Tuesday, 1 September 2020

ম্যান্ডেলার দেশে - পর্ব ৮

 


ক্যাসল অব গুড হোপ

 

হলুদ বাসের বেশিরভাগ সিটই খালি। কারণ বুঝলাম একটু পরে। এই বাস কেইপ টাউন শহরের দ্রষ্টব্য মিউজিয়াম ও স্থাপনাগুলোর সামনে দিয়ে যায়। বেশিরভাগ মিউজিয়াম চারটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। তার মানে আমাকে আরেকদিন সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে। আজ রাস্তাগুলো দেখে আসি।

          লং স্ট্রিট থেকে কুইন ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের  জর্জ ক্যাথিড্রাল হলো প্রথম স্টপ। ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের শেষ মাথায় কোম্পানিজ গার্ডেন পেরিয়ে সাউথ আফ্রিকান মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের সাথে লাগানো প্লেনেটোরিয়াম। সেটা পেরিয়ে এসে টেবল মাউন্টেনের প্রায় কাছ দিয়ে মাউন্ট নেলসন হোটেল। তারপরই সাউথ আফ্রিকান জিউস মিউজিয়াম অ্যান্ড হলোকাস্ট সেন্টার। তার একটু পরেই সাউথ আফ্রিকান পার্লামেন্ট হাউজ। নিরাপত্তাপ্রহরীদের বেশ তৎপরতা দেখা গেলো এখানে। তারপর অনেকগুলো ছোট ছোট গলি পেরিয়ে একটা সরু গলির মোড়ে ডিস্ট্রিক্ট সিক্স মিউজিয়াম। দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের দুঃসময়ের সাক্ষী এই মিউজিয়াম বিকেল চারটায় বন্ধ হয়ে গেছে এই মিউজিয়াম

          এই এলাকাটি এখনো অনগ্রসর বাড়িঘর এখনো পুরনো শহরের একপ্রান্তে অবহেলায় পড়ে আছে কিছু কিছু জায়গায় বড় বড় বহুতল ভবন তৈরি হয়েছে। কিন্তু সামনেই পড়ে আছে অনেক খালি জায়গা যেখানে ময়লা আবর্জনার স্তূপ, গৃহহীন মানুষের অস্থায়ী আস্তানা এখানেই নাকি অপরাধ ঘটে সবচেয়ে বেশি আর অপরাধীর জন্মও হয় বেশি এখানে।

          কেইপ পেনিনসুলা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি ডিস্ট্রিক্ট সিক্সের কাছেই। আসলে ডিস্ট্রিক্ট সিক্সের জায়গাতেই তৈরি হয়েছে এই ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের যতটুকু দেখা গেলো মনে হলো বেশ সুন্দর। আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে দক্ষিণ আফ্রিকায়।

          আরেকটু সামনে এসে নেলসন ম্যান্ডেলা হাইওয়ের কিছুটা অংশ দেখা গেলো। এখানে কেইপ টাউনের পুরনো কনভেনশান সেন্টার। নতুন কনভেনশান সেন্টার হবার পর এই সেন্টারের কদর কিছুটা কমে গেছে।

          বাস ঢুকলো একটি বিশাল চত্বরে। ক্যাসল অব গুড হোপ। কেইপ টাউনের সবচেয়ে পুরনো স্থাপনাগুলোর একটি। রাস্তার ওপারেই বিশাল বাঁধানো মাঠ গ্র্যান্ড প্যারেড। নেমে গেলাম এখানে।

          ক্যাসল অব গুড হোপ কেইপ টাউনের প্রথম দুর্গ। তৈরি হয়েছিলো ১৬৬৬ থেকে ১৬৭৯ পর্যন্ত। পড়ন্ত বিকেলের রোদে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে উঁচু পাথরের দেয়াল ঘেরা হলুদ গেটের এই দুর্গকে। মোগলদের যে দুর্গ ইন্ডিয়ায় দেখা যায় -এই দুর্গের সাথে তার কোন মিল নেই। এই দুর্গ রেড ফোর্ট বা আগ্রা ফোর্টের তুলনায় বেশ ফ্যাকাশে।

          গেটের দুপাশে কৃত্রিম খাল। বাইরের গেটের দুপাশে দুটো ছোট কামান বসানো। হলুদ গেটের ওপর দুটো পাথরের সিংহ বসে আছে। মানুষজন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। একটা পুরনো ডাকবাক্স দাঁড়িয়ে আছে সাড়ে তিনশ বছরের পুরনো দেয়াল ঘেঁষে। সিংহদ্বার বলেই সিংহ বসে আছে। এগুলোর ইতিহাসও পাওয়া গেলো দেয়ালের কাছে লাগানো প্লাকার্ডে। ১৭২০ থেকে ১৭৪০ সালের দিকে এই সিংহদুটো বানানো হয়েছিল। খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায় একটির ঘাড়ে লম্বা কেশর আছে, অন্যটির নেই। সিংহ এবং সিংহী।

          মূল ফটকের বাইরে বেশ বড় একটা ত্রিভুজাকার বাড়ি দেখা গেলো। লাল রঙের দরজা বন্ধ। এটা ঠিক কী কারণে ব্যবহৃত হয় বোঝা গেল না। খুব উঁচু পাথরের দেয়ালের এক পাশে প্রশস্ত বাগান। সেখানে প্রচুর ফুলগাছ আর লেবু গাছ। গাছভর্তি হলুদ লেবু। মূলভবনেরও গেট বন্ধ। একটা ছোট গেট খোলা আছে। ঢুকলাম ভেতরে। কেউ নেই। বিকেল চারটায় বন্ধ হয়ে গেছে মিউজিয়াম। দেয়ালের গায়ে দুর্গের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

          ১৬৫২ সালে প্রথম একটা দুর্গ বানানো হয়েছিল মাটি ও কাঠ দিয়ে। কেইপ টাউন তখন ছিল কেইপ অব গুড হোপ। ওটা ছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজগুলির বিশ্রাম নেয়ার জায়গা। নেদারল্যান্ড থেকে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া) পর্যন্ত লম্বা পথ পাড়ি দেয়ার পথে বিশ্রাম নেবার দরকার ছিল। ওয়েস্টার্ন কেইপ ডাচরা দখল করেছিল সেই কারণে।

          ১৬৬৪ সালে ইংল্যান্ডের সাথে নেদারল্যান্ডের যুদ্ধ লাগার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তখন কাঠ-মাটির দুর্গের বদলে লোহা ও পাথরের দুর্গ তৈরির সিদ্ধান্ত হয় ১৬৬৫ সালে। ১৬৬৬ থেকে ১৬৭৯ সালের মধ্যে দুর্গ তৈরি হয়ে যায়। ১৬৮২ সালে যে গেট তৈরি করা হয়েছিল তা প্রায় একইভাবে সংস্কার করে রাখা হয়েছে একই জায়গায়। গেটের উপর ৩০০ কেজি ওজনের একটি ঘন্টা স্থাপন করা হয় ১৬৯৭ সালে। সময় জানানো ছাড়াও বিপদ সংকেতও জানানো হতো এই ঘন্টা বাজিয়ে। দশ কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যেতো এই ঘন্টাধ্বনি।

          ব্রিটিশরা যখন ওয়েস্টার্ন কেইপ দখল করে নেয় তখন এই দুর্গের ডাচ স্টাইল মুছে দিয়ে ব্রিটিশ স্টাইল চাপানো হয় ১৭৯৮ সালে। ১৯৩৬ সালে এই স্থাপনাকে ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৬৯ সালে এটাকে জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ এবং ২০০০ সাল থেকে এটাকে প্রাদেশিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এখন এই দুর্গ একটা সামরিক জাদুঘর।

          ভেতরের বাগান ও লনের চারপাশে হাঁটলাম কিছুক্ষণ। তারপর বেরিয়ে এলাম। সামনেই গ্র্যান্ড প্যারেড। ২০১০ সাল পর্যন্ত এখানে শুধু সামরিক কুচকাওয়াজই হতো। ২০১০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় গ্র্যান্ড প্যারেডে বিশাল টিভি স্ক্রিন বসানো হয়। পুরো মাঠ হয়ে ওঠেছিল স্টেডিয়ামের বাইরে ত্রিশ হাজার মানুষের খেলা দেখার জায়গা। এই মাঠে এখন অস্থায়ী দোকান বসে। সারি সারি দোকান। আর যা হয়- প্রচুর ময়লা চারদিকে।

 

কেইপ টাউন সিটি হল

    

গ্র্যান্ড প্যারেডের সংলগ্ন রাস্তার ওপরেই কেইপ টাউন সিটি হল। এই সিটি হলের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে প্রথম ভাষণ দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার জণগণের উদ্দেশ্যে। সেদিন প্রায় এক লক্ষ মানুষ জমায়েত হয়েছিল এই গ্র্যান্ড প্যারেড গ্রাউন্ডে। গ্র্যান্ড প্যারেড ধরে হাঁটতে হাঁটতে কেইপ টাউন সেন্ট্রাল ট্রেন স্টেশন প্রথম দিন এসেছিলাম এখানে। ট্রেন স্টেশন থেকে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম সিভিক সেন্টারে। শহর এলাকায় প্রায় সবগুলো বাস এই সিভিক সেন্টার দিয়ে যায়। খুবই ব্যস্ত এলাকা। সিভিক সেন্টার পেরিয়ে ম্যালান স্ট্রিটে আর্ট স্কেইপ থিয়েটার সেন্টার। ১৯৭১ সালে নির্মিত বিশাল আর্টসেন্টারে একটি অপেরা হাউজ আর দুটো থিয়েটার হল আছে।

          আর্টসেন্টারের সামনে প্রায় তিনতলার সমান উঁচু একটি স্থাপত্য; যেন দুটো বাচ্চা একসাথে হাত তুলে নাচছে।

 



          ঝপ করে অন্ধকার নেমে গেলো। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মনে হলো চেনা রাস্তা। বাসে চেপে কয়েকবার গিয়েছি এই পথে। হোটেলে ফেরার পথে মরিয়মস কিচেন থেকে ডিনার কিনে নিলাম। অ্যারাবিয়ান রেস্টুরেন্ট। মনে হলো পরিবারের ছেলেবুড়ো সবাই মিলে ব্যবসা সামলাচ্ছে। সবচেয়ে বৃদ্ধ ভদ্রলোক ক্যাশ সামলাচ্ছেন, আর সবচেয়ে বৃদ্ধা সামলাচ্ছেন কিচেন। ছেলেমেয়েরা করছে পরিবেশন।

          পনেরো মিনিট হাঁটার পর হোটেলে ফিরলাম। রিসেপশানের সামনেই দেখা হয়ে গেলো ইভানা আর আনিটার সাথে। দুজনকেই কেমন যেন মনমরা মনে হলো।

     কী হয়েছে?

     আনিটা হ্যাজ লস্ট হার ব্যাগ

     কীভাবে?

          তাদের দুজনের কথা থেকে জানা গেলো আনিটাকে গ্রুট কন্সট্যানশিয়াতে রেখে আমি চলে আসার পরে সে অনেকক্ষণ ছিল সেখানে। প্রায় বিকেল পর্যন্ত। তারপর বাসে করে ওয়াটারফ্রন্টে এসে নেমেছে। সেখানেও তার ব্যাগ ছিল। সে ব্যাগ থেকে পার্স বের করে সিগারেট কিনেছে, পানি কিনেছে ইত্যাদি। তারপর ওয়াটারফ্রন্ট থেকে বাসে উঠতে গিয়ে দেখে যে তার ব্যাগ নেই। কে কীভাবে তার ব্যাগ নিয়ে গেছে সে জানে না। ব্যাগে টাকা পয়সা ছাড়াও পাসপোর্ট ছিল তার। আই ফোন ছিল।

          ব্যাগ হারিয়ে সে বাসে না উঠে পুলিশকে জানিয়েছে সব। পুলিশ বলেছে কিছু জানতে পারলে হোটেলে খবর দেবে। এমনও হতে পারে যে সে যেখানে বসে সিগারেট খেয়েছে সেখান থেকে কেউ নিয়ে গেছে তার ব্যাগ।

          খুব খারাপ লাগছে তার জন্য।

     তুমি কি তোমাদের অ্যাম্বেসিকে জানিয়েছো? তোমার পাসপোর্টের ব্যাপারে তো রিপোর্ট করা দরকার।

          আনিটাকে কেমন যেন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। সে তুলনায় ইভানা অনেক বেশি ধীর স্থির। সে বললো অ্যাম্বেসিতে এখনো ফোন করেনি।

          পরামর্শ দিলাম হোটেলে তার পাসপোর্টের যে ফটোকপি আছে তার কপি নিয়ে পাসপোর্ট নম্বর ইত্যাদি জানিয়ে যেন ফোন করে।

          হোটেলে এরকম অবস্থায় সাহায্য করার লোক আছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এরকম ব্যাগ হারানো বা চুরি হওয়ার ঘটনা প্রায় ঘটে। যার চুরি যায় সমস্যা তারই। ব্যাগ খুঁজে পাবার ঘটনা ধরতে গেলে ঘটেই না। ইউরোপিয়ান পাসপোর্টের দাম আফ্রিকার কালোবাজারে প্রচুর।

          সমবেদনা জানানো ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমার। আমার ব্যাগ চুরি হলে তাদেরও কিছু করার থাকতো না।

          রুমে চলে এলাম। কাল সারাদিন কাটবে কনফারেন্সে। 

পর্ব ৯

No comments:

Post a Comment

Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts