যেতে যেতে পথে
ধীরেসুস্থে গর্জস্ট্রিট পার হয়ে বাসস্টপে এসে ইলেকট্রনিক বোর্ডে তাকিয়ে
দেখলাম - নেক্সট বাস আসতে আরো ছয় মিনিট বাকি। ছয় মিনিট কম সময় নয়। ট্রলিব্যাগটা
সোজা করে রেখে ব্যাকপ্যাকটা পিঠ থেকে নামিয়ে বাসস্টপের একমাত্র বেঞ্চের দিকে
তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো মেয়েটার সঙ্গে। মনে হয় এতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়েছিল।
চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো অন্যদিকে। সামান্য একটু সরে বসে তাকিয়ে রইলো
রাস্তার দিকে। সেদিক থেকেই আসবে এয়ারপোর্টগামী ৯০১ নম্বর ‘স্মার্টবাস’।
আমার
বাসা থেকে বেরিয়ে কব স্ট্রিট ধরে মিনিট তিনেক হাঁটলেই হাইভোল্টেজ গ্রিডলাইনের নিচে
বিশাল খোলা মাঠ। তার মাঝখান দিয়ে পায়ে চলার পাকা পথ পেরোতে আর তিন মিনিট। তারপর
একেবারে ঝকঝকে নতুন রেসিডেন্সিয়াল কলোনির ভিতর দিয়ে দু’মিনিট হাঁটলেই গর্জ স্ট্রিট। বাসার
এত কাছ দিয়ে যে এয়ারপোর্টে যাবার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আছে তা আবিষ্কার করেছি মাস
ছয়েক আগে। এর মধ্যে কয়েকবার যাওয়া আসা হয়ে গেছে এই পথে। যেখানে টেক্সি ভাড়া লাগে
৬০-৬৫ ডলার, সেখানে এই বাসে লাগে তিন ডলারেরও কম। তবে অনেক রাস্তা ঘুরে ঘুরে যায়
বলে সময়টা একটু বেশি লাগে। কিন্তু তাতে আমার ভালোই লাগে। ভ্রমণ করতে বেরিয়ে
প্রতিটি সেকেন্ড আমি উপভোগ করতে চাই। তাড়াহুড়ো করলে উপভোগ করার আনন্দটুকু থাকে না।
ডিজিটাল
ডিসপ্লেতে এখন দুপুর ২টা ২৩ মিনিট। বাস আসবে ২টা ২৮ মিনিটে। এয়ারপোর্টে পৌঁছতে
এখান থেকে একঘন্টা ১৫ মিনিটের মতো লাগে।
মে মাসের দুপুরের রোদে
তখনো তাপ আছে। এ বছর শীত আসতে দেরি করছে। অন্যান্য বছর এই সময় মেলবোর্নে বেশ
ঠান্ডা পড়ে যায়।
বাসস্টপে
মেয়েটি ছাড়া আর কেউ নেই এখন। রোদ থেকে মুখ বাঁচাতেই হয়তো সে তাকিয়ে আছে অন্যদিকে।
নাকি আমার ওপর রেগে আছে? আমার কি একটা ‘সরি’ বলা উচিত? ধরতে গেলে সরি বলার মতো কিছুই হয়নি তার সাথে। আধঘন্টা আগে তার সাথে আমার আচরণ শীতল ছিলো ঠিকই, কিন্তু কোনরকম অভদ্রতা আমি করিনি।
এই সেমিস্টারে শুক্রবারে
আমার একটাই ক্লাস - সাড়ে নয়টায় শুরু হয়ে শেষ হয় সাড়ে এগারটায়।
প্ল্যান ছিলো বারোটার মধ্যে চলে আসবো বাসায়। কিন্তু ক্লাশ শেষে বসতে হলো পরীক্ষার
প্রশ্ন নিয়ে। যাবার আগে সব সংশোধন করে দিয়ে যেতে হবে। ডিপার্টমেন্টের নতুন
ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার মাইক্রো-ম্যানেজমেন্টে ওস্তাদ। কমা, সেমিকোলন ইত্যাদি
আপাত-অপ্রয়োজনীয় সম্পাদনার কাজ করতে করতে মেজাজ কিছুটা খারাপ হয়েছিলো। বাসায় আসতে
আসতে দেড়টা বেজে গেলো। প্ল্যান ছিলো দুটোর মধ্যে বেরিয়ে পড়ার। ব্যাগ রেডি করা
ছিলো।
লাঞ্চটা মাইক্রোওভেনে ঢুকিয়েছি এসময়
দরজায় ঠক ঠক ঠক। কিচেন থেকে গলা বাড়িয়ে দেখলাম দরজার দিকে। কাচের প্যানেলে মানুষের
ছায়া। মাইক্রোওভেনের চারটা বাটন টিপতে
যতটা সময় লাগলো তার মধ্যেই আবার দরজায় ঠক ঠক ঠক।
দ্রুত এসে দরজা খুলে দেখি সাদা শার্ট আর
কালো প্যান্ট পরা একজন তরুণী। গলায় আইডি ঝুলছে আর হাতে কিছু লিফলেট। বুঝতে
পারছিলাম কোন কিছুর বিজ্ঞাপন নিয়ে এসেছে।
“হাই, আই অ্যাম...”
উচ্চারণ শুনে বুঝলাম সে ভারতীয়। ভারতীয়দের
ইংরেজিতে একটা অদ্ভূত টান থাকে। উচ্চারণের সেই টানের কারণে অনেকসময় তাদের কথা
ঠিকমতো বোঝা যায় না। মেয়েটির নাম কী বললো বুঝতে পারলাম না। লিফলেট আর কথাবার্তা
মিলিয়ে বুঝতে পারলাম ডাউনলাইট রিপ্লেস করার বুকিং নিতে
এসেছে।
বিদ্যুৎ
সাশ্রয় করার জন্য ভিক্টোরিয়ান সরকার বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বছর দুয়েক আগে
ফিলামেন্ট বাল্ব বদলে গ্যাস বাল্ব দিয়েছে ঘরে ঘরে বিনামূল্যে। এখন আবার গ্যাসবাল্ব
বদলে এল-ই-ডি বাল্ব দিচ্ছে। ভিক্টোরিয়ান এনার্জি এফিসিয়েন্সি টার্গেট বা VEET স্কিমের আওতায় হাজার হাজার ডলার খরচ করছে ভিক্টোরিয়ান সরকার। ‘সরকারি মাল’ ঠিক ‘দরিয়ামে ঢাল’ না হলেও অনেকগুলো ছোট বড় প্রতিষ্ঠান ঘরে ঘরে যাচ্ছে এই কাজে।
যারা যত বেশি ঘরে বাল্ব বদল করার সুযোগ পাবে তারা তত বেশি বিল করতে পারবে। অনেক পার্ট-টাইম
চাকরিও সৃষ্টি হয়েছে একাজে। মেয়েটি এই পার্টটাইম কাজেই এসেছে এখন। হাতে একটুও সময়
নেই তার সাথে কথা বলার। যথাসম্ভব মোলায়েম ভাবেই বললাম, “সরি, আমি একটু ব্যস্ত আছি। আপনার সাথে এখন কথা বলতে পারছি না বলে কিছু মনে করবেন
না।"
“তবে কি পরে আসবো?”
“আমি তো কিছুদিন থাকবো না তাই বলতে পারছি না।”
“ওকে”
মনে হলো খুব হতাশ হয়ে গেলো মেয়েটি। আমার
একটুও সময় ছিলো না আর। দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তারপর বের হবার তাড়ায় মেয়েটার কথা
ভুলেই গিয়েছিলাম। বাসস্টপে তাকে দেখার পর থেকে একটু খারাপ লাগছে।
ঠিক
২টা ২৮ মিনিটেই বাস এসে দাঁড়ালো। দু’জন আধবয়সী মানুষ নামলো। আমি দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে আগে উঠতে দিলাম। বড় ব্যাগ রাখার জন্য রেলিং দেয়া জায়গা আছে বাসের ভেতর। সেখানে ব্যাগটা রেখে মাইকি কার্ড ভ্যালিডেট করে বাসের পেছন দিকের সিটে গিয়ে বসলাম। সারা বাসে আমি আর মেয়েটি ছাড়া আর মাত্র এক জোড়া তরুণ তরুণী। একেবারে পিছনের
সিটে গায়ের সাথে গা লাগিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে তারা।
ঝকঝকে নতুন বাসের ভেতর আরামদায়ক শীতলতা।
এত কম ভাড়ায় এত দামী পাবলিক ট্রান্সপোর্ট কীভাবে চালায় সরকার! বাস, ট্রাম, ট্রেনে
সারাদিন-রাত সারাশহর উপশহর ঘুরে বেড়ালেও ভাড়া মাত্র সাত ডলার আশি সেন্ট। শনিবার
রবিবারে ভাড়া আরো কম। আর কম সময়ের জন্য মানে দু’ঘন্টার টিকেটের দাম চার ডলারেরও কম। জোন-২ এ ভাড়া আরো কম। এয়ারপোর্টে নামার সময় মাইকি টাচ
অফ করলে ভাড়া কাটবে আড়াই ডলারের মতো।
আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে বসার পর চোখ গেলো
অন্যদিকের জানালায়। মেয়েটি বসেছে সেদিকে। আবার চোখাচোখি হয়ে গেলো। ভদ্রতার হাসি
হাসলাম। সেও হাসলো। তার জানালায় তীব্র রোদ। একটু পরেই সে ওদিক থেকে উঠে আমার
সামনের সিটে এসে বসলো।
বাস গর্জ স্ট্রিট থেকে প্লেনটি রোড ক্রস
করে ম্যাকডোনাল্ডস রোডের প্রথম স্টপেজে থামলো। কেউ নামার নেই। সামনের দরজা খুলে
গেলো। সেদিকে তাকিয়ে ড্রাইভার দ্রুত উঠে গেলেন সিট ছেড়ে। দরজায় গিয়ে টেনে তুললেন
একটা প্র্যাম। প্র্যামের পিছু পিছু আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা এক মহিলা। মেলর্বোনে
বোরকায় ঢাকা মহিলার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। প্র্যামে ঘুমন্ত শিশুটিরও
মুখ ঢাকা। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে মুখ ঢাকা বোরকা অনেক সময় অস্বস্তির কারণ হয়ে
দাঁড়াচ্ছে ইদানীং।
বাসের
সিটের কাছে প্র্যাম রেখে মুখের কালো পর্দা পেছনে উঠিয়ে দিলো মহিলাটি। তীব্র
প্রসাধনচর্চিত একটি আরবদেশীয় কিশোরীর মুখ দেখা গেলো। সৌদি আরবের অনেক ছেলে পড়তে
আসে অস্ট্রেলিয়ায়। তাদের সরকার প্রচুর পরিমাণে শিক্ষাবৃত্তি দেয় যা দিয়ে পরিবার
পরিজন নিয়ে আরামে দিন কেটে যায় তাদের। এই তরুণী হয়তো তাদেরই কারো স্ত্রী।
শ্যাম্পুর
ঘ্রাণ আর ঈষৎ ঘামের গন্ধ নাকে এলো হঠাৎ। সামনে বসা মেয়েটি খোপার বাঁধন থেকে চুল
মুক্ত করছে। সারাদিন হয়তো রোদে রোদে ঘুরেছে বেচারি। গলা
থেকে কোম্পানির ফিতা লাগানো ন্যামট্যাগ খুলে হাতে নিয়েছে। চোখে পড়লো তার নাম - মুনশি। মুনশি কি নাম – নাকি পদবি? জানালার দিকে পিঠ দিয়ে আরাম করে বসার সময় আবার চোখাচোখি।
হাসিমুখে বললাম, “অনেক পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছে?”
“হ্যাঁ। অনেক ঘুরেছি মানুষের বাসায় বাসায়।”
“টার্গেট পূর্ণ হয়েছে?”
“না। বেশিরভাগই আপনার মতো। কথাই বলতে চায় না।”
“আমি সত্যি দুঃখিত সেইসময় আপনার সাথে ভালো করে কথা বলতে পারিনি। দেখতেই তো পাচ্ছেন। বের হবার তাড়া ছিল।”
“কোথায় যাচ্ছেন আপনি? ইন্ডিয়া?”
“না, সাউথ আফ্রিকা।”
“তাই? আপনি আফ্রিকান? আমি আপনাকে ইন্ডিয়ান ভেবেছিলাম।”
গায়ের বর্ণ কালো হলেই কি আফ্রিকান ভাবতে
হবে? আমার এক ছাত্রও একবার জ্ঞিজ্ঞেস করেছিলো, “আফ্রিকার ঠিক কোন দেশে তোমার জন্ম?”
প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য প্রশ্ন করলাম, “আপনার নাম বুঝি মুনশি?”
“না। ওরা ভুল করেছে। আমার নাম মান্সি। এ এর জায়গায় ইউ প্রিন্ট করেছে।”
ভুল নাম শুদ্ধ করার সময়ও দেয়নি কোম্পানি। বাঙালি হলে এই
মেয়েটার নাম হতো মানসী।
মান্সি ইন্ডিয়ার কোন অঞ্চল থেকে এসেছে
জানি না। জানার দরকারও নেই। যা বলার সে নিজেই বলছে। কথা বলতে বলতে প্রায়ই তার চোখ
চলে যাচ্ছে বাসের পেছনের সিটের দিকে। সেখানে তরুণ-তরুণী একটু বেশিরকম খোলামেলা হয়ে
প্রেম করছে। কিন্তু বারবার সেদিকে তাকানো দৃষ্টিকটু। মনে হচ্ছে মান্সি এখনো
অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি এদেশের এসব দৃশ্যে।
মান্সির ফোন বেজে উঠলো। তার হ্যান্ডব্যাগ
থেকে বের হলো আইফোন-সিক্স। মাঝে মাঝে অবাক লাগে কিছু কিছু ব্যাপারে। একটু আগেও মনে
হচ্ছিলো মান্সি কত অর্থ কষ্টে আছে। রোদে রোদে ঘুরে ঘুরে নিরস চাকরি করছে। আবার
এখন বেশি করে চোখে পড়ছে দামী আইফোন, পায়ের নাইকি।
এপিং প্লাজায় বাস থামলো। ফোনে কথা বলতে
বলতে নেমে গেলো মান্সি। নামার সময় অবশ্য একবার পিছন ফিরে হাত নেড়ে বিদায় জানালো।
বেশ
কিছু যাত্রী উঠলো এপিং প্লাজা থেকে। এর পরের চল্লিশ মিনিট বিভিন্ন সাবার্বের
বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে ঘুরে এয়ারপোর্ট এসে নামলাম পৌনে চারটায়।
পৃথিবীর
সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের এয়ারপোর্ট ঝকঝকে পরিষ্কার। কিন্তু আয়তনে খুব একটা বড় নয়।
তবে এখন জনসংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি এয়ারপোর্টের ব্যাস্ততাও বাড়ছে দিনে দিনে। নতুন
একটা টার্মিনাল হয়েছে। পার্কিংস্পেস বেড়েছে। অবশ্য পার্কিং চার্জও বেড়েছে অনেক।
বাসস্টপ
থেকে টার্মিনাল পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় আধকিলোমিটার হবে। আমার টিকেট সাউথ আফ্রিকান
এয়ারলাইন্স-এর। কিন্তু মেলবোর্ন থেকে পার্থ পর্যন্ত তাদের
ক্যারিয়ার হলো ভার্জিন অস্ট্রেলিয়া। আমাকে চেক ইন করতে
হবে ডোমেস্টিক টার্মিনালে।
টার্মিনাল-১ এ
ভার্জিনের কাউন্টার। এসকেলেটর দিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। এ পর্যন্ত কতবার যে এসেছি এই
এয়ারপোর্টে। কিন্তু প্রত্যেকবারই নতুন মনে হয়। কারণ এর গতি। এখানে সব মানুষ
প্রচন্ড গতিশীল।
ভার্জিন অস্ট্রেলিয়ার সারি সারি
কাউন্টারে প্রচন্ড ভিড়। বেশিরভাগই অনলাইন চেক ইন করে ব্যাগ ড্রপ করতে লাইনে
দাঁড়িয়েছেন। আমিও অনলাইন চেক ইন করে এসেছি - পার্থ থেকে কেইপ টাউন পর্যন্ত। কিন্তু
মেলবোর্ন থেকে পার্থ অনলাইন চেক ইন করা যায়নি।
লাল স্কার্টপরা ‘ভার্জিন’ কর্মীদের একজনকে জ্ঞিজ্ঞেস করলাম আমার চেক ইন করার ব্যাপারে। সে আমাকে দ্রুত নিয়ে গেলো একটা স্পেশাল কাউন্টারে। বললো, “ট্রেসি উইল টেক কেয়ার অব ইউ।”
ট্রেসি মোটাসোটা হাসিখুশি করিৎকর্মা।
আমার পাসপোর্ট স্ক্যান করে ঝটপট তিনটা বোর্ডিংপাস প্রিন্ট করে ফেললো। আমি
জ্ঞিজ্ঞেস করলাম, “পার্থে গিয়ে কি আমাকে আবার চেক ইন করতে হবে? বা ব্যাগেজ?”
মনে হলো আমার প্রশ্নে খুব মজা পেলো
ট্রেসি। হাসিমুখে বললো, “তোমার ব্যাগেজ একেবারে কেইপ টাউন পর্যন্ত চলে যাবে। তবে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে জোহানেসবার্গে। স্টেপ বাই স্টেপ বলছি।"
বাচ্চাদেরকে বোঝানোর মতো করে ট্রেসি
আমাকে বুঝিয়ে দিলো কী কী করতে হবে।
“এই টার্মিনালের সিকিউরিটি গেট পার হয়ে চার নম্বর গেটে চলে যাও। তোমার প্লেন সেখান থেকে ছাড়বে। ৫টা ৪৫ মিনিটে বোর্ডিং।”
আমি মনযোগী ছাত্রের মতো তার মুখের দিকে
তাকিয়ে শুনছি।
“পার্থে নেমে তোমার লাগেজ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। লাগেজ আমরা তোমার জোহানেসবার্গের ফ্লাইটে তুলে দেবো। পার্থে তুমি ডোমেস্টিক টার্মিনাল থেকে ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে যাবে।”
“ওটা কত দূরে?”
“ওটা একই জায়গায়। এই যে বোর্ডিং পাসের খামের পেছনে ম্যাপ আঁকা আছে। তুমি ডোমেস্টিক টার্মিনাল থেকে এই পথ ধরে মিনিট
পাঁচেক হাঁটলেই ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল পেয়ে যাবে। সেখানে ইমিগ্রেশান পার হয়ে
তোমার গেটে চলে যাবে। গেট নাম্বার ওখান থেকে দেখে নিও।”
“জোহানেসবার্গে নেমে তোমার আফ্রিকান ইমিগ্রেশান শেষ করে তুমি তোমার লাগেজ নিয়ে নেবে। তারপর কাস্টমস পার হয়ে লাগেজ দিয়ে দেবে সাউথ
আফ্রিকান এয়ারওয়েজের কাউন্টারে। আর তুমি ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল থেকে ডোমেস্টিক
টার্মিনালে চলে যাবে।”
“অনেক ধন্যবাদ ট্রেসি। তুমি অনেক সুন্দর করে বোঝাতে পারো।”
ট্রেসি হাসলো। মনে হলো এরকম কথা সে
প্রায়ই শোনে। এই কাউন্টারে কোন ভিড় নেই। আরো কিছুক্ষণ কথা
বলা যেতে পারে ট্রেসির সাথে। বললাম, “তুমি শিক্ষক হলে খুবই উপকার হতো স্টুডেন্টদের।”
“আই হেট টিচিং।”
“তার মানে?”
“ঠিক সরাসরি শিক্ষকতাকে ঘৃণা করি বলা যায় না। তবে শিক্ষক হতে গেলে অনেক পড়াশোনা করতে হয়। পড়াশোনা করাটাকে আমি ঘৃণা করি।”
“তুমি কি তবে কিছুই পড়ো না?”
“অনেক কিছুই পড়ি। হাজার হাজার পাসপোর্ট পড়ি, নাম পদবি পড়ি। হাঃ হাঃ হাঃ। আর ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়ি। হাঃ হাঃ হাঃ।
“ওকে ট্রেসি। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। বাই।”
এবার বোর্ডিং গেটের দিকে যাওয়া যাক।
হাতে এখনো দেড় ঘন্টার মতো সময় আছে।
এই টার্মিনালের সবগুলো গেটই ভার্জিনের।
সিকিউরিটি চেকিং স্বাভাবিক গতিতে চলছে। অনেক ভিড় আজ। শুক্রবার সন্ধ্যার
ফ্লাইটগুলোতে খুবই ভিড় থাকে। বেশিরভাগই কাজের প্রয়োজনে ভ্রমণ করছে। অনেকে কাজ শেষে
ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ স্টেটে। আয়তনে বিশাল দেশ হওয়াতে কম সময়ে এক স্টেট থেকে অন্য
স্টেটে যাবার জন্য আকাশপথই সবচেয়ে উপযুক্ত।
চার নম্বর গেটে প্রচুর ভিড়। বসার কোন
জায়গাই খালি নেই। এডেলেইড যাবার ফ্লাইট রেডি হচ্ছে। একটু পরেই বোর্ডিং শুরু হবে।
এয়ারপোর্টে এসে হাতে সময় থাকলে
টার্মিনালের একদিক থেকে অন্যদিকে ঘুরে ঘুরে মানুষ দেখতে খুবই ভালো লাগে আমার।
দেখতে দেখতে চোখ পড়ে কত সাদৃশ্য, কত বৈচিত্র্য! মানুষের মতো বিচিত্র প্রাণী কি আর
আছে?
মেলবোর্ন টু পার্থ
ক্রিকেট খেলায় একটা রান বাঁচানো
একটা রান করার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এয়ারলাইন ব্যবসাতেও নাকি তাই। অর্ধেক সিট ভর্তি
করে একই রুটে দুটো ফ্লাইট চালানোর চেয়ে সবসিট ভর্তি করে একটা ফ্লাইট চালানো অনেক
বেশি লাভজনক। তাই আমার সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজের ফ্লাইট SA7255 এর টিকেট দিয়ে ভার্জিন অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইট VA693 তে উঠে বসেছি।
ভার্জিনের প্লেনগুলো ঝকঝকে নতুন। মেলবোর্ন থেকে পার্থের আকাশপথে
দূরত্ব প্রায় ২৭০০ কিলোমিটার। স্থলপথে দূরত্ব প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। গাড়ি
চালিয়ে যেতে গেলে ছত্রিশ ঘন্টা গাড়ি চালাতে হবে। প্লেনে সময় লাগে প্রায় চার ঘন্টা।
ভার্জিনের স্বল্পদূরত্বের ফ্লাইটগুলোতে
খাবারদাবার বা বিনোদনের ব্যবস্থার জন্য আলাদা মূল্য দিতে হয়। কিন্তু এই ফ্লাইটে
দেখলাম খাবারদাবার আর বিনোদনের সুবন্দোবস্ত আছে। ঝকঝকে নতুন এয়ারক্রাফট। আমার সিট জানালার পাশে।
পাশের সিটে একজন মাথা কামানো উল্কি আঁকা মানুষ। তার কানে সাত-আটটি ছিদ্র এবং সবগুলো
ছিদ্র থেকেই ঝুলছে নানারকম ধাতব জিনিস। একটুও যে অস্বস্তি আমার হচ্ছে না তা নয়।
যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি। এই বিদঘুটে গেটআপের মানুষগুলোকে দেখলে
অনেকের যে প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা তারাও জানে। কিন্তু এমন ভাব করে থাকে যেন এসব কিছুই
না। অন্যের পোশাক রুচি পছন্দ ইত্যাদির প্রতি কোন প্রতিক্রিয়া না দেখানোই এখন
সভ্যতা যাচাইয়ের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে। সভ্য হতে গেলে কত মুখোশ যে পরতে হয় মানুষের।
লোকটার সাদা কব্জিতে যে উল্কিটি আছে তার
দিকে দু’বার তাকানো যায় না। একটা নিরাবরণ মেয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে বসে আছে সেখানে। আমি সেদিকে একবার তাকাতেই লোকটা একটু নড়ে চড়ে বললো “হাই”।
আমিও ‘হাই' বলে জানালায় চোখ রাখলাম। আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে টার্মিনাল ভবন। একটু পরেই
রানওয়ে। তারপর প্রচন্ড গতি নিয়ে উঠে পড়লো আকাশে। মাটি ছেড়ে আকাশে উঠার মুহূর্তটা
খুব ভালো লাগে আমার। এই মুহূর্তটা অর্জন করতে বিজ্ঞানের যে কত বছর সাধনা করতে
হয়েছে।
ইনফ্লাইট
এন্টারটেইনমেন্ট খুবই চমৎকার। সিটের সামনে লাগানো দশ ইঞ্চি ফ্ল্যাট-প্যানেল
টাচ-স্ক্রিন মনিটরে অনেকগুলো চ্যানেল। মুভিচ্যানেলে অনেক সিনেমা। ক্ল্যাসিক মুভি
থেকে সাম্প্রতিক অ্যাকশান সবই আছে। ওয়ার্ল্ড মুভির জগতে ইউরোপিয়ান এশিয়ান সিনেমার
পাশপাশি বলিউডের সিনেমাও এখন ফ্লাইটে সংযুক্ত হয়েছে। ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ দেখছে আমার সামনের সিটে বসা একজন ভারতীয় মেয়ে। আমি স্টিভ জবসের
বায়োপিক দেখলাম। সেটা শেষ হবার পর দেখলাম অ্যাকশান মুভি HITMAN
47। সিনেমা দেখার ব্যাপারে আমার কোন বাছবিচার নেই। সত্যজিৎ, মৃণাল, বুদ্ধদেব, কুরুসাওয়া, স্পিলবার্গ, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, উডি অ্যালেন, চার্লি চ্যাপলিন, টম হ্যাংকস, আমির খান, জসিম,
রোজিনা, সালমান খান, দীপিকা পাড়ুকোন সবই চলে আমার। শুধু হাতে একটু সময় থাকলেই হলো।
দুটো সিনেমা দেখার পরেও ঘন্টাখানেক
ঝিমানোর সময় পেলাম। পার্থে যখন নামলাম তখন আমার ঘড়িতে রাত পৌনে এগারটা। মেলবোর্নের
সাথে সময়ের পার্থক্য ঘোচাতে ঘড়ির কাঁটা দুই ঘন্টা পিছিয়ে দিতে হলো।
পার্থে আমি আগেও এসেছিলাম। কিন্তু এই
টার্মিনাল নতুন তৈরি হয়েছে। সবকিছু একেবারে ঝলমলে নতুন। এখানে আমার ব্যাগেজ
কালেক্ট করতে হবে না। চেকিংও করতে হবে না। কিন্তু ইমিগ্রেশান পার হতে হবে।
প্লেন থেকে বেরিয়ে দোতলা থেকে নিচতলায়
নামলাম। টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে একটু হাঁটলেই ইন্টারন্যাশনাল ডিপার্চার চেক ইন
কাউন্টার। প্রচুর ভিড় সবগুলো কাউন্টারেই। চায়নিজ আর ইন্ডিয়ানদের সরব উপস্থিতি চোখে
পড়ছে প্রচন্ডভাবে। পৃথিবীর সাতশ' কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় আড়াই শ' কোটি মানুষ আছে
চীন ও ইন্ডিয়ায়। ভবিষ্যতে কোন একসময় অস্ট্রেলিয়ায় চায়নিজ ও ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত
মানুষের সংখ্যা অস্ট্রেলিয়ানদেরও ছাড়িয়ে যাবে।
জোহানেসবার্গের ফ্লাইটের বোর্ডিং পাস
বের করে পাসপোর্ট আর ইমিগ্রেশান কার্ড হাতে নিয়ে আবার দোতলায় উঠলাম।
ইমিগ্রেশান কাউন্টার এদিকে। ইমিগ্রেশানে
মোটামুটি ভিড়। বেশিক্ষণ লাগলো না ইমিগ্রেশান আর সিকিরিউটি পার হতে।
আমার ফ্লাইট ৫০ নম্বর গেটে। গেট নম্বর
৫০ দেখে এখানে ৫০টি গেট আছে ভাবলে ভুল হবে। ৫০ থেকে ৫৬ - এই ৭টি মাত্র গেট
ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের জন্য। ৫০ নম্বর গেটে আসতে উপর থেকে আবার নিচে নেমে আসতে
হলো। সারি সারি খালি চেয়ার। খুব একটা ভিড় নেই।
এয়ারপোর্ট টার্মিনালটি নতুন - কিন্তু
খুবই ছোট। অবশ্য চাহিদা অনুযায়ী আয়তন। এই আয়তন সময়ের সাথে বাড়বে। যথেচ্ছ বাড়ানোর
মতো জায়গা রেখেই এটা তৈরি করা হয়েছে।
টার্মিনালের ভেতর দোকানপাট খুব বেশি
নেই। যে ক'টা আছে সেগুলোরও বেশিরভাগ এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে।
প্লেনের চিকেন রাইস এতক্ষণে হজম হয়ে গেছে। কফিশপে ঢুঁ মারলাম। কফি আর মিষ্টি ডোনাট
ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না। যাত্রীদের কেউ কেউ আসতে শুরু করেছে। মেলবোর্নে এখন রাত
বারোটা বেজে গেছে। ঘুম চলে আসছে। মনে হচ্ছে কখন প্লেনে উঠবো- কখন ঘুমাবো।
No comments:
Post a Comment