চতুর্থ
অধ্যায়
শুক্র গ্রহের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সূর্য ও তার গ্রহগুলোর উৎপত্তি সম্পর্কে আমরা একটু আগেই আলোচনা করেছি (পৃষ্ঠা ২৫-৩৩)। গ্যালাক্সির নেবুলায় লক্ষ লক্ষ সূর্যের সাথে আমাদের সূর্যও যখন গঠিত হলো তখন তার উপাদানের কিছু অবশিষ্ট অংশ থেকে উৎপন্ন হয়েছে সূর্যের গ্রহগুলো। ভারী, কঠিন এবং বেশি ঘনত্বের গ্রহ হিসেবে সূর্যের দ্বিতীয় গ্রহ শুক্র এবং তৃতীয় গ্রহ পৃথিবী গঠিত হয়েছে। প্রায় একই সময়ে গঠিত হয়েছে বলে পৃথিবী ও শুক্র গ্রহের বয়স সমান; প্রায় ৪৬০ কোটি বছর।
শুক্র ও পৃথিবীর আকার ও আয়তন প্রায়
সমান। প্রায় একই সময়ে জন্ম এবং দুটো গ্রহকে দেখতে একই রকমের মনে হয় বলে শুক্র ও
পৃথিবীকে টুইন সিস্টার্স বলা হতো। কিন্তু পৃথিবীর বিবর্তন যেভাবে হয়েছে শুক্র
গ্রহের বিবর্তন হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত গতিতে। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন
যে শুক্র গ্রহে এক সময় প্রচুর পানি ছিল। কিন্তু দ্রুতই সেই পানির সমুদ্র শুকিয়ে
গেছে। পানি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বিবর্তনের গতি গেল বন্ধ হয়ে। পৃথিবীর মতো
কোন টেকটোনিক প্লেট গঠিত হতে পারেনি শুক্র গ্রহে। জৈব বিবর্তন ঘটেনি। ফলে
বায়ুমন্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করার মত কিছু না থাকাতে শুক্রের বায়ুমন্ডল
ভর্তি হয়ে আছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ঘন আবরণে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মেঘের কারণে
গ্রহটি প্রচন্ড গরম। বাইরের গ্যাসের স্তরে আলো প্রতিফলিত হয়ে শুক্র গ্রহকে একটি
উজ্জ্বল গ্রহে পরিণত করেছে।
এই গ্রহের বাকি ইতিহাস হলো
মানুষের ইতিহাস। এই গ্রহটিকে মানুষ কীভাবে দেখেছে, কীভাবে জেনেছে তার ইতিহাস। চলো
দেখি গত সাড়ে তিন হাজার বছরে মানুষ ও শুক্র গ্রহের মধ্যে কী কী প্রধান ঘটনা ঘটেছে।
3600 বছর
আগে
ব্যবিলনিয়ার[1]
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা শুক্র গ্রহের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছিলেন বলে তাদের পুরনো
রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে।
3500 বছর
আগে
ব্যবিলনিয়রা
শুক্র গ্রহকে আকাশের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে।
2700 বছর আগে
গ্রিকরা
ভোরে সূর্যোদয়ের আগে যে শুক্র গ্রহকে দেখা
যায় আর সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের সময় যে শুক্রকে দেখা যায় তাদের আলাদা আলাদা দুটো নক্ষত্র
বলে মনে করেছিল। তারা ভোরেরটার নাম দিয়েছিল ফসফরাস (phosphorus), সন্ধ্যারটার নাম দিয়েছিল হেস্পারাস (hesperus)।
2500 বছর আগে
গ্রিক
দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ পাইথাগোরাস (Pythagoras)
ধারণা দেন যে ফসফরাস ও হেস্পারাস আসলে একই বস্তু যা পৃথিবী ও সেই বস্তুর ঘূর্ণনের
কারণে একবার ভোরে দেখা যায় এবং আবার সন্ধ্যায় দেখা যায়।
2000 বছর আগে
চীনা
দার্শনিকরা শুক্র গ্রহকে নক্ষত্র মনে করে। উজ্জ্বলতার কারণে তারা এই নক্ষত্রের নাম
দেয় মেটাল স্টার বা ধাতব নক্ষত্র।
বিজ্ঞানী গ্যালিলিও
তাঁর টেলিস্কোপের সাহায্যে শুক্র গ্রহের বিভিন্ন দশা পর্যবেক্ষণ করেন। চাঁদের মত
শুক্র গ্রহও যে সময়ের সাথে বিভিন্ন দশা প্রাপ্ত হয়, পৃথিবীর আকাশে তার আকারের
পরিবর্তন হয় গ্যালিলিও তা সর্বপ্রথম পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্রকাশ করেন।
জার্মান বিজ্ঞানী
জোহানেস কেপলার সর্বপ্রথম ট্রানজিট অব ভেনাসের ধারণা দেন। এর আগে গ্যালিলিও ধারণা
দিয়েছেন যে গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। পৃথিবী যেমন সূর্যের চারপাশে
ঘুরছে, শুক্র গ্রহও সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে শুক্র গ্রহ যখন
পৃথিবী ও সূর্যের সাথে এক লাইনে চলে আসে তখন তাকে ট্রানজিট অব ভেনাস বলে। তিনি
হিসেব করে দেখিয়েছিলেন যে 1631 সালে শুক্র গ্রহের
ট্রানজিট ঘটবে। কিন্তু তিনি হিসেব করতে ভুল করেছিলেন। তিনি বুঝতে পারেননি যে সেই
ট্রানজিট ইওরোপ থেকে দেখা যাবে না।
1639
আবার
ট্রানজিটের জন্য অপেক্ষা করতে হয় প্রায় একশ বছরের বেশি।
ইতালির
জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওভান্নি ডোমেনিকো ক্যাসিনি (Giovanni Domenico Cassini) দাবি করেন যে তিনি শুক্র গ্রহের একটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেছেন। পরে অবশ্য
দেখা যায় যে শুক্র গ্রহের কোন উপগ্রহ নেই।
1961
রাশিয়ান
মহাকাশযান ভেনেরা-1 (Venera-1) শুক্র গ্রহের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিন্তু শুক্র গ্রহে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।
1962
আমেরিকার
মহাকাশযান ম্যারিনার-2 শুক্র
গ্রহের পাশ দিয়ে উড়ে যায় এবং সেখান থেকে শুক্র গ্রহের বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করে।
1966-1969
রাশিয়ান মহাকাশযান
ভেনেরা-3, 4, 5, & 6 শুক্রগ্রহের পাশ দিয়ে উড়ে গিয়ে শুক্র গ্রহ
সম্পর্কে অনেক তথ্য পাঠায়।
1970
রাশিয়ান মহাকাশযান
ভেনেরা-7 প্রথমবারের মত সফলভাবে শুক্র গ্রহে
অবতরণ করে।
1975
রাশিয়ান
নভোযান ভেনেরা-9 শুক্র গ্রহ থেকে সরাসরি পৃথিবীতে ছবি পাঠাতে
সক্ষম হয়।
1978
পাইওনিয়ার ভেনাস প্রজেক্টের আওতায় আমেরিকা দুটো নভোযান
পাঠায় শুক্র গ্রহে।
1990
আমেরিকার মহাকাশযান ম্যাগেলান (Magellan) শুক্র গ্রহের ভূমিতে জরিপ চালায় এবং শতকরা 98 ভাগ ভূমির উপরিতলে কী কী আছে তা রেকর্ড করে।
1998-99
মহাকাশযান ক্যাসিনি-হাইগেন্স শুক্রের পাশ দিয়ে যায় এবং শুক্র সম্পর্কে
তথ্য সংগ্রহ করে।
2006
ইওরোপিয়ান
স্পেস এজেন্সির মহাকাশযান ভেনাস এক্সপ্রেস শুক্রগ্রহে গিয়ে পৌঁছায়।
2010
জাপান
মহাকাশ গবেষণা সংস্থার মহাকাশযান আকাৎসুকি (Akatsuki)
এবং ইকারোস (Ikaros) শুক্র গ্রহের পাশ দিয়ে উড়ে যায়।
2015
ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির মহাকাশযান ভেনাস এক্সপ্রেসের কার্যক্রম শেষ হয়। জাপানি মহাকাশযান আকাৎসুকি শুক্র গ্রহের চারপাশে ঘুরতে শুরু করে।
দেখা
যাচ্ছে শুক্র গ্রহ সম্পর্কে সব ধরনের বৈজ্ঞানিক তথ্য পাওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা কাজ
করে যাচ্ছেন অনেক অনেক বছর ধরে। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে স্বয়ংনিয়ন্ত্রিত
মহাকাশযান এখন দূর দূরান্তের গ্রহগুলোতে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞানের এরকম
উৎকর্ষতারও অনেক আগে বিজ্ঞানীরা মহাকাশের নক্ষত্র ও তাদের গ্রহ-উপগ্রহগুলোর গতি,
কক্ষপথ, প্রতিফলিত আলোকরশ্মির ধর্ম ইত্যাদি পরীক্ষা করতে করতে গ্রহগুলোর অনেকগুলো
ভৌত ধর্ম এবং মৌলিক তথ্য আবিষ্কার করেন।
সৌরজগতের গ্রহগুলোর গতি এবং কক্ষপথ
বুঝতে হলে আমাদের জানা দরকার কেপ্লারের সূত্রগুলো। দেখা যাক এই সূত্রগুলো কী কী।
No comments:
Post a Comment