অষ্টাদশ অধ্যায়
ব্যক্তি সত্যেন্দ্রনাথ
উপমহাদেশের পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে সত্যেন বসুই একমাত্র পদার্থবিজ্ঞানী যাঁকে বলা চলে খাঁটি বাঙালি। তিনি শিশুর মত সরল। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে পাড়ার রিকশাওয়ালা সবার সাথেই তাঁর সম্পর্ক আন্তরিক। তিনি জ্ঞানী। জ্ঞানের আলোয় তিনি আলোকিত করেন, কিন্তু জ্ঞানের অহমিকায় পুড়িয়ে ফেলেন না। গবেষণা করেন তিনি জানার জন্য, নিজেকে জাহির করার জন্য নয়।
বাঙালি মধ্যবিত্ত
একান্নবর্তী পরিবারে সত্যেন্দ্রনাথের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। মা-বাবার অবাধ্য হওয়ার কথা
ভাবেনওনি কোনদিন। মায়ের পছন্দে বিশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে এগারো বছর বয়সী উষাবতীর
সাথে। সেই সময়ের সামাজিক অবস্থা বদলে ফেলার উপায় তাঁর ছিল না। বিজ্ঞানের ছাত্র
হিসেবে তিনি জানতেন যে মেয়েদের এগারো বছর বয়স বিয়ের উপযুক্ত বয়স নয়। কিন্তু পুরো
সামাজিক ব্যবস্থা যে অন্যরকম। প্রাইমারি স্কুলে পড়েছিলেন উষাবতী। কিন্তু সত্যেনদের
পরিবারে মেয়েদের পড়ানোর চল ছিল না। সত্যেনের ছোট ছয় বোনের কেউ স্কুলে যাননি।
সত্যেন তাঁর বাবার পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে যাননি। বিদ্রোহও করেননি। নিজের
স্ত্রীকে ঘরে বসে লেখাপড়া করানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হয়নি। প্রাকৃতিক নিয়মেই
বিয়ের দু'বছরের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ ও ঊষাবতীর প্রথম সন্তান প্রথম কন্যা নীলিমার জন্ম হয় ১৯১৬ সালে। দু'বছর
পরেই ১৯১৮ সালে তাদের দ্বিতীয় সন্তান প্রথম পুত্র জন্ম নেয়। কিন্তু এক বছরের
মধ্যেই নিউমোনিয়ায় মারা যায় তাদের পুত্র সন্তানটি। ১৯২০ সালে তাদের তৃতীয় সন্তান -
দ্বিতীয় কন্যার জন্ম হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবনে একটি দুর্ঘটনায় এক বছরের শিশুকন্যাটির মৃত্যু হয়। সত্যেন
বসু ও ঊষাবতী দু'বছরের ব্যবধানে দু'বার
সন্তান হারানোর কষ্ট পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের শুরুতেই এরকম একটি তীব্র কষ্ট
তাঁরা পেয়েছেন - কিন্তু সেই কষ্ট তাঁরা সহ্য করেছেন নিরবে। সত্যেন বসু যেন এক
উদাসীন সন্ন্যাসী যাঁকে এ ধরনের কষ্ট কাবু করতে পারে না। অন্য অর্থে তিনি
সন্ন্যাসী নন মোটেও। ১৯২২ সালে তাঁদের চতুর্থ সন্তান পূর্ণিমার জন্ম হয়। পর পর
দুইটি সন্তানের মৃত্যুর পর সন্তান হলে কুসংস্কারবশত সেই সন্তানের একটা তুচ্ছ নাম
রাখা হয় - যেন মৃত্যু তার দিকে চোখ দিতে না পারে। পূর্ণিমাকে তাই ডাকা হতো পঁচা
বলে। ১৯২৪ সালে তাঁদের পঞ্চম সন্তান হয় আরেকটি মেয়ে। নাম রাখা হয় জয়া।
চিত্র: সত্যেন বসুর স্ত্রী উষাবতী দেবী
বড়লোক ডাক্তার বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন ঊষাবতী। আবাল্য আদরে মানুষ।
প্রাচুর্য ছিল বাবার বাড়িতে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে অভাব না থাকলেও প্রাচুর্য ছিল
না। সীমিত আয়। বৃহৎ সংসার। সংসার সীমিত রাখার কোন উপায় ছিল না। তাই হিসেব করে
সংসার চালাতে হতো ঊষাবতীকে। কিন্তু কোনদিন কোন কিছু নিয়ে তিনি অভিযোগ করেননি। সত্যেন
বসু আর উষাবতীর সংসার ছিল ভীষণ ছন্দোবদ্ধ।
১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বর
থেকে ১৯২৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইওরোপে ছিলেন সত্যেন বসু। তিনি একাই গিয়েছিলেন
ইওরোপে। পারিবারিক অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য কোন ভ্রমণেই সত্যেন বসু তাঁর স্ত্রী বা
সন্তানদের নিয়ে যাননি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর তিনি আরো অনেক বার
ইওরোপে গিয়েছিলেন, কোনবারই তিনি স্ত্রীকে সাথে নিয়ে যাননি।
সত্যেন বসু ইওরোপ থেকে
ফিরে আসার পর তাঁদের আরো চারটি সন্তান হয়। ১৯২৮ সালে জন্ম নেয় তাঁদের ষষ্ঠ সন্তান
শোভা। ১৯৩৩ সালে জন্ম নেয় তাঁদের সপ্তম সন্তান একটি পুত্রসন্তান। নাম রাখা হয়
রথীন্দ্রনাথ। সংসারে তখন তাঁদের চারটি কন্যাসন্তান এবং একমাত্র পুত্রসন্তান
রথীন্দ্রনাথ। ১৯৩৭ সালে তাঁদের প্রথম সন্তান নীলিমার বয়স যখন একুশ - তখন তার বিয়ের
আয়োজন করা হয়। সত্যেন বসু তাঁর কন্যাদের সবাইকে পড়াশোনা করিয়েছেন। কাউকেই
বাল্যবিয়ে দেননি। নীলিমার স্বামী বারীন্দ্রনাথ মিত্র ছিলেন ডাক্তার। বড় মেয়ের
বিয়ের পর সত্যেন বসু ও উষাবতী দেবীর আরো দুটি সন্তান হয়। কন্যা অপর্ণার জন্ম হয়
১৯৩৯ সালে, আর সবশেষে আরেকটি পুত্রসন্তান রমেন্দ্রনাথের জন্ম হয় ১৯৪১ সালে। নিজে
আমেরিকা ভ্রমণে যাওয়ার ভিসা পাননি। কিন্তু দুই ছেলেকেই আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন
লেখাপড়া করার জন্য।
চিত্র: পরিবারের সদস্যদের সাথে সত্যেন বসু |
সত্যেন বসুর মা বেশিদিন বাঁচেননি। সত্যেন বসুর বিয়ের কয়েক বছর পর তিনি মারা
যান। কিন্তু বাবা সুরেন্দ্রনাথ বেঁচেছিলেন নব্বই বছরের বেশি। সত্যেন বসুর ৭০তম
জন্মদিনে যখন সম্বর্ধনা দেয়া হয় তখনো বেঁচে ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ। ধরতে গেলে
সারাজীবন বাবার শাসন মেনে চলেছেন সত্যেন বসু। তবে শেষের দিকে পিতা-পুত্র পরস্পর
বন্ধুর মত হয়ে গিয়েছিলেন। বাবার জন্য সিগারেটের টিন কিনে আনতেন সত্যেন বসু। তারপর
বাবার পাশাপাশি বসে একসাথে সিগারেট টানতেন। যাঁরাই এ দৃশ্য দেখতেন একটু অস্বস্তিতে
পড়তেন। তবে সত্যেন বসুর ছেলেরা কখনো তাঁর সামনে ধূমপান করতেন না। বাবা হিসেবে
সত্যেন বসু ছিলেন খুবই স্নেহময়। সন্তানদের কাছে তাঁর শুধু একটাই দাবি ছিলো - সৎ
থাকতে হবে, সত্যের পথে থাকতে হবে। পড়ালেখা কর বা না কর, চাকরি কর কিংবা না, অসৎ পথ
অবলম্বন করা চলবে না।
চিত্র: স্নেহময় দাদু সত্যেন বসু |
সত্যেন বসুর সন্তানরা তাঁদের বাবার সম্মান রেখেছেন। তাঁর বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ এখনো ঈশ্বর মিল লেনের পুরনো বাড়িতেই থাকেন সবাইকে নিয়ে। উত্তর কলকাতার ২২ নম্বর ঈশ্বর মিল লেন এখনো বাঙালির এক গর্বের জায়গা।
চিত্র: পরিবারের সদস্যদের সাথে সত্যেন বসু |
স্ত্রী
উষাবতীর সাথে চমৎকার অন্তরঙ্গ ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল সত্যেন বসুর। উষাবতী
সত্যিকারের জীবনসঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন তাঁর। প্রাত্যহিক জীবনের সব কথাই তিনি বলতেন
স্ত্রীকে। বিদেশে গেলে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। ১৯৫৮ সালে প্যারিস থেকে লেখা একটি চিঠি
পড়লেই বোঝা যায় কত আন্তরিক ছিল তাঁদের সম্পর্ক। সত্যেন বসু তখন বিশ্বভারতী
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন।
8ই জুন 1958
6 Rue de la Taur Paris
16th
ঊষা,
6ই কলকাতা থেকে রাত 11 1/2 টায় প্লেন ছেড়েছিল, 7ই কাল এখানে রাত 9টায় হবলিতে নেমেছি। পারী শহরের প্লেন সব ওইখানে থামে।
দেখা করতে এসেছিলেন মালাকাররা, আর জ্যাকলীন, আগে থেকে মালাকার এই হোটেল ঘর ঠিক করে রেখেছিল, সেইখানে সকলে এলাম, জ্যাকলীনের গাড়িতে। পৌঁছাতে রাত 10 1/2টা। তারপর স্নান করে উঠে পড়তে প্রায় 12টা বাজ্ল। খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে গেছে। এদের নামবার আগে তার করে জানিয়েছিলাম।
পথে বেশী কিছু হয়নি। প্রথম শ্রেণীর যাত্রী বেশী ছিল না। আমার জায়গা ছিল ঠিক জানলার ধারে, ওপাশের সিট্ প্রায় শেষ অবধি খালি ছিল। ঘুম বেশী না হলেও, বেশ হাত পা ছড়িয়ে বসতে পেরেছি। বোতাম টিপলেই চেয়ারের পেছনটা হেলে যায়, আবার নিচ থেকে পা রাখার একটা ছোট্ট পাদান বেরিয়ে আসে।
আজকের দিন বিশ্রাম করার সুযোগ মিলেছে, রবিবার এখানে কোন গোলমালের লক্ষণ নেই। মালাকার বলছিল ওইসব ভীতিপ্রদ খবর কাগজেই পড়া যায়। সকলেরই একভাবেই কেটে যাচ্ছে শহরে। কাজেই তোমরা আমার জন্য ভেব না।
বসে প্রোগ্রাম ঠিক করবো আজকে। কাল সকালে যে কর্মকর্তার সৌজন্যে চিঠিটি মিলেছে, তাঁর সঙ্গে দপ্তরে দেখা করতে যাব। ভাবছি আগে Morn এর কাজ সেরে এসে, কটা দিন এখানে থেকে বাড়ী ফিরবো। এই অল্পদিন থাকবো জেনে জ্যাক দুঃখ করছিল।
শান্তিনিকেতনে এখন গরম কিভাবে চলেছে। প্রথম দিকে করাচী শহরে দেখলাম কালমেঘ ভোরের দিকে খেলা করছে কখন বৃষ্টি নামবে কে জানে। তবে সন্ধ্যায় আমার বেরোবার আগে বেশ এক শিলাবৃষ্টি হয়েছিল তোমরাও তার ভাগ পেয়েছিলে কি? সন্ধ্যায় জয়া দেবপ্রসাদ এসেছিলেন, তবে তাদের গাড়ী খারাপ হওয়াতে দমদমে যায়নি। I.S.I. এর একটা বাসে করে বাড়ীর অনেকে গিয়ে ছিল, তবে তারা ঢুকে কি দেখলে জানি না। আমার সঙ্গে 1টা থেকে ছাড়াছাড়ি হয়েছিল। আমার ভালবাসা জেনো।
ইতি
স
চিত্র: জার্মানির ফ্রিটজ-হ্যাবার ইন্সটিটিউটে ম্যাক্স ফন লাউইয়ের সাথে সত্যেন বসু (১৯৫৮) |
খুব
ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন সত্যেন বসু। ভোর পাঁচটায় উঠে কাউকে না জাগিয়ে নিজের জন্য
দু'কাপ কফি বানিয়ে পড়ার টেবিলে বসে যেতেন। আপন মনে অংক কষতেন, পড়াশোনা করতেন,
সমস্যার সমাধান করে সেই সমাধান ফেলেও দিতেন। তারপর সাতটার দিকে সবাই উঠলে সবার
সাথে ব্রেকফাস্ট করে ইউনিভার্সিটিতে চলে যেতেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন
পুরোদস্তুর বাঙালি। রাস্তার ফেরিওয়ালার কাছ থেকে মুড়ি তেলেভাজা খেতে পছন্দ করতেন।
আর যে কোন ভালো খাবারে আপত্তি করতেন না। খাবারের ব্যাপারে কোন ধরনের সংস্কার ছিল
না তাঁর।
পোশাকের ব্যাপারে মোটেই সচেতন ছিলেন না
সত্যেন বসু। যে কোন একটা পোশাক হলেই হলো। ইওরোপে গিয়ে ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য
ইওরোপিয়ান পোশাক পরেছেন ঠিকই - কিন্তু কোন নিয়মনীতি মানেননি। অনেকগুলো হ্যাট ও
ওয়াকিং স্টিক ছিল তাঁর। মাঝে মাঝে সেগুলো পরতেন। ধূতি-পাঞ্জাবি, ধূতি-ফতুয়া ছিল
তাঁর নিত্যদিনের পোশাক। বাড়িতে লুঙ্গি পরতে পছন্দ করতেন। একবার জাপানের এক
কনফারেন্সে তিনি লুঙ্গি পরে বক্তৃতা দিতে উপস্থিত হয়েছিলেন।
যখনই সময় পেতেন
ট্রানজিস্টার রেডিও শুনতেন। শেষ বয়সে শ্রবণশক্তি কমে গিয়েছিল। তখন কানের কাছে
রেডিও নিয়ে শুনতেন - রাগ সঙ্গীত।
চিত্র: সত্যেন বসুর ট্রানজিস্টার রেডিও |
চিত্র: সত্যেন বসুর কলম
মেঘনাদ সাহার মত রাগী-বিপ্লবী ছিলেন না সত্যেন বসু। কিন্তু তিনি বিপ্লবী
ছিলেন নিজের নিয়মে নিজের আদর্শে। কারো সাথে গলা উঁচু করে কথা তিনি বলেননি, কিন্তু
কোনদিন কোন অন্যায়ের সাথে আপোষ তিনি করেননি। জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমাদের পিছিয়ে পড়ার
পেছনে যে আমাদের লালিত কুসংস্কার দায়ি তা তিনি যুক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন
বিভিন্ন লেখায় ও বক্তৃতায়। আমাদের প্রাচীন দর্শন যেগুলো ইহলোকের অনিত্যতা প্রচার
করে সেগুলোর ব্যাপারেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই আধুনিক। নালন্দা ও তক্ষশীলার মতো
শিক্ষাকেন্দ্রগুলি পারলৌকিক দর্শনে গুরুত্ব দিয়েছে। দুনিয়া দু'দিনের পান্থশালা বলে
ক্রমাগত প্রচার করেছে। ফলে মানুষের মনে তৈরি করেছে পার্থিব জীবন সম্পর্কে
ঔদাসীন্য। এর জন্যই জাগতিক ব্যাপারে আমরা আধিপত্য হারাই। সত্যেন বসুর মতে
পারলৌকিকতা আসলে জড়ত্ব, স্বার্থপরতা ও লোভেরই প্রকৃষ্ট জন্মভূমি। মানুষের উদ্বেগ
যখন তার নিজস্ব মোক্ষলাভের জন্যই তখন সে মূল সমস্যার মুখোমুখি না হয়ে লোকালয় ছেড়ে
আশ্রয় খোঁজে গুহা বা জঙ্গলে। এরই মধ্য দিয়ে সে নিজে মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু যারা
সংসারের অশুভ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়াই করে, সমাজ ও দেশের বৈষয়িক সমৃদ্ধির
জন্য চেষ্টা করে - তাদের চেয়ে কীভাবে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে তারা?[1]
উগ্র জাতীয়তাবাদ তিনি
সমর্থন করতেন না। মানুষ ধার্মিক হলেই যে সুবিবেচক হবেন এমন কোন কথা নেই। তিনি
লিখেছেন, "হিটলার সত্যিকারের খুব ধার্মিক লোক ছিলেন। তাঁর জীবন নিয়ে আলোচনা
করলে দেখবো যে, তিনি আমিষ কখনও ছুঁতেন না, ইত্যাদি অনেক কিছু। যে সব বাইরের অঙ্গ
থেকে আমরা বিচার করি তাই থেকে আমাদের মনে হতো ধার্মিক ঐ লোকের কাছ থেকে যা পাওয়া
যাবে তা সত্যি করেই মানুষের পক্ষে ভাল। ...... আজকের দিনে সেই অত্যন্ত নিম্ন
রসাতলে পতিত জাতি যদি আবার উঠে আসে তাহলে সেটা বিজ্ঞানের জোরেই। বিজ্ঞানীরাই আবার
তাকে টেনে তুলেছে।"[2]
আমাদের ভাগ্য-নির্ভরতা বা
অদৃষ্টবাদিতা যে আমাদেরকে পদে পদে পেছনে টেনে রাখছে তা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন
সত্যেন বসু। গৌতম বুদ্ধের উদাহরণ টেনে তিনি বলেছেন,[3]
"বুদ্ধদেব যখন কিসা গৌতমীকে বললেন যে, 'যাও
তুমি, যার বাড়িতে কেউ মরেনি সেখান থেকে নিয়ে এস সর্ষে, তাহলে আমি তোমার ছেলেকে
বাঁচিয়ে দিচ্ছি' - এটা সহানুভূতির চূড়ান্ত হতে পারে; কিন্তু তার বেশি নয়। এর সঙ্গে
উনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের মনোভাব একটু
আপনারা বিচার করে দেখুন। হঠাৎ কয়েকটা লোক বসন্তে মারা গেল। তাদের বাঁচাবার
কথাই শুধু হল না, লক্ষ লক্ষ লোকের সামনে ঐরকম বিপদপাতের জন্য এই বলে সান্ত্বনা
দিলে না যে এটা ভগবানের মার। বরঞ্চ তারা মনে করল যে আমাদের কোথাও একটা ঘাটতি রয়ে
গেছে। অতএব এর জন্য তৎপর হতে হবে।"
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছেন তিনি ঢাকায়, কলকাতায়। সেই সময় তিনি নিজের
বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন অনেক দাঙ্গাপীড়িত মানুষকে। ঢাকায় ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের
পিয়নকে তিনি বাঁচিয়েছেন দাঙ্গাকারীদের হাত থেকে। কলকাতায় তিনি কলেজের ছাত্রদের
নিয়ে তৈরি করেছিলেন রিলিফ কমিটি।
আর্ত-মানবতার সেবায় তিনি
সবকিছু দিয়ে এগিয়ে আসতেন। কিন্তু কারো কষ্ট দূর করার জন্য, শরণার্থীদের সাহায্য
করার জন্য, রোগীকে বাঁচানোর জন্য গান-বাজনা বিনোদন উৎসব করে চাঁদা তোলার
ব্যাপারটাকে তিনি খুবই অমানবিক বলে মনে করতেন। মানুষ মানবিকতা দেখালে তো এমনিতেই
দেখাবে - তার বিনিময়ে তাকে বিনোদন দিতে হবে কেন?
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল যখন মুজিবনগর সরকার গঠিত হলো, সত্যেন বসু তার সাথে একাত্মতা
ঘোষণা করেছিলেন। যুগান্তর সাময়িকীতে সেদিন তিনি লিখেছিলেন,
'বাংলাদেশ ডাক দিয়েছে':[4]
"জন্ম
শহরে, এই কলকাতায়। ছেলেবেলা যখন স্কুলে পড়ি তখন দেশে এসেছিল স্বদেশী জোয়ার। তখনকার
দিনে রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি সকলেই নেমেছিলেন। প্রচার করেছিলেন বাঙালির ঐক্য। আমরাও
রাখীবন্ধন করেছিলাম, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছিলাম, গেয়েছিলাম "আমার
সোনার বাংলা" গান। তারপর কত কী হলো। দেশের ছেলেমহলে এল বিপুল আকাঙ্খা। বিদেশী কব্জা থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে,
ইত্যাদি নানা কথা। পথ খুঁজে বেড়িয়েছে
লোকে, প্রাণ দিয়েছে অনেকে। তার একসময় মনে হয়েছিল হিন্দুর ঐতিহ্য হয়তো বেশি দামী।
কাজেই অনেকে স্বীকার করে নিলেন দেশ ভাগ করা যাক। হয়তো এইভাবে আমরা আবার জাতি
হিসেবে মাথা তুলে উঠতে পারব।
দেশ
ভাগ হয়ে গেছে আজ তেইশ বছর - হিন্দুস্থান- পাকিস্তান। ভাবা গিয়েছিল এই ভাবেই দেশের
লোকের সুখ-স্বচ্ছন্দতা বাড়বে। মনের মত করে গড়ে তুলতে পারবে দেশ। কিন্তু তাও হয়নি।
হঠাৎ দেখা গেল পূর্ববঙ্গে এক বিপুল অভ্যুত্থান। বাঙালি যারা থাকতেন পূর্ববঙ্গে
তারা নানাভাবে কষ্ট পেয়েছেন। সম্প্রতি দৈব-দুর্বিপাকে, ঝড়-ঝাপটে বহু লক্ষ লোক মারা
গিয়েছে। তার ওপর মিলিটারি শাসনের গুঁতো। দুঃখের মধ্যেও শাসক সম্প্রদায় দেশের লোকের
ত্রাণকার্যে গড়িমসি করেছেন। তারপর এল ওপার বাংলার গণ-নির্বাচন। দেখা গেল নানা কষ্ট
ও দুঃখের মধ্যে বাঙালি এক হয়ে আওয়ামী লীগের পেছনে দাঁড়িয়েছে। এক বাক্যে স্বায়ত্ত্বশাসন
চাইছে সকলে। শাসকদের শোষণ নীতি আর বরদাস্ত করবে না। নানান রকম কারসাজি দেখা গেল।
মিটমাট করবার নানা কথা উঠল, এখন বোঝা যাচ্ছে সেটা শুধু ছল। পূর্ববঙ্গে সৈন্যসম্ভার
এনে ফেলাবার যতটুকু সময় লাগে ততটুকুর জন্য নিত্য বৈঠক ও বোঝাপড়ার কারসাজি। হঠাৎ একদিন
শাসকপ্রভুরা মনে করলেন এবার দমননীতি চাপানো যাক। ধরপাকড় আরম্ভ হলো, গুলি-গোলা
চালাল। যাঁরা শিক্ষিত, ভাবুক, লেখক, যাঁরা এই মিলিটারি শাসনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে
দাঁড়িয়েছিল তাঁদের অনেককেই প্রাণ দিতে হয়েছে। যে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ঢাকা - রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরেছিল তাও নিঃশেষে বিনষ্ট করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। তবে সাবাস
বাঙালী, এর মধ্যে সে মাথায় নোয়ায়নি। লড়ে যাচ্ছে। ঘরের ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত রুখে
দাঁড়িয়েছে। ওপর থেকে বোমা বর্ষণ হচ্ছে, মেশিনগানে কাতারে কাতারে লোক মরছে। সাত
কোটি বাঙালির জীবনমরণ পণ। তার নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবে। এ মিলিটারি জবরদস্তি
সহ্য করবে না।
সেদিন
জ্ঞানবৃদ্ধেরা আলোচনা করেছেন, জাতির ঐক্য বলতে কী বোঝায়? এক সময় ভেবেছিলেন অনেকেই
- ধর্মের ভিত্তিতেই জাতির একতা গড়ে তুলতে হয়। কিন্তু (সেদিন) বাঙালি ভুল করেছে।
তবে ভবিষ্যতে বিশ্বের দরবারে মানুষের ঐতিহ্য যে ওতপ্রোতভাবে দেশের মাটির সঙ্গে
জড়ানো, তাই প্রমাণের একটা ধাপ এগিয়ে দিল বাঙালীর এই বিপুল প্রচেষ্টা।
যাঁরা
মানুষে বিশ্বাস করেন তাঁরা ভাবছেন এই বিপর্যয়ে একাত্ম বঙ্গজাতির জয় হোক। আমারও এই
আশা। জয় বাংলা। (১৮ই এপ্রিল, ১৯৭১)।"
[1] সত্যেন্দ্রনাথ
বসু, শিক্ষা ও বিজ্ঞান, রচনা সংকলন, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা ১৯৯৮, পৃষ্ঠা
১০৯।
[2] সত্যেন্দ্রনাথ
বসু, বৈজ্ঞানিকের সাফাই, রচনা সংকলন, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা, ১৯৯৮। পৃষ্ঠা
৪৭।
[3] সত্যেন্দ্রনাথ
বসু, কথা প্রসঙ্গে, রচনা সংকলন, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা, ১৯৯৮। পৃষ্ঠা ২৮৭।
[4] সত্যেন বসু,
বাঙলা দেশ ডাক দিয়েছে, যুগান্তর (সাময়িকী), ১৮ই এপ্রিল, ১৯৭১।
No comments:
Post a Comment