কেইপ
পয়েন্ট
আটটা থেকে সোয়া আটটার মধ্যে আমাকে হোটেলের লবি থেকে গাড়িতে তুলে নেয়ার কথা। আটটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে থেকেই হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দক্ষিণ আফ্রিকানদের সময়ানুবর্তিতা সম্পর্কে এপর্যন্ত ভালো কিছু শুনিনি। এদেশের সবাই ধীরেসুস্থে কাজ করতে পছন্দ করে। সোজাসাপ্টাভাবে বলতে গেলে বলতে হয় আলস্য করতে পছন্দ করে।
আলস্য করা মনে হয় দক্ষিণ গোলার্ধের
মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অস্ট্রেলিয়ানরাও আলস্য করতে পছন্দ করে।
নিউজিল্যান্ডাররাও। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানরা সময়ের ব্যাপারে খুবই নিয়ম মেনে চলে। অথচ
আফ্রিকানদের ব্যাপারে প্রচলিত প্রবাদ হলো- যদি আফ্রিকানরা বলে ‘জাস্টনাউ’- বুঝতে হবে আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে কোন
একসময়। এখন এদের আটটা থেকে সোয়া আটটা ক’টায় বাজবে জানি না।
অপেক্ষার সময় আপেক্ষিকভাবে ধীরে চলে।
অনন্তকাল অপেক্ষা করার পর ঘড়ি দেখলাম - এখনো আটটা। বিশাল এক ট্যুরবাস হোটেলের
সামনে এসে দাঁড়ালো। ভাবলাম অন টাইম। দেখলাম হোটেলের ভেতর থেকে প্রায় দৌড়ে এলো
এলোমেলো সোনালী চুলের এক শ্বেতাঙ্গিনী। আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বাসে ওঠার জন্য
চলে গেলো বাসের গেটে। আমি তাকে অনুসরণ করলাম।
“এটা কি কেইপ পয়েন্টের বাস?”
“না”- বাস ড্রাইভারের
সংক্ষিপ্ত উত্তর।
মেয়েটির হাতে ধরা ট্যুরবাসের ভাউচারের
দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেও আমার ট্যুরই বুক করেছে।
“কেইপ পয়েন্ট? আট থেকে সোয়া আট?” জ্ঞিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ। তুমি?”
“আমিও”
বেড়াতে যাচ্ছি একটা ট্যুরে। সারাদিন না
হলেও অর্ধেক দিন একই গাড়িতে ঘুরবো। আলাপ পরিচয় হবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া নিজের
দেশে নিজের পরিচিত পরিবেশ অনেকে খুব গম্ভীর হয়ে থাকলেও দেশের বাইরে এসে অপরিচিত
মানুষের সাথে আলাপ করতে আগ্রহী হয়।
“আমার নাম এলিজাবেথ। ফ্রান্স।”
নাম জানার পরেই মানুষ জানতে চায় কোন দেশ
থেকে এসেছে। এলিজাবেথ এক বাক্যেই সেরে ফেললো দুটো। আমিও তাই করলাম।
“কয়দিন এসেছো এই দেশে?”
“আজ সপ্তম দিন। তুমি?”
“কেইপ টাউনে আজ পঞ্চম। দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছি ২৫ দিন আগে। জোহানেসবার্গ,
প্রিটোরিয়া, আর সাফারি ক্যাম্প ঘুরে এখানে।”
“একা একা ভ্রমণ করছো?”
“আমি একা ভ্রমণ করতে পছন্দ করি। স্বাধীনভাবে ঘোরা যায়। তুমি?”
“একই, স্বাধীনতা।”
এলিজাবেথের কথাবার্তায় ইউরোপীয় টান আছে।
কিন্তু ইংরেজি শব্দ খুঁজতে হয় না তাকে। ফরাসীরা ইংরেজি জানে বেশ ভালোই, কিন্তু
বলতে পছন্দ করে না। আর আমরা ইংরেজি জানি বা না জানি, বলতে খুব পছন্দ করি।
“আমাদের কি আবার হোটেলের লবিতে ফিরে যাওয়া
উচিত?”
বাস দেখে ফুটপাতে নেমে এসেছিলাম। কিন্তু
বিশাল বাস এখন হোটেলের সামনের কিছু অংশ ব্লক করে রেখেছে। লবিতে ফিরে গেলে ট্যুরগাইডের
কাজ বাড়বে। বললাম, “গাড়ি তো
এখানেই আসবে।”
ব্যাগ খুলে ক্যামেরা বের করলো এলিজাবেথ।
দেখলাম অলিম্পাস এস-এল-আর। বাসস্টপের যাত্রীছাউনির দেয়ালে স্কেচ-পেন দিয়ে অনেকেই ভালোবাসার
চিহ্ন এঁকে রেখেছে। হার্ট সাইন এঁকে তার ওপর মুদিবা+কিঞ্জে ইত্যাদি। এই ব্যাপারটাও
কোন ভৌগোলিক সীমারেখা মেনে চলে না। এলিজাবেথ এসব লেখার ছবি তুলছে একের পর এক।
“প্র্যাডিব?”
“ইয়েস”
“আই অ্যাম গারথ। ইওর ট্যুরগাইড”
দেখলাম হিলটন রস
কোম্পানির একটা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়িয়েছে। গারথের বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি হবে
না। খুব ছোট করে ছাটা চুল, চটপটে স্বাস্থ্যবান। গায়ের রঙ বাদামী, আফ্রিকানদের মতো
কালো নয়। আবার চেহারা ভারতীয়ও নয়। ব্রিটিশরা নাম দিয়েছিলো ‘আফ্রিকান কালারড পিপল’।
“আরো একজনের যাবার কথা”
এলিজাবেথ তখনো দেয়াললিখনের ছবি তুলতে
ব্যস্ত। ডাক দিলাম, “হেই
এলিজাবেথ, আওয়ার কার ইজ হিয়ার।”
দৌড়ে চলে এলো। গারথ মাইক্রোবাসের দরজা
খুলে দিলো, এলিজাবেথ প্রায় দৌড়ে গিয়ে জানালার পাশে বসে পড়লো।
সামনের সিটে গারথের পাশে বসে আছেন একজন
প্রৌঢ় ভদ্রলোক। পেছন ফিরে হাত বাড়িয়ে দিলেন- “মাই নেম ইজ দোমিনিক। ফ্রম আর্জেন্টিনা।”
দোমিনিকের কাঁচাপাকা গোঁফ, মাথাভর্তি
টাক। হাসিখুশি মানুষ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বোঝা গেল ননস্টপ কথা বলেন ডোমেনিক।
পেটে বিদ্যা থাকলে অনেকেই চুপ করে থাকতে পারেন না, একটু পরপরই জ্ঞান উগলে দিতে
পছন্দ করেন। ডোমেনিক সেরকমই একজন।
“আর দু’জন যাত্রী
উঠবেন ওয়াটারফ্রন্ট থেকে। তারপর সোজা চলে যাবো কেইপ পয়েন্টে” - ওয়াটারফ্রন্টে
ঢুকতে ঢুকতে বললো গারথ।
হোটেল রেডিসন ব্লু থেকে উঠলেন এক প্রৌঢ়
দম্পতি। সৌজন্যমূলক পরিচয় হলো। ডন ও ডোনা। কানাডার হ্যালিফ্যাক্সের বাসিন্দা। অবসর
কাটাচ্ছেন বিশ্বভ্রমণ করতে করতে। মাইক্রোবাসে এখন পাঁচ মহাদেশের অধিবাসী।
ওয়াটারফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে বিচ রোড ধরে
চলছে গাড়ি। হাউট বে পর্যন্ত এসেছিলাম আগে। হাউট বে থেকে গাড়ি চললো টেবল মাউন্টেনের
অন্যপাশে চ্যাপম্যানস পিক ড্রাইভ ধরে। এটা টোলওয়ে। টোল প্লাজা পার হয়ে যে রাস্তায়
এলাম তা পৃথিবীর আশ্চর্য সুন্দর রাস্তাগুলোর একটি। চ্যাপম্যানস পিক ড্রাইভ।
টেবিল মাউন্টেনের চ্যাপম্যান চূড়ার
উচ্চতা ৬০০ মিটার। এর নিচে পর্বতমালার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে সাগরের পানি। পাহাড়ের
ঢাল কেটে সরু রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে হাউট বে থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার।
শক্ত গ্রানাইটের স্তর
কেটে কেটে এই রাস্তা বানানো হয়েছিল ১৯২২ সালে। কিন্তু বৃষ্টির সময় পাহাড় থেকে পাথর
পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ঘটনা ঘটে অনেকবার। ২০০০ সালে এই রাস্তা বন্ধ করে
দেয়া হয়েছিল। তারপর আধুনিক উপায়ে রাস্তায় পাথরপড়া বন্ধ করে রাস্তা খুলে দেয়া
হয়েছে। তবে এখনো ঝড় বৃষ্টি হলে এই রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়।
কিছুদূর এসে ডানদিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে
গেলো। পাহাড় ঘেরা একটি হৃদের মতো লাগছে একটা জায়গায়। হৃদের ওপারে আটলান্টিক। মনে
হচ্ছে গলায় পর্বতের মালা পরে অপরূপা হয়েছে সাগরকন্যা। পাহাড় চূড়ার মেঘ সেতু তৈরি
করেছে পানির সাথে।
রাস্তা এখানে একটু বড় আছে। রাস্তার পাশে
গাড়ি দাঁড় করালো গারথ। গাড়ি থেকে নেমে মিনিট পাঁচেক তাকিয়ে রইলাম অপরূপ প্রকৃতির
দিকে। সবাই মিলে কয়েকটা ছবি তুলে আবার যাত্রা শুরু।
একটু পরপরই রাস্তার বাঁক। বামে পাহাড় আর
প্রায় তিন চারশ মিটার নিচে সাগর। একটু অসতর্ক হলে গাড়ি চলে যাবে আটলান্টিকের কোলে।
চ্যাপমান পিক্স ড্রাইভ |
ডোমিনিক সামনের সিটে বসে অনবরত বক বক করছেন। তিনি জানেন না এমন কোন বিষয় আছে বলে মনে হয় না। গাইড গারথ কিছু দেখালে বা কোন তথ্য দিলে সেই প্রসঙ্গেও কয়েক পৃষ্ঠা বক্তৃতা দিয়ে ফেলেন তিনি। ডন এবং ডোনা দম্পতি মাঝে মাঝে ডোমিনিকের কথায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু এলিজাবেথ ও আমি একেবারে চুপ।
চ্যাপম্যান্স পিক ড্রাইভ পার হয়ে ছুটে
চলেছি স্টেলেনবশ শহরের ভেতর দিয়ে। স্টেলেনবশ দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে পুরনো শহরগুলোর
একটি, ওয়াইনের জন্য বিখ্যাত।
রাস্তার পাশে মাঝে মাঝে আফ্রিকান
লোক-শিল্পের মেলা। সেখানে মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে বিশাল আকৃতির জিরাফ দাঁড়িয়ে আছে।
একেবারে আসল জিরাফের সাইজ। এগুলো কেউ কিনলে কীভাবে নিয়ে যাবে জানি না।
ডোমিনিক বলে চলেছেন স্টেলেনবশ কেন কী কারণে
বিখ্যাত ইত্যাদি। আপাতত গাড়ি চালানো ছাড়া ট্যুরগাইড গারথের আর কোন কাজ নেই। ইতিহাস
বর্ণনা করার কাজটা মিস্টার আর্জেন্টিনা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
কিন্তু রাস্তার পাশে দরিদ্র আফ্রিকানদের
দেখে ডোমিনিক যেভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের ঠিক কী কী করা উচিত বলে যাচ্ছেন। তাতে
মনে হচ্ছে ডোমিনিক সাহেবের উচিত দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের বিরোধী দলে যোগ দেয়া।
ডোমিনিক, প্রদীপ, এলিজাবেথ, ডন ও ডোনা। ছবি তুলেছে গার্থ।
‘কেইপ অব গুড হোপ’- টেবল মাউন্টেন
ন্যাশনাল পার্কের কেইপ পয়েন্ট এরিয়া। ন্যাশনাল রিজার্ভ। বিশাল এলাকা নিয়ে পাহাড় আর
সমতল ঘেরা এই পার্ক। পার্কে ঢোকার আগে একটা প্রাইভেট আস্ট্রিচ ফার্ম দেখেছি। উটপাখির
ডিম খুবই জনপ্রিয় এখানে।
বনভূমিতে কিছু জেব্রা আর সাদা-কালো হরিণ
ছাড়া আর কোন বড় প্রাণী দেখলাম না। আফ্রিকান
বন্যপ্রাণী দেখার জন্য অনেক দূরে সাফারি পার্কে যেতে হয়। কিংবা কেনিয়ার জঙ্গলে।
দক্ষিণ আফ্রিকার এই অংশে যত প্রাণী আছে সবই অহিংস।
কেইপ পয়েন্টে পৌঁছলাম। গাড়িপার্ক করার
পর গারথ জানালো পাহাড়ের উপর বাতিঘরে উঠার জন্য ফিউনিকুলার ট্রেনে উঠতে হবে। ওঠানামার
জন্য ট্রেনের ভাড়া ৫৮ র্যান্ড। এই টাকা নিজের পকেট থেকে দিতে হবে শুনে নিচুস্বরে
গজ গজ করতে শুরু করলো এলিজাবেথ। মেয়েটা কি কৃপণ নাকি?
ফিউনিকুলার ট্রেন
একটা রেস্টুরেন্ট আর
স্যুভেনির শপ, তার পাশে টিকেট ঘর। ছোট্ট ট্রামের মতো এক কামরার একটা বগি। পাহাড়ি
পথে ট্রেনলাইন বেয়ে আস্তে আস্তে উঠে গেলো উপরে। চারপাশ কী যে সুন্দর। পাহাড়ের
একপাশে আটলান্টিক, অন্যপাশে ভারত মহাসাগর পরস্পর মিশে গেছে দক্ষিণে এসে।
উপরের স্টেশনে একটা ছোট্ট স্যুভেনির শপ।
সেখান থেকে প্রশস্ত সিঁড়ি এঁকেবেঁকে উঠে গেছে লাইট হাউজে। বাতিঘরে ওঠার পর চারদিকে
ঘুরে ঘুরে দেখা যায়। এই সকালেই বেশ ভিড় হয়ে গেছে এখানে। সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত।
দূরে চারপাশে পাহাড় – নিচে দুটো
মহাসাগর পাশাপাশি এসে মিশে গেছে। এমন জায়গায় আসার স্মৃতি ধরে রাখছে সবাই। বেগুনি
রঙের কিছু পাখি উড়ে এসে বসছে কাছাকাছি। ২৫০ প্রজাতির পাখি আছে এখানে।
এখনকার পাথরের দেয়ালেও অনেকে পাথর দিয়ে
ঘষে ঘষে লিখেছে নিজের নাম আর তার প্রেমিকার নাম। এলিজাবেথ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবি
তুলছে সেগুলোরও।
আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে দক্ষিণের বাতিঘর |
কেইপ পয়েন্টে ছবিটা তুলেছে এলিজাবেথ |
গারথ আমাদের সময় দিয়েছিলো বিশ মিনিট। ডন আর ডোনা তার অনেক আগেই নেমে গেছেন। ডোমিনিক এলিজাবেথের কাছে কাছে ঘুরছেন। কেইপ পয়েন্টকে আফ্রিকার সবচেয়ে দক্ষিণ বিন্দু বলা হলেও আসল দক্ষিণ বিন্দু যে আরো ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে কেইপ আগালহাস - তা বিস্তারিত বলতে না পেরে শান্তি পাচ্ছেন না ডোমিনিক।
ফেরার পথে কিছুদূর আসার
পর গাড়ি থামাতে হলো। রাস্তা দখল করে বসে আছে দলে দলে বেবুন। এই পার্কে হাজার হাজার
বেবুন। হর্ন বাজানোর পরেও রাস্তা ছাড়ে না তারা। অন্য দিক থেকেও আসতে পারছে না
গাড়ি। গারথ গাড়ি থেকে নেমে অনেক কষ্টে দলের সর্দারকে বসা থেকে উঠিয়ে দিলো। সাথে
সাথে অন্যরাও উঠে গেলো। দলপতির প্রতি এমন আনুগত্য আর কোন্ কোন্ পশুর মধ্যে আছে
জানি না।
যা ভেবেছিলাম তাই, ডোমিনিক আফ্রিকার
সর্বদক্ষিণ পয়েন্ট কোনটা তা নিয়ে লেকচার শুরু করলেন। ভদ্রলোক মনে হয় গাইডবুক
মুখস্ত করে ফেলেছেন।
গারথ জানালো এবার আমরা
যাবো বুল্ডার্স পেঙ্গুইন কলোনিতে। আফ্রিকান পেঙ্গুইনের সবচেয়ে নিরাপদ কলোনি। মেইন
রোড থেকে অনেক ভেতরে আবাসিক এলাকার মধ্যে যে এরকম একটা স্থাপনা আছে তা বাইরে থেকে
বোঝার উপায় নেই। পার্কিং এরিয়ার চারপাশে অনেক ফুলের গাছ। বেশিরভাগই জবা জাতীয় ফুল।
বিভিন্ন রঙের জবা। একপাশের রাস্তায় খোলা বাজার। জামাকাপড়, খেলনা, পুঁতির মালা, বালা,
ব্যাগ ইত্যাদি হস্তশিল্পের বাজার।
এখান থেকে প্রায় একশ মিটার হেঁটে ছোট্ট
রাস্তার শেষ মাথায় বুল্ডারস পেঙ্গুইন কলোনিতে ঢুকার পথ। ৬৫ র্যান্ড টিকেটের দাম।
এলিজাবেথের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য তার দিকে তাকালাম। সে গজগজ করতে করতে ব্যাগ
খুললো। সিকিউরিটি স্ক্যানারের ভেতর দিয়ে ঢুকতে হলো।
আফ্রিকান হস্তশিল্পের বাজার |
ভেতরে একশ মিটারের
মধ্যে বিচ। কাঠের সেতু এঁকে বেঁকে চলে গেছে অনেক দূর। চারপাশে সাদা বালির স্তূপ, তার
ওপর কিছু সামুদ্রিক লতা-গুল্ম। তার ভেতরে যেদিকে তাকাই পেঙ্গুইন আর পেঙ্গুইন।
এখনকার পেঙ্গুইন অ্যাকোয়ারিয়ামের পেঙ্গুইনের চেয়ে অনেক বেশি হৃষ্টপুষ্ট।
১৯৮২ সালে মাত্র একজোড়া পেঙ্গুইন নিয়ে
শুরু করা হয়েছিল এই কলোনি। এখন প্রায় আড়াই হাজার পেঙ্গুইন আছে এখানে।
চারদিকে একটা দুর্গন্ধ ভাসছে।
পেঙ্গুইনদের সাথে ছবি তোলা ছাড়া আর কোন কাজ নেই।
আধঘন্টার মধ্যে আবার গাড়িতে। এবার কেইপ
টাউনে ফেরার পথ। যেদিক দিয়ে এসেছিলাম ফিরছি অন্যপথে।
একটু পরই সাইমনস টাউন। সেই ১৭৪৩ সালে এই
শহর গড়ে উঠেছিল নৌবাহিনীর শহর হিসেবে। রয়েল নেভির অনেক পুরনো ভবন এখন মিউজিয়ামে রূপান্তরিত
হয়েছে।
বুল্ডার্স পেঙ্গুইন কলোনি
মেইন রোডের দু’পাশে দেড়শো বছর আগের ঘরবাড়ি-দোকানপাট এখনো চলছে।
রাস্তা থেকেই দেখা গেলো
জুবিলি স্কোয়ার। সাইমনস টাউনের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে রাস্তার পাশে পার্কে একটা
কুকুরের মূর্তি। এই কুকুর খুব বিখ্যাত এখানে। কুকুরটি নৌবাহিনীর সৈনিকের মর্যাদা
পেয়েছিল ১৯৩৯ সালে। তার নাম ছিল ‘জাস্ট নুইসেন্স’। নামের অর্থ
যাই হোক ১৯৪৩ সালে জাস্ট নুইসেন্স যখন মারা যায় তখন তাকে নৌবাহিনীর সামরিক
মর্যাদায় দাফন করা হয়। তার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় সাইমনস টাউনের প্রধান পার্কে।
জাস্ট নুইসেন্সই বটে।
গাড়ি চলছে কেইপ টাউনের দিকে।
“ইউনিভার্সিটির কোন ক্যাম্পাসে যেতে চান?” গাড়ি চালাতে চালাতে
প্রশ্ন করলো গারথ।
“কয়টা ক্যাম্পাস আছে?”
“ইউ-সি-টির চারটা ক্যাম্পাস, এখানে তিনটা, একটা সিটিতে ওয়াটারফ্রন্টের কাছে।
রনডেবশ-এ গ্রুট ইশকির ক্যাম্পাস, অবজারভেটরিতে মেডিকেল ক্যাম্পাস, হিডিন ক্যাম্পাস
সিটিতে। গ্রুট ইশিকির ক্যাম্পাস আবার তিনভাগ, আপার, মিডল, লোয়ার। পাহাড়ী এলাকা তো।”
“রোডস মেমোরিয়েলের কাছে কোনটা?”
“আপার ক্যাম্পাস। হাইওয়ের কাছেই। এটা এম-থ্রি
রোডস ড্রাইভ। ইউনিভার্সিটির কাছে একটা ট্রাফিক লাইট পাবো। সেখান থেকে আপার
ক্যাম্পাস কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ।”
ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাচ্ছে গারথ। হাইওয়েতে
স্পিড লিমিট ১১০ কিলোমিটার। সে মনে হচ্ছে ১২০এ চালাচ্ছে। কেউই খুব একটা মাইন্ড
করছে বলে মনে হচ্ছে না। সামনের সিটে ডোমিনিক হা করে ঘুমাচ্ছেন। পেছনের সিটে ডন ও
ডোনা দম্পতি না ঘুমালেও নিস্তেজ হয়ে এলিয়ে পড়েছেন। আমি রেডি নেমে যাবার জন্য।
এলিজাবেথের দিকে তাকালাম সে তার ছোট্টব্যাগটা কোলের উপর নিয়ে পিট পিট করে তাকাচ্ছে
আমার দিকে।
মিনিট পনেরো আগে গারথকে জ্ঞিজ্ঞেস
করেছিলাম ইউনিভার্সিটির কাছ দিয়ে যখন যাবে, আমাকে ইউনিভার্সিটির কাছে নামিয়ে দিতে
পারবে কি না। ইউনিভার্সিটি এরিয়ায় অনেক কিছু দেখার আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অবজারভেটরি
আছে এখানে। সিসিল রোডস মেমোরিয়েলটাও দেখার ইচ্ছা আছে। আর সময়মতো পৌঁছাতে
পারলে গ্রুট ইশকির হাসপাতালের “হার্ট অব কেইপ টাউন” মিউজিয়াম
দেখবো।
গারথ সেই সময় বলেছিল, “কোন সমস্যা নেই।”
এলিজাবেথ জানতে চাইলো, “ইউনিভার্সিটিতে যাবে
তুমি?”
“হ্যাঁ-এসেছি যখন ক্যাম্পাসটা দেখে যাই।”
“তারপর হোটেলে ফিরবে কীভাবে?”
“বাস বা ট্যাক্সি নিয়ে।”
তারপর আর কোন কথাবার্তা নেই। তার পনেরো
মিনিট পরে গারথ জানতে চাইলো- কোন ক্যাম্পাস।
এম-থ্রি হাইওয়ের রোডস ড্রাইভ যেখান থকে
ডি-ওয়াল ড্রাইভ হয়ে গেছে তার কাছাকাছি গাড়ি থামালো গারথ। দ্রুত নেমে এসে দরজা খুলে
দিলো গারথ।
“থ্যাংক ইউ এভরিবডি। বাই” বলে নেমে গেলাম।
গারথের হাতে কিছু টিপস গুঁজে দিয়ে
ঘুরতেই দেখি এলিজাবেথও নেমে গেছে গাড়ি থেকে।
“তুমি কোথায় যাচ্ছো?” জ্ঞিজ্ঞেস
করলাম।
“আমিও যাবো রোডস মেমোরিয়েল দেখতে।”
গারথ বলেছিল কয়েক মিনিটের পথ কিন্তু হাঁটতে
হলো প্রায় পনেরো মিনিট। সময়ের ব্যাপারে যেমন জাস্ট নাউ বললে কয়েকদিন বোঝায় সেরকমই
কয়েক মিনিটের পথ মানে কয়েক ঘন্টার পথও হতে পারে আফ্রিকায়।
No comments:
Post a Comment