কিরস্টেনবশ ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন
জেটল্যাগের সুফল ভোগ করছি। ভোর চারটায় উঠতেও
কোন সমস্যা হচ্ছে না। অবশ্য এখানের ভোর চারটা মেলবোর্নের দুপুর বারোটা। ফেরার পর
উল্টো সমস্যা দেখা দেবে। কিন্তু সেটা নিয়ে এখনই চিন্তিত হবার কোন কারণ নেই।
কেইপ টাউনের ম্যাপ আর ভ্রমণ গাইড ঘেঁটে
সারাদিনের জন্য একটা প্ল্যান তৈরি করলাম। ট্যুরবাসের টিকেট করা আছে। গতকাল লাল-বাসে
চড়ে কেইপ টাউনের অর্ধেক ঘুরেছি। আজ নীল-বাস, বেগুনি-বাস আর হলুদ-বাসে চড়তে হবে।
সোয়া সাতটার দিকে নিচে নেমে
রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। এর মধ্যেই অনেকে চলে এসেছে। কর্মদিবসের ব্যস্ততা শুরু হয়ে
গেছে। ব্রেকফাস্টের মেনু অনেক লম্বা। বুফে ব্রেকফাস্ট বটে কিন্তু অতগুলো আইটেম
থেকে খাবার বাছাই করতে আমার খুব একটা সমস্যা হয় না। কারণ দুধ দই পনির মাখন
যেগুলোতে আছে সেগুলো বাদ। তারপর বাকি যা থাকে তার সংখ্যা খুব বেশি নয়।
কাপকেক, ব্ল্যাক কফি আর দুটো বিস্কুট
নিয়ে বসলাম। বিস্কুটগুলো এত শক্ত যে মনে হচ্ছে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভাঙতে হবে। দাঁত
আর চোয়ালের ব্যায়াম করার জন্য এরকম বিস্কুট খুব উপযোগী। গরম কফিতে ডুবিয়ে নরম করবো
কিনা ভাবছি। এদেশে কাপে ডুবিয়ে বিস্কুট খাওয়া কতটা গ্রহণযোগ্য তা তো জানি না।
বাংলাদেশে এই ব্যপারটাকে অনেকে ভদ্রতার পরিপন্থী বলে মনে করে। ব্যাপারটাকে অনেকে
গাঁইয়া শুধু নয়, আরো সুনির্দিষ্টভাবে 'চাঁটগাইয়া' বলে মনে করে। এদেশে অবশ্য আমাকে
কেউ চেনে না। দিব্যি আরাম করে কফিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাওয়া যায়। তবুও একবার চোখ
বুলিয়ে নিলাম চারপাশে কেউ দেখছে কিনা।
আশ্চর্য! একজন তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
চোখাচোখি হতেই মনে হলো হাসলো একটু। আমার দিকেই হাসলো কি?
জানালার পাশে দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে
বসেছি আমি। আমার পেছনে কেউ নেই। সুতরাং পরিচিতের হাসিটা আমার দিকে তাকিয়ে সন্দেহ
নেই। আমিও হাসি বিনিময় করলাম। ইতিমধ্যে সে চলে এসেছে আমার টেবিলের কাছে।
“গুডমর্নিং প্রাডিব!”
“গুডমর্নিং। হাউ আর ইউ? হোয়েন ডিড ইউ কাম?”
একগাল হেসে তাকে অভ্যর্থনা করে দ্রুত কয়েকটি
প্রশ্নও করা ফেললাম বটে। কিন্তু স্মৃতির অলিগলি খুঁজেও তার নাম মনে করতে পারছি না। সে আমার নাম
জানে। তার চেহারা আমার মনে আছে। দু’বছর আগে বুলগেরিয়াতে তার সাথে পরিচয় হয়েছিলো তাও মনে পড়েছে। কিন্তু নামটা
কিছুতেই মনে করতে পারছি না।
“আই কেইম লাস্ট নাইট” বলতে বলতে আমার
মুখোমুখি চেয়ারে বসলো সে।
মনে পড়লো দু’বছর আগে বুলগেরিয়ায় কনফারেন্স-ডিনারে এভাবে
মুখোমুখি বসেছিলাম তার। সেদিন তার আরো বন্ধুরা সাথে ছিল। পরনে ছিলো পার্টি
ড্রেস। দু’বছরে তার কী
কী পরিবর্তন হয়েছে বুঝতে পারছি না। একটু মোটা হয়েছে কি? গোলাপী টী-শার্টের কাঁধ
ছুঁয়েছে তার বাদামী চুল। বোঝা যাচ্ছে একটু আগেই শাওয়ার নিয়েছে। একটা স্নিগ্ধ
মিষ্টি গন্ধ ঘিরে আছে তাকে।
“হোয়েন ডিড ইউ কাম?” প্লেটের সসেজ
কাটতে কাটতে প্রশ্ন করলো সে।
“শনিবার দুপুরে”
প্লেটের সসেজে তার বাঁহাতে ধরা
কাঁটাচামচ গেঁথে আছে। সরু অনামিকা ঘিরে একটা আংটি জ্বলজ্বল করছে। দু'বছরে হয়তো এই পরিবর্তনটা
হয়েছে। বিয়ে কিংবা অ্যানগেজমেন্ট। কিন্তু তার নামটা এখনো মনে করতে পারছি না বলে স্বস্তি পাচ্ছি
না। অস্বস্তি লুকানোর
উপায় হলো খেজুরে আলাপ শুরু করা।
“আমিতো ভেবেছিলাম তুমি ওয়েস্টিনেই উঠবে। এই হোটেলে তোমাকে
আশা করিনি।”
“আমি তো আসবো না ভেবেছিলাম। শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
তার কথা শেষ হবার আগেই একহাতে ব্রেকফাস্টের
প্লেট অন্যহাতে এক কাপ কফি নিয়ে আমাদের টেবিলে চলে এলো ছিপছিপে লম্বা একজন শ্বেতাঙ্গ
স্বর্ণকেশী। হাতের কাপ আর প্লেট দ্রুত নামিয়ে রাখতে রাখতে বললো, “ইভানা ..." তার পরের
কথাগুলোর একটা শব্দও বুঝতে পারলাম না ভাষার দুর্বোধ্যতার কারণে।
কিন্তু তার প্রথম শব্দেই মনে পড়ে গেলো আমার
পরিচিতার নাম ইভানা। বুলগেরিয়ার কনফারেন্সের পরেও কয়েকবার বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংক্রান্ত
ইমেইল বিনিময় হয়েছে ইভানার সাথে। তাই সে আমার নাম মনে রেখেছে। তার নামও আমার
মনে থাকা উচিত ছিল।
ইভানার সঙ্গী স্বর্ণকেশী কাপ-প্লেট রেখে দ্রুত
চলে গেছে কফি-কর্নারের দিকে। দেখলাম আরেক কাপ কফি আর প্লেটে দুটো দইয়ের ডিব্বা নিয়ে ফিরে
এলো। তার চলাফেরা
বেশ দ্রুতগতি সম্পন্ন। ইভানা সে তুলনায় ধীরস্থির।
ইভানার পাশের চেয়ারে বসে পড়লো সে।
উচ্চতায় সে ইভানার চেয়ে বেশকিছুটা লম্বা। তার সোনালি চুল এখনো ভেজা
এখনো এলোমেলো। লম্বাটে সাদা মুখে ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট লাল লাল বিন্দু বিন্দু দাগ।
ইভানা পরিচয় করিয়ে দিলো, “প্রাডিব, দিস ইজ আনিটা, মাই পার্টনার,
অ্যান্ড আনিটা, দিস ইজ প্রাডিব, মাই অস্ট্রেলিয়ান
ফ্রেন্ড।”
“নাইস টু মিট ইউ” বলে হাত বাড়িয়ে
দিলো আনিটা। আমি হাত বাড়াতেই ধরে এমন চাপ দিলো যে মনে হলো হাতের হাড় মটমট করে ভেঙে যাবে। বক্সিং করে নাকি
মেয়েটা?
“ওয়াও! ইউ হ্যাভ আ স্ট্রং হ্যান্ড।”
“ইয়েস”
আনিটার গলার স্বরও তার হাতের মতোই জোরালো। এই মেয়ে ইভানার
পার্টনার। তার মানে কী? দেখলাম আনিটার বাম হাতেও ইভানার মতো একই ডিজাইনের একটা আংটি। তবে কি ইভানা
লেসবিয়ান? হতেই পারে। সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বুলগেরিয়ায়
তো সেরকম মনে হয়নি।
আনিটা প্লেট থেকে একটা দই এর কাপ আমার দিকে
এগিয়ে দিয়ে বললো, “ডু ইউ লাইক ওয়ান?” তার ইংরেজি উচ্চারণে ইউরোপিয়ান টান স্পষ্ট।
“নো, থ্যাংক ইউ আনিটা।”
জানতে চাইলাম, “আনিটা, তুমিও কি মেডিকেল
ফিজিসিস্ট?”
ইভানাই বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো আনিটা সম্পর্কে। আনিটা কাজ করে
প্রাগের একটা অটো ইন্ডাস্ট্রিতে। স্কোডা গাড়ি বানায় তারা। গাড়ির শক্ত পার্টস
নাড়াচাড়া করতে করতেই হয়তো এত শক্ত হয়ে গেছে আনিটার হাত।
“এখান থেকে কনফারেন্স সেন্টারে কীভাবে যেতে হয় জানো?" জানতে
চাইলো ইভানা।
“খুব বেশি দূরে নয় এখান থেকে। এক কিলোমিটারের
মতো হবে। হেঁটেই যাওয়া যায়।”
“চলো, একসাথে যাই।”
“হ্যাঁ, যাওয়া যায়। তবে আমি আজ অ্যাটেন্ড করবো না। আমি রেজিস্ট্রেশন
করেছি একদিনের জন্য। সেটা আগামীকাল। কালকেই আমার বক্তৃতা।”
“আমিও রেজিস্ট্রেশন করেছি একদিনের। সেটা আজকে। আমার বক্তৃতা
আজকে।”
“তাহলে?”
“আজ তোমার প্ল্যান কী?”
“সারাদিন ঘুরবো। ট্যুরবাসের টিকেট করা আছে।”
আনিটা চেক ভাষায় কিছু বললো ইভানাকে। মিনিট খানেক
কথা হলো তাদের মধ্যে। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।
তারপর ইভানা বললো,“আনিটা যদি তোমার সাথে যায়
তোমার কি কোন আপত্তি আছে? তাকে ট্যুরবাস দেখিয়ে দিলেই হবে।"
আপত্তির তো প্রশ্নই ওঠে না। সানন্দে রাজি
আমি।
ইভানা ও আনিটার রুম আমার ফ্লোরেই। আধঘন্টার মধ্যেই
আমরা তিনজন কেইপ টাউনের রাস্তায়।
পৌনে ন’টার রোদঝলমল সকাল। অফিস পাড়া সরগরম
হয়ে উঠছে। রাস্তায় গাড়ির ভিড়। সমারসেট রোডের ফুটপাত ধরে হাঁটছি আমি আর ইভানা পাশাপাশি। আনিটা একটা সিগারেট
ধরিয়েছে। আসছে পেছনে।
“দিস সিটি ইজ বিউটিফুল” বললো ইভানা।
“হ্যাঁ। আমি কাল থেকে দেখছি। প্রকৃতি এখানে খুবই উদার।”
“তুমি কি টেবল মাউন্টেন দেখে ফেলেছো?”
“হ্যাঁ, গতকাল। শুরুতেই ওটা দেখে নিয়েছি।”
“আমরা কালকে যাবো।”
"হ্যাঁ, সেটাই ভালো। তুমি আর আনিটা
মিলে কালকে দেখে নিও। আজ আনিটা কী দেখবে?”
“সেটা সে ঠিক করবে। আজ আমি তাকে সময় দিতে পারবো না তা সে জানে। তুমি তাকে ট্যুরবাসের
একটা স্টপেজ দেখিয়ে দিলেই হবে।”
যে প্রশ্নটা মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে, করেই ফেললাম, “তোমরা কি বিয়ে করেছো?”
“আমি আর আনিটা?”
“হ্যাঁ?”
“ঠিক বিয়ে নয়। আমরা রেজিস্টার্ড কাপল।”
“কনগ্র্যাচুলেশানস।"
রাস্তা পার হতে হবে। আনিটার সিগারেট
শেষ হয়েছে। দ্রুত এসে দাঁড়িয়েছে ইভানার পাশে। রাস্তা পার হবার সময় ইভানাকে
হাত ধরে নিরাপদে পার করে দিলো আনিটা। ইভানাকে যে সে খুব ভালোবাসে তা বোঝা যাচ্ছে।
কনভেনশান সেন্টারের সামনে চলে এসেছি। ইভানা
ভেতরে চলে গেলো। আমি আর আনিটা দাঁড়ালাম ট্যুরবাসের স্টপেজে।
“আনিটা, আমি রেড বাসে করে লং স্ট্রিট পর্যন্ত যাবো। তারপর ব্লু বাস
ধরবো।”
“টিকেট?”
“টিকেট তুমি বাসের ড্রাইভারের কাছ থেকে কিনতে পারবে।”
একটু পর দু’জন বয়স্কা মহিলার সাথে কথা বলতে বলতে এক আফ্রিকান
ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন বাসস্টপের দিকে। তাঁকে দেখে চিনতে পারলাম। গতকাল শুরুতে
যে রেড বাসে উঠেছিলাম তিনি সেই বাসের ড্রাইভার ছিলেন। আমাকে দেখে তিনিও
চিনতে পারলেন। বললেন, “সেকেন্ড ডে?”
“ইয়েস”
তিনি সাথের ভদ্রমহিলাদের বললেন এই স্টপেজে
দাঁড়াতে। লাল বাস এলে সেখানে উঠতে। আমাকে দেখিয়ে বললেন যে আমিও বাসে উঠবো।
ভদ্রমহিলাদের সাথে চোখাচোখি হতেই ‘হাই’ ‘হ্যালো’ ইত্যাদি হলো। মনে হলো আমেরিকান।
আমেরিকান ট্যুরিস্টের সংখ্যা প্রচুর এদেশে।
কয়েকমিনিটের মধ্যেই রেড বাস এসে থামলো। ভদ্রমহিলাদের
উঠতে দিলাম আগে। আমার গতকালের টিকেট আজকেও ভ্যালিড। আনিটার জন্য অপেক্ষা করলাম। সে ক্রেডিট
কার্ডে টিকেট কিনলো। তারপর বাসের দোতলায় উঠে পড়লাম।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই লং স্ট্রিটের ট্যুর
অফিসের সামনে চলে এলাম। আনিটা মনযোগ দিয়ে বাসের রুটম্যাপ দেখছে। বললাম, “আনিটা, আমি এখানে নেমে
যাবো। এই বাস যাবে টেবল মাউন্টেনের দিকে। আমি ব্লু বাস ধরে বোটানিক্যাল গার্ডেন
দেখতে যাবো।”
“ঠিক আছে। আমি মনে হয় টেবল মাউন্টেন দেখতে যাবো।”
ইভানা যে ঠিক করেছে আগামীকাল টেবল
মাউন্টেন দেখতে যাবে সেটা মনে হয় আনিটা জানে না। যাই হোক, সেটা তাদের ব্যাপার।
বললাম, “ওকে। হ্যাভ
আ নাইস ডে। সি ইউ লেইটার।”
বাস থেকে নেমে নীলবাসের টাইম-টেবল
দেখলাম। বারো মিনিটের মতো সময় আছে পরের বাস আসার।
ট্যুর-অফিসের নিচেরতলারও একটা নিচেরতলা
আছে, আন্ডারগ্রাউন্ড। সেখানে কেইপ টাউনের যত প্রাইভেট ট্যুর কোম্পানি আছে তাদের
সবগুলোর বুথ আছে পাশাপাশি। এখন সময় নেই নিচে নেমে দেখার।
পাশে একটা অ্যান্টিকশপ। একটা আফ্রিকান
মূর্তির দিকে তাকিয়ে দেখছি এমন সময় পিঠে
হাতের স্পর্শে চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি - আনিটা।
“হাই, তুমি যাওনি?”
“আমি তোমার নাম ভুলে গেছি।”
“সেজন্য তুমি বাস থেকে নেমে পড়েছো?”
“না, সেজন্য নয়। আমার মনে হলো টেবল মাউন্টেনের বদলে বোটানিক্যাল গার্ডেন
দেখে আসি তোমার সাথে।"
আনিটাকে একটু এলোমেলো টাইপের মানুষ বলে
মনে হলো। বললাম, “চলো তাহলে। ওই
যে বাস আসছে।”
“বাট দিস ইজ নট ব্লু -বাস। দিস ইজ রেড বাস।”
"ব্লু -বাস মানে নীল রঙের বাস নয়। রুটের নাম নীল।"
ব্লু -বাসের যাত্রী অনেক। হুড়মুড় করে উঠে
পড়লো সবাই। দোতলায় উঠে পেছনের দিকে একটা সিটে বসলাম। আনিটা বসলো আমার
পাশে।
ট্যুরিস্টদের মধ্যে বিশাল এক চায়নিজ
গ্রুপ। চায়নিজদের হাতে এখন প্রচুর টাকা-পয়সা। পৃথিবীর যেকোন
দেশে এখন তাদেরকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানানো হয়। চায়নিজরা সস্তা জিনিস বানায় ঠিকই কিন্তু
ইদানীং নিজেরা অনেক দাম দিয়ে অন্য দেশের তৈরি জিনিস কেনে।
লং স্ট্রিট পার হয়ে কয়েকটা বাঁক নিয়ে বাস
এসে থামলো মাউন্ট নেলসন হোটেলের সামনে। কেইপ টাউনের একটি প্রথম সারির হোটেল এই মাউন্ট
নেলসন। বাম দিকে একটি স্কুলের প্রবেশপথ দেখা যাচ্ছে। বড়লোকদের স্কুল
মনে হচ্ছে।
সারা পৃথিবীতেই এখন স্কুল পর্যায়ের লেখাপড়ায়
ধনী-গরীব বৈষম্য ঢুকে পড়েছে। প্রচুর বেতন দিয়ে ‘গ্রামার স্কুলে' ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারলে
মা-বাবার সামাজিক মর্যাদা বেড়ে যায়।
আনিটা আই-ফোনে ছবি তুলছে। আমার কানে ধারাবিবরণীর
ইয়ারফোন। আনিটার আগ্রহ নেই তাতে। ইভানা যেরকম হাসিখুশি মিশুক টাইপের আনিটা সে তুলনায় কিছুটা
গম্ভীর, সিরিয়াস। রোদচশমা লাগিয়ে নিয়েছে সে। রোদে মুখ লাল হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই।
বাসের গতি এবার অনেক বেড়ে গেছে। রাস্তাও বড় হচ্ছে। চোখে পড়লো M3 - কেইপ টাউনের
হাইওয়ে। ডানদিকে টেবিল পর্বতের অনেকটুকুই দেখা যাচ্ছে। বাসের প্রায়
সবাই ক্যামেরার ভেতর দিয়ে দেখছে তাকে। ইদানিং সবার হাতে স্মার্টফোন, সবাই একটু পর
পর ছবি তোলে। প্রকৃতিকে খালি চোখে দেখার দিন মনে হচ্ছে শেষ। অবশ্য এটাও ঠিক
-
এখন
স্মৃতি ধরে রাখার ব্যাপারটা আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গেছে।
বাসের দোতলায়
ডি-ওয়াল ড্রাইভ
ধরে ছুটছে বাস। এদিকে রাস্তার দু’পাশে তেমন জনবসতি
নেই। বিস্তীর্ণ তৃণভূমি
দেখা যাচ্ছে। সেখানে মনের সুখে চরছে অনেকগুলো জেব্রা। পাশেই একটা হাইওয়েতে
শত শত গাড়ি চলছে তাতে তাদের ভ্রুক্ষেপই নেই।
চায়নিজ পর্যটকদের কোলাহলে কান ঝালাপালা হবার
অবস্থা। দূরে জেব্রা দেখে সবাই এমন হৈ চৈ করে উঠলো যেন জীবন্ত ডায়নোসর দেখেছে।
“দে আর ভেরি লাউড”- আমার কানের কাছে
মুখ এনে ফিসফিস করলো আনিটা।
বেড়াতে এসে গম্ভীর হয়ে বসে থাকবে নাকি সবাই? আনন্দ প্রকাশ
করার স্বাধীনতা আছে তাদের। কিন্তু অন্যের অসুবিধা হচ্ছে কিনা তা দেখার ভদ্রতা এই চায়নিজদের
নেই। অবশ্য এই
ভোগবাদী সমাজে অন্যের অসুবিধা না ঘটাতে পারলে ভোগের আনন্দ মনে হয় সম্পূর্ণ হয় না।
আনিটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার মুখ টকটকে
লাল হয়ে গেছে। মুখের লাল বিন্দুগুলো স্পষ্টতর। মুখ কি রাগে লাল হয়েছে নাকি
সহযাত্রীদের অভদ্রতায় রাগে লাল হয়েছে বুঝতে পারছি না। প্রসঙ্গ বদলাবার
জন্য বললাম, “দেখো কত্তো জেব্রা
এখানে।”
“দেখেছি, দে আর বিউটিফুল।”
আনিটার মুখে তামাকের গন্ধ। যারা সিগারেট
খায় এই গন্ধ নাকি তাদের নাকে লাগে না। চীনা পর্যটকদের হৈ চৈ-এ আনিটা যেরকম
বিরক্ত হচ্ছে- তার মুখের নিকোটিনের গন্ধেও আমার সেরকম বিরক্তি লাগছে।
হাইওয়ের ব্যস্ততা ক্রমশ বাড়ছে। গাড়ির গতি কমতে
কমতে এক সময় প্রায় থেমেই গেলো। বামদিকে রাস্তা থেকে একটু দূরে দেখা যাচ্ছে গ্রুট
ইশকির (Groote Schuur) হাসপাতাল। এই হাসপাতালটি পৃথিবী বিখ্যাত। ১৯৬৭ সালে এখানেই হয়েছিলো পৃথিবীর
সর্বপ্রথম হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট - হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপন।
একটু সামনে যেতেই রাস্তার ডানদিকে ঘন গাছপালার
ভেতর দিয়ে দেখা গেলো রোডস মেমোরিয়েল। দক্ষিণ আফ্রিকার দোর্দন্ড প্রতাপশালী মানুষ ছিলেন সিসিল রোডস। তাঁর স্মরণে
এখানে একটা বিশাল মেমোরিয়েল গড়া তোলা হয়েছিল প্রায় একশ বছর আগে। যে রাস্তা দিয়ে
আমাদের বাস যাচ্ছে তা পাহাড়ের এত উপরে যে রোডস মেমোরিয়েল ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ইউনিভার্সিটি
অব কেইপ টাউনের ক্যাম্পাসও এদিকে। আরেকদিন এসে দেখে যেতে হবে এসব।
মস্টার্ট মিল
উটার মস্টার্ট নামে এক ডাচ ব্যবসায়ী এই বায়ুকল
স্থাপন করেছিলেন ১৭৯৬ সালে। তখনকার ডাচ শাসকরা তাদের কাছের মানুষদের এদেশে এনে বসতি স্থাপনসহ
ফার্ম গড়ে তোলার সুযোগ দিয়েছিলেন। ফার্মের শ্রমিক হিসেবে খাটাতো আফ্রিকানদের। এই
বায়ুকলটি এখন একটি দ্রষ্টব্য। ১৯৩৬ সালে এটাকে ভালো করে মেরামত করে দর্শকদের জন্য
খুলে দেয়া হয়েছে।
প্রধান সড়ক ছেড়ে ছোট্ট সুন্দর রাস্তা
দিয়ে চলছে বাস। রাস্তার দুপাশে বিশাল বিশাল গাছের সারি। মাঝে মাঝেই সূর্যালোক আটকে
যাচ্ছে ঘন বনের মাথায়। তখন প্রাকৃতিক আলো-আঁধারির খেলা চলে।
“দি নেক্সট স্টপ ইজ কিরস্টেনবশ”- ধারাবিবরণীতে ঘোষণা
শুনেই আনিটাকে বললাম, “আমরা নামবো
এবার।”
মনে হচ্ছে পুরু সবুজ কাপের্টের উপর দিয়ে
চলছে আমাদের বাস। দু’পাশে ঘন
সবুজ ঘাসের লনের ওপারে সাজানো বাগান। নাম না জানা হাজার রঙের ফুল সেখানে। প্রধান
সড়ক থেকে একটা শাখা রাস্তায় ঢুকে পড়লো বাস। দু'পাশে গাড়ি পার্কিং-এর জায়গা পার হয়ে বাস এসে থামলো
নির্ধারিত স্টপে। আমার পিছু পিছু আনিটাও নেমে এলো। চায়নিজ দলটির কেউ এখানে নামলো
না বলে স্বস্তি পেয়েছে সে।
কিরস্টেনবশ বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভিজিটরস সেন্টারের বাইরে |
ম্যাপে দেখা যাচ্ছে এই বোটানিক্যাল
গার্ডেনে ঢোকার তিনটি গেট আছে। আমাদেরটা ১নং গেট। এদিকেই বেশিরভাগ মানুষ আসে।
বিশেষ করে বিদেশীরা। ২নং গেটে পাবলিক বাসস্টপ। ভিজিটর সেন্টারে ঢোকার পর গার্ডেনের
ম্যাপ দেখতে গিয়ে আনিটার চোখে পড়লো - ভেতরে ধূমপান নিষেধ। আর প্রায় সাথে সাথেই তার
ধূমপানের নেশা জাগলো। আমাকে বললো, “তুমি ভেতরে ঢুকে যাও। আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসি।”
“ভেতরে তুমি আমাকে কোথায় খুঁজবে?”
“খুজবো না। এমনিতে দেখা হয়ে গেলে হবে। নইলে তুমি তোমার মতো চলে যেও।”
“আর ইউ শিওর?”
“ইয়েস”
একবার ভাবলাম তার জন্য অপেক্ষা করি।
আবার ভাবলাম সে তো আমার অতিথি নয় বা ঠিক ভ্রমণসঙ্গীও নয় যে অপেক্ষা করতে হবে।
আনিটা বাইরে চলে গেলো সিগারেট খেতে। আমি
ভিজিটরস সেন্টারের দেয়ালে লাগানো বিশাল বোর্ডের ছবি আর ইতিহাস দেখতে শুরু করলাম।
দক্ষিণ আফ্রিকার দশটি ন্যাশনাল বোটানিক্যাল
গার্ডেন আছে। এগুলোকে উদ্ভিদের জীবন্ত জাদুঘর বলা চলে। বায়োডাইভারসিটি রক্ষায়
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এগুলো। এখানে হাজারো রকমের উদ্ভিদের সংরক্ষণ তো আছেই-
সাথে চলছে গবেষণা ও শিক্ষার কাজ।
কিরস্টেনবশ ন্যাশনাল বোটানিক্যাল
গার্ডেন - যেটাতে আমরা এসেছি-সেটা দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় এবং পৃথিবীর বিখ্যাত
বোটানিক্যাল গার্ডেনগুলোর একটি। সাউথ আফ্রিকান ন্যাশনাল বায়োডাইভারসিটি ইন্সটিটিউট
এই বাগানগুলো পরিচালনা করে। ইন্সটিটিউটের হেড অফিস এখানে। ইতোমধ্যে এই
প্রতিষ্ঠানের বয়স ১০০ বছর হয়ে গেছে। ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ইন্সটিটিউট।
গাঢ় কমলা রঙের কিছু ফুল আছে যেগুলো
দেখতে অনেকটা মোরগের ঝুঁটির মতো লাগে। এই ফুলগুলিরই আফ্রিকান নাম কিরস্টেনবশ।
অস্ট্রেলিয়াতেও এই ফুল দেখেছি বিভিন্ন জায়গায়। সেই ফুলের আদি নিবাস যে আফ্রিকা তা
জানতাম না।
“ইউ আর ওয়েটিং ফর মি! ইউ আর সো নাইস।” আনিটা এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। তার
পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ চাপা পড়ে গেছে সিগারেটের ঝাঁঝালো গন্ধে। সে ভেবেছে আমি তার
জন্য অপেক্ষা করছি!
“লেটস গো ইনসাইড।”
কিরস্টেনবশ ফুল |
ডানপাশের গেটে টিকেট দেখিয়ে ভেতরে
ঢুকলাম। মনে হচ্ছে বিশাল এক টুকরো মরুভূমি ঢুকিয়ে রেখেছে এই কাচের ঘরে। নানা রকমের
অর্কিড আর মরুউদ্ভিদে ভর্তি। গুল্ম, লতা, ফার্ন -তাদের বৈজ্ঞানিক পরিচয়। সব
খুঁটিয়ে দেখতে গেলে কয়েকদিন লেগে যাবে। তবুও যতটুকু পারা যায় ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
বিশাল কাচের ঘরের ঠিক মাঝখানে একটি বেশ
বড় গাছ। মরুভূমির গাছ। লেখা আছে বাওবাব (baobab) ট্রি। লিমপোপো প্রদেশ
থেকে আনা হয়েছে এই গাছ। বাওবাব - জীবনের গাছ; ট্রি অব লাইফ। এই গাছের ওপর
নির্ভর করে বেঁচে থাকে অনেক প্রাণী। বানর, বেবুন আর হাতি এই গাছের ফলের বীজ খায়। অনেক পোকামাকড়ের
বসতি এই গাছের কোটরে। সেগুলো খেতে পাখি আসে। বাসা বাঁধে এই
গাছের ডালে। পাখির ডিম, বাচ্চা খেতে আসে সাপ, সরীসৃপ। এই গাছের ছাল
ও ফল থেকে বিভিন্ন রকমের টোটকা ওষুধ তৈরি করে ব্যবহার করে আফ্রিকার মানুষ। বাওবাব
গাছের চারপাশে আছে আরো অনেক মরুগুল্ম। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় সব জায়গায়
মরুউদ্ভিদের প্রজাতি সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে এই ছাদের নিচে। কতগুলো ছোটছোট উদ্ভিদ
আছে দেখতে পাথরের মতো; লিভিং স্টোনস। প্রচন্ড গরমের সময় এদের সব পাতা ও মূল গুটিয়ে
গোল ছোট ছোট নুড়ি পাথরের মতো হয়ে যায় তারা।
কনজারভেটরিতে দক্ষিণ আফ্রিকার মরুউদ্ভিদ |
বাইরের রোদ কনজারভেটরির
ভেতরটা উনুনের মতো গরম করে তুলেছে। আনিটার মুখটা পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। এত
ঘেমেছে যে তার হাত-কাটা টি-শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে।
বেরিয়ে এলাম কনজারভেটরি থেকে। সামনেই ইট
বিছানো বড় রাস্তা। একটু পরপরই দিকনির্দেশনা আছে। এই রাস্তার নাম ক্যাম্ফর
অ্যাভেনিও। রাস্তার দু’পাশে বিশাল
সাইজের আফ্রিকান গাছের সারি আকাশের দিকে বেড়ে উঠে ডালপালার শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে
দিয়েছে রাস্তার উপর। ছায়াঢাকা রাস্তার দুপাশে একটু পর পর কাঠের বেঞ্চ। আনিটা বসে
পড়লো একটাতে। ছোট্ট ব্যাকপেক থেকে পানির বোতল বের করে ঢক ঢক করে কয়েক ঢোঁক গিলে
কিছুটা ছড়িয়ে দিলো নিজের ঘাড়ে আর মুখে। এত গরম লাগছে তার! মোটর কারখানায় কাজ করতে
অভ্যস্ত মানুষ এই গরমেই হাঁপিয়ে উঠলো?
আমিও বসে পড়লাম তার পাশে। জ্ঞিজ্ঞেস
করলাম, “আর ইউ ওকে?”
“টু হট হিয়ার। জাস্ট নিড সাম রেস্ট।”
“ওকে”
আমি দাঁড়িয়ে রাস্তার
পাশে বোর্ডে লাগানো ইতিহাস পড়তে শুরু করলাম।
এই এভিনিউটা বানিয়েছিলেন সিসিল রোডস ১৮৯৮
সালে। দক্ষিণ আফ্রিকানরা এখন সযত্নে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে সিসিল রোডস এর নাম। সেরকমই
হবার কথা, কারণ সিসিল রোডস নামক মানুষটা ছিলেন ভীষণ বর্ণবাদী।
এই
বোটানিক্যাল গার্ডেনের পুরো জায়গাটির মালিক ছিলেন সিসিল রোডস। ১৯০২ সালে সিসিল রোডস
মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি এই বিশাল জায়গা দক্ষিণ আফ্রিকার জনগনকে দান করে যান।
এখন এই বাগানের ক্ষেত্রফল প্রায় ১২৩৫ একর। তাছাড়াও আছে আরো প্রায় ১২০০ একর ফাইনবশ
ও জঙ্গল।
এই বাগানে প্রায় সাত হাজার প্রজাতির
উদ্ভিদ আছে। যার মধ্যে প্রায় এক হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ এখানে ছাড়া আর কোথাও পাওয়া
যায় না। নব্বই একর জায়গা সংরক্ষিত আছে শুধুমাত্র গবেষণামূলক চাষাবাদের জন্য।
“দিস পার্ক ইজ সো বিউটিফুল”-
কিছুটা সতেজ হয়েছে আনিটা। মুখে পানি
দেয়ার কারণে সিগারেটের গন্ধও আর পাচ্ছি না।
একটু সামনে এগিয়ে ডানে একটু ঘুরতেই বিশাল সবুজ চত্বর। একপাশে একটা পাকা স্টেজ। কনসার্ট লন। এখানে মাঝে মাঝে নাচ-গানসহ আরো অনুষ্ঠান হয়। মাঝে মাঝে কিছু বড় গাছ। এই মুহূর্তে ঘাসের ওপর ঝলমলে রোদ।
নো বিন্স ইন দি গার্ডেন |
এই বোটানিক্যাল
গার্ডেনের কোথাও রাবিশ-বিন নেই। কারণ ময়লার বিন থেকে খাবার খোঁজার জন্য খাবার মাটিতে পড়ে
অনেক পোকামাকড় জন্মে। সেগুলো খাবার লোভে ইঁদুর আসে। আর ইঁদুর যে
হারে বংশ বৃদ্ধি করে তাতে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে বাগানের। তাহলে? অনুরোধ করা হচ্ছে
যার ময়লা সে যেন সাথে করে নিয়ে যায়। এত বড় উদ্যান থেকে ময়লা পরিষ্কার করতে হলে
অনেক লোকবলও লাগবে। মানুষ নিশ্চয় খুব সচেতন এখানে। কোথাও কোন ময়লা চোখে পড়ছে না।
অথচ ভারতের তাজমহল, লালকেল্লাসহ সবগুলো দর্শনীয় স্থানে শুধুমাত্র ময়লা ফেলে বলে
কোন খাবার নিয়ে ঢুকতে দেয় না। এই খাবার চেক করার জন্য প্রায় সব দর্শনার্থীর ব্যাগ
খুলে গায়ে হাত দিয়ে যে অবস্থা করে তারা!
কনসার্ট লনের বামপাশে হলুদ ফুলের বন
পেরিয়ে বেশ উঁচু জায়গা। এখানে ঘন গাছের বেড়া। এই গাছগুলো খুব বেশি উঁচু হয় না। তবে
ঘন পাতা আর ডালপালার কারণে দ্রুত বেড়ে ঝোপ হয়ে যায়। লেখা আছে ভ্যান রিয়োবক’স হেজ। কালের সাক্ষী
হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই বেড়া প্রায় সাড়ে তিনশ বছর। ১৬৬০ সালে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন
শুরু হবার সময় এই গাছগুলো লাগিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছিল। এদিকের গাছগুলো অনেক বড়। প্রায়
সাড়ে চারশো প্রজাতির আফ্রিকান বৃক্ষ গভীর অরণ্যের আবহ সৃষ্টি করেছে। প্রচুর পাখি
এখানে। নানারকম পাখির ডাক। ঠান্ডা বাতাস। বিশাল গাছগুলো উপরের দিকে উঠে গেছে কয়েকশ
ফুট। আর কিছু গাছ একে অপরের গায়ে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে বোঝা মুশকিল সেখানে কোনটা
কোন গাছের শরীর।
আরেকটু এগিয়ে যেতেই পেয়ে গেলাম
সেন্টেনারি ট্রি ক্যানোপি ওয়াকওয়ে। বড় বড় গাছপালার মাথার উপর দিয়ে হেঁটে যাবার
জন্য ব্রিজ বানানো হয় পৃথিবীর সব বিখ্যাত বোটানিক্যাল গার্ডেনে। ব্রিসবেনের রয়েল
বোটানিক্যাল গার্ডেনে বানানো হয়েছে ইস্পাত আর কাঠ দিয়ে। এখানের ব্রিজটি আরো
আধুনিক।
বুমস্লাং ওয়াকওয়ে |
কিরস্টেনবশ গার্ডেনের
শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে ২০১৪ সালে তৈরি হয়েছে ১৩০ মিটার লম্বা এই ব্রিজ। দূর থেকে
দেখলে মনে হয় অরণ্যের বৃক্ষরাজির মাথার ওপর বাঁকা হয়ে শুয়ে আছে একটি বিশাল সাপ। সে
কারণেই এই ব্রিজের নাম বুমস্লাং ওয়াকওয়ে। বুমস্লাং (boomslang) এক ধরনের
আফ্রিকান সাপ- যারা গাছে থাকে।
এক পাশ থেকে উঠতে শুরু করলাম ব্রিজের
উপর। মাটি থেকে ব্রিজের সর্বোচ্চ বিন্দুর উচ্চতা প্রায় ১২ মিটার। ব্রিজের উপর অনেক
মানুষ। বাগানের প্রধান আকর্ষণ এখন এই ব্রিজ। এখান থেকে টেবিল মাউন্টেন দেখা যায়
পরিষ্কার। এদিক থেকে কয়েক কিলোমিটার ট্র্যাকিং করে টেবিল মাউন্টেনে ওঠা যায়।
দেখলাম ব্রিজটি বাতাসের সাথে সামনে
পেছনে দুলছে একটু একটু। এভাবেই ডিজাইন করা হয়েছে এটাকে। মূল কাঠামো তৈরি হয়েছে
ইস্পাত দিয়ে। তাকে ঘিরে আনুষঙ্গিক কাঠামো তৈরি হয়েছে কাঠ দিয়ে। এমনভাবে ডিজাইন করা
হয়েছে যেন ব্রিজের গায়ে শেওলা জন্মাতে পারে। ব্রিজের গা বেয়ে বেড়ে উঠতে পারে
লতা-পাতা।
ব্রিজের মাঝখানে প্রচন্ড রোদ। সেখানেই
দুটো বেঞ্চ পাতা। আনিটা দেখলাম আবার হাপাচ্ছে। বুঝতে পারছি রোদ সে একদম সহ্য করতে
পারছে না। অল্পেই ঘেমে যাচ্ছে। ব্রিজের ওপর আরো কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে থাকলেও নেমে
আসতে হলো আনিটার জন্য। তার ছায়া দরকার।
ব্রিজ থেকে নামতেই ছায়াঘেরা পথ।
আরামদায়ক ঠান্ডা এখানে। সামনে এগোতেই গাছের নিচে একটা বেঞ্চ দেখে বসে পড়লো আনিটা।
সকালে প্রথম দেখায় তাকে যতটা শক্ত মনে হয়েছিলো- এখন মনে হচ্ছে সে ততটা শক্ত নয়।
এইটুকু গরমেই তার এ অবস্থা! আফ্রিকাতে এখন শীত আসি আসি করছে। গ্রীষ্মকালে এলে কী
করতো সে?
হাতকাটা টী-শার্ট আবারো ভিজে গেছে
আনিটার। দেখলাম নিঃসংকোচে সেটা খুলে ফেললো সে। এক টুকরো কালো বক্ষবন্ধনী প্রাণপণ
চেষ্টা করছে তার বিপুল বক্ষসম্পদ আগলে রাখতে।
আনিটার দিকে আর তাকানো উচিত হবে না।
বললাম, “তুমি তাহলে
এখানে একটু বিশ্রাম নাও। আমি ওদিকটা ঘুরে আসি।”
এদিকের প্রকৃতি আরো শান্ত। বিশাল এলাকা
জুড়ে প্রোটিয়া আর প্রোটিয়া। আর রাস্তার দুপাশে ফিনবশ। অনেক প্রজাতির প্রোটিয়া আছে।
এক ধরনের প্রোটিয়ার নাম দেখলাম- প্যাগোডা। ছোট ছোট ফুলভর্তি গোছা দেখতে দেখতে
প্যাগোডার মতোই লাগে। এগুলো এখানে ফোটে মে থেকে নভেম্বর মাসে।
ছোট্ট ইটবিছানো রাস্তার দুপাশে ফিনবশ
ঝোপ। ফিনবশ কথাটা এসেছে ফাইন বুশ থেকে। চিকন চিকন পাতার পাতা-ফুলভর্তি ঝোপ। দক্ষিণ
আফ্রিকার প্রায় সবজায়গায় দেখা যায় এরকম ঝোপ। এখানে ফিনবুশ আর প্রোটিয়ার একটি
ট্র্যাক আছে প্রায় ৬ কিলোমিটার লম্বা।
আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখলাম ডানদিক ম ম
করছে ফুলের সৌরভে। সাদা হলুদ আর মিশ্র রঙের অনেক ফুলে ভর্তি হয়ে আছে বাগান। মৌমাছি
আর প্রজাপতি উড়ছে ফুলের উপর।
সুগন্ধী বাগান ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম
ছায়াঘেরা একটা জায়গায়। ঘন ছায়া মেশানো বড় বড় গাছ আর কাছেই একটা ঝর্ণা আর পুকুর।
এই জায়গাটি প্রাগৈতিহাসিক; বাগানের
সবচেয়ে পুরনো অংশ। এখানে কিছু বড় বড় গাছ আছে যেগুলো ডায়নোসরযুগ থেকে এ পর্যন্ত খুব
একটা বিবর্তিত হয়নি।
সভ্যতার ইতিহাস শুরু হবার আগে থেকেই
মানুষ বাস করতো এখানে। আফ্রিকার মাটিতেই আদি মানুষের উৎপত্তি। লক্ষ বছর ধরে
মানুষের বসতি আফ্রিকায়। ওয়েস্টার্ন কেইপে এক লক্ষ ত্রিশ হাজার বছর আগের মানুষের
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। কেইপ পেনিনসুলাতে মানুষের বাস প্রায় ত্রিশ
হাজার বছর ধরে। দু’হাজার বছর
আগপর্যন্ত ওয়েস্টার্ন কেইপের সব মানুষই বন্যপ্রাণী শিকার করে জীবনধারণ করতো।
তারপর কিছু মানুষ বন্যপ্রাণী শিকার করার
বদলে নিজেরা এক জায়গায় বসতি গড়ে গরু ছাগল-কুকুর ইত্যাদি পশুপালন করতে শুরু করলো। মাটি
দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র বানানোও শুরু করলো তারা। আদি মানুষদের দুটো দল হয়ে গেলো। পশুশিকারী দলের
নাম হলো খোইখোই (Khoikhoi) আর পশুপালনকারী দলের নাম
হলো স্যান (san)।
ইউরোপিয়ানদের দখলদারিত্ব শুরু হবার
আগপর্যন্ত প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে সুখেশান্তিতে দিন কাটছিলো আদি-আফ্রিকানদের।
কিন্তু ইউরোপিয়ানরা সভ্যতার নামে অনেককিছু তছনছ করে দিলো- যা ছিলো আফ্রিকানদের
একেবারে নিজস্ব।
আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানেই পাওয়া
গিয়েছিল প্রস্তর যুগের কুঠার- যা ব্যবহার করতো খোইখোই দলের শিকারীরা। বাগানের এই
অঞ্চলটা সেই সময়ে ছিল খোইখোই দলের এলাকা। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কমান্ডার জাঁ
ভন রিবেক ১৬৫২ সালের অক্টোবর মাসে জরিপ করেন এই এলাকা। কোম্পানির উন্নয়ন কাজের
জন্য প্রচুর কাঠের দরকার হতো। বনাঞ্চল দখল করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৬৫৭
সালে ফরেস্ট অফিস স্থাপিত হলো। লিনডার্ট
করনোলিজেনকে নিয়োগ দেয়া হলো প্রথম বনরক্ষক হিসেবে। জ্যাঁ ভন রিবেক ১৬৬১ সালে
সীমানা নির্ধারণ করে বেশ কিছু গাছ লাগিয়ে দেন সীমানা করার। সেই গাছের কয়েকটি এখনো
বেঁচে আছে এই বাগানে।
১৭০০ সালে ব্রিটিশরা যখন দ্বিতীয়বার
দক্ষিণ আফ্রিকার দখল নেয়, তখন কর্নেল হেনরি আলেকজান্ডার এবং তার ডেপুটি কর্নেল
ক্রিস্টোফার বার্ড এই জায়গা তাদের নিজেদের নামে করে নেন। কর্নেল বার্ড এখানে একটি
স্নানাগার তৈরি করেন সেই সময়। সেটির অংশবিশেষ এখনো আছে।
তারপর অনেকবার হাতবদল হয়েছে এই জায়গার।
সর্বশেষ মালিক ছিলেন সিসিল রোডস। ১৮৯৫ সালে তিনি নয় হাজার পাউন্ড দিয়ে এই পুরো দুই
হাজার একর জায়গা কিনে নিয়েছিলেন টেবিল মাউন্টেনের পূর্বদিকটা বসতি গড়ে ওঠার হাত
থেকে বাঁচাতে। সেই সময় সবাই টেবিল মাউন্টেনের চারপাশের ঢালুতে ঘরবাড়ি বানাতে শুরু
করে। সিসিল রোডস প্রচুর গাছপালা লাগিয়ে এলাকাটিকে একটি সমৃদ্ধ বাগানে পরিণত করেন
যেন এখানে কোন জনবসতি গড়ে না ওঠে। ১৯০২
সালে সিসিল রোডস মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি এই জায়গাটি দক্ষিণ আফ্রিকার জনগনকে
দান করে যান। ১৯১৩ সালের ১লা জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে এটা ন্যাশনাল বোটানিক্যাল
গার্ডেনে রূপান্তরিত হয়।
কিরস্টেনবশে ছবিটা তুলেছে আনিটা |
“আই অ্যাম হিয়ার।”
পেছন ফিরে দেখি আনিটা। আবারো সতেজ
দেখাচ্ছে তাকে। রোদে হাঁটাহাঁটি করলে হয়তো আবার নেতিয়ে পড়বে।
“আমাকে দেখলে কীভাবে?”
“ওখান থেকে দেখলাম তো।”
দেখলাম সে যেখানে বসেছিলো সেখান থেকে
খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। অনেকদূর ঘুরে আবার আগের জায়গাতেই ফিরে এসেছি।
“আই নিড সাম ড্রিংকস। এদিকে দোকান আছে। যাবে?”
“চলো”
পুকুরপাড় দিয়ে আসার সময় দেখলাম এক ঝাঁক
ছোটছোট ছেলেমেয়ে পিকনিক করছে। আরেকটু এগোতেই চোখে পড়লো একটা বিশাল আফ্রিকান
মেহগনি। গায়ে লেখা আছে তার বৈজ্ঞানিক নাম - খাইয়া অ্যানথোমিকা।
আফ্রিকান শব্দ ‘খাইয়া’ অর্থ ‘আমি জানি না’। প্রচলিত কাহিনি হলো একজন ইউরোপিয় উদ্ভিদবিজ্ঞানী যখন প্রথম
এদেশের এই গাছ আবিষ্কার করেন, তাঁর আফ্রিকান গাইডকে জ্ঞিজ্ঞেস করলেন, এর নাম কী?
উত্তরে গাইড বলেছিলেন, “খাইয়া” অর্থাৎ “আমি জানি না”।
আর উদ্ভিদবিজ্ঞানী নাম লিখে নেন “খাইয়া”।
দুই নম্বর গেটে গার্ডেন সেন্টারে টি-রুম
এবং অন্যান্য খাবার ও পানীয়ের দোকান আছে। সেদিকে যাবার পথে পড়লো ভেষজ উদ্ভিদের
বাগান। তার পাশে সুগন্ধী উদ্ভিদ- যেখান থেকে নানারকম সুগন্ধ তৈরি হয়।
ভেষজ উদ্ভিদের মধ্যে পুদিনা আর তুলসীর
প্রাধান্য। মাথাধরা তাড়ানোর উদ্ভিদ দেখলাম, দেখলাম বেদনা নাশক উদ্ভিদ। মানুষ
ইদানীং অলটারনেটিভ মেডিসিন বা বিকল্প ওষুধের দিকেও ঝুঁকছে।
গার্ডেন সেন্টারে বেশ বড় একটা টি-রুম
আছে। আনিটা সেদিকে যাচ্ছে দেখে জ্ঞিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি চা খাবে নাকি?”
“খেয়ে দেখি”।
“এই গরমে? তোমার না গরম লাগছে খুব?”
“কোল্ড টি”
বরফ ঠান্ডা চা-ও যে একটা জনপ্রিয় পানীয়
তা মনে ছিল না।
পাথরের আট-নয় ধাপ সিঁড়ি ভেঙে টি-রুমে
এলাম। বারান্দায় বসলাম আনিটার মুখোমুখি। বেশ আরামদায়ক ঠান্ডা এখানে। সামনেই
বাগানের অনেকটুকু দেখা যাচ্ছে।
আনিটা তার ব্যাকপ্যাক চেয়ারে রেখে বাথরুমের দিকে চলে গেলো।
প্রায় পঁচিশ
রকমের চা আছে এখানে। ভেষজ চা থেকে শুরু করে অনেক রকমের লতা-পাতা ফুলের চা-ও। জেসমিন-টি
আর সিলোন-টি ছাড়া আর কিছুই আমি চিনি না।
আমারও বাথরুমে যাওয়া দরকার। কিন্তু
আনিটার ব্যাগ রেখে যেতে পারছি না। প্রায় দশ মিনিট পর ফিরলো আনিটা। আমি আমার জন্য
একটা কোল্ড জেসমিন-টির অর্ডার দিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেলাম।
বাথরুম ঝকঝকে পরিষ্কার। সাবান, টিস্যুর
পাশাপাশি দরজার কাছে একটা বড় প্যাকেটভর্তি কনডম। বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা আফ্রিকার
এইডস সংক্রমণ কমানোর যথাসাধ্য করছে। অবাধ যৌনাচার আফ্রিকার একটা প্রধান
স্বাস্থ্যঝুঁকি।
ফিরে এসে দেখি আনিটা চেয়ারে হাত পা
এলিয়ে আরাম করে চুমুক দিচ্ছে একটা বড় গ্লাসে। আমার চাও রেখে গেছে। মিষ্টি-কষা-তিক্ত
স্বাদের কোল্ড জেসমিন-টি একটুও ভালো লাগলো না আমার। কিন্তু আনিটা খুব আরাম পাচ্ছে
বলে মনে হচ্ছে।
“তুমি কি চা খুব পছন্দ করো?” জ্ঞিজ্ঞেস করলাম।
“খুব বেশি না। তবে ইভানা খুব পছন্দ করে।”
“সকালে তো তোমরা কফি খেলে।”
“সকালে কফি। আর রাতে টি।”
“তুমি রোদ একেবারে সহ্য করতে পারো না, তাই না?”
“এখানের রোদ ইউরোপের রোদের মতো না। এখানের রোদ অনেক বেশি কড়া।”
“জায়গাটা খুব সুন্দর।”
“হু”। গ্লাসে লম্বা একটা
চুমুক দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করলো আনিটা।
“এখানে সিগারেট খাবে? আমাকে তাহলে উঠে যেতে
হবে। আমি সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারি না।”
“ঠিক আছে। এখন খাবো না।”
“সিগারেট খাও কেন? সিগারেট যে তোমার শরীরের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে জানো না?”
“তুমিও তো দেখছি ইভানার মতো কথা বলছো।”
খুব ইচ্ছে করছিলো জানতে - ইভানার সাথে
তার সম্পর্ক কীভাবে হলো। কিন্তু কীভাবে প্রশ্নটি করি। আমি কিছু বলার আগেই সে
জ্ঞিজ্ঞেস করলো-“ইভানাকে
তুমি কীভাবে চেনো?”
“খুব ভালোভাবে চিনি না। এমনিতে পরিচয় দু’বছর আগে। বুলগেরিয়াতে। তুমি কীভাবে চেনো?”
“সে আমার পার্টনার।”
“পার্টনার তো হয়েছে সম্প্রতি। তার আগে? পরিচয় কীভাবে?”
“ক্লাবে। আই ওয়াজ লুকিং ফর সামওয়ান অ্যান্ড শি ওয়াজ লুকিং ফর সামওয়ান টু।”
“তারপর?”
“স্টার্টেড ডেটিং”
খুবই গতানুগতিক কাহিনি। আনিটা কৈশোরেই
বুঝতে পারে যে সে ভেতরে ভেতরে অন্যরকম। তারপরও মিশেছে কয়েকজন ছেলের সাথে।
বয়ফ্রেন্ডও ছিল। তখন নিশ্চিত হয়েছে যে নরদেহের প্রতি তার কোন আকর্ষণ নেই। ইভানারও
প্রায় একই ব্যাপার হবে নিশ্চিত করে বলা যায়। চেক রিপাবলিক ২০০৬ সালে সমপ্রেমকে
আইনী স্বীকৃতি দিয়েছে। এখন তাদের আইনগত কোন জটিলতায় পড়তে হয় না। কিন্তু সামাজিক
জটিলতা এখনো আছে।
কথা বলতে বলতে বেশ চাঙা হয়ে গেছে আনিটা।
মনে হচ্ছে আরো একটু ফ্রেন্ডলি হয়েছে।
২নং গেট থেকে ১নং গেটের দিকে আসার সময়
স্কাল্পচার গার্ডেনে কিছু আফ্রিকান শিল্পীদের গড়া মূর্তি দেখলাম। এই মূর্তিগুলো
বিক্রিও হয়।
গেটের কাছে এসে পেছন ফিরে তাকালাম। টেবল
মাউন্টেন-এর সৌন্দর্য আবারো মুগ্ধ করলো। নেলসন ম্যান্ডেলার একটা আবক্ষ মূর্তি আছে
এখানে একটা গাছের নিচে। পেপারব্যাংক ট্রি। নেলসন ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট হবার পর ১৯৯৬
সালের ২১ আগষ্ট কিরস্টেনবশ-এ এসে এই পেপারব্যাংক ট্রি রোপন করেছিলেন। দক্ষিণ
আফ্রিকার প্রসিদ্ধ ঔষধী গাছ এই ‘পেপারব্যাংক’।
কিরস্টেনবশ-এ প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা |
কিরস্টেনবশ বোটানিক্যাল
গার্ডেন হলুদ রঙের কিরস্টেনবশ ফুল উৎপাদন করে ফেলেছে। স্বাভাবিক কমলা রঙ থেকে হলুদ
রঙের কিরস্টেনবশ সৃষ্টি করতে প্রায় বিশ বছর গবেষণা করতে হয়েছে বায়োডারভার্সিটি
ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীদের। এই হলুদ রঙের কিরস্টেনবশের নাম রাখা হয়েছে নেলসন
ম্যান্ডেলার নামে।
বাসস্টপে এসে দেখলাম বাস আসতে মিনিট
দশেক দেরি আছে। খুব খুশি হয়ে গেলো আনিটা। সিগারেট খাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলো।
তার দিকে তাকাতেই হাসিমুখে বললো, “ভয় নেই, দূরে গিয়ে
খাচ্ছি।”
পার্কিং এরিয়ায় রাবিশ বিনের কাছে গিয়ে
ভোঁশ ভোঁশ ধোঁয়া ছাড়ছে আনিটা। আক্ষরিক অর্থেই বিষাইছে বায়ু। এই এরাই আবার বায়ুদূষণ
দূর করার জন্য আন্দোলন করে। সারা পৃথিবীর ধূমপায়ীরা যদি ধূমপান ছেড়ে দিতো আমার তো
মনে হয় পৃথিবীর বাতাস অনেকটুকু পরিচ্ছন্ন হয়ে যেতো এমনিতেই। কারণ তাতে করে
সিগারেট-বিড়ি-চুরুট-তামাক ইত্যাদির কারবার বন্ধ হয়ে যেতো। কমে যেতো ফুসফুসের
ক্যান্সার। আরো কত ভালো কিছু হতে পারতো। কিন্তু জেনেশুনে বিষপান অনেক সময় কাব্যের
সম্মান পায়।
বাস এসে গেলো।
“আমি কিন্তু পরের স্টেশনে নেমে যাবো।” বাসে উঠে দোতলার সিঁড়িতেই বললাম আনিটাকে।
“কেন”?
“ওয়াইন ট্যুরে যাবো”
“আমিও যাবো”- বেশ খুশি
হয়ে বললো আনিটা।
মধ্য দুপুরে বাসের দোতলার অর্ধেক সিট
খালি। সামনের দিকে কয়েকটা সিটের উপর ছাউনি আছে। সেখানেই বসলাম।
বেগুনি বাসস্টপ ২১
ঘন সবুজ বনের ভেতর দিয়ে
আঁকাবাঁকা পথ- কী যে সুন্দর। দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম পরবর্তী স্টেশনে। স্টপ
নম্বর-২১। ওয়াইন ট্যুর শুরু হয় এখান থেকে।
নীল বাস আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
কাছেই বেগুনি বাসের স্টেশন। বেগুনি রুটের বাসগুলোও টকটকে লাল। এই বাসগুলো একতলা।
যাত্রী খুব বেশি নেই। আমরা দু’জনসহ দশ-বারোজনের বেশি হবে না। ম্যাপে দেখলাম মাত্র চারটা স্টেশনের এই রুট।
পুরোটা ঘুরে আসতে বিশ মিনিটের মতো লাগে।
কিন্তু ওয়াইনট্যুরতো - মদের কারখানায়
গিয়ে মদ চেখে দেখতে দেখতে অনেকে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়। এখনো অবশ্য মদ্য
সেবনের সময় হয়নি। তাই বাসে তেমন ভিড় নেই।
কন্সট্যানশিয়া ভ্যালি ওয়াইন ট্যুর শুরু
হলো। রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছ আর মাইলের পর মাইল আঙুরের বাগান নিয়ে গড়ে উঠেছে
অনেকগুলো ওয়াইনল্যান্ড। দক্ষিণ আফ্রিকার মদের বেশ চাহিদা আছে বিশ্বজুড়ে। দেশের
প্রথম আঙুর বাগান গড়ে তোলা হয়েছিল কন্সট্যানশিয়া ভ্যালিতে।
এখন কন্সট্যানসিয়া ভ্যালির বিশাল বিশাল
বাগানবাড়িতে বাস করে দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে ধনীরা। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে চরে বেড়াচ্ছে
ঘোড়া। তাদের চালচলনেও বড়লোকি ভাব স্পষ্ট।
ডানে বামে আঙুরলতার বাগান। সামনে আকাশ
মিশেছে টেবল মাউন্টেনের মাথায়। বাস ঢুকলো গ্রুট কন্সট্যানশিয়া এস্টেটে। সাইনবোর্ডে
লেখা আছে “নিজ
দায়িত্বে প্রবেশ করিবেন”।
গ্রুট কন্সট্যানশিয়া এস্টেট |
এই এস্টেট প্রতিষ্ঠিত
হয় ১৬৮৫ সালে। তৎকালীন কমিশনার ভ্যান রেড এই জমি দান করেছিলেন গভর্নর সাইমন ভ্যান
ডার স্টেলকে। এখানে গড়ে ওঠে প্রথম মদের কারখানা।
বাস থামতেই দ্রুত নেমে পড়লো সবাই। কয়েকটা
রেস্টুরেন্ট আছে। স্যুভেনির শপ। আর ওয়াইন মিউজিয়াম।
ফ্রি মদের স্যাম্পল চাখবার জন্য আনিটার
যে উৎসাহ দেখছি তাতে মনে হচ্ছে সে এখান থেকে আর কোথাও যেতে চাইবে না। বললাম, “তুমি তাহলে থাকো এখানে,
মদের স্বাদ নাও। আমি গেলাম।”
“এমন বিখ্যাত মদ না খেয়েই চলে যাবে?”
“বিখ্যাত জিনিস আমার সহ্য হয় না।”
“ঠিক আছে।”
স্যুভেনির শপের পাশে একটা আর্টগ্যালারিও
আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার নবীন শিল্পীরা এখানে তাদের ছবি রেখে যায়। ঘুরে ঘুরে কিছুক্ষণ
দেখলাম। উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার আফ্রিকান চিত্রকলার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।
বিশ মিনিটের মধ্যেই বাসস্টপে চলে এলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস এলো। অনেক মানুষ এই বাসে। সবাই নেমে গেলো এখানে। ফেরার
যাত্রী আমি ছাড়া আর দু’জন
বুড়োবুড়ি। কন্সট্যানশিয়ার পরের স্টপ ইগলসনেস্ট ওয়াইন ফার্ম। কেউ নামলো না সেখানে।
প্রায় আধঘন্টা ধরে সবুজ অরণ্য-ভ্রমণ শেষ করে বাস ফিরে এলো যেখান থেকে শুরু
করেছিলাম সেখানে।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো নীল বাসের
জন্য। টাইমটেবল অনুযায়ী ৫ মিনিট পরেই বাস আসার কথা থাকলেও সেই বাস এলো না। আরো
আধঘন্টা পরে বাসের দেখা মিললো। একেবারে কানায় কানায় ভর্তি। তবে বেশিরভাগই এখানে
নেমে ওয়াইনট্যুরের দিকে চলে গেলো।
বাসের দোতলায় পিছন দিকে কিছু সিট খালি।
আরাম করে বসলাম। বেশ টায়ার্ড লাগছিল। প্রায় চল্লিশ মিনিট বাসের জন্য অপেক্ষা করতে
গিয়েই টায়ার্ড হয়ে গেছি। কারণ বাসস্টপে না আছে কোন ছাউনি, না আছে কোন বসার
ব্যবস্থা। তাই পুরো সময়টা গেছে এদিক সেদিক হেঁটে। দূরেও যেতে পারছিলাম না- যদি বাস
এসে যায়।
সুন্দর পাহাড়ী রাস্তা-হাউট বে’ মেইন রোড। পাকা
রাস্তার পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে কাঁচা রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের দিকে। প্রচন্ড গতিতে
ছুটছে বাস। ছোট্ট একটা পাহাড়ী নদী পেরিয়ে গেলাম। নদীর নাম ‘দিশা’ (DISA)। পাহাড়ের ঢালুতে
বেশ কিছু আলিশান বাংলো। ধনীদের গ্রীষ্মাবাস বা সামার হাউজ।
পরের স্টেশন ওয়ার্ল্ড অব বার্ডস অ্যান্ড
মাংকি জাঙ্গল। পাখি ও বানরের সংগ্রহশালা। ভ্যালি রোডের এই পাখির জগতের একটা ছোট্ট
ইতিহাস আছে। স্থানীয় বাসিন্দা ওয়াল্টার ম্যানগোল্ড ছিলেন পাখিপ্রেমিক। আহত পাখীদের
চিকিৎসার জন্য তিনি একটা হাসপাতাল খোলেন। সেখানে অসুস্থ পাখিদের সুস্থ করে তোলা
ছাড়াও পথহারা পাখীদের আশ্রয় দেবার ব্যবস্থাও হয়। আস্তে আস্তে জঙ্গলের ভিতর বিশাল
বিশাল খাঁচার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন এখানে প্রায় ৪৫০ প্রজাতির তিন হাজারের বেশি
পাখি আছে।
পাখির পাশাপাশি শাখামৃগদেরও আশ্রয় প্রশ্রয়
দেয়া শুরু হয়। পাখিদের কাছেই এখন শত শত বানরের বাস বড় বড় গাছের ওপর।
পাখি ও বানর দেখার জন্য নামতে ইচ্ছে
করলো না। এখানেও প্রচুর যাত্রী জমে গেছে। আগের বাস না আসাতে ভিড় হয়ে গেছে। বাস থামতে না
থামতেই ভর্তি হয়ে গেলো সবগুলো সিট। আমার ঠিক সামনের সিটটিতে এসে বসলো একজন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী। স্বাভাবিক আয়তনের
দ্বিগুণ তার আয়তন। কানে বিশাল আকৃতির বালা। পিঠময় খোলা লম্বা চুল। একটা তীব্র বুনো
গন্ধ এসে নাকে লাগলো।
বাস চলতে শুরু করলো। গতি বাড়ার সাথে
সাথে গন্ধের তীব্রতা বাড়তে লাগলো। গন্ধটা মোটেও আনন্দময় নয়। তার চেয়েও বড়
বিপদ দেখা দিলো একটু পরেই। বাতাস পেয়ে উড়তে শুরু করলো তার লম্বা চুল। চাবুকের মতো
এসে লাগছে আমার মুখে, ক্যামেরায় আর গায়ের ওপর। একটু সরে বসে
বাঁচতে চাইলাম চুলের ঝাপটা থেকে। কিন্তু তেমন কোন কাজ হলো না। সিট ছেড়ে উঠে
গিয়ে যে অন্য সিটে বসবো তারও উপায় নেই।
বাস আর বাতাস দুটোর গতি যত বাড়ছে, আমার মুখে
চুলের ঝাপটাও তত বাড়ছে। রেশমী কোমল ঝলমলে চুলের প্রশংসা শুনেছি। কিন্তু এই মেয়ের
চুল ঝলমলে ঠিকই কিন্তু রেশমী কোমল মোটেও নয়। এগুলো ধাতব তারের মতো শক্ত। তার
কেশাঘাত কশাঘাতের মতো লাগছে। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। কোন অপরিচিত
মেয়েকে চুল সামলাতে বলা ভদ্রতার মধ্যে পড়ে কিনা জানি না। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে
গিয়ে বললাম, “এক্সকিউজ
মি, ক্যান ইউ প্লিজ কনট্রোল ইওর হেয়ার?”
সে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখলো কয়েক
সেকেন্ড। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে আরো রিলাক্স হয়ে বসলো। আমি ব্যাকপ্যাকে
মুখ গুঁজে অপেক্ষা করতে লাগলাম, পরের স্টেশনে বাস থামলেই নেমে যাবো।
মনে হলো যেন অনন্তকাল পরে বাস থামলো।
মাথা তুলে ব্যাকপ্যাক হাতে উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম অন্যপাশের কয়েকজনও নামার
প্রস্তুতি নিচ্ছে। দ্রুত উঠে গিয়ে ওদিকের একটা সিটে বসে পড়লাম। বাঁচা গেলো। এখানে
না নামলেও চলবে।
এটা ২৩ নম্বর স্টপ। স্থানীয় সাধারণ
আফ্রিকান মানুষ কীভাবে থাকে তা যদি কেউ দেখতে চায় এখানে ‘ইমিঝামো ইয়েথু’ টাউনশিপ ট্যুরের ব্যবস্থা আছে। জনপ্রতি ৭০
র্যান্ড দিয়ে টিকেট কাটা যায় বাসের ড্রাইভারের কাছে থেকে। স্থানীয় ট্যুরগাইড বাসস্টপে
অপেক্ষা করে। পর্যটকদের পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে দেখিয়ে আবার এই স্টপে দিয়ে যায়।
কয়েকজন পর্যটক নামলেন এখানে। আবার
উঠলেনও অনেকে। এদিকের বসতিগুলো দেখেই বোঝা যায় অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। টিনের আর
অর্ধপাকা একতলা ছোট ছোট ঘর। অপরিচ্ছন্ন এলোমেলো। পৃথিবীর সব দেশেই ধনী ও দরিদ্রের
ব্যবধান বাড়ছে ক্রমশ।
বাস চলতে শুরু করেছে। পেছন ফিরে দেখলাম
মুক্তকেশী তরুণীর পেছনের সিটের প্রৌঢ় চায়নিজ মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন সিটের হাতল ধরে।
আর আফ্রিকান তরুণী তার খোলা চুল পিঠ থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছে বুকের দিকে। ধরে রেখেছে
হাতের মুঠোয়। মেয়েটি আমার ইংরেজি বুঝলো না, কিন্তু চায়নিজ কীভাবে বুঝলো কে জানে।
বাতাসে সমুদ্রের গন্ধ ভেসে আসছে। মাছের
আশঁটে গন্ধও। হাউট বে। রাস্তার দুপাশে এখন সামুদ্রিক বালি। সৈকতে চিকচিক করছে
রোদ্দুর। পৌনে তিনটা বাজে। আকাশে সাদা মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। দূরে টেবিল মাউন্টেনের
মাথায় কালো মেঘ জমছে। মেরিনার্স ওয়ার্ফে বাস থামলো। নিচে নামলাম।
এই এলাকাটা মুলত মৎস্যজীবীদের ছিল
একসময়। এখনো জেলেরা মাছ ধরে এনে এখানের জেটিতে ভিড়ায় তাদের নৌকা। এখন এটাও পর্যটন
কেন্দ্র হয়ে গেছে।
মেরিনার্স ওয়ার্ফ
ছোট্ট সুন্দর বিচে অনেক মানুষের আনাগোনা। বিরাট একটা বাণিজ্যকেন্দ্রও আছে এখানে। সামুদ্রিক মাছের রেস্টুরেন্ট আর স্যুভেনির শপ। রাস্তা থেকে ভেতরের দিকে গেল একটা জাদুঘরও আছে। জেলেদের মিউজিয়াম; মাছ ধরার সরঞ্জাম ইত্যাদির প্রদর্শনী।
হাউট শব্দটি আফ্রিকান। যার অর্থ কাঠ।
একসময় এখানে প্রচুর কাঠ পাওয়া যেতো। এখন কাঠের জন্য তেমন প্রসিদ্ধ না হলেও হাউট বে
এখনো দক্ষিণ আফ্রিকার মৎস্যসম্পদ আহরণের অন্যতম কেন্দ্র।
মেরিনার্স ওয়ার্ফ কমপ্লেক্সে একটা পার্ল
ফ্যাক্টরি আছে। দেখলাম প্রচুর ভিড় সেখানে। অনেকেই ঝিনুক কিনছে। সামুদ্রিক ঝিনুক
যার ভেতর মুক্তা আছে। চোখের সামনে ঝিনুক খুলে সেই মুক্তা পছন্দ মতো গয়নায় বসিয়ে
দিচ্ছে। সবগুলো ঝিনুকেই মুক্তা পাওয়া যাচ্ছে এখানে। ঝিনুকের ভেতর মুক্তা রেখে দিলে
তো পাওয়া যাবেই। মণিমুক্তা পছন্দ করে না এমন মানবী পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
জায়গাটা আধঘন্টার মধ্যে দ্রুত চক্কর
দিয়ে বাসস্টপে চলে এলাম। মিনিট পাঁচেক পরেই বাস এলো। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে।
পথে বেশ কিছু মানুষ দেখলাম হাতে
প্ল্যাকার্ড নিয়ে ভিক্ষা করছে। প্ল্যাকার্ডে লেখা - সাহায্য করো, চাকরি নেই, খাবার
নেই, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক ইত্যাদি। এত কষ্টের মধ্যেও মানুষ যে ঈশ্বরকে মঙ্গলময়
মনে করে এটাই আশ্চর্যের।
হাউট বে রোড সমুদ্র আর পাহাড়ের মাঝখান
দিয়ে এসে মিশেছে ভিক্টোরিয়া রোডের সাথে। বামে আটলান্টিক মহাসাগর আর ডানে টেবল
মাউন্টেন। এই রাস্তাটি মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রাস্তাগুলোর একটি।
দেখতে দেখতে আকাশ অন্ধকার হয়ে গেলো। মেঘ
ভেসে ভেসে চলে এলো প্রায় মাটির কাছাকাছি। পাহাড়ের গায়ে আছাড় খেয়ে বিন্দু বিন্দু
বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে মাথায়।
বে হোটেলের সামনের স্টপে এসে নীল রুট
মিশলো লাল রুটের সাথে। এই পথ দিয়ে গতকালও গিয়েছি। কিন্তু আবারো ভালো লাগছে।
প্রকৃতি কখনো পুরনো হয় না। ক্যাম্পস বে, ব্যান্ট্রি বে, সি পয়েন্ট, গ্রিন পয়েন্ট-
দেখতে দেখতে আবার ওয়াটারফ্রন্টে চলে এলাম। এদিকে আবার রোদ ঝলমল করছে।
প্রায় সাড়ে চারটা বাজে। হলুদ রুটে চড়া হয়নি এখনো। হলুদ বাস ছাড়ে লংস্ট্রিট থেকে। লাস্ট বাস সোয়া পাঁচটায়। এখনো সময় আছে। ওয়াটারফ্রন্টে বাস প্রায় খালি হয়ে গেলো। আমি নামলাম না। একেবারে লং স্ট্রিটে গিয়ে হলুদ বাসে উঠবো। নতুন ওঠা যাত্রীদের নিয়ে বাস চলতে শুরু করলো কেইপ টাউন সিটি সেন্টারের দিকে। এই রাস্তাগুলো পরিচিত হয়ে গেছে এর মধ্যে। লং স্ট্রিটের স্টপে এসে নেমে গেলাম।
No comments:
Post a Comment