Wednesday, 2 September 2020

ম্যান্ডেলার দেশে - পর্ব ১২

 

কনফারেন্স ডিনার


বলরুম-ওয়ান এর সামনে অনেক ভিড় কনফারেন্স ডিনারের ডেলিগেটদের সবাই এমন সেজেগুজে এসেছে যে চেনাই যাচ্ছে না অনেককে বলরুম খুলবে সাতটায় এখনো মিনিট পনেরো বাকি সামনে প্রশস্ত লবি ছোট ছোট গোল উঁচু টেবিল একটু পর পর ক্যাটারাররা মদের গ্লাসের ট্রে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে

          যে টেবিলের সামনে আমি দাঁড়িয়েছি সেখান থেকে বলরুমের দরজা দেখা যাচ্ছে আমার চোখ ঘুরছে পরিচিত অপরিচিত স্বল্প পরিচিত মুখের ওপর। রঙিন ঝাড়বাতি থেকে ঠিকরে পড়ছে বর্ণিল আলো। সেই আলোর কিছুটা প্রতিফলিত হচ্ছে সুবেশা মোহময়ীদের মুখ থেকে।

          মদের পাত্র কয়েকবার ফিরিয়ে দিয়েছি। আমার এক বন্ধু তো এ নিয়ে নিয়মিত উপহাস করে আমাকে। আমি নাকি এতটাই নির্লজ্জ গাঁইয়া যে অরেঞ্জ জুসের গ্লাস তুলে চিয়ার্স বলতে লজ্জা পাই না। সামনে আসা কৃষ্ণার ট্রে থেকে আপেলের রস তুলে নিতে নিতে ভাবছিলাম আমার মতো গাঁইয়া তাহলে আরো কিছু কিছু আছে। নইলে তার ট্রেতে তো এই বস্তু থাকার কথা ছিল না।

          বাজনার শব্দ কানে আসছে। দেখলাম ব্যান্ডপার্টি আসছে। কনফারেন্সে ব্যান্ডপার্টি খুব বেশি দেখেছি বলে মনে হয় না। বাজনার শব্দ তীব্র হচ্ছে। লম্বা করিডোর ধরে এগিয়ে আসছে ধাতব যন্ত্রপাতির শব্দ তুলতে তুলতে জরির পোশাক পরা সাত আটজনের একটা দল। কেউ কেউ তাদের বাজনার তালে তালে কোমর দোলাতে শুরু করেছে। বাদক দলের বেশিরভাগেরই বয়স মনে হয় ষাটের কাছাকাছি। কিন্তু তেজোদীপ্ত শরীর।

 

 

       গুড ইভনিং

          বাজনার শব্দে ঠিক বুঝতে পারিনি কখন মি লিং আর তার বয়ফ্রেন্ড এসে দাঁড়িয়েছে আমার টেবিলের কাছে।

     হাই, ইউ লুক বিউটিফুল। হোয়াট আ নাইস ড্রেস।

          এগুলো রুটিন প্রশংসা। আমার ঝুলিতে মাত্র কয়েকটা বাক্য আছে এরকম। সেগুলো সব বলে ফেললে আর কিছু বলার মতো কথা খুঁজে পাই না।

          মি-ও রুটিন ধন্যবাদ বাক্য বললো। তার বয়ফ্রেন্ড ইংরেজিতে স্বল্পভাষী। তাই চুপচাপ। কিন্তু এধরনের অনুষ্ঠানে খেঁজুরে আলাপ আবশ্যক। তাই আমাকে প্রসঙ্গ টেনে আনতে হলো।

     কী কী করলে আজ সারাদিন?

     বক্তৃতা শুনলাম। মর্নিং প্লেনারি সেশানটা খুব ভালো ছিল না?

          আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আজ সারাদিনও কনফারেন্স বক্তৃতা ছিল।

     কেইপ টাউনের কিছু দেখোনি এখনো?

     কাল দেখবো। টেবল মাউন্টেন দেখতে যাবো।

          এরপর আর প্রসঙ্গ লাগে না। টেবিল পর্বত থেকে শুরু করে ডিস্ট্রিক্ট সিক্স পর্যন্ত বলা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু তেমন কিছু বলার আগেই অরুণকুমারের প্রবেশ।

     হাই প্রদীপ। আই ওয়াজ লুকিং ফর ইউ হোল ডে।

          ডক্টর অরুণকুমার ভারতীয়। কেরালার পদার্থবিজ্ঞানী। ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে চাকরি করতেন। ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন ওমানে। সেখানে প্রচুর টাকা বেতনে মধ্যপ্রাচ্য সরকারের রেডিয়েশন ব্যবস্থাপনা দেখাশোনা করেন। আমার সাথে প্রথম পরিচয় বুলগেরিয়ায়। তারপর গতবছর আবার দেখা হয়েছে জয়পুরে। এখন তৃতীয়বার।

          অরুণকুমারের সাথে মি-দের পরিচয় করিয়ে দিলাম। অরুণকুমারের একটি বৈশিষ্ট্য হলো কোন মেয়ের সাথে তার পরিচয় হলে সে কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটির কান ঝালাপালা করে দেয়। এখন আমার আর কোন কাজ নেই। মি লিং এর সাথে অরুণকুমার বাক্যবিনিময় শুরু করলো। আরো সুনির্দিষ্টিভাবে বললে বলা যায়  বাক্যবরিষণ শুরু করলো।

          ঠিক সাতটায় বলরুমের দরজা খুললো। সবাই ঢুকতে চায় একই সাথে। আমি ঠিক করেছি ঢুকবো সবার পরে। কিন্তু মি দেখলাম ইতোমধ্যেই অতিষ্ঠ হয়ে গেছে অরুণকুমারের বাক্যবর্ষায়। আমার কনুইতে ধাক্কা দিয়ে বললো, লেটস গো। আই অ্যাম সো হাংরি।

          তার কথাবার্তায় ন্যাকামির ভাব তার বয়ফ্রেন্ডের চোখে পড়লো। এই ক্ষুধার্ত বালিকা কি জানে না যে বয়ফ্রেন্ডের উপস্থিতিতে অন্য কোন পুরুষকে এরকম ন্যাকামি দেখাতে নেই!

          ঢুকলাম ভিতরে। বিশাল হলঘরের মাঝখানে স্টেজ। স্টেজের ওপর আফ্রিকান বাদ্যযন্ত্র সাজানো। সামনে ড্যান্সফ্লোর। আর বাকি ফ্লোরজুড়ে বিরাট বিরাট টেবিলের চারপাশে চেয়ার সাজানো।

          বিশেষ অতিথিদের জন্য দুটো টেবিল সংরক্ষিত। সেদুটো ছাড়া আর যেখানে খুশি বসা যাবে। ঢুকতে দেরি করাতে বেশিরভাগ টেবিলই অর্ধভর্তি হয়ে গেছে। স্টেজ থেকে বেশ দূরে খালি টেবিল পাওয়া গেলো বসলাম

          টেবিলে মদের বোতল, অরেঞ্জ জুস, পানি সাজানো আর ধবধবে বিশাল সাদা প্লেটের মাঝখানে একতাল সবজির মত বস্তুর ওপর দুটো চিংড়ি

          খাবার দেখলে ক্ষুধা লাগতে দেরি হয় না কিন্তু অরুণকুমার বললো এখন খাওয়া যাবে না ইতোমধ্যে আমাদের টেবিলে এসে যোগ দিয়েছে চারজন তরুণীর একটি দল অরুণকুমার উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করলো তাদের। ক্যাথেরিন আমেরিকান। সান ডিয়েগো ইউনিভার্সিটির পোস্টডক্টরেট ফেলো। বাকি তিনজনের কেউই অ্যাকাডেমিক নয়। তারা ক্যাথরিনের সাথে এসেছে কেইপ টাউন দেখতে। ডেলিগেটের সঙ্গী হয়ে চলে এসেছে ডিনারে।

          পরিচয়ের পর অরুণকুমার ক্যাথরিনের দিকে মনোযোগী হলো। আমি খাবারের দিকে। বক্তৃতাপর্ব শুরু হলো। ভদ্রতা করে সবাই কখন খেতে শুরু করবে তার জন্য অপেক্ষা করা বোকামি।

          চিংড়ি আর সবজির আইটেমটা সুস্বাদু। টেবিলে মেনুও দেয়া আছে কোন খাবারের পর কোন খাবার দেয়া হবে ইত্যাদি।

          বক্তৃতা শেষ হবার কোন লক্ষণ নেই। একজনের পর একজন কর্মকর্তা উঠছেন আর বেশি কিছু বলবেন না প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছেন। স্বাভাবিকভাবেই যে যার মতো কথা বলতে শুরু করেছে হলের মধ্যে। বক্তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে- কিন্তু বক্তৃতা থামাচ্ছেন না।

          সম্মেলনের সভাপতি উঠে অনেকটা রাগতস্বরেই সবাইকে চুপ করে বক্তৃতা শোনার অনুরোধ করলেন। এ ধরনের অনুরোধ অনেকের জন্যই একটু অপমানজনক। আমাদের টেবিলের ক্যাথরিন আমেরিকান কালচারে অভ্যস্ত। সেখানে গ্র্যান্ডডিনারের বক্তৃতা চুপ করে শোনার জন্য অনুরোধ করতে হয় না। বক্তৃতা যারা করেন তারা জানেন এক মিনিটের লম্বা বক্তৃতা কেউ শুনতে চায় না সামনে খাবার রেখে।

          খাওয়া আর বক্তৃতা দুটোই চলছে। বক্তৃতাশেষে এক পর্যায়ে সঙ্গীত আর নৃত্য শুরু হলো। আফ্রিকান সাংস্কৃতিক দলের নৃত্য। বেশ উপভোগ্য। মেইন ডিশ - বুনো ছাগলের একতাল নরম মাংস, বিভিন্ন সবজি ও মসলার রসে ডুবানো। মাংসের রঙ কুচকুচে কালো, খেতে বেশ ভালো।

          অরুণকুমার পড়ে গেলো সমস্যায়। সে নিরামিশাষী নয়, কিন্তু ছাগলের মাংস খায় না। আরো ভালোভাবে বলতে গেলে বলা যায়- সে পশুর মাংস খায় না, পাখির মাংস খায়। মোরগ মুরগি হাঁস বক ইত্যাদি চলে। (অস্ট্রিচ চলে কিনা জানতে চাওয়ায় একটু বেকায়দায় পড়েছিল সে।)

          প্রায় ছয়শ মানুষের জন্য ষাটটা টেবিলে একসাথে খাবার পরিবেশন করা সহজ কাজ নয়। সারিবদ্ধভাবে এসে একের পর এক প্লেট রেখে যাচ্ছে নিঃশব্দে। অরুণকুমার পরিবেশনকারীদের সাথে কথা বলতে চাইলো তার পশু-পাখি সংক্রান্ত ব্যাপারে। কিন্তু তারা ব্যস্ত, তাছাড়া খাবারের প্লেট হাতে তাদের কথা বলা নিষেধ।

          অনেকক্ষণ তার সমস্যার কোন সমাধান হলো না। একজন ম্যানেজার এসে টুকে নিয়ে গেলো টেবিল নম্বর। মুরগির ব্যবস্থা করে ফেলবে কোনভাবে।

          এদিকে নাচ শুরু হয়ে গেছে। খাওয়া চলছে। অনেকেই নাচতে শুরু করেছে ড্যান্সফ্লোরে গিয়ে আফ্রিকান ড্রামের বাজনার সাথে। আমার খাওয়া প্রায় শেষ। অরুণকুমারের জন্য মুরগির ঠ্যাং এসেছে দুটো। ক্যাথরিন তার বন্ধুদের সামলাচ্ছে। মি তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে চীনা ভাষায় বাক্যালাপ করছে। আমার মনে হলো আজকের মতো কাজ শেষ। এবার চলে যাওয়াই উত্তম।

 



   অরুণকুমারকে বললাম, আমি গেলাম।

     এখনি যাবে কী! নাইট ইজ স্টিল ইয়াং।

          তুমি এই ইয়াংদের সাথে থাকো। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি গেলাম।

          আস্তে করে উঠে ড্যান্সফ্লোরের কাছে গিয়ে কিছু ছবি তুলে আর দাঁড়ালাম না। বেরিয়ে এলাম ওয়েস্টিন হোটেলের সামনে রাস্তায়।

          এখান থেকে আমার হোটেলের দূরত্ব প্রায় বিশ মিনিট হাঁটা। রাস্তায় মানুষজন খুব একটা নেই। হোটেলের সামনে ট্যাক্সিস্ট্যান্ড পার হয়ে একটা পার্কের মতো আছে। অন্ধকার সেখানে। পার্কের মাঝখান দিয়ে গেলে অন্তঃত আধ কিলোমিটার রাস্তা বেঁচে যায়। জোরে হাঁটতে শুরু করলাম।

          মিনিট তিনেক পরে হঠাৎ যেন মাটিফুঁড়ে উদয় হলো একজন লিকলিকে লম্বা কালো মানুষ। তার হাতে লম্বা একটা কিছু। তলোয়ার মনে করে আমি ভয়ে লাফিয়ে উঠলাম।

          সে ফিসফিস করে বললো, ওয়ানা জিরাফ?

          জিরাফ! ভালো করে দেখলাম। আবছা আলোয় তার হাতে ধরা কাঠের জিরাফ তলোয়ারের মতো লাগছে। কালো শরীরে তার সাদা দাঁতগুলো জ্বলজ্বল করছে।

          "ওয়ানা জিরাফ ম্যান?"

          একেবারে মুখের সামনে দোলাতে লাগলো হাতের লম্বা জিনিস। ভয়ে আমার হৃৎপিন্ড লাফাতে শুরু করেছে।

     থ্যাংক ইউ। আই ডোন্ট ওয়ান্ট। বলে প্রায় ছুটে চললাম। নিজের অজান্তেই দৌড়াতে শুরু করেছি। আমি দৌড়াচ্ছি দেখে সেও দৌড় দিলো। তার সাথে আমার পারার কথা নয়। সে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো, হ্যাই ম্যান, স্টপ রানিন, আই নট আ থিপ, আই নট আ থিপ।

     আমি চোর নই, আমি চোর নই বলে পেছনে সে দৌড়াচ্ছে, আর আমি তার ভয়ে দৌড়াচ্ছি তার সামনে সামনে। সে যেভাবে চোর নই, চোর নই করছে তাতে লোকে না আবার চোর চোর' শুনে আমাকেই চোর মনে করে।

          প্রায় দুশ' মিটার রাস্তা পার্কের ভেতর দিয়ে দৌঁড়ে রাস্তায় উঠলাম। পেছনের জিরাফ বিক্রেতা অবশ্য ততক্ষণে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এত লম্বা দৌড় অনেকদিন দৌড়াইনি। মনে হচ্ছে রাস্তায় পড়ে যাবো।

          সমারসেট রোডে এসে একটা বেঞ্চ পেয়ে প্রায় শুয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ পর শ্বাসপ্রশ্বাস একটু স্বাভাবিক হবার পর হোটেলের পথ ধরলাম। খাওয়ার পর পর এতটা দৌড়ানো উচিত হয়নি।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts