প্রথম বিকেল প্রথম সন্ধ্যা
হোটেল
থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই বাতাসে শীতের স্পর্শ অনুভব করলাম। দক্ষিণ
গোলার্ধের দেশ হওয়াতে কেইপ টাউনের আবহাওয়া আর মেলবোর্নের আবহাওয়ার মধ্যে মিল আছে।
তবে কেইপ টাউনে শীতের তীব্রতা মেলবোর্নের চেয়ে কম হবে বলে মনে হয়। জুন-জুলাই মাসে কেইপ
টাউনের তাপমাত্রা সবচেয়ে কম এবং তা গড়ে ১৭-১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
হোটেলের সামনে প্রশস্ত রাস্তাটির নাম
সমারসেট রোড। পাশদিয়ে আরেকটি ছোট রাস্তা ইবেনিজার রোড চলে গেছে ওয়াটার ফ্রন্টের
দিকে। রাস্তায় লোকজন খুব বেশি নেই। রাস্তা-ফুটপাত সব ঝকঝকে পরিষ্কার।
এদিকে বেশিরভাগ দোকান বন্ধ। রাস্তার
ওপাশে একটা কে-এফ-সি দেখে গেলাম সেখানে। মাত্র ৫-৬ টা টেবিল। মেনুতে অপরিচিত কিছুই
নেই। তবে সবকিছুর দাম মেলবোর্নের তুলনায় অনেক কম। কাউন্টারে অর্ডার দেবার শেষ
পর্যায়ে কাউন্টারের ছেলেটা জ্ঞিজ্ঞেস করলো, “কতজন ক্ষুধার্ত শিশুকে আপনি খাওয়াতে চান?”
আমি শুরুতে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না সে কী
বলতে চায়।
“মানে কী?”
“মানে আমাদের KFC 'Feed The Children' নামে একটা প্রোগ্রাম চালায়। মাত্র দুই র্যান্ড
দিয়েই একটা ক্ষুধার্ত শিশুকে পেটভরে খাওয়ানো যায়।”
খুবই
ভালো লাগলো তাদের এই প্রোগ্রাম। অস্ট্রেলিয়ান এক ডলার দিয়ে ৫ জন ক্ষুধার্ত শিশুর
ক্ষুধা দূর করা গেলে এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। শুধু তাই নয় দোকানে দু’জন দরিদ্র মেয়েকে চাকরিও দিয়েছে তারা। সবাই হাত বাড়িয়ে
দিলে কোন কঠিন কাজই আর কঠিন থাকে না।
কে-এফ-সি থেকে বের হয়ে সমারসেট রোড ধরে
হাঁটতে শুরু করলাম সিটি সেন্টারের দিকে। আসলে সিটি সেন্টার ঠিক কোনটা বা কোনদিকে
সেটা ঠিক জানি না। শহরের রাস্তা ধরে ইতস্তত উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে হাঁটতে ঠিকই পেয়ে
যাবো কিছু না কিছু। দিনের আলো ইতিমধ্যেই কমতে শুরু করেছে। সূর্য ডোবার আগেই একটু
হেঁটে আসা যাক। কাল থেকে ভ্রমণ গাইড দেখে পরিকল্পনা মোতাবেক চলা যাবে।
যেকোন নতুন শহরেই আমি একটা কাজটা করি।
কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়াই শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটি - আর শহরের পরিবেশ গতি
ইত্যাদি বোঝার চেষ্টা করি। প্রত্যেকটা শহরেরই একটা নিজস্বতা থাকে। এই নিজস্বতা
ধরতে পারলে শহরটাকে আর অচেনা মনে হয় না।
ডাউনটাউন মানে শহরের কমার্শিয়াল এরিয়া -
সবগুলো বড় শহরেই একই রকম বলে মনে হয়। বড় বড় বিল্ডিং-রাস্তা ইত্যাদি প্রায় একই রকম।
কিন্তু কেইপ টাউনের বিশেষত্ব হলো এর পাশ ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে বিশাল পর্বতমালা। বলা
চলে এই পর্বতের কোলেই গড়ে উঠেছে এই সুন্দর শহর।
প্রায় নির্জন কোলাহলমুক্ত রাস্তায়
হাঁটতে হাঁটতে তৃষ্ণার্ত হয়ে গেলাম। লং স্ট্রিটে চোখে পড়লো বাংলাদেশের
ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোর মতোই একটা বড়
দোকান। ফ্রিজে সফট ড্রিঙ্কস আছে দেখতে পেয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরের জিনিসপত্র- বিস্কুট, চানাচুর, মুড়ি মনে হচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি।
কাছে গিয়ে দেখলাম ঠিক তাই। অন্য কোন কাস্টমার দেখতে পাচ্ছি না। দোকানদারকেও চোখে
পড়ছে না। বাম দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে ভাত তরকারি, চিকেন ফ্রাই এসবের ব্যবস্থাও
আছে। হঠাৎ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কেউ জ্ঞিজ্ঞেস করলো, “বদ্দা ক্যান আছন?”
আমার মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিলো, “আঁই ভালা আছি।”
দেখলাম প্রায় ৫০/৫৫ বছরের একজন দাড়িওয়ালা
মানুষ মোবাইল ফোন কানে লাগিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছেন। আমাকে তিনি
দেখতেও পাননি। হয়তো তাঁর গ্রামের বাড়ির কারো সাথে কথা বলছেন।
ফ্রিজ খুলে দুটো ম্যাঙ্গো জুস আর দু’ প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে ডান দিকে তাকিয়ে দেখি- ক্যাশ
কাউন্টারের সামনে একজন ৩০-৩৫ বছরের যুবক একটা উঁচু চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পা দুটো
তুলে দিয়েছেন সামনের ডেস্কের উপর। ডানহাতে ফোন ধরে নিচু স্বরে কথা বলছেন। আমি
কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন যুবক। কিন্তু তাঁর অবস্থানের
কোন পরিবর্তন হলো না। তিনিও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলছেন। তার দুলাভাইকে
পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বাকিটা নিজের কাছে রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি।
কাউন্টারে
রাখা আমার বিস্কুট আর জুস দেখে কাঁধ উঁচু করে কানের সাথে মোবাইল চেপে রেখে বাঁ
হাতে একটা ক্যালকুলেটর টেনে নিয়ে ডান হাতে বোতাম টিপে টুকটাক হিসেব করে ক্যালকুলেটরটি
আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
“পাঁচ হাজার, পাঁচ হাজার দিবা দে।”
আমি হঠাৎ আঁৎকে উঠলাম। পাঁচ
হাজার! পর মুহূর্তে বুঝতে পারলাম তিনি ফোনে কথা বলছেন। আমি
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে তিনি ইঙ্গিতে ক্যালকুলেটরের পর্দা দেখিয়ে
দিলেন আমাকে। সেখানে লেখা আছে ৪৩।
আমি ৫০ র্যাল্ডের একটি নোট কাউন্টারে
রাখলাম। তিনি বাঁ হাত দিয়ে সেটা টেনে নিয়ে ক্যাশ রেজিস্টারের ড্রয়ার খুলে ৭ র্যান্ড
ফেরত দিলেন। কিন্তু এমনভাবে দিলেন যে ৫ র্যাল্ডের কয়েনটা কাউন্টার থেকে গড়িয়ে
নিচে পড়ে গেলো। তারপরও তিনি চেয়ার থেকে উঠলেন না, পা-ও নামালেন না। আমি কয়েনটা কুড়িয়ে নিয়ে জুস আর
বিস্কুট ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে বেরিয়ে এলাম।
মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। যুবক যে এই
দোকানের কর্মচারী তা বোঝা যায়। নিজের দোকান হলে কাস্টমার সার্ভিস আরো অনেক ভালো
হতো। নিশ্চয় অনেক কষ্ট করে এদেশে এসেছেন। কিন্তু দায়িত্ব ঠিকমতো পালন না করার
ব্যাপারটাও সাথে করে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে এসেছেন। এটাই কষ্টদায়ক। আবার এমনটাও হতে
পারে যে দোকানটার মালিক তার আত্মীয়। চাকরি চলে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই।
দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তার নির্দেশনা
দেখে হাঁটতে শুরু করলাম কনভেনশন সেন্টারের দিকে। এই সেন্টারটা চিনে রাখা দরকার।
এখানে আসতে হবে কনফারেন্সের দিনে।
মিনিট
দশেক হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম সিসুলু স্ট্রিটে। কেইপ টাউন ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশান
সেন্টারের বিশাল ভবন এই রাস্তার পুরো একপাশ দখল করে আছে। দেখলাম লাল দোতলা ছাদখোলা
ট্যুরবাস দাঁড়িয়ে আছে কনভেনশান সেন্টারের সামনে। সেন্টারের সাথেই লাগানো ওয়েস্টিন
হোটেল। রাস্তার ওপাশে আরো কয়েকটি হোটেল।
দেখতে দেখতে হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারলাম
এদিকে অনেক ব্যস্ততা আছে। রাস্তা ক্রস করে দেখলাম তিন রাস্তার সংযোগস্থলে একটি
ফুটবলারের ম্যুরাল। ২০১০ সালে এদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল। গাঢ়
বাদামী বর্ণের ধাতব খেলোয়াড়ের পায়ে ধাতব ফুটবল, যেন এখনই কিক করবে। তার পাশে ঘাসের
ওপর নির্ভয়ে চরছে একটি লাল রঙের হাঁস।
শহরের মাঝখানে উঁচু দালানের ভিড়ে মনে হয়েছিল দিনের আলো নিভে
রাস্তায়
দিকনির্দেশনা আছে- সামনের রাউন্ড-অ্যাবাউট থেকে ডানদিকে ঘুরে একটু সামনে গেলে ওয়াটারফ্রন্ট।
কাছেই শিপ-ইয়ার্ড। বিশাল এক জাহাজের চারপাশে পিঁপড়ার মতো মানুষ; পুরনো জাহাজ ঘষেমেজে
পরিষ্কার করছে।
কিছুদূর এগোনোর পর মনে হলো একটা নতুন
নির্মাণাধীন শহরের মুখে এসে পড়েছি। অনেকগুলো বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ চলছে পুরোদমে।
রাস্তার দু’পাশে সুরক্ষা-বেষ্টনি গড়ে তোলা হয়েছে।
আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই প্রশস্ত
চত্বর। সেখানে বেশ কিছু পাথরের বেঞ্চ। অনেক ট্যুরিস্ট এখানে। এখান থেকে শুরু হয়েছে
উপরের দিকে ওঠার প্রশস্ত সিঁড়ি। অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে উঠার পরে সম্পূর্ণ আরেকটি
জগত।
পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যেন পাহাড়ের
কোলে হেলান দিয়ে বসে আছে পুরো কেইপ টাউন শহর। আর সামনের দিকে সাগর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে
ওয়াটারফ্রন্ট। বিশাল আয়োজন এখানে। মনে হচ্ছে পুরো একদিন লেগে যাবে এর অলিতে গলিতে
হাঁটতে।
সামনের
বিলবোর্ডে ওয়াটার ফ্রন্টের ম্যাপ দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম আজ অন্ধকার হওয়ার আগপর্যন্ত
প্রধান সড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে ফিরে যাবো হোটেলে।
ট্যুরিস্টে ভর্তি ওয়াটার ফ্রন্টের রাস্তাঘাট
দোকানপাট। অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট এখানে। সারি সারি ঝলমলে দোকান শপিংমল। আর পাঁচতারা
হোটেলও আছে একাধিক। হারবারে নোঙর করা আছে সারিসারি স্পিডবোট। সূর্যডোবার রঙিন আলোর
প্রতিফলন হারবারের পানিতে।
পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাবার আগেই হোটেলে
ফেরার রাস্তা ধরলাম। কাল সকালে আবার আসতে হবে এখানে। এখান থেকেই শুরু
হয় শহর ঘুরে দেখার বাস-যাত্রা।
ঝপ করে অন্ধকার নেমে গেলো। বৈদ্যুতিক
বাতি জ্বলে উঠেছে সবখানে। ওয়াটার-ফ্রন্ট থেকে শহরের রাস্তার দিকে ফিরছে অনেক
মানুষ। তাদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে আবার মূল সিটিতে চলে এলাম।
দ্রুত এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তা ক্রস
করে অনুমানের ভিত্তিতে হোটেলের দিকে এগোচ্ছি। কিন্তু রাস্তা মনে হচ্ছে ক্রমশ বেড়ে
যাচ্ছে। মিনিট দশেক পরে বুঝতে পারলাম আমি ‘পথ হারাইয়াছি’।
অন্ধকার
নামার সাথে সাথে তাপমাত্রাও কমতে শুরু করেছে। ব্যাকপ্যাক থেকে জ্যাকেটটা বের করে
পরে নিলাম। রাস্তায় আলো আছে। কিন্তু ফুটপাত খুব নির্জন। মনে করতে চেষ্টা করলাম
যাবার সময় ঠিক কোন কোন রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলাম। কারণ গত দশ-পনেরো মিনিট ধরে যতটুকু
হেঁটেছি তাতে মনে হচ্ছে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি।
বর্তমান প্রযুক্তির যুগে গুগল-ম্যাপের
কল্যাণে যেকোন রাস্তার দিক নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া খুব সহজ কাজ। স্মার্টফোনে কয়েকটি
টিপ দিলেই কাজটা হয়ে যায়। কিন্তু তা করতে ইচ্ছে করছে না। পথ হারানো পথে পথ খুঁজে
বেড়ানোর মধ্যে এক ধরনের আনন্দ আছে। তাতে গন্তব্যে পৌঁছানোর অনেকগুলো বিকল্প পথ
আবিষ্কৃত হয়। তাই মাঝে মাঝে অনেক কাছের গন্তব্যে পৌঁছাতে গিয়েও আমার হাঁটা হয়ে যায়
অনেকদূর।
নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছানোর তাড়া থাকলে পথ
হারানোর স্বাধীনতা খুব একটা থাকে না। এখন তাই স্বাধীনতার স্বাদ পুরোটা নিতে গিয়ে
হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়লাম কেইপ টাউন সিটি সেন্ট্রাল ট্রেন স্টেশনে।
কেইপ টাউন ট্রেন স্টেশন
শহরের
কেন্দ্রের একটা রেলস্টেশনে যেরকম ব্যস্ততা বা কোলাহল থাকার কথা তার চেয়ে অনেক কম
ভিড়। কয়েকজন ট্যুরিস্ট ছাড়া বাকি যেসব মানুষ দেখছি তাদের মধ্যে বর্ণভেদ নেই বললেই
চলে। একদল কিশোর-কিশোরী নিজেদের মধ্যে হল্লা করছে। স্টেশনের ভেতর ধূমপান নিষেধ
লেখা আছে এবং তা মানছেও সবাই।
স্টেশনের বাইরের বিশাল চত্বর প্রায়
ফাঁকা। এখানে ওখানে কিছু মানুষ জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে বা বসে গল্প করছে। আর হ্যাঁ, এখানে
প্রচুর ধুমপায়ী দেখা যাচ্ছে। ডাস্টবিন থাকলেও ধুমপায়ীরা কেন জানি না সিগারেটের
টুকরো ছাই ইত্যাদি ছুঁড়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। অনেকে জ্বলন্ত অংশটুকু নিভিয়ে দেয়ার
দরকারটুকুও গা করে না। এখানেও ডাস্টবিনের আশে পাশে স্টেশনের প্রবেশ পথের রাস্তায়
প্রচুর সিগারেটের টুকরো।
স্টেশান চত্বরের কোণায় হলুদ রঙের একটা
বিশাল খালি ফ্রেম। ফ্রেমের উপরের বর্ডারে
লেখা আছে টেবল মাউন্টেন, কেইপ টাউন। ফ্রেমের ভেতর দিয়ে দেখলাম পেছনের টেবল
মাউন্টেন এখন কুয়াশায় ঢাকা। হয়তো এই ফ্রেমের ভিতর বসে বা দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার জন্য
লাইন পড়ে যায় দিনের বেলা।
কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে
চারদিক। আর দেরি করা ঠিক হবে না। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ম্যাপ দেখার চেষ্টা
করছি - এমন সময় দু’জন লিকলিকে
কিশোর যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হলো আমার দু’পাশে। বিদঘুটে একটা পোড়া তামাকের গন্ধ নাকে এলো। হয়তো গাঁজা বা এজাতীয় কোন
কিছু টানছে তারা। জড়ানো গলায় প্রায় ফিসফিস করে জানতে চাইলো, “নিড অ্যানিথিং?”
গাঁজার গন্ধ ছাপিয়ে বিপদের গন্ধ টের
পেলাম। কিশোর অপরাধীর গ্যাং আক্টিভিটি সম্পর্কে সকালে পড়ার পর থেকে ভয়ে ভয়ে আছি।
মোবাইলটা তাড়াতাড়ি পকেটে চালান করে দিয়ে কোন রকমে ‘নো থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে দ্রুত পা চালালাম। তারাও পেছনে পেছনে
আসছে। একবার ভাবলাম দৌড় দিই। আবার ভাবলাম কোন লাভ নেই তাতে। দৌড়ে পারবো না তাদের
সাথে। যদি তারা কিছু করতে চায় যেকোন মুহূর্তে করতে পারে। তাই স্বাভাবিক থাকার
চেষ্টা করা ভালো।
যথাসম্ভব দ্রুত হাঁটছি আর পেছনে পায়ের
শব্দ শুনতে চেষ্টা করছি। একটু পরে মনে হলো পেছনে কেউ নেই। পেছন ফিরে দেখলাম তারা
দু’জন অন্য
কাউকে পেয়ে গেছে রাস্তায়। আমি দ্রুত আরেকটা গলির ভেতর ঢুকে পড়লাম। গলির ভেতর দিয়ে প্রায়
দৌড়ে একটা বড় রাস্তায় উঠে মনে হলো রাস্তা পেয়ে গেছি। সামনেই কিউবান পাব-এ জোরে
ব্যান্ড বাজছে। আর একটু পরেই গীর্জা। এই রাস্তার শেষেই আমার হোটেল।
হোটেলের লবিতে প্রচন্ড ভিড়। একসাথে অনেক
ট্যুরিস্ট। তাদের গলায় ব্যাজ ঝুলছে। ব্যাজের ফিতায় লেখা ‘গেট-ওয়ান’। কোন একটা কনফারেন্সে যে এসেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। কথাবার্তা
শুনে মনে হচ্ছে সবাই আমেরিকান। লিফটের সামনে লম্বা লাইন। চারতলায় ওঠার জন্য লিফট
দরকার নেই। কিন্তু সিঁড়ি কোথায়? লিফটের পাশেই থাকার কথা। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না।
সব স্টাফ ব্যস্ত তাদের গেস্ট সামলাতে। ডান দিকে এগিয়ে গেলাম। রেস্টুরেন্ট। এদিকের
পুরোটাই রেস্টুরেন্ট। সারি সারি চেয়ার টেবিল আর আলো আঁধারি মায়াবী পরিবেশ। অনেকেই ডিনার সারছেন। বেশিরভাগই
শ্বেতাঙ্গ।
মানুষ দেখার পরপরই নিজের অজান্তেই তার অঙ্গের
বর্ণ চোখে পড়ছে। আমি কি বর্ণবাদী হয়ে যাচ্ছি? নাকি মনের অজান্তেই
একটা জরিপ করতে শুরু করেছে আমার মস্তিষ্ক - দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের অবসান
হবার ঘোষণা দেবার পর তার কতটুকু কার্যকরী হয়েছে দেখার। এখানে বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গকে
সার্ভ করছে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ। এই দৃশ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। উল্টোটা আমি দেখতে
চাচ্ছি। কিন্তু সেটা খুব সহজলভ্য নয়। কারণ এখনো বেশিরভাগ কালো মানুষের হাতে সাদা
মানুষের সেবা কেনার সামর্থ্য নেই।
আমাকে রেস্টুরেন্টের লবিতে দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখে একজন ওয়েট্রেস এগিয়ে এলো হাসিমুখে।
“ওয়েলকাম স্যার, আর ইউ এলোন?”
“আমি আসলে উপরে ওঠার সিঁড়ি খুজছি।”
“আমার সঙ্গে আসুন স্যার।”
আমি তাকে অনুসরণ করলাম। সাদা শার্ট আর
কালো স্কার্ট পরা মোটাসোটা আফ্রিকান তরুণীটি আমাকে নিয়ে গেলো লিফটের পেছনে একটা
দরজার কাছে। দরজা খুলে বললো, “এটাই ওপরে ওঠার সিঁড়ি স্যার।”
সিঁড়ি আমি দেখতে পাচ্ছি। বাক্যটা না বললেও
চলতো। ‘অনেক
ধন্যবাদ’ বলে উপরে
উঠতে গিয়ে দেখলাম সে তখনো দাঁড়িয়ে আছে। পকেট থেকে একটা দশ র্যাল্ডের নোট হাতে
দিতেই তার মুখে হাসি।
রুমে চলে এলাম। একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে
লম্বা ঘুম দিতে হবে। জামাকাপড় ছাড়ছি এসময় কলিং বেল বেজে উঠলো। পিপহোলে চোখ দিয়ে
দেখি হোটেলের একজন স্টাফ হাতে ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও সাইন টাইন করতে হবে
নাকি? দরজা খুললাম।
“গুডইভনিং স্যার। আই অ্যাম ক্লারা। আই অ্যাম দি ফ্লোর ম্যানেজার।”
গলার স্বর খুবই মিষ্টি ক্লারার। বললাম, “হাই ক্লারা। হোয়াটস আপ?”
“হাউস কিপিং ঠিক আছে কিনা জানতে এসেছি। আপনার যা যা দরকার সব কি দিয়েছে?”
“হ্যাঁ সবকিছুই ঠিকমতো আছে।”
“থ্যাংক ইউ স্যার। কোন কিছু লাগলে আমাকে জানাবেন।”
স্বীকার করতেই হয় এদের সার্ভিস খুবই
ভালো। হবে নাই বা কেন? প্রোটিয়া হোটেলগুলোর ম্যানেজমেন্ট এখন ম্যারিয়ট হোটেলগুলোর
হাতে। প্রোটিয়া হোটেলগুলোর গোড়াপত্তন হয়েছিল ৪০ বছর আগে। তখন কেইপ টাউনের হোটেল
হিরেনগ্রাস্ট (Heerengracht) মন্দার কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। সেই সময়
হোটেলের রিশেপসনিস্ট অটো স্টেহলিক (Otto Stehlic)
হোটেলটি
কিনে নেন।
কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানরা তখন গণতন্ত্রের জন্য, কালোদের ন্যায্য
অধিকার আদায়ের জন্য শ্বেতাঙ্গ শাসকদের অত্যাচার সহ্য করে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
অসন্তোষের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেও ভালো নয়। শ্বেতাঙ্গ অটো
স্টেহলিক কিন্তু ঠিকই হোটেলটাকে দাঁড় করিয়ে ফেললেন। হোটেলের নাম বদলে রাখলেন দক্ষিণ
আফ্রিকার বিশেষ প্রজাতির ফুলের নামে - প্রোটিয়া।
ক্রমেই একটা হোটেল থেকে আরো হোটেল হলো। আরো অনেক হোটেল কিনে নিচ্ছিলো
বা অন্য হোটেলের সাথে শেয়ারে ব্যবসা করছিলো। আফ্রিকার হোটেল ব্যবসায় প্রথম সারিতে
উঠে আসে প্রোটিয়া হোটেল। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও আফ্রিকা মহাদেশের অন্যান্য দেশেও
প্রোটিয়া হোটেলের চেইন বাড়তে থাকে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও লন্ডনেও প্রোটিয়া হোটেল
জায়গা করে নেয়।
প্রচন্ড লাভজনক এবং সুনামের শিখরে তুলে
প্রচুর লাভের বিনিময়ে অটো স্টেহলিক প্রোটিয়া হোটেলের মালিকানা হস্তান্তর করে
ম্যারিয়ট গ্রুপের কাছে বছর খানেক আগে। এদিকে ২০১২ সালে অটো স্টেহলিকের ছেলে গাই
স্টেহলিক (Guy Stehlic) BON হোটেলস নামে নতুন এক হোটেল
খুলেছে কেইপ টাউনে। অটো স্টেহলিক এখন ছেলের ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যস্ত।
২০১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকান সরকার অটো স্টেহলিককে
দেশের বাণিজ্যে অবদান রাখার জন্য সর্বোচ্চ পুরষ্কার অর্ডার অব দি বাওবাব (order of
the baobab) প্রদান করে।
আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে শুয়ে কীর্তিমানদের
কীর্তি পড়তে পড়তে ঘুম এসে গেলো।
হোটেলের জানালা থেকে |
No comments:
Post a Comment