46
আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল টেলিফোন উদ্ভাবনের
প্যাটেন্ট নিয়েছিলেন ১৮৭৬ সালে। তারপর ১২০ বছর কেটে গেছে। শুনেছি উন্নত দেশের ঘরে ঘরে
আজ টেলিফোন। অথচ আমাদের দেশে এই টেলিফোন এখনো আভিজাত্যের প্রতীক। এটা এতই অভিজাত যে
এর জন্য ‘টিএন্ডটি’ নামে খুব ‘পাওয়ারফুল’ একটি সরকারি বিভাগ আছে। নতুন
টেলিফোন সংযোগ পাবার জন্য নাকি এই প্রতিষ্ঠানে অনেক দেনদরবার করতে হয়। খুব ‘পাওয়ারফুল’ না হলে বা ‘পাওয়ারফুল’ কারো সুপারিশ না থাকলে কিংবা
টাকার বিনিময়ে ‘পাওয়ার’ কেনার ব্যবস্থা করা না গেলে
টেলিফোনের দরখাস্ত ‘ফ্রুটফুল’হয় না। এই কারণেই যাদের বাড়িতে টেলিফোন আছে – তাদের প্রতিবেশিরা
তাদেরকে এক্সট্রা খাতির করেন। সামাজিক আভিজাত্যের এই নিদর্শনটি সম্প্রতি আমাদের
টিচার্সরুমে সাঈদ স্যার ও মহিউদ্দিন স্যারের টেবিলে অধিষ্ঠিত হয়েছে। মজিদ স্যারের শাসনকালে
একটি নতুন টেলিভিশনকে রাজকীয় আয়োজনে উদ্বোধন করা হয়েছিল। অথচ টেলিভিশনের চেয়ে অনেক
বেশি সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন এই টেলিফোন যন্ত্রের কোন ধরনের আনুষ্ঠানিক অভিষেকের আয়োজন
করা হলো না।
ক্যাটক্যাটে সবুজ রঙের এই যন্ত্রটির
লম্বা তার বিমল স্যার যেখানে বসেন সেখানকার জানালা দিয়ে ঢুকেছে এবং দেয়ালের আশেপাশে
ঘুরে সাঈদ স্যারের টেবিলে উঠেছে। সাঈদ স্যার যখন রুমে থাকেন, টেলিফোন বাজলেই তিনি রিসিভার
উঠিয়ে গম্ভীরভাবে বলেন, “হ্যালো”। তখন তাঁর গলায় আভিজাত্য গমগম
করে। কিন্তু ঝামেলাটা হয় যখন সাঈদ স্যার রুমে থাকেন না। তখন যদি টেলিফোন বাজে, মহিউদ্দিন
স্যার টেবিলে থাকলেও রিসিভার ঊঠান না। যন্ত্র-সভ্যতার প্রতি তিনি প্রকাশ্যেই বিরক্তি
প্রকাশ করেন। সাঈদ স্যারের অনুপস্থিতিতে শংকর স্যার টেলিফোন রিসিভ করতে ইতস্তত করেন
না। কিন্তু এখন রুমে সাঈদ স্যারও নেই, শংকর স্যারও নেই – কিন্তু টেলিফোনে কয়েকবার রিং হলো। আমি জানি আমার
কাছে কোন ফোন আসবে না। কারণ আমার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কারোরই কোন টেলিফোন নেই।
আর নেই বলেই আমি সুযোগ পেলে তাদেরকে আমার কলেজের টেলিফোন নম্বর দিয়ে বুঝিয়ে দিই যে
আমি কত অভিজাত কলেজে চাকরি করি যেখানে টিচারদের জন্য আলাদা টেলিফোন আছে। কয়েক সপ্তাহ
আগেও কলেজে টেলিফোন ছিল শুধুমাত্র প্রিন্সিপালের রুমে। তারপর ভাইস-প্রিন্সিপাল স্যার
ও ম্যাডামের টেবিলে টেলিফোন এসেছে। এখন টিচারদের রুমেও। কিন্তু টেলিফোন কীভাবে কাজ
করে সেই গ্রন্থগত বিদ্যা আমার থাকলেও তার ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা আমার হয়নি এখনো।
টেলিফোনটি আবার বাজছে। ছোটদের ছড়ায় পড়েছি
– ক্রিং ক্রিং টেলিফোন,
হ্যালো হ্যালো হ্যালো/ কে তুমি, কাকে চাই, বলো বলো বলো। কিন্তু এই টেলিফোনটি ক্রিং
ক্রিং না করে অন্য ধরনের একটা বাজনা বাজাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা সুযোগ আজ এসেছে টেলিফোন রিসিভ করার।
ফিফ্থ পিরিয়ডে এখন আমি ছাড়া আর কেউ নেই রুমে। চেয়ার থেকে উঠে এক পা এগোতেই টেলিফোনের
বাজনা বন্ধ হয়ে গেল।
পরের দুই ঘন্টা আমার প্র্যাকটিক্যাল
ক্লাস আছে। কয়েকদিন পরেই নতুন ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হবে। এবছর এসএসসিতে ৬৪০ নম্বরের
কম পেয়েছে এমন কাউকে ভর্তির ফর্মও দেয়া হয়নি। সব ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া ভালো শিক্ষার্থীরা
ভর্তি হচ্ছে এখন। এইচএসসির রেজাল্টও বের হবে এই মাসে।
“অ্যাই
প্রদীপ, তোমার ফোন।“
বারান্দা থেকে ডাক দিয়েছেন আয়শা আপা।
আমি থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
“আমার
ফোন? কোথায় আপা?”
“কোথায়
আবার? ফোনে আরকি। তোমার বন্ধু মনে হয় ফোন করেছে।“
“আপনাদের
রুমে ফোন করেছে?”
“আমাদের
রুম আর তোমাদের রুমের ফোন তো একই নম্বরের। প্যারালাল লাইন না? যাও, কথা বলো।“ বলেই আয়শা ম্যাডাম বারান্দা
থেকেই চলে গেলেন। তাঁদের রুম থেকে এত দূরে নিজে এসে খবর দিয়ে গেলেন। পিয়নদের কাউকে
দিয়ে খবর দিলেই হতো। টেলিফোনের রিসিভার উঠাতেই ম্যাডামদের রুমের কথাবার্তা শোনা গেল।
প্যারালাল লাইনের এই অসুবিধা। ভুল রুমে রিসিভ করলে অন্য রুমে খবর দিতে হয়। এক রুমে
কেউ টেলিফোনে কথা বললে অন্যরুমের রিসিভার তুলে সেই কথা ইচ্ছে হলেই শোনা যায়।
“হ্যালো” বলতেই ওপাশ থেকে গালিগালাজ করে
উঠলো বিপ্লব। ম্যাডামদের কারো কানে এই বিপ্লবী শব্দাবলির অংশবিশেষও যদি প্রবেশ করে
তাহলে সর্বনাশ। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গালিগালাজ যে কতটা শ্রুতিকটু হতে পারে – তা সহ্য করা তো দূরের কথা, অনেকে
চিন্তাই করতে পারবে না। কিন্তু বিপ্লবের এসব শব্দচয়নে আমি অভ্যস্ত। সে বন্ধুকে বিদায়
জানাতে এয়ারপোর্টে এসেছে। আমি এখনো কেন এয়ারপোর্টে উপস্থিত হইনি – এটাই গালিগালাজের মূল কারণ।
তাকে কোন রকমে আশ্বস্ত করে টেলিফোন রেখে দিলাম। আমাকে যে সে ফোন করবে এটা আমার ধারণাতেই
ছিল না। এয়ারপোর্টে নাকি টাকা দিয়ে টেলিফোন করার ব্যবস্থা আছে।
ইউনিভার্সিটিতে আমাদের ক্লাসে আমরা দুজন
প্রদীপ ছিলাম। সে ফর্সা প্রদীপ, আমি কালো প্রদীপ। যারা সাদা-কালোর বিভেদ উচ্চারণ করতে
চায় না – তারা আমাকে ডাকে
লম্বা প্রদীপ, তাকে বেঁটে প্রদীপ। আজ বেঁটে প্রদীপ চলে যাচ্ছে মিডল ইস্টে। দুপুর সোয়া
দুটোয় তার ফ্লাইট। আমাকে বলেছিল এয়ারপোর্টে যেতে। আজ দেড়টা পর্যন্ত আমার ক্লাস আছে।
এরপর যেতে যেতেই দুটো বেজে যাবে। এতক্ষণে নিশ্চয় তার ইমিগ্রেশান হয়ে গেছে। ইমিগ্রেশান
গেট পার হলে আর দেখা হবার সুযোগ নেই। আবার কবে তার সাথে দেখা হবে জানি না। কিন্তু তাকে
বিদায় দিতে অন্যান্য বন্ধু যারা এসেছে তারা প্লেন যাওয়ার এক মিনিট আগেও এয়ারপোর্ট ত্যাগ
করবে না। তাদের সাথে দেখা করার জন্য হলেও আমাকে এয়ারপোর্টে যেতে হবে।
ছুটির পর তাড়াহুড়ো করে বের হবার সময়
বন্ধু আবুল হোসেন খানকে বললাম, “আজ বেঁটে প্রদীপ আবুধাবি চলে যাচ্ছে। আমি একটু দেখাও করতে পারলাম না।“
“কেন?
তার ফ্লাইট কখন?”
“সোয়া
দুইটায়।“
“এখন
তো মাত্র দেড়টা বাজে।“
“ইমিগ্রেশান
হয়ে গেছে না?”
“ফ্লাইট
অনেক সময় ডিলে হয়। চলো আগে এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি।“
খান
সাহেব নিজের বাসায় না গিয়ে আমাকে নিয়ে চললো এয়ারপোর্টে। ঘাঁটির ভেতর দিয়ে খুব কম সময়ের
ভেতর এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। ডিপার্চার গেটের বাইরে প্রচন্ড ভীড়। ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট
হিসেবে খুবই ছোট এয়ারপোর্ট চট্টগ্রাম। শুধুমাত্র কলকাতা আর মিডলইস্টের ফ্লাইট যায় এখান
থেকে। এই ভীড়ের মধ্যে বিপ্লব এবং অন্যরা কোথায় আছে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু খান
সাহেব ভীড়ের দিকে না গিয়ে সিভিল এভিয়েশান অথরিটির গেটের দিকে যাচ্ছে।
“ওদিকে
কোথায় যাচ্ছো?” – আমি জানতে চাইলাম।
“আসো
না আমার সঙ্গে। দেখি কোথায় যাওয়া যায়।“ – হাঁটতে হাঁটতে বললো খান সাহেব। একটু মোটাসোটা
হলেও বেশ দ্রুত হাঁটতে পারে সে। একটু পরেই সে আমাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের অফিসে
ঢুকে গেল। এরকম অফিসে এয়ারপোর্টের কর্মকর্তা ছাড়া আর কেউ যে ঢুকতে পারে সেটাই আমার
জানা ছিল না।
“আরে
খান সাহেব, আসেন আসেন।“ – এয়ারপোর্ট ম্যানেজার বেশ উষ্ণ অভ্যর্থনা করলেন খান সাহেবকে।
ভদ্রলোকের বয়স ৪৫ থেকে ৫০ এর মধ্যে। সুগঠিত, সুদর্শন। খান সাহেবের জনসংযোগ অনেক বিস্তৃত
তা জানতাম। কিন্তু তা যে ঘাঁটি পেরিয়ে এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছে তা জানা ছিল না।
“ও
হচ্ছে প্রদীপ, আমার বন্ধু, ফিজিক্সের টিচার।“
“বসেন
বসেন। প্লিজ।“
চেয়ার
ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ডেস্কের সামনের চেয়ারে আমাদের বসালেন। এত বড় অফিসার এত সৌজন্য
দেখাচ্ছেন তাতেই আমি মুগ্ধ।
“আপনিই
কি শাহীনের – প্রদীপ দেব?”
মনে
হচ্ছে শাহীনের প্রদীপ দেবের নাম তিনি আগেও শুনেছেন। কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, “জ্বি।“
“আমার
মেয়ের কাছে আপনার নাম শুনেছি। আমার বড় মেয়ে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আপনি চিনেন হয়তো – সিফাত
তাসনিম। আর ছোটটা তো স্কুলে। খান সাহেবের ছাত্রী।“
বুঝতে
পারছি খান সাহেব তাঁর ছোট মেয়েকে প্রাইভেট পড়ায়। আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে ম্যানেজার
বেল টিপেছেন। একজন সহকারী উঁকি মারতেই তিনি নির্দেশ দিলেন, “আমাদেরকে চা দাও।“
খান
সাহেব দ্রুত বললো, “চা এখন খাবো না। একটা কাজে এসেছি আপনার কাছে। আমাদের এক বন্ধু আবুধাবি
চলে যাচ্ছে সোয়া দু’টার ফ্লাইটে। তার ইমিগ্রেশান হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা দেখা করতে পারিনি।
একটু যদি দেখা করে সি অফ করতে পারতাম।“
“সোয়া
দুটার আবুধাবি – ফ্লাইট ডিলে আছে। এক ঘন্টা ডিলে। দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবো। আগে
চা খান। আপনাদের আর কখন পাবো তো ঠিক নেই। অ্যাই, আমাদের তিনজনকে চা দাও।“
স্বয়ং
এয়ারপোর্ট ম্যানেজার যখন বলছেন দেখা করা যাবে – আর কী চাই। খান সাহেব আরাম করে বসলো।
আমিও বেশ খুশি হয়ে গেলাম।
“আপনার
বড়বোন জাপান গেছেন না কিছুদিন আগে?”
ম্যানেজারের
প্রশ্নে আমি বেশ অবাক হলাম। এই ভদ্রলোক কি আমার দিদির পরিচিত?
“জ্বি।
একটা ট্রেনিং-এ গেছে গত মাসে।“
“আমার
সাথে দেখা ব্যাংকক এয়ারপোর্টে।“
“আপনি
কি চেনেন আমার দিদিকে?”
“না,
আগে কখনো পরিচয় হয়নি। দেখলাম ব্যাংকক এয়ারপোর্টে ট্রানজিটের জন্য অপেক্ষা করছেন। হাতে
চটের ব্যাগ দেখে বেশ অবাক হলাম। আজকাল তো কেউ চটের ব্যাগ নিয়ে কাঁচাবাজারেও যায় না,
অথচ তিনি বিদেশে চলে যাচ্ছেন রেয়াজউদ্দিন বাজারের চটের ব্যাগ নিয়ে। কৌতূহল বশত আলাপ
করলাম। অনেকক্ষণ কথাবার্তা হয়েছে। আমার ফ্রাংকফুটের ফ্লাইট ডিলে ছিল। আমার মেয়েরা শাহীনে
পড়ে শুনে তিনি আপনার কথা বলেছেন। গভমেন্ট অফিসারদের মধ্যে এরকম সিমপ্লিসিটি আজকাল খুব
একটা দেখা যায় না।“
চা
বিস্কুট খাবার পর ম্যানেজার একজন অফিসারকে ডেকে বললেন আমাদেরকে যেন আবুধাবির ফ্লাইটের
বোডিং গেটে পৌঁছে দেন। ম্যানেজারকে ধন্যবাদ দিয়ে চললাম সিভিল এভিয়েশান অফিসারকে অনুসরণ
করে।
আমাদের
দুজনকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেলো প্রদীপ। তার ধারণাই ছিল না যে আমরা বোর্ডিং-গেটে গিয়ে
তার সাথে দেখা করতে পারবো। যাত্রীর তুলনায় ভেতরে জায়গা অনেক কম। ফ্লাইট ছাড়তে যে দেরি
হবে তা যাত্রীদের জানানোও হয়নি। দেখলাম সবাই হাতে পাসপোর্ট আর বোর্ডিং পাস নিয়ে শুকনো
মুখে অপেক্ষা করছে। সবাই নিজের দেশ ছেড়ে সব প্রিয়জনকে ছেড়ে মরুভূমির দেশে যাচ্ছে পরিশ্রম
করে টাকা উপার্জন করার জন্য। ভ্রমণে যে আনন্দ থাকে – সে আনন্দ এখানে অনুপস্থিত। এখানে
সবার ভেতরই ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগ। প্রদীপ এমনিতেই খুব ঘরকাতুরে মানুষ। ইউনিভার্সিটির
হলে থাকতে সপ্তাহে দু’দিন বাড়ি চলে যেতো। এখন জানি না বিদেশে কীভাবে থাকবে। অবশ্য সেখানে
তার নিজের বড় ভাইদের সাথে থাকবে।
বিদায়ের
কোলাকুলি করে চলে এলাম। খান সাহেবকে একটা বড় ধন্যবাদ দেয়া উচিত। কিন্তু আমাকে ধন্যবাদের
সুযোগ না দিয়ে সে দ্রুত চলে গেল। আমি ভীড়ের মাঝে বিপ্লবকে খুঁজতে শুরু করলাম। অনেকক্ষণ
খোঁজার পরেও পরিচিত কাউকে পেলাম না। সোয়া দুটো বেজে গেছে। প্লেন ছেড়ে চলে গেছে ভেবে
হয়তো এরাও চলে গেছে সবাই। আমাকে ফিরতে হবে লোকাল বাসে। এদিক থেকেই ছাড়ে শহর এলাকার
তিন নম্বর বাস। দ্রুত রাস্তা পার হয়ে বাসের দিকে যাচ্ছি – শুনতে পেলাম - “অ্যাই প্রদীপ,
প্রদীপ, এই যে এদিকে এদিকে।“ মনে হচ্ছে অনেক উপর থেকে কেউ ডাকছে আমাকে। শব্দ অনুসরণ
করে তাকিয়ে দেখলাম হাটহাজারি রোডের একটি বড় বাসের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে অপু। আমাদের আরেক
বন্ধু। বিপ্লবকেও পাওয়া গেল আশেপাশে। তারা এই বড় বাসটি ভাড়া করেছে বন্ধুকে সি-অফ করতে
এয়ারপোর্টে আসার জন্য। দেখলাম বন্ধু, আত্মীয়স্বজন সবাই চলে এসেছে। সবার মুখেই বিদায়ের
বিষাদ। অপুরা বাসের ছাদে উঠে গেছে – প্লেন উড়ে যাবার সময় যথাসম্ভব কাছ থেকে দেখার জন্য।
>>>>>>>>>>>
কলেজের দিন
চলে যাচ্ছে বেশ দ্রুত। এইচএসসির রেজাল্ট আউট হয়েছে। শাহীনের রেজাল্ট বেশ ভালো। সায়েন্স
থেকে সানিয়া স্ট্যান্ড করেছে। নতুন ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে। দেখতে দেখতে ডিসেম্বর
চলে এলো। প্রথমবারের মতো শাহীন কলেজে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী ও বিজয় দিবস উদ্যাপনের
আয়োজন করা হলো।
শাহীনের পুরনো
ভবনের ঘাসের চত্বরে বেঞ্চ পেতে শিক্ষার্থীরা বসলো। আর বারান্দায় মঞ্চ। সুব্রত ও রেহনুমার
উপস্থাপনায় খুব উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে অনুষ্ঠান শুরু হলো। রিফাৎ আরা ম্যাডাম তাঁর বক্তৃতায়
খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন যে বিজয়ের ২৫ বছর পূর্তিতে শাহীন কলেজে প্রথম বারের মত বিজয়
দিবসের অনুষ্ঠান হচ্ছে এমন একজন প্রিন্সিপালের সভাপতিত্বে যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।
শিক্ষার্থীরা সবাই আনন্দে হাততালি দিলো। কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যার যখন বক্তৃতা দিতে
শুরু করলেন, মনে হলো কোথায় যেন কিছু একটা গন্ডগোল আছে। এত নিরস বক্তৃতা সহ্য করা কঠিন।
নিরস খাবার খুব কম পরিমাণে খেয়ে কোন রকমে সহ্য করা যায়। সেরকম নিরস বক্তৃতাও খুব বড়জোর কয়েক মিনিট সহ্য করা
যায়। সেখানে প্রিন্সিপাল স্যারের বক্তৃতা চলছে তো চলছেই – থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে
না। ছেলে-মেয়েরা উশখুস করতে করতে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু করলো। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে
গেল। প্রিন্সিপাল স্যার একটু পরপরই বলতে শুরু করলেন, “অ্যাই তোমরা বস। এরপর কিন্তু
তোমাদের জন্য খাবার আছে।“ ভাবলাম জোরে হাততালি দিলে মনে হয় কাজ হবে। হাততালি কিছুটা
সংক্রামক। একজন দিলে অনেকেই দেয়। স্যার-ম্যাডমরা শুরু করলেন, ছাত্রছাত্রীরাও হাততালি
দিতে শুরু করলো। কিন্তু বক্তা হাততালিতে আরো বেশি উৎসাহিত হয়ে গেলেন। কী বলতে কী বলছেন
তার মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তাঁর উচিত ছিল বক্তৃতা লিখে আনা। নিজে না পারলে
কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে পারতেন। আর একজন দায়িত্বশীল মানুষের সময়জ্ঞান থাকবে না? বঙ্গবন্ধুর
সাতই মার্চের ভাষণ – যেটা পৃথিবীর সেরা ভাষণগুলির একটি – তার দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র দশ
মিনিট। বঙ্গবন্ধুর মতো বক্তা যদি ঘন্টার পর ঘন্টাও বলেন, সবাই আগ্রহভরে শুনবে। কিন্তু
বঙ্গবন্ধু ভালো করেই জানতেন কোথায় থামতে হবে, কখন থামতে হবে। কিন্তু আমাদের আজকের বক্তার
মাত্রাজ্ঞান একেবারেই নেই। একটা মহান অনুষ্ঠান শেষ হলো পুরোপুরি বিরক্তিকর একটা অনুভূতির
ভেতর দিয়ে। কিন্তু এই অনুভূতির কথাটি কেউই তাঁকে জানিয়েছেন বলে আমার মনে হয় না। নিজের
পায়ে যে কুড়োল মারতে হয় না সেটুকু জ্ঞান নিশ্চয় শিক্ষকদের আছে। তারা সবাই জানেন - নির্গুণ
ক্ষমতাবানের অহং কত মারাত্মক হতে পারে।
>>>>>>>>>>>>>>>
“আচ্ছা, আপনি
আমাদের চিঠি পাননি?”
ট্রেনিং-কোঅর্ডিটেনর
বিষ্ণুবাবু চোখের সোনালী চশমাটা খুলে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছতে মুছতে প্রশ্নটা
করলেন আমাকে। এখন ট্রেনিং-এ চা-বিরতি চলছে। আমি চায়ের কাপ হাতে এদিক ওদিক তাকিয়ে অপরিচিত
মুখগুলিকে মনে রাখার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় বিষ্ণুবাবু গিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছেন
তাঁর টেবিলে। তার সামনে চেয়ারে বসার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি চিঠি পেয়েছি কি না।
“না, কোন চিঠি
তো পাইনি। কিসের চিঠি?”
“আপনাকে আমরা
ট্রেইনার হিসেবে চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা আপনাকে ট্রেইনি হিসেবে পাঠালো।“
“চিঠি কাকে
লিখেছিলেন? প্রিন্সিপালকে?”
“না, চিঠি তো
পাঠিয়েছি আপনার নামে। পেলেন না কেন জানি না। যাক, ভালোই হলো আপনাকে তো পেয়েছি। আপনার
সাথে অনেক কথা আছে আমার। এই তিন সপ্তাহের প্ল্যানিং-এর ব্যাপারে আপনার সাহায্য দরকার।“
“ঠিক আছে। কী
করতে হবে জানাবেন।“
বিশ্বব্যাংক
বাংলাদেশের স্কুল শিক্ষার উন্নয়নে কয়েক হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। এই টাকা দিয়ে সরকার
টিচার্স ট্রেনিং কলেজের মাধ্যমে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান সংক্রান্ত
ট্রেনিং-এর আয়োজন করে বিভিন্ন সময়ে। এখন ডিসেম্বরের ২১ তারিখ থেকে জানুয়ারির ৯ তারিখ
পর্যন্ত তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে। পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে
প্রশিক্ষণ চলছে আলাদা আলাদাভাবে। চট্টগ্রামের আশেপাশের অনেক স্কুল থেকে ফিজিক্সের টিচাররা
এসেছেন ট্রেনিং-এ। চন্দনাইশ, গাছবাড়িয়া, পটিয়া থেকে শিক্ষকরা এসেছেন। এদিকে ফতেয়াবাদ,
হাটহাজারি, রাউজান, ফটিকছড়ি থেকেও শিক্ষকরা এসেছেন। সবাই হাইস্কুলের শিক্ষক। কিন্তু
শাহীন থেকে ফিজিক্সে পাঠানো হয়েছে আমাকে। গণিতে পাঠানো হয়েছে ফারুকী স্যারকে, আর ইংরেজিতে
সংযুক্তা ম্যাডামকে।
পদার্থবিজ্ঞান
প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সমন্বয় করছেন টিচার্স ট্রেনিং কলেজের পরিসংখ্যানের শিক্ষক বিষ্ণুপদ
রায়। ভদ্রলোক লিকলিকে লম্বা, শরীরে মাংস নেই বললেই চলে। সুন্দর ঝকঝকে হাসি দিয়ে কথা
বলেন বেশ গুছিয়ে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষকদের অতিথি প্রশিক্ষক
হিসেবে আনার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। দেখলাম তাঁর লিস্টে আমার নামও আছে। আমার কথা তিনি
শুনেছেন প্রামাণিক স্যারের কাছে। চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদের এক অনুষ্ঠানে প্রামাণিক
স্যার এসেছিলেন বক্তৃতা দিতে। স্যার আমাকে খুবই স্নেহ করেন।
বিষ্ণুবাবুর
সাথে বসে বেশ উৎসাহ নিয়ে তিন সপ্তাহের একটা কার্যকর কর্মসূচি দাঁড় করালাম। উপস্থিত
শিক্ষকদের মতামত নিয়ে টপিক ঠিক করা হলো। কোন্ বিষয়ে কোন্ অতিথি শিক্ষক ভালো প্রশিক্ষণ
দিতে পারবেন তার ব্যাপারে পরামর্শ দিলাম। বিষ্ণুবাবু পদার্থবিজ্ঞানের মানুষ নন। তাঁকে
কেন পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়ের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হলো জানি না। কিন্তু দেখলাম শুধু
তিনি নন, অনেক মানুষই কাজ করছেন এমন কিছু বিষয়ে – যে বিষয়ে কোন জ্ঞান তাঁদের নেই।
যাঁরা প্রশিক্ষণ
দিতে এলেন – তাঁদেরকে টপিক ঠিক করে দেয়া হলেও – তাঁরা নির্দিষ্ট টপিকের বাইরে গিয়ে
ব্যক্তিগত আলাপ করে সময় কাটান। এবং বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করলেও – তার ধরন ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের
শেখানোর মতো। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া আর শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দেয়া তো এক কথা নয়।
এডুকেশন আর ট্রেনিং – দুটো আলাদা জিনিস। যাঁরা প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন তাঁদের বেশিরভাগই
বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক। লাঞ্চের পরের সেশানে বেঞ্চের উপর মাথা রেখে নিঃসংকোচে ঘুমিয়ে পড়েন।
বিষ্ণুবাবুর অতিথি প্রশিক্ষকদের কেউ না এলেই তিনি আমাকে দাঁড় করিয়ে দেন ক্লাস নেবার
জন্য। আমার তো মাস্টারদের শেখানোর কোন যোগ্যতা নেই। আমি ছাত্র হিসেবে শিক্ষকদের কাছ
থেকে কী কী আশা করি সেটুকুই বলার চেষ্টা করি। স্কুলের বয়স্ক বিজ্ঞানশিক্ষকরা নতুন আবিষ্কার
সম্পর্কে পড়ার সময় পান না, কিংবা পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁদেরকে নতুন কোন বিষয়ে
আগ্রহী করে তোলা খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু এত কষ্ট করে এত দূর থেকে কেন আসেন তাঁরা? মূল
কারণ টাকা। দৈনিক দুইশ টাকা দেয়া হয় ট্রেনিং নেয়ার জন্য। ট্রেনিং দেয়ার জন্য কত দেয়া
হয় আমি জানি না। সরকারি বাজেট যে অনেক বড় তা বোঝা যায়।
এর মধ্যে একদিন
পিকনিকে নিয়ে যাওয়া হলো কাপ্তাই – কর্ণফুলি পেপার মিলে। বাস ভাড়া করে সবাইকে নিয়ে কর্ণফুলি
পেপার মিল, কাপ্তাই লেক সব ঘুরিয়ে, বিরিয়ানি খাইয়ে ফিরিয়ে আনা হলো।
শেষের দিন দশটা
থেকে বসিয়ে রাখা হলো শিক্ষার মহাপরিচালক এসে সার্টিফিকেট দেবেন বলে। দুপুর পর্যন্ত
বসিয়ে রাখার পর বলা হলো ডিজি আসতে পারছেন না। বিষ্ণুবাবুই ডিজির হয়ে আমাদের সার্টিফিকেট
দিয়ে দিলেন।
ভালো প্রশিক্ষণ
কোথায় হয় আমি জানি না। কিন্তু আমি নিজে অংশ না নিলে বুঝতেই পারতাম না শিক্ষার নামে
প্রশিক্ষণের নামে কীভাবে সময়ের অপচয় হয়, টাকার অপচয় হয়। এই তিন সপ্তাহের ট্রেনিং থেকে
আমি পাঠদান সংক্রান্ত নতুন কিছুই শিখিনি। তবে এই তিন সপ্তাহে আমি এটুকু উপলব্ধি করেছি
যে শাহীন কলেজের স্কুল পর্যায়ে যেভাবে পড়াশোনা হয়, অনেক স্কুল থেকে তা অনেক গুণ ভালো।
No comments:
Post a Comment