ডিস্ট্রিক্ট
সিক্স মিউজিয়াম
ভেতরে পা দিয়েই মনে হলো
আমি ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। করুণ ইতিহাস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গেলে
যেরকম দাঁড়াতে হয় ইতিহাসের সামনে- এখানেও অনেকটা সেরকম। এই ইতিহাস আফ্রিকার
কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের ইতিহাস।
কেইপ টাউনের ঝলমলে শহরকেন্দ্রের এত কাছে
এই মিউজিয়াম। হেঁটেই এসেছি এখানে লাঞ্চের পর। কিন্তু জায়গাটা সুনশান, ছোট্ট গলির
ভেতর। আশেপাশের বাড়িগুলো সব ছোট ছোট, পুরনো। যে বাড়িতে গড়ে উঠেছে এই জাদুঘর-তাও
প্রায় একশো বছরের পুরনো। ইট আর কাঠের তৈরি দোতলা একটা বাড়ি। অনেক আগে এটাকে চার্চ
হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শাসকরা ১৮৬৭ সালে
কেইপ টাউনের ষষ্ঠ মিউনিসিপ্যাল ডিস্ট্রিক্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন যে এলাকা,
সেটাই ডিস্ট্রিক্ট সিক্স। এর সীমা ছিল উত্তরে স্যার লাওরি রোড, পশ্চিমে টেন্যান্ট
রোড, দক্ষিণে ডি-ওয়াল ড্রাইভ এবং পূর্বে ক্যামব্রিজ স্ট্রিট। ক্রমশই জমজমাট হয়ে ওঠে
ডিস্ট্রিক্ট সিক্স।
মেঝের পুরোটা জুড়ে একটা ম্যাপ। ডিস্ট্রিক্ট সিক্স এর ম্যাপ। ১৯৬৬ সালে যেমন ছিল ঠিক তেমনি।
পরবর্তী একশ বছরে এখানে
বসতি গড়ে ওঠে শ্রমজীবী মানুষের। নিজেদের মতো করে তারা বাড়িঘর তুলে নেয়। তাদের কেউ
কেউ আগে কৃতদাস ছিল। কেউ কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের
হয়ে কাজ করার জন্য মালয়েশিয়া থেকে নিয়ে এসেছিল প্রচুর মালয় শ্রমিক। ইন্ডিয়া থেকেও
এসেছিলো অনেকে। সবাই মিলে প্রায় দুই হাজার পরিবারের ষাট হাজারেরও বেশি মানুষ বাস
করতো ডিস্ট্রিক্ট সিক্সে। স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও সুখের অভাব ছিলো না তাদের।
দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার-সচেতনতা
যতই বাড়ছিলো শ্বেতাঙ্গ শাসকদের অত্যাচারের মাত্রাও বাড়ছিলো পাল্লা দিয়ে। তারা নতুন
নতুন আইন বানাচ্ছিলো যাতে কৃষ্ণাঙ্গরা কখনোই একতাবদ্ধ হতে না পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শ্বেতাঙ্গ
শাসকরা আইন করলো যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কোনরকমের ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে
উঠতে পারবে না। জাতিগতভাবে আলাদা দু'জন
মানুষ একে অপরকে ভালোবাসতে পারবে না। তাদের বাস করতে হবে আলাদা আলাদা।
কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পর্ক ছাড়া এক জাতির সাথে অন্য জাতির আর কোন সম্পর্ক থাকবে
না।
মানবজাতির ইতিহাস বড় বিচিত্র আর কতো
স্ববিরোধিতায় ভরা। হিটলার উঁচুজাতি-নিচুজাতি, আর্য-অনার্য ইত্যাদির প্রশ্ন তুলে
বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে ফেললো। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স সবাই একজোট হয়ে হিটলারকে
পরাজিত করলো। সব মানুষ সমান - এটাই ছিল আদর্শ। অথচ দেখা গেলো দক্ষিণ আফ্রিকার
শ্বেতাঙ্গ সরকার অশ্বেতাঙ্গদের জাতিস্বত্বা, গায়ের বর্ণ, ভাষা ইত্যাদির ভিত্তিতে
আলাদা করে ফেলতে আইন পাস করে ফেললো। গ্রুপ এরিয়া অ্যাক্ট নামে যে আইন পাস হলো তার
মূল কথা হলো বর্ণভেদ। যদিও সরকারের ভাষ্য হলো এই আইনের ফলে প্রত্যেক জাতি আলাদা
আলাদা জায়গায় আলাদা আলাদা ভাবে অনেক ভালো থাকবে।
১৯৬০ সালে ডিস্ট্রিক্ট সিক্সের বেশিরভাগ
অধিবাসীই ছিল অশ্বেতাঙ্গ। কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের পাশাপাশি ছিল মালয়েশিয়ান মুসলমান,
খোশা জাতিগোষ্ঠীর কৃষ্ণাঙ্গ, ছিল আফ্রিকান, ইন্ডিয়ান এবং খুব অল্পসংখ্যক
শ্বেতাঙ্গ।
সময়ের সাথে কেইপ টাউন শহরের সমৃদ্ধি
ঘটছিলো। হীরার ব্যবসা জমজমাট, কেইপ টাউন বন্দরে জাহাজের সংখ্যা বাড়ছে। দক্ষিণ
আফ্রিকার অর্থনীতি ক্রমশই উন্নত হচ্ছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রের এত কাছে - হারবার ও
টেবিল পর্বতের মাঝখানের এই জায়গাটির ভবিষ্যতমূল্য আকাশছোঁয়া। সরকার ভাবলো এটা খালি
করতে পারলে তাদের লাভ বহুমুখী।
বস্তি খালি করতে হলে কোর্টের অর্ডার
নিয়ে অবৈধ স্থাপনা হিসেবে রাতারাতি তুলে দেয়া যায়। কিন্তু ডিস্ট্রিক্ট সিক্স এর
বাসিন্দাদের কেউই অবৈধ নয়। তাদের প্রত্যেকরই বাড়ির মালিকানার দলিল আছে। কিন্তু
সরকারের আছে ক্ষমতা।
সরকার অনেকগুলো কারণ দেখালো। প্রধান
চারটি কারণ হলো:
· ভিন্নজাতির
মানুষ একসাথে থাকলে দ্বন্দ্ব বাড়ে। সুতরাং জাতিগতভাবে আলাদা করে দেয়া দরকার।
· ডিস্ট্রিক্ট
সিক্স একটি বস্তি যেখানে মাদকের ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, অপরাধ, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ
ইত্যাদি চলে।
· ডিস্ট্রিক্ট
সিক্স দিনে দিনে রেড লাইট ডিস্ট্রিক্টে পরিণত হচ্ছে-দেহ ব্যবসা বাড়ছে- যা সমাজের
জন্য বিষফোঁড়া।
· এই বিষফোঁড়া
গেলে দিতে হবে। তা করতে হলে এদের সবাইকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে দূরে। আর
এখানে গড়ে তুলতে হবে শ্বেতাঙ্গদের স্থাপনা।
শ্বেতাঙ্গ শাসকরা কী
চায় তা বুঝতে কারোরই কোন অসুবিধা হলো না। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের হাতে, অভিবাসীদের
হাতে করার কিছুই ছিল না।
১৯৬৮ সালে বুলডোজার এসে ভেঙ্গে দিয়ে
গেলো ষাট হাজার মানুষের এত দিনের এত কষ্টে গড়ে তোলা ঘরবাড়ি, জীবন। আলাদা করে ফেলা
হলো বন্ধুত্ব, ভেঙে দেয়া হলো মানুষে মানুষে সম্পর্ক। বেশ কিছু পরিবার ছিল যারা
আলাদা জাতির মধ্যে বিয়ে করে সংসার করছিলো। সরকারী আইনে তাদের বিয়েও অবৈধ হয়ে গেলো।
আলাদা করে ফেললো স্বামী, স্ত্রী এবং সন্তান।
১৮৬৬ থেকে ১৯৮২’র মধ্যে ষাটহাজার মানুষকে বাধ্য করলো
ডিস্ট্রিক্ট সিক্স থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ‘কেইপ ফ্ল্যাটে’ চলে যেতে। কেইপ ফ্ল্যাট পরিণত হলো সরকারি
বস্তিতে। ডিস্ট্রিক্ট সিক্সের সব ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হলো।
কৃষ্ণাঙ্গদের সংগ্রাম, দক্ষিণ আফ্রিকান
ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্বে গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলছিলো, ক্রমশ বেগবান হচ্ছিলো সেই
সময়। নেলসন ম্যান্ডেলাসহ আরো সব নেতাকে নাশকতার মামলায় ফাঁসিয়ে যাবজ্জীবন জেলদন্ড
দেয়া হয়েছে। সারা বিশ্বে প্রতিবাদ শুরু হলো। শ্বেতাঙ্গ সরকার জায়গা খালি করতে
পারলেও নতুন করে ঘরবাড়ি বা দোকান পাট অফিস কিছুই বানাতে পারলো না ডিস্ট্রিক্ট
সিক্সের জায়গায়। তারপরও কেইপ পেনিনসুলা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিকে ডিস্ট্রিক্ট
সিক্সের অনেক জায়গা দিয়ে দেয়া হলো। সেখানে তাদের ক্যাম্পাস গড়ে উঠেছে। বাকি জায়গা
এখনো খালি, পরিত্যক্ত।
অধিকার বঞ্চিতরা অধিকার আদায়ের সংগ্রামে
সোচ্চার এবং সক্রিয় হলে, আপোষ না করলে সংগ্রামের জয় হবেই। ১৯৮৯ সালে ডিস্ট্রিক্ট
সিক্স মিউজিয়াম ফাউন্ডেশান গঠিত হয়। নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবার
পর ১৯৯৪ সালে এই মিউজিয়াম প্রদর্শনীর জন্য খুলে দেয়া হয়। এখন এখানের সব দেয়ালজুড়ে,
ফ্লোরজুড়ে সেই সময়ের স্মৃতি, স্মৃতিচারণ, ছবি, ক্ষোভ, আশা, হতাশা ও সংগ্রামের
জীবন্ত ইতিহাস।
ডিস্ট্রিক্ট সিক্স মিউজিয়ামের ভেতরে |
মানবজাতির ইতিহাসে অনেক
কলঙ্কজনক অধ্যায় আছে। মানুষ মানুষের ওপর অত্যাচার যে কত ভয়ংকর রকমের করতে পারে তারই
একটা উদাহরণ এই ডিস্ট্রিক্ট সিক্স।
ডিস্ট্রিক্ট সিক্স থেকে যাদের
বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল নেলসন ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট হবার পর তাদের পুনর্বাসনের
ব্যবস্থা করলেন। বেশ কয়েকটি বহুতল বাসভবন তৈরি হয়েছে ডিস্ট্রিক্ট সিক্স এর জায়গায়।
যাদের বয়স ৮০ বছরের উপরে তাদের হাতে বাড়ির চাবি তুলে দিয়েছেন তিনি ২০০৪ সালের ১১
ফেব্রুয়ারি- উৎখাতের ঠিক ৩৮ বছর পর।
ডিস্ট্রিক্ট সিক্স এর ঘটনার ভিত্তিতে
অনেক গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান, চলচিত্র তৈরি হয়েছে। ২০০৯ সালে পিটার জ্যাকসন ও
নীল ব্লুথক্যাম্প তৈরি করেছেন “ডিস্ট্রিক্ট নাইন”- যা মূলত ডিস্ট্রিক্ট
সিক্স এর ঘটনা।
মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এলাম। কেইপ টাউনে
এখন কোথাও জাতিগত বৈষম্য নেই। গণতান্ত্রিক দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানে মানুষে মানুষে
কোন ধরনের বৈষম্যের স্থান দেয়া হয়নি। এখন কোথাও চোখে পড়বে না “এই জায়গা কালোদের জন্য” বা “এই গাড়িপার্কে
শ্বেতাঙ্গদের গাড়ি ঢোকা মানা”। অবশ্য এখন একটা বৈষম্যই খুব বেশি চোখে পড়ে- তাহলো অর্থনৈতিক
বৈষম্য। কেউ ধনী, কেউ গরীব। এটাতেই অনেককিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিন্ন হয়ে যায়।
No comments:
Post a Comment