Tuesday, 10 November 2020

যে গ্রহে সূর্য উঠে পশ্চিম দিকে - পর্ব ১৩

 


অষ্টম অধ্যায়

শুক্রের বায়ুমন্ডল

শুক্র আমাদের পৃথিবীর নিকটতম গ্রহ হলেও, শুক্রের আয়তন ভর পৃথিবীর কাছাকাছি হলেও শুক্রের বায়ুমন্ডলের সাথে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কোন মিল নেই। সাড়ে চার কোটি বছর আগে জন্মের সময় শুক্র পৃথিবীর পরিবেশ হয়তো একই রকম ছিল। কিন্তু তারপর দুই গ্রহের বিবর্তন হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে।

     শুক্র গ্রহের বায়ুমন্ডল এতটাই পুরু এবং ভারী যে এর বায়ুমন্ডলের চাপ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের চাপের 90 গুণ। সূর্যের কাছের গ্রহ হওয়ার কারণে শুক্র পৃথিবীর চেয়েও অনেক বেশি সূর্যালোক পায়। কিন্তু শুক্রের ঘন বায়ুমন্ডলের কারণে সেই সূর্যালোকের শতকরা মাত্র তিন ভাগ শক্তি শুক্রের মাটিতে এসে পৌঁছায়। বেশির ভাগ সূর্যালোক বায়ুমন্ডলের বাইরের স্তরে প্রতিফলিত হয়ে যায় - ফলে দূর থেকে এই গ্রহটিকে খুবই উজ্জ্বল দেখায়। শুক্রের ভূমির উপরে প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুমন্ডল।

     শুক্র গ্রহের ভূমি থেকে 20-25 কিলোমিটার পর্যন্ত বাতাস স্বচ্ছ। শুক্রে ভূমির সমতলে বাতাস প্রায় স্থির বলা চলে। বাতাসের বেগ ঘন্টায় 10 কিলোমিটারের বেশি নয় সেখানে। কিন্তু তাপমাত্রা প্রায় 500 ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। বাতাসের চাপ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের চাপের 90 গুণ। শুক্রের বায়ুমন্ডলের মোট ভরের শতকরা 90 ভাগ এই নিচের ভূমি-সংলগ্ন স্তরের ভর। এখানে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ শতকরা 96 ভাগেরও বেশি।

 

চিত্র 49: শুক্রের বায়ুমন্ডল

 

ভূমি থেকে যতই উপরের দিকে উঠবে, বায়ুর চাপ কমতে থাকবে, এবং তাপমাত্রাও কমতে থাকবে। শুক্রের ভূমি থেকে প্রায় 50 কিলোমিটার উপরে বাতাসের চাপ পৃথিবীপৃষ্ঠে বায়ুমন্ডলের চাপের সমান [চিত্র 49] সেখানে তাপমাত্রাও প্রায় পৃথিবীর তাপমাত্রার মতোই। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আস্তরণের পর সালফিউরিক এসিডের পাতলা স্তর ভূমির 25 থেকে 50 কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। তার উপরে সালফিউরিক এসিডের ঘন মেঘের আস্তরণ প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তরে তাপমাত্রা খুবই কম, প্রায় -45 ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই উপরের স্তরে বাতাসের বেগ অত্যন্ত বেশি; ঘন্টায় প্রায় 350 কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

     শুক্র গ্রহের মেঘের চলাচলের কারণ হলো তাপ। সূর্যের তাপে বাতাসের গ্যাসীয় উপাদান দ্রুত গরম হয়ে যায়। গরম বাতাস উপরের দিকে যেখানে তাপমাত্রা কম সেদিকে উঠে যায়। শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য উপরের ঠান্ডা গ্যাসীয় মেঘ নিচে চলে আসে। এভাবে অনবরত চলতে থাকে।

 

চিত্র 50: শুক্র গ্রহকে ঘিরে আছে সালফিউরিক এসিডের ঘন মেঘের আস্তরণ। পাইওনিয়ার ভেনাস অরবিটার থেকে তোলা ছবি।

 


শুক্রের বায়ুমন্ডলের রাসায়নিক উপাদান

 

শুক্রের বায়ুমন্ডলের রাসায়নিক উপাদানগুলো নিচের সারণিতে দেয়া হলো:

 

শুক্র গ্রহের বায়ুমন্ডলের রাসায়নিক উপাদান

উপাদান

পরিমাণ

কার্বন ডাইঅক্সাইড CO2

96.5%

নাইট্রোজেন N2

3.5%

হাইড্রোক্লোরিক এসিড HCl

0.4 ppm*

হাইড্রোফ্লোরাইড HF

0.01 ppm

হাইড্রোজেন সালফাইড H2S

0.8%

সালফার ডাইঅক্সাইড SO2

150 ppm

পানি H2O

100 ppm

আর্গন Ar

70 ppm

কার্বন মনোক্সাইড CO

40 ppm

অক্সিজেন O2

20 ppm

নিয়ন Ne

5 ppm

ক্রিপ্টন Kr

 4 ppm

*ppm = parts per million. 1 ppm = 0.000001

শুক্রের বায়ুমন্ডলের গ্যাসের মধ্যে অনবরত রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটছে। বিক্রিয়ার ফলে শুক্রের বাতাসে তৈরি হচ্ছে সালফিউরিক এসিডসহ আরো সব বিষাক্ত রাসায়নিক। বায়ুমন্ডলের উপরের স্তরে যেখানে বাতাসের বেগ অনেক বেশি সেখানে  সালফার ডাইঅক্সাইডের (SO2) সাথে সূর্যের আলোর বিক্রিয়ায় তৈরি হয় সালফিউরিক এসিড (H2SO4)। আবার যেখানে বাতাসের বেগ খুব কম সেখানে বেশ কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে সালফিউরিক এসিড তৈরি হয়। শুক্রের ভূমির উপরিতলে আছে আয়রন সালফেট (FeS2)। জলীয় বাষ্প ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের সাথে তার বিক্রিয়ায় তৈরি হয় কার্বন অক্সিসালফাইড (COS) ও হাইড্রোজেন সালফাইড (H2S)। কার্বন অক্সিসালফাইড ও হাইড্রোজেন সালফাইড মিশে হয় সালফিউরিক এসিড। বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প অনবরত এই বিক্রিয়ায় সাহায্য করছে। বায়ুমন্ডলের নিচের স্তরে সালফিউরিক এসিড ভেঙে তৈরি হচ্ছে সালফার ট্রাই অক্সাইড।

 

শুক্রের তাপমাত্রা ও গ্রিনহাউজ ইফেক্ট

 

চিত্র 51: শুক্রে গ্রিনহাউজ ইফেক্ট

 

শুক্রের গড় তাপমাত্রা 464 ডিগ্রি সেলসিয়াস। সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে শুক্রের তাপমাত্রাই সবচেয়ে বেশি। বুধ সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ হওয়া সত্ত্বেও বুধের গড় তাপমাত্রা শুক্রের গড় তাপমাত্রার চেয়ে কম। শুক্রের তাপমাত্রা এত বেশি হওয়ার কারণ কী? কারণ গ্রিনহাউজ ইফেক্ট।

            শুক্রের বায়ুমন্ডলের সালফিউরিক এসিডের ঘন মেঘের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো খুব বেশি আসতে পারে না।  মেঘের স্তর ভেদ করে যেটুকু সূর্যালোক তাপ শুক্রের ভূমিতে আসে, তাতে শুক্রের ভূমি উত্তপ্ত হয়। শুক্রের ভূমি থেকেও নির্গত হয় ইনফ্রারেড বা অবলোহিত রশ্মি। ইনফ্রারেড রে এবং তাপের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সূর্যের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে বেশি। শুক্রের বাতাসের শতকরা 96.5% কার্বন ডাইঅক্সাইড। এই কার্বন ডাইঅক্সাইডের ভেতর দিয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো যেতে পারলেও বেশি তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের তাপ ইনফ্রারেড রে যেতে পারে না। ফলে তারা বায়ুমন্ডলের নিচের স্তরে আটকে পড়ে। তাপ নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা না থাকাতে শুক্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা শুধুই বাড়ছে।

    

শুক্রের বায়ুমন্ডলে অভিকর্ষ তরঙ্গ

 

চিত্র 52: শুক্রে অভিকর্ষ তরঙ্গ

 

শুক্রের চারপাশে ঘুরছে জাপানি নভোযান আকাৎসুকি। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে আকাৎসুকি শুক্র গ্রহের বায়ুমন্ডলে প্রায় দশ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ অভিকর্ষ তরঙ্গ (gravity wave) পর্যবেক্ষণ করে। উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে শুক্র গ্রহের এক মেরু থেকে অন্য মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল একটি অভিকর্ষ তরঙ্গ। এর আগেও শুক্র গ্রহে অভিকর্ষ তরঙ্গ দেখা গেছে। কিন্তু এবারের তরঙ্গটির দৈর্ঘ্য ছিল আগেরগুলোর চেয়ে অনেক বড়। অভিকর্ষ তরঙ্গ হলো গ্রহের অভিকর্ষ বল বা মাধ্যাকর্ষণ বলের টানে বায়ুমন্ডলে যে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। এগুলোকে আবার মহাকর্ষ তরঙ্গ বা গ্র্যাভিটেশানাল ওয়েভ (gravitational wave) মনে করো না। Gravitaional wave উৎপন্ন হয় মহাবিশ্বের কোথাও যদি কোন নক্ষত্র বিস্ফোরণের মতো বিশাল কিছু ঘটে তখন স্পেস-টাইম বা স্থান-কালের যে পরিবর্তন হয় সেখান থেকে। অভিকর্ষ তরঙ্গ সব গ্রহেই সৃষ্টি হয় গ্রহের অভিকর্ষ বলের কারণে। শুক্র গ্রহের ভারী আবহাওয়ার কারণে এই তরঙ্গ ভালোভাবে দেখা গেছে।

 

 

শুক্রের অভ্যন্তরীণ গঠন

পৃথিবী ও শুক্রের বাহ্যিক গঠনের মধ্যে কিছুটা মিল আছে। দুটো গ্রহের আকার ও ভর কাছাকাছি হবার কারণে এই দুটো গ্রহের অভ্যন্তরীণ গঠন একই রকম হতে পারে এরকম ধারণা কেউ কেউ করেছেন। কিন্তু শুক্র ও পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন[1] হুবহু এক রকম নয়। শুক্র ও পৃথিবীর মধ্যে যে পার্থক্যগুলো আছে সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। শুক্রের ভর ও ঘনত্ব পৃথিবীর ভর ও ঘনত্বের চেয়ে কম। শুক্রের চুম্বকত্বের পরিমাণ নগণ্য। চুম্বকত্ব না থাকার অর্থ হচ্ছে শুক্রের কেন্দ্র বা ইনার কোরের (inner core) কোন চলাচল বা ঘূর্ণন নেই। কারণ পৃথিবীর ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি অন্তকেন্দ্রের বাইরে একটি তরল অংশ আছে যেখানে কঠিন অন্তকেন্দ্রটি ঘুরে। এই ঘুর্ণনের ফলেই পৃথিবীর চুম্বকত্বের সৃষ্টি হয়েছে। শুক্র নিজের অক্ষের উপর খুবই আস্তে আস্তে ঘুরে। এবং অন্যান্য গ্রহগুলো যেদিকে ঘুরে শুক্র ঘুরে তার বিপরীত দিকে। এটাও শুক্রে চুম্বকত্ব না থাকার আরেকটা কারণ হতে পারে। পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন আমরা ভালোভাবে জানতে পেরেছি ভূমিকম্পের তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে। শুক্র গ্রহে যেসব স্যাটেলাইট পাঠানো হয়েছে সেগুলোর কোনটাই শুক্র গ্রহের কোন ভূমিকম্পের প্রমাণ পায়নি। শুক্রের ভুমি এবং বায়ুমন্ডলের উপর থেকে সংগৃহীত হাজার হাজার ডাটা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা শুক্রের অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে একটা গ্রহণযোগ্য মডেল দাঁড় করিয়েছেন।

 

 

চিত্র 53: শুক্র গ্রহের অভ্যন্তরীণ গঠন


শুক্র গ্রহ পৃথিবীর তুলনায় অনেক বেশি গোলাকার। পৃথিবীর যেরম উত্তর দক্ষিণ মেরুর দিকে একটু চাপা, শুক্রের সেরকম নয়। শুক্রের ব্যাসার্ধ 6,052 কিলোমিটার। এই ছয় হাজার কিলোমিটারের প্রায় অর্ধেক ব্যাসার্ধের একটি কঠিন ভারী অন্তকেন্দ্র বসে আছে শুক্রের কেন্দ্রে। শুক্রের অন্তকেন্দ্রের ব্যাসার্ধ 2,900 কিলোমিটার। এর প্রধান উপাদান লোহা নিকেল। শুক্র গ্রহের মোট ভরের শতকরা 90 ভাগেরও বেশি দখল করে আছে এই অন্তকেন্দ্র। ধারণা করা হচ্ছে অন্তকেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় পাঁচ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুক্রের কেন্দ্রের তাপমাত্রা নির্ণয় করা অনেক কঠিন। কারণ শুক্রে কোন টেকটোনিক প্লেটের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার মানে শুক্র পুরোটাই একটা সলিড গোলক। সেখান থেকে পরিচলন পদ্ধতিতে তাপ প্রবাহিত হওয়ার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি এখনো।

            অন্তকেন্দ্রের বাইরে আছে সিলিকেটের ম্যান্টল। এই স্তরের পুরুত্ব প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার। এর তাপমাত্রা অনেক বেশি - ফলে এখানকার পদার্থগুলো গলে গিয়ে একটা আরেকটার সাথে লেগে গেছে।

            ম্যান্টলের বাইরের স্তর হলো শুক্র গ্রহের ভূমির স্তর বা ক্রাস্ট। এই ক্রাস্টের পুরুত্ব  10 থেকে 30 কিলোমিটারের মধ্যে।  ভেনেরা মিশনের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে শুক্র গ্রহের ভূমির উপরের স্তরের মাটির উপাদান সিলিকেট গ্রানাইট। পৃথিবীর উপরের স্তরের গঠন যেরকম জটিল; বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের, শুক্রগ্রহের উপরের স্তরের উপাদানের গঠন সে তুলনায় অনেক সরল।

 

সারণি: শুক্রের অভ্যন্তরীণ গঠন

স্তর

প্রধান উপাদান

পুরুত্ব

ক্রাস্ট

সিলিকেট

10 - 30 কিলোমিটার

ম্যান্টল

সিলিকেট

3,000 কিলোমিটার

কোর বা অন্তকেন্দ্র

লোহা ও নিকেল

2,900 কিলোমিটার

ব্যাস প্রায় 5800 কিলোমিটার



[1] পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ো প্রদীপ দেবের 'পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ', মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৬। 

পর্ব - ১৪

No comments:

Post a Comment

Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts