সব পরীক্ষাই পেছাতে হবে। সেক্ষেত্রে সায়েন্স ও আর্টস
ফ্যাকাল্টির ডিনের সম্মতি থাকলে তাঁর নিজের কোন আপত্তি নেই। ছাত্রনেতারা দেখলো
দু'জন ডিনকে রাজি করাতে পারলেই পরীক্ষা পিছিয়ে যাবে। আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন তাঁর কোন আপত্তি
নেই। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন সত্যেন বসু রাজি হলেই তিনি রাজি। তাই ছাত্রনেতারা
সবাই এসেছে সত্যেন বসুর কাছে।
সত্যেন বসু হাসিমুখে
জিজ্ঞেস করলেন, "পরীক্ষা পেছাতে হবে কেন? তোদের কারো বিয়ে নাকি?"
"না স্যার"
"না? বিয়ের নেমন্তন্ন
নয়, অথচ পরীক্ষা পিছিয়ে দেব সে কেমন কথা?"
হাসিঠাট্টা করলেও তাঁকে দিয়ে যে পরীক্ষা পেছানোর দাবি আদায় করা সম্ভব নয় তা
ছাত্রনেতারা বুঝে গেল। সাধারণ ছাত্রদের কাছে তারা বড়মুখ করে বলে এসেছে পরীক্ষা
পিছিয়ে দেবে। আসলে পরীক্ষা তো সাধারণ ছাত্ররা পেছাতে চাচ্ছে না। নেতারাই চাচ্ছে -
তাতে আরো বেশিদিন তারা ছাত্ররাজনীতি করতে পারবে। তারা সত্যেন বসুকে বললো,
"দাবি না মানলে আমরা অনশন করবো"।
সত্যেন বসু বললেন,
"তোরা অনশন করলে আমিও অনশন করবো তোদের অন্যায় দাবির প্রতিবাদে। এমনিতেই আমি
একবেলা খাই, আরেক বেলাও না খেয়ে থাকবো।"
নেতারা হুমকি দিলো যে তারা
ডিন অফিসের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করবে। তখন সত্যেন বসু পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন,
"দেখো ছেলেরা। আমি জীবনে কোনদিন অন্যায় করিনি। তোমাদের দাবি যদি ন্যায়সঙ্গত
হতো, আমি সাথে সাথে মেনে নিতাম। কিন্তু অন্যায় দাবি আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো
না। দরকার হলে আমি পদত্যাগ করতেও রাজি আছি।"
ছাত্রদের উপকার করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করার দরকার হতো না। ১৯৩৯-৪০ সালে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন অজিত রায়।[3] বিএ ফার্স্ট ইয়ারে ইংলিশ টিউটোরিয়াল ক্লাসে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপস্থিতি না
থাকাতে অজিতকে সেকেন্ড ইয়ারের প্রমোশন দেয়া হয়নি। অজিতের লেখাপড়া সেখানেই শেষ হয়ে
যাবার কথা। কিন্তু কয়েকদিন পর অজিতকে ঢাকা হলের অফিস থেকে বলা হলো ইংলিশ
ডিপার্টমেন্টের রিডার এস এন রায়ের সাথে দেখা করার জন্য। তিনি জানালেন ইংলিশ
ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর মাহমুদকে ফোন করেছিলেন ঢাকা হলের প্রভোস্ট
সত্যেন বসু। বলেছেন অজিতকে কোনভাবে সাহায্য করা যায় কি না দেখার জন্য। নইলে
ছেলেটার লেখাপড়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। অজিত রায় তখনো সত্যেন বসুকে চোখেও দেখেননি
কোনদিন।
অজিত রায় কমিউনিস্ট পার্টি
করতেন। ১৯৪১ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় নারায়ণগঞ্জে এক সমাবেশে ব্রিটিশবিরোধী
বক্তৃতা দেয়ার অপরাধে। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয় তাকে সাধারণ কয়েদীদের সাথে। এক
সপ্তাহ পর ডেপুটি জেলার এসে অজিতকে নিয়ে যান জেলের স্পেশাল সেলে যেখানে ডিভিশান-১
পাওয়া রাজবন্দীদের রাখা হয়। তিনি পরে জেনেছেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে চিঠি
লিখে এই সুবিধা আদায় করে দিয়েছেন প্রফেসর সত্যেন বসু।
ছাত্রদের জন্য সত্যেন বসুর
বাড়ি ও অফিসের দরজা সবসময় খোলা থাকতো। ছাত্রদের শুধু লেখাপড়া নয়, ব্যক্তিগত
সুখদুঃখের সব খবরও তিনি রাখতেন।
সত্যেন বসুর পড়ানোর স্টাইল
ছিল চমৎকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রফেসর শামছুল হক ছিলেন সত্যেন
বসুর ছাত্র। তিনি স্মৃতিচারণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ষাট
বছর' সঙ্কলনে লিখেছেন:[4]
"ভর্তি হয়ে প্রথম যেদিন তাঁর ক্লাস করতে
গিয়েছিলাম, তাঁর পড়ানোর কায়দা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। প্রায়শ দেখা যায় পন্ডিত ব্যক্তিরা সাধারণ ছাত্রদের বোধের
স্তরে নেমে এসে তাঁদের বক্তব্যকে প্রকাশ করতে পারেন না। কিন্তু প্রফেসর বোসের
সেদিনের পড়ায় মনে হয়েছিল তিনি সাধারণ ছাত্রদের নাড়ি ভালভাবেই বুঝতেন। তদুপরি তাঁর
বলার ভঙ্গি ছিল সুন্দর এবং পরিবেশন-দক্ষতা ছিল অপূর্ব। জানি না বড় বড় সভা সমিতিতে
তিনি কেমন বক্তৃতা করতেন, তবে শ্রেণিতে পড়ানোর জন্য তাঁর বাচনভঙ্গি সুন্দর ছিল।
বিজ্ঞান-বিষয়ক বক্তৃতার প্রসঙ্গে প্রাণবন্ত শব্দটা ব্যবহৃত হয় না বলেই তাকে
প্রাণবন্ত বলা থেকে বিরত রইলাম। তাঁর বক্তব্য পরিবেশনে কোন আড়ষ্টতা ছিল না,
প্রতিটি শব্দ যথাযথ উচ্চারণের সাথে তিনি স্পষ্টভাবে বলতেন।"
চিত্র: বিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকার ও সত্যেন বসু
ছাত্রছাত্রীরা সত্যেন বসুর
বিরাট ব্যক্তিত্বের মাঝে একটি কোমল অনুভূতিশীল হৃদয়ের সন্ধান পেতো। সত্যেন বসু
তাদের কাছে শুধু শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন অতি আপন কেউ। খুব বেশি শিক্ষক
শিক্ষার্থীদের এত আপন হয়ে উঠতে পারেন না। সত্যেন বসু ছিলেন ব্যতিক্রমী একজন
শিক্ষক।
সত্যেন বসুর ছাত্রসংখ্যা অগণিত। শুধু যাদের পড়িয়েছেন তারা নন, সব প্রজন্মের
শিক্ষার্থীর কাছেই সত্যেন বসু ছিলেন প্রিয় 'মাস্টার মশাই'। পদার্থবিজ্ঞানী জয়ন্ত
নারলিকার তাঁর সরাসরি ছাত্র নন, কিন্তু তাঁকে 'গুরু' মানেন।
[1] পূর্ণিমা
সিংহ, "সত্যেন বসুর ব্যক্তিত্ব ও মনের ধারা', দেশ, ২৯ অক্টোবর ১৯৭৭, পৃষ্ঠা
১৩।
[2] পূর্ণিমা
সিংহ, "সত্যেন বসুর ব্যক্তিত্ব ও মনের ধারা', দেশ, ২৯ অক্টোবর ১৯৭৭, পৃষ্ঠা
১৩।
[3] Ajit Roy,
Two Famous Bengali Scientists Some Personal Memories, Economic and Political
Weekly, Vol. 28, No 17 (Apr 24 1993), pp796-797.
[4] সামছুল হক,
প্রফেসর এস এন বোস - তাঁকে যেমন দেখেছিলাম, সত্যেন্দ্রনাথ বসু স্মারক গ্রন্থ (তপন
চক্রবর্তী সম্পাদিত), বাংলা একাডেমী, ঢাকা ১৯৮৬। পৃষ্ঠা ৬৮-৬৯।
No comments:
Post a Comment