সকাল আটটা বাজার আগেই পৌঁছে
গেলাম কনভেনশান সেন্টারে। প্রথম প্লেনারি সেশান শুরু হবে সাড়ে আটটায়। হাতে কিছুটা
সময় পাওয়া গেলো সেন্টারটা ঘুরে দেখার। তার আগে রেজিস্ট্রেশন ডেস্ক।
ইন্টারন্যাশনাল রেডিয়েশান প্রোটেকশান অ্যাসোসিয়েশনের
৫০ বছর পূর্তি হয়েছে এবছর। সেই উপলক্ষে নিয়মিত চর্তুবার্ষিক কনফারেন্স একটু জাঁকজমকভাবে
পালিত হচ্ছে এবছর। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন ফি অনেক বেশি। চার দিনের কনফারেন্সের
পুরো ফি তেরো হাজার র্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ান ডলারে প্রায় বারশো ডলার। বাংলাদেশের
টাকায় প্রায় বাহাত্তর হাজার টাকা।
বেশিরভাগ গবেষক তাঁদের প্রতিষ্ঠানের কাছ
থেকে সব খরচ আদায় করে নেয়। উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানীদের জন্য কয়েকটি বৃত্তির
ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু আমাদের ইউনিভার্সিটির যে সাপোর্ট আমরা পাই তার একটা কোটা
থাকে। আমার তিন বছরের কোটা ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। এই কনফারেন্সের সবকিছুই নিজের
পকেট থেকে যাচ্ছে। তাই চারদিনের কনফারেন্সের বদলে একদিনের জন্য রেজিস্ট্রেশন
করেছি। তার জন্য লেগেছে চার হাজার র্যান্ড। মানে প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা।
রেজিস্ট্রেশন ডেস্কে তেমন ভিড় নেই।
কনফারেন্স ব্যাগ, আইডেন্টিটি ট্যাগ ইত্যাদি নিয়ে ডেস্ক থেকে বেরিয়ে এলাম।
এবার যেতে হবে কন্ট্রোল রুমে। আমার
বক্তৃতার পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশান ফাইল আপলোড করতে হবে। কন্ট্রোলরুম দোতলায়।
কেইপ টাউন ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশান
সেন্টার একেবারে ঝকঝকে নতুন। সাইজ দেখে মনে হচ্ছে একটা পুরো স্টেডিয়াম ঢুকে যাবে
এর ভেতর। ওয়াল্টার সিসুলু স্ট্রিটের একপাশের পুরোটাই দখল করে রেখেছে এই কনভেনশান
সেন্টার। সেন্টারের সাথে লাগানো ফাইভ স্টার হোটেল ওয়েস্টিন কেইপ টাউন।
২০০৩ সালে তৈরি হয়েছে এই কনভেনশান
সেন্টার। এখন কেইপ টাউন শহরে প্রতিমাসেই অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় এখানে।
সেই অবকাঠামো এখানে তৈরি হয়েছে।
স্কেলেটর বেয়ে দোতলায় উঠলাম। দু’পাশে সারি সারি
বক্তৃতাকক্ষ, অফিস। কন্ট্রোল রুম খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না।
জানালার কাছের ডেস্ক কনফারেন্স
সেক্রেটারির। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করলো, “গুড মর্নিং ডক্টর দেব”
"গুড মর্নিং"
“আই অ্যাম লাতিসা রামমূর্তি”
হাত বাড়িয়ে দিলো। মনে মনে বললাম তুমি
রামমূর্তি নও, তুমি আফ্রিকাবাসিনী উর্বশী।
আজকাল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট একটা বড়
বিজনেস। এই কনফারেন্স সামলাচ্ছে টারনার্স কনফারেন্সেস অ্যান্ড কনভেনশানস প্রাইভেট
লিমিটেড। কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই কৃষ্ণাঙ্গ। লাতিসা ভারতীয় তরুণী। কর্পোরেট
ম্যানেজার।
তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে
তাকাতেই চোখে পড়লো নিচের বিশাল হলঘরে খাবার দাবার আর বিভিন্ন কোম্পানির মেডিকেল ইকুইপমেন্টের
প্রদর্শনীর আয়োজন চলছে। এ ধরনের কনফারেন্সগুলোতে এই কোম্পানিগুলো বিরাট অঙ্কের
টাকা দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে। বিনিময়ে তাদের পণ্যের পসার হয়, প্রচার হয়। একটা
লিনিয়ার অ্যাক্সিলেরেটর বিক্রি করতে পারলেই কয়েক লক্ষ ডলার।
এই রুম আসলেই কন্ট্রোল রুম। সিসিটিভিতে
দেখা যাচ্ছে কোথায় কী হচ্ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফাইল আপলোড হয়ে গেলো। আরো অনেক
গবেষক চলে এসেছেন ফ্ল্যাশ ড্রাইভে ফাইল নিয়ে। লাতিসার সামনে বয়স্ক প্রফেসররা ভিড়
করতে শুরু করেছেন।
আমার বক্তৃতা একেবারে শেষ অধিবেশনে -
বিকাল পাঁচটায়। তার আগপর্যন্ত অন্য সেশনগুলোতে অনেক ইন্টারেস্টিং বিষয়ে বক্তৃতা
শোনার ইচ্ছে আছে। অনেকগুলো অধিবেশন একই সময়ে আলাদা আলাদা রুমে। লবিতে বসে ঠিক করে
নিলাম কোন কোন রুমে যাব আমি।
১নং অডিটোরিয়ামে ঢুকলাম। বিশাল হল। দেড়
হাজার মানুষ বসতে পারবে একই সাথে। বড় বড় পর্দায় প্রজেক্ট করা হচ্ছে স্টেজে যা যা
হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশানের কর্মকর্তাদের আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা শেষ হবার
পর শুরু হলো প্লেনারি অধিবেশন।
ত্রিশ বছর হয়ে গেলো চেরনোবিলে পারমাণবিক
দুর্ঘটনার। এখন কেমন আছে সেখানকার মানুষ? কী কী শিক্ষা আমরা নিয়েছি সেই ঘটনা থেকে?
তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাব দুর্বোধ্য। একদিকে এটা ক্যান্সারের চিকিৎসাসহ আরো অনেক
ব্যাপারে মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে, অন্যদিকে এর অপব্যবহার বা দুর্ঘটনা ঘটলে
মারাত্মক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের ধারণা নেই কোত্থেকে
কীভাবে কী হয়।
অবশ্য বিজ্ঞানের সাথে সাধারণ মানুষের একটা
দূরত্ব সবসময় রয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে চাইলেও তাদের কথা
সাধারণ মানুষ বিপদে না পড়লে খুব একটা শুনতে চান না।
প্রথম অধিবেশনে ম্যানচেস্টার
ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রিচার্ড ওয়েকফোর্ড, জার্মানির হ্যানোভার ইউনিভার্সিটির
অধ্যাপক রলফ মার্কেল, ইংল্যান্ডের জন হ্যারিসন, ফ্রান্সের ইসাবেল থিয়েরি-শেফ আর
ভারতের ভাষা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের ডক্টর বিজয়লক্ষ্মী দাশের বক্তৃতা শুনলাম।
কফি ব্রেকে কফি খেতে খেতে সায়েন্টিফিক
পোস্টার দেখতে গিয়ে পল মার্কসের সাথে দেখা হয়ে গেলো। পল মার্কস মেলবোর্নের অস্ট্রেলিয়ান
রেডিয়েশান প্রটেকশান অ্যান্ড নিউক্লিয়ার সেফটি এজেন্সিতে কাজ করেন। কাজের সূত্রে আমার
পূর্বপরিচিত।
পলের মাথাভর্তি চকচকে টাক আর মুখভর্তি
খোচাখোচা দাড়ি। ননস্টপ কথা বলে। বিশ মিনিট ধরে বকর বকর করলো অনেকগুলো বিষয় নিয়ে।
আমি কিছুটা শুনলাম আবার কিছুটা না শুনেই মাথা নাড়লাম। শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেলাম তার
বাথরুম পাওয়াতে।
কফিব্রেক শেষে আবার বারোটা পর্যন্ত
বক্তৃতা শুনলাম রোগীদের শরীরে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা কম রেখে কীভাবে এক্স-রে, সি-টি
স্ক্যান ইত্যাদি করা যায়।
সোয়া বারোটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত লাঞ্চ
ব্রেক এক্সিবিশান হলে। প্রায় চারশো মানুষের দুপুরের খাবার। তিন-চার টেবিলে খাবার
দেয়া হলো। লম্বা লাইন। বুফে খাবার। আফ্রিকান। রুটির মাঝখানে একধরনের কুচকুচে কালো
মাংস। কিসের মাংস ঠিক জানি না। কাউকে জ্ঞিজ্ঞেসও করলাম না। খেতে ভালোই লাগলো।
এই কনফারেন্সের পরবর্তী আসর বসবে চার বছর
পর ২০২০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায়। সে উপলক্ষে দক্ষিণ কোরিয়ার পর্যটন কর্তৃপক্ষ একটা
স্টল দিয়েছে। সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে দু’জন কোরিয়ান তরুণী।
ডেলিগেটদের সাথে হাসিমুখে ছবির পোজ দিচ্ছে তারা। আমার সাথেও ছবি তোলা হলো। ২০২০
সালে সেখানে যাওয়া হবে কিনা এখনই কি বলা সম্ভব?
লাঞ্চের পরে আবার অনেকগুলো বক্তৃতা
শুনলাম। বিকেল ৩টা থকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি
এজেন্সির ওয়ার্কশপে কাটালাম। চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগ নির্ণয়ে এক্স-রে, সি-টি এখন একটি
নিয়মিত ব্যাপার। কিন্তু তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ক্ষতিকর দিক আছে। ক্যান্সার হতে পারে
তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকে। রোগীদের এই তেজস্ক্রিয় ঝুঁকির ব্যাপারটা জানানোও হয় না
কোন কোন দেশে। আন্তর্জাতিক কমিটিগুলো এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির প্রশিক্ষণ দিচ্ছে
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
ওয়ার্কশপ শেষ হতে না হতেই রুম থেকে বেরিয়ে
৬নং রুমে গেলাম। আমার বক্তৃতার অধিবেশন তখন শুরু হচ্ছে সেখানে।
এই অধিবেশনটা মূলত রেডিয়েশানের ভালোমন্দের
বৈজ্ঞানিক কথাগুলো কীভাবে রোগী, রোগীর পরিবার এবং অন্যান্যদের কার্যকরীভাবে জানানো
যায় সে বিষয়ে। আমার বক্তৃতার বিষয় হলো সি-টি স্ক্যানের সময় রোগীর শরীরে যে এক্স-রে ঢুকে
তাতে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা আছে। সেই ব্যাপারে কতটুকু কী করা যায়। এই সম্ভাবনা
সত্ত্বেও দরকার না থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুধু মাত্র টাকার লোভে ডাক্তাররা সি-টি
স্ক্যান করার পরামর্শ দেন। এটা কীভাবে বন্ধ করা যায়।
জোহানেসবার্গ থেকে কেইপ টাউনে আসার
ফ্লাইটে সাউথ আফ্রিকান এয়ারলাইনস এর
ফ্লাইট ম্যাগাজিনের প্রকাশিত একটা পূর্ণপৃষ্ঠা বিজ্ঞাপনের ব্যাপার উল্লেখ করলাম।
সেখানে রোগ হবার আগেই সারা শরীর এক্স-রে দিয়ে স্ক্যান করার কথা বলা হচ্ছে যা খুবই
ঝুকিপূর্ণ। মানুষকে সচেতন করাটা তো বিজ্ঞানীদের কাজ।
অস্ট্রেলিয়াতে রেডিয়েশান রেগুলেশান খুব
কড়া। তাই সাধারণত অপ্রয়োজনীয় মেডিকেল টেস্ট করা সহজ নয়। কিন্তু যেসব দেশে এ
সংক্রান্ত কোন নিয়ম কাজ করে না, চাইলেই এক্স-রে, সি-টি সব করে লক্ষ লক্ষ টাকা
উপার্জন করা যায়, সেখানে জনগনকেই সচেতন হতে হবে। সচেতন হতে গেলে ব্যাপারটা বুঝতে
হবে জানতে হবে। কিন্তু দায়িত্ব কার?
আমার সেশানে আমার সাথে আছেন ক্যালিফোর্নিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বারবারা হ্যামারিক, আমেরিকার এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশান
এজেন্সির মাইক বয়েড, ইরানের আমির কবির বিশ্ববিদ্যালয়ের মেহেদি সোহরাবি, ফ্রান্সের
নিউক্লিয়ার এনার্জি এজেন্সির টেড ল্যাজো এবং দক্ষিণ আফ্রিকার রেডিয়েশান প্রটেকশন
কনসালট্যান্ট মগওয়েরা খোয়ামেইন।
ছ’টার দিকে অধিবেশন শেষ হলো। অন্ধকার নেমে
গেছে বাইরে। কাল সন্ধ্যায় কনফারেন্স ডিনারে আসতে হবে। তার আগপর্যন্ত ছুটি।
ব্যাগ গুছিয়ে যাদের চিনি তাদের ‘গুড বাই’ ‘গুড নাইট’ ইত্যাদি বলে চলে আসার
সময় এগিয়ে এসে কথা বললো একটা চায়নিজ মেয়ে।
“হাই, ক্যান আই টক টু ইউ ফর এ মোমেন্ট?”
“সিওর”
“ইওর টক ওয়াজ ভেরি গুড”
আমি জানি এটা বলতে সে আমার কাছে আসেনি। গলায়
ঝোলানো আই-ডিতে দেখলাম তার নাম মি লিং। এসেছে তাইওয়ান থেকে। আই-ডিতে শুধু নাম আর
দেশ। বললাম, “থ্যাংক ইউ।
তাইওয়ানের কোন্ ইউনিভার্সিটি তোমার?”
“ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটি"
“তাইপে?"
“হ্যাঁ”
“এবার কী বলতে চাও বলে ফেলো।”
“আমি অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে যেতে চাই। সে ব্যাপারে একটু কথা বলতাম।”
দেখলাম একটি চায়নিজ ছেলে একটু দূরে
দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে দেখছে বারবার। মি-কে জ্ঞিজ্ঞেস করলাম, “তোমার বন্ধু?”
“বয়ফ্রেন্ড”
“কাছে আসতে বলো।”
মি তাকে ইশারায় ডাকলো। আমি হ্যান্ডশেক
করলাম। জানা গেলো ছেলেটি ব্যাংকে চাকরি করে। মি রেডিয়েশান ফিজিক্সে মাস্টার্স
করছে। অস্ট্রেলিয়ায় যেতে চায় পিএইচডি করতে।
তার আগ্রহ দেখে ভালোই লাগলো। বললাম কী
কী করতে হয়, করা উচিত। কথা বলতে বলতে নিচে নেমে এলাম।
মি আর তার বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে বিদায়
নিয়ে রাস্তা পার হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম সিটি সেন্টারের দিকে। ডিনার করতে হবে কোন রেস্টুরেন্টে।
No comments:
Post a Comment