চতুর্থ
অধ্যায়
মঙ্গলের অভ্যন্তরে
মঙ্গলগ্রহে পাঠানো স্যাটেলাইট ও রোভারগুলো যে সব তথ্য ও
উপাত্ত পাঠিয়েছে তা থেকে মঙ্গল গ্রহের গঠন সম্পর্কে আমরা অনেককিছু জানতে পেরেছি।
এবার চলো দেখি মঙ্গল গ্রহের অভ্যন্তরীণ গঠন কী রকম। সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে পৃথিবী
গঠিত হবার সময়েই সূর্যের অন্যান্য গ্রহের মত মঙ্গল গ্রহও গঠিত হয়েছে। গ্যালাক্সির
ঘূর্ণায়মান নেবুলাতে গ্রহগুলো গঠিত হবার সময় নেবুলার কৌণিক ভরবেগ সঞ্চালিত হয়েছে
গ্রহগুলির মধ্যে। প্রচন্ড বেগে ঘুরতে ঘুরতে গ্রহগুলোর আকার হয়েছে গোলাকার। উৎপন্ন
হওয়ার সময় প্রচন্ড গরম এবং নরম ছিল গ্রহগুলোর দেহ। সেই সময় অপেক্ষাকৃত ভারী
মৌলগুলো চলে গেছে গ্রহের ভেতরের দিকে, আর হালকা মৌলগুলো রয়ে গেছে গ্রহের উপরের
স্তরগুলোতে। এভাবেই সৌরজগতের চারটি কঠিন গ্রহ - বুধ, শুক্র, পৃথিবী ও মঙ্গলের
কেন্দ্রে রয়েছে কঠিন কোর বা অন্তকেন্দ্র, আর উপরিস্তরে রয়েছে পাতলা ক্রাস্ট। কোর ও
ক্রাস্টের মাঝখানের স্তর অপেক্ষাকৃত হালকা পদার্থের তৈরি ম্যান্টল। গ্রহের আকার
অনুযায়ী এই স্তরগুলোর পুরুত্ব ও ঘনত্বের পার্থক্য দেখা যায়।
মঙ্গলের ভূমির স্তর
মঙ্গল গ্রহের একেবারে কেন্দ্রে আছে কঠিন কোর (core) বা অন্তকেন্দ্র, যার ব্যাসার্ধ ১,৭৯৪ কিলোমিটার। এই
কোরের শতকরা ৮৩ থেকে ৮৪ ভাগ লোহা ও নিকেল, বাকি ১৬ থেকে ১৭ ভাগ সালফার। আয়রন
সালফাইড আংশিক তরল। পৃথিবীর অন্তকেন্দ্রে যে পরিমাণ হালকা পদার্থ আছে, মঙ্গলের
অন্তকেন্দ্রে হালকা পদার্থ আছে তার দ্বিগুণ। ফলে পৃথিবীর অন্তকেন্দ্রের চেয়ে
মঙ্গলের অন্তকেন্দ্রের ঘনত্ব কিছুটা কম।
চিত্র:
মঙ্গল গ্রহের অভ্যন্তরীণ গঠন
অন্তকেন্দ্রের বাইরে রয়েছে প্রায় ১৪৭৭ কিলোমিটার পুরু
সিলিকেটের স্তর - ম্যান্টল। এই ম্যান্টল এক সময় খুবই সক্রিয় ছিল। এখানেই ছিল
টেকটোনিক প্লেট। মঙ্গলের ভূমির উপরিস্তরে টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট
পাহাড়-পর্বত এবং খাঁজ ও খাদের প্রমাণ আছে। মঙ্গল গ্রহের এই স্তর থেকেই ঘটেছিল
আগ্নেয়গিরি - যার লাভাস্রোতের চিহ্নও দেখা যায় মঙ্গলের ভূমিতে। ধারণা করা হচ্ছে
মঙ্গলের ম্যান্টলে এখন আর ভূতাত্ত্বিক সক্রিয়তা নেই।
চিত্র:
মঙ্গলের ভূমিতে গ্রহাণু বা উল্কাপিন্ডের আঘাতে সৃষ্ট গহ্বর
মঙ্গলের উপরিস্তর ক্রাস্টের গড় পুরুত্ব ৫০ কিলোমিটার।
কোন কোন জায়গায় এই ক্রাস্ট প্রায় ১২৫ কিলোমিটার পুরু, আবার কোন কোন জায়গায় ৩০
কিলোমিটারেও কম। মঙ্গলের ক্রাস্ট পৃথিবীর ক্রাস্টের তুলনায় অনেক বেশি পুরু। মঙ্গলের
ক্রাস্টের উপাদানের মধ্যে আছে লোহা, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম, এবং
পটাসিয়াম। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন মঙ্গল গ্রহের মোট গাঠনিক উপাদানের শতকরা
৪৩.৯ ভাগ সিলিকন ডাই-অক্সাইড (SiO2) বা সিলিকা, অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড (Al2O3) ৩.১৫ ভাগ, ফেরাস অক্সাইড (FeO) ১৮.৮ ভাগ, ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড (MgO) ৩১.৬৬ ভাগ, ও
ক্যালসিয়াম অক্সাইড (CaO) ২.৫ ভাগ।
মঙ্গলের চুম্বকত্ব
মঙ্গল গ্রহে কোন চৌম্বকক্ষেত্র পাওয়া যায়নি। মঙ্গল
মিশনগুলোর পাঠানো তথ্য থেকে জানা গেছে যে প্রায় ৩৮০ কোটি বছর আগে মঙ্গল গ্রহে
চৌম্বকত্ব ছিল। পৃথিবীর একেবারে কেন্দ্রে বা অন্তকেন্দ্রে আছে
প্রায় চাঁদের সমান আয়তনের একটা বিশাল লোহার গোলক। এটার তাপমাত্রা প্রায় ৫৫০০
ডিগ্রি সেলসিয়াস। এত তাপে কোন স্থায়ী চুম্বক তৈরি হতে পারে না। তাই লোহার বলটা
চুম্বক নয়। কিন্তু এই লোহার বলকে ঘিরে রয়েছে আউটার কোর বা বহিকেন্দ্র। সেখানে আছে
লোহার তরল (অনেকটা ঘন কাদার মতো)। পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে এই তরলেও একটা স্রোত তৈরি
হয়েছে - যার ফলে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সৃষ্টি হচ্ছে। বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবাহিত হলে তাকে
ঘিরে চুম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়। পৃথিবীর কেন্দ্রেও তাই হয়েছে। পৃথিবী পরিণত হয়েছে
একটা বিরাট আকারের চুম্বকে। পৃথিবীর মত মঙ্গল গ্রহেরও চৌম্বকত্ব থাকার অর্থ হচ্ছে
মঙ্গল গ্রহের অন্তকেন্দ্রের বাইরে একটি তরল স্তর ছিল। কিন্তু মঙ্গল গ্রহের
তাপমাত্রা হঠাৎ কমে গিয়ে সেই তরল স্তরটা শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। ফলে মঙ্গল গ্রহের
অন্তকেন্দ্রের ঘূর্ণন বন্ধ হয়ে যায়, মঙ্গল গ্রহের চৌম্বকত্বও নষ্ট হয়ে যায়।
মঙ্গলের বায়ুমন্ডল
মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ বলের মান পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের
মাত্র ৩৮%। পৃথিবী যে বলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলকে ভূমির দিকে টেনে রাখতে পারে মঙ্গলের
সে বল নেই। তা সত্ত্বেও মঙ্গলের গড় তাপমাত্রা কম এবং বায়ুমন্ডলের উপাদানের গড় ওজন
পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উপাদানের গড় ওজনের চেয়ে বেশি হওয়ার কারণে মঙ্গলের ভূমি থেকে
প্রায় ১০.৮ কিলোমিটার উপর পর্যন্ত
মঙ্গলের বায়ুমন্ডল বিস্তৃত। পৃথিবীর বায়ুমন্ডল কিন্তু ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫ কিলোমিটার
উপরে গেলেই শেষ। মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগ কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ৩%
নাইট্রোজেন, ১.৬% আর্গন, ১.৩%
অক্সিজেন, খুবই সামান্য পরিমাণ মিথেন ও পানির বাষ্প। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে যেসব
উপাদান আছে, মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে তার সব উপাদানই আছে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়।
ফলে সেই বাতাসে পৃথিবীর প্রাণিদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। মঙ্গল গ্রহ ও পৃথিবীর
বায়ুমন্ডলের উপাদানগুলোর পরিমাণের তুলনামূলক চিত্র নিচের সারণিতে দেয়া হলো।
সারণি:
মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডলের উপাদান
উপাদান |
মঙ্গল গ্রহে পরিমাণ (%) |
পৃথিবীতে পরিমাণ (%) |
কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO2) |
৯৫ |
৩৪৫ পিপিএম* |
নাইট্রোজেন (N2) |
২.৭ |
৭৮.০৮ |
আর্গন (Ar) |
১.৬ |
০.৯৩ |
অক্সিজেন (O2) |
১.৩ |
২০.৯৫ |
কার্বন-মনোক্সাইড (CO) |
৭০০ পিপিএম |
১০০ পিপিবি** |
পানির বাষ্প (H2O) |
৩০০ পিপিএম |
০.৩ থেকে ০.৪ পিপিএম |
নিয়ন (Ne) |
২৫ পিপিএম |
১৮ পিপিএম |
ক্রিপটন (Kr) |
০৩ পিপিএম |
১ পিপিএম |
জিনন (Xe) |
০০৮ পিপিএম |
১ পিপিটি*** |
ওজোন (O3) |
০১ পিপিএম |
০ থেকে ১২
পিপিএম |
*পিপিএম - পার্ট পার মিলিয়ন
**পিপিবি - পার্ট পার বিলিয়ন
***পিপিটি - পার্ট পার ট্রিলিয়ন
মঙ্গলের তাপমাত্রা
মঙ্গল গ্রহের গড় তাপমাত্রা মাইনাস ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু মঙ্গলের কক্ষপথ এমন উৎকেন্দ্রিক যে সূর্যের চারপাশে ঘুরার সময় সূর্য থেকে গ্রহটির দূরত্ব অনেক বেশি বাড়ে কমে। ফলে তার তাপমাত্রাও খুব বদলে যায়। যখন সূর্যের খুব কাছে আসে তখন মঙ্গলের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যায়, আবার যখন সূর্য থেকে অনেক দূরে চলে যায়, সূর্যের আলো ঠিকমত পায় না, তখন সেদিকে গ্রহের তাপমাত্রা কমে গিয়ে শূন্যের নিচে আরো ১৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে।
মঙ্গলের বায়ুচাপ
মঙ্গলের গড় বায়ুচাপ পৃথিবীর তুলনায় খুবই কম।
সমুদ্রপৃষ্ঠে পৃথিবীর গড় বায়ুচাপ যেখানে ১০১.৩
কিলোপ্যাসকেল, সেখানে মঙ্গলের গড় বায়ুচাপ মাত্র ৬০০ প্যাসকেল বা ০.৬ কিলোপ্যাসকেল যা পৃথিবীর চেয়ে ১৪০ গুণ কম। বায়ুচাপ মাপার আন্তর্জাতিক
একক হলো প্যাসকেল, আর ব্যবহারিক একক হলো মিলিবার। ১ বার = ১০০ কিলোপ্যাসকেল। ১
মিলিবার = ১০০ প্যাসকেল। মঙ্গলের সর্বোচ্চ স্থান অলিম্পাস মন্স-এর চূড়ায় বায়ুচাপ
সবচেয়ে কম, মাত্র ৩০ প্যাসকেল। যেখানে পানি শুধুমাত্র থাকতে পারে কঠিন অবস্থায়,
অথবা বাষ্প আকারে। এত কম চাপে পানি তরলে পরিণত হতে পারে না। আবার দক্ষিণ গোলার্ধের
হেলাস অববাহিকার সবচেয়ে গভীর স্থানে বায়ুচাপ সবচেয়ে বেশি, ১,১৫৫ প্যাসকেল। এখানে
কোন কোন জায়গায় তরল পানি থাকা অসম্ভব নয়, কারণ তাপমাত্রা বাড়লে এই চাপে পানি তরল
আকারে থাকতে পারে। পানির ট্রিপল পয়েন্টে পানি কঠিন, তরল, কিংবা বায়বীয় - যে কোন
অবস্থায় থাকতে পারে। পানির ট্রিপল পয়েন্টের তাপমাত্রা হলো ০.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এবং বায়ুচাপ ৬০০ প্যাসকেল। মঙ্গলের গড় বায়ুচাপ
পানির ট্রিপল পয়েন্টের চাপের সমান। কিন্তু তাপমাত্রা অনেক কম বলেই মঙ্গলে
স্বাভাবিক অবস্থায় তরল পানি থাকতে পারে না। কিন্তু মঙ্গলের হেলাস বেসিনের কোন কোন
জায়গায় বায়ুচাপ ও তাপমাত্রা তরল পানি থাকার অনুকুলে।
মঙ্গলে বায়ুপ্রবাহ
মঙ্গলে স্যাটেলাইট পাঠানোর আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা প্রমাণ
পেয়েছেন যে মঙ্গলে বায়ুপ্রবাহ আছে। মঙ্গলে মাঝে মাঝে দীর্ঘদিনব্যাপী বালিঝড় বয়ে
যায়। পৃথিবী থেকে টেলিস্কোপ দিয়ে মঙ্গল পর্যবেক্ষণ করার সময় দেখা যায় বায়ুপ্রবাহের
কারণে মঙ্গলের উজ্জ্বলতার হ্রাস-বৃদ্ধি চোখে পড়ে। স্যাটেলাইট ম্যারিনার-৯ মঙ্গলের
বালিঝড়ের কবলে পড়ে। বায়ুপ্রবাহের কারণে মঙ্গলের ভূমিতে তৈরি হয়েছে অনেক বালিয়াড়ি।
চিত্র: মঙ্গলে বায়ুপ্রবাহের ফলে সৃষ্ট
বালিয়াড়ি
মঙ্গলে মেঘ
পৃথিবীর আকাশে যেমন অবিরাম মেঘের আনাগোনা চলছে, মঙ্গলের
আকাশে সেরকম নয়। মঙ্গলের বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ যদিও খুব কম, কিন্তু যেটুকু
আছে তাতেই মেঘ তৈরি হতে পারে। পৃথিবীর টেলিস্কোপ থেকে মঙ্গলের আকাশে হালকা মেঘের
আনাগোনা দেখা যায়। অলিম্পাস পর্বতের উপর থেকে এবং থারসিস ভলকানো অঞ্চলে প্রায়ই
মেঘের সৃষ্টি হয়। মেরু অঞ্চলে সমান্তরাল রেখার মত মেঘের উৎপত্তি ঘটে। নিচু এলাকায়
কুয়াশা দেখা যায়, বিশেষ করে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের সময়।
মাঝে মাঝে মঙ্গলের মিহি ধুলো থেকেও তৈরি হয় ধুলিমেঘ।
মঙ্গলের বাতাস মিহিধুলো উড়িয়ে নিয়ে যায়। তার ওপর সূর্যের আলো পড়ে মঙ্গলের আকাশ হয়ে
ওঠে গোলাপী। এই রঙের তীব্রতা নির্ভর করে বাতাসে ধুলির পরিমাণের উপর। মঙ্গলের ধুলির
কণার ব্যাস মাত্র ১.৫
মাইক্রোমিটার।
মঙ্গলের বায়ুমন্ডল যখন সূর্যালোকে উত্তপ্ত হয়, তখন
বাতাসের সাথে মিহিধুলি উড়তে থাকে। অনেক ধুলিকণা একসাথে মিশে সূর্যের আলোর প্রায়
২৫% প্রতিফলন ঘটায়। পৃথিবী থেকে এই উড়ন্ত ধুলিগুলোকে ধুলিঝড়ের মত লাগে। এপর্যন্ত
অনেকগুলো ধুলিঝড় দেখা গেছে মঙ্গলে।
চিত্র:
মঙ্গলের আকাশে মেঘের আনাগোনা
মঙ্গলে উল্কাপাত
পৃথিবীর কক্ষপথে যত ধুমকেতু আসে, তার প্রায় চারগুণ বেশি
আসে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে। তাই মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডলে প্রচুর উল্কাপিন্ড প্রবেশ
করে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে উল্কাপিন্ড প্রবেশ করার সময় বাতাসের সাথে সংঘর্ষে
উল্কাপিন্ড চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে যায়। মঙ্গল গ্রহেও একই ব্যাপার ঘটে। মঙ্গল গ্রহের
বায়ুমন্ডল পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের চেয়ে হাল্কা হলেও, মঙ্গলের বায়ুমন্ডল পৃথিবীর
বায়ুমন্ডলের চেয়ে বেশিদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বায়ুমন্ডলের সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষের ফলে
উল্কাপিন্ডগুলো ধ্বংস হয়ে যাবার সময় ধাতব কণাগুলো চার্জিত হয়ে যায়। ফলে ক্ষণস্থায়ী
প্লাজমার একটা লম্বা রেখা তৈরি হয় - যা পৃথিবীর রেডিও-টেলিস্কোপে ধরা পড়ে।
বিজ্ঞানীরা এভাবে অনেক ধুমকেতু এবং উল্কাপাত পর্যবেক্ষণ করেন।
চিত্র:
মঙ্গলের মাটিতে পাওয়া উল্কাপিন্ড 'হিট শিল্ড রক'।
ছোট ছোট উল্কাপিন্ডগুলো বায়ুমন্ডলের সাথে সংঘর্ষে
চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে মাটিতে পড়ার আগেই বাতাসে মিশে যায়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত বড়
উল্কাপিন্ডগুলোর কিছু কিছু অংশ মঙ্গলের মাটিতে নেমে আসে।
মঙ্গলের ভূমির বিবর্তন
মঙ্গলের উপরিস্তরে অসংখ্য গ্রহাণুর আঘাতের ফলে তৈরি হয়েছে
অসংখ্য গহ্বর। হিসেব করে দেখা গেছে এসব ঘটেছিল প্রায় ৩৮০ কোটি বছর আগে যখন মঙ্গল
গ্রহের ক্রাস্ট নরম ছিল। এই গ্রহাণুগুলোর কিছু এসেছে সৌরজগতের ভেতর থেকে। তবে
বেশিরভাগই এসেছে সৌরজগতের বাইরের অন্যান্য বিশাল গ্রহের সাথে সূর্যের মহাকর্ষীয়
আকর্ষণের কারণে। বুধ, শুক্র, পৃথিবী এবং চাঁদেও এরকম অসংখ্য গ্রহাণু আছড়ে পড়ে
ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির গহ্বর তৈরি করেছে। শুক্র ও পৃথিবীতে আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোত
সেই গহ্বরগুলোর বেশিরভাগ ঢেকে দিয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর চাঁদ, বুধ এবং মঙ্গলের
ক্রাস্টে সেই ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। মঙ্গল গ্রহ উষ্ণ ও আর্দ্র অবস্থা থেকে বেশ দ্রুত
ঠান্ডা হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে ৩৮০ কোটি বছর আগে অসংখ্য গ্রহাণুর আঘাতের সাথে
সাথে অসংখ্য বরফ-শীতল ধুমকেতুও আছড়ে পড়েছিল মঙ্গলের বুকে। মঙ্গল গ্রহের চারপাশে
আবর্তনরত স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি, মঙ্গলের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো রোভার এবং
ল্যান্ডার থেকে প্রাপ্ত ছবি ও অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণ করে যে ধারণা পাওয়া গেছে
তাতে গত সাড়ে চারশ কোটি বছরে মঙ্গলের গঠনের কী কী পরিবর্তন হয়েছে তার একটা
গ্রহণযোগ্য চিত্র পাওয়া যায়।
মঙ্গল
গ্রহের উত্তর মেরুতে ক্রেটারের সংখ্যা দক্ষিণ মেরুর ক্রেটারের চেয়ে অনেক বেশি।
তাছাড়া উত্তর মেরুর গহ্বরগুলোর আয়তনও দক্ষিণ মেরুর গহ্বরগুলোর আয়তনের চেয়ে বেশি।
বোঝাই যাচ্ছে উত্তর মেরুর ক্রাস্ট দক্ষিণ মেরুর ক্রাস্টের চেয়ে পুরনো। তার মানে
দক্ষিণ মেরুর ক্রাস্টে যেসব পরিবর্তন হয়েছে উত্তর মেরুর ক্রাস্টে সেরকম পরিবর্তন
ঘটেনি। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মঙ্গলের ভূমির উপরিতলের প্রায় পুরোটাই জরিপ করা হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের হাতে এখন যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে মঙ্গল গ্রহ একসময় পৃথিবীর মতই উষ্ণ এবং
আর্দ্র ছিল। তারপর প্রচুর উল্কাপাত হয়েছে সেখানে। গ্রহাণুর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে
মঙ্গলপৃষ্ঠ। অসংখ্য শীতল ধুমকেতু আছড়ে পড়েছে মঙ্গলের পিঠে। তারপর দ্রুত ঠান্ডা হতে
শুরু করেছে মঙ্গল। আগ্নেয়গিরির ফলে লাভাস্রোত এসে ভরাট করে ফেলেছে অনেকগুলো
ক্রেটার। সেখানকার ভূমি হয়ে গেছে সমতল। ভূমিতে শুকিয়ে যাওয়া চিহ্ন সেই সময়ের
সাক্ষ্য দেয়।
মঙ্গল
গ্রহের বিভিন্ন অঞ্চলের ভূমির উপাদান পরীক্ষা করে ভূমির পরিবর্তনকে চারটি
পর্যায়কালে ভাগ করা যায়:
- প্রাক-নোয়াচিস পর্যায় (Pre-Noachian
Period)
- নোয়াচিস পর্যায় (Noachian Period)
- হেস্পেরিয়া পর্যায় (Hesperian Period)
- আমাজনিস পর্যায় (Amazonian Period)
মঙ্গলের ভূমির এই পর্যায়কালগুলোর নাম দেয়া হয়েছে মঙ্গলের
ভূমিতে প্রাপ্ত ভিন্ন ভিন্ন সময়ের তিনটি অঞ্চলের নামে। নোয়াচিস (Noachis) টেরা হলো মঙ্গলের সবচেয়ে পুরনো অঞ্চল। টেরা হলো সমতল
থেকে অনেক উঁচু ভূমি। ৪১০ কোটি থেকে ৩৭০ কোটি বছর আগে এই অঞ্চল গঠিত হয়েছিল। তারপর
আর কোন পরিবর্তন সেখানে হয়নি। এই অঞ্চলের নামানুসারে নোয়াচিস পর্যায়। হেস্পেরিয়া
পর্যায়ের নাম দেয়া হয়েছে হেস্পেরিয়া প্ল্যানামের নামানুসারে। প্ল্যানাম হলো খাড়া
উঁচু সমতল ভূমি। এই প্ল্যানামের বয়স ৩৭০ কোটি থেকে ৩০০ কোটি বছরের মধ্যে। আমাজনিস
পর্যায়ের নাম দেয়া হয়েছে আমাজনিস প্ল্যানেটিয়ার নাম অনুসারে। প্ল্যানেটিয়া হলো
আশেপাশের ভূমি থেকে নিচু সমতল ভূমি। মঙ্গলে এধরনের ভূমি সৃষ্টি হয়েছে ভূমির অনেক বিবর্তনের
মধ্য দিয়ে। এটাকেই মঙ্গলের আধুনিক পর্যায় বলে মনে করা হয়। ৩০০ কোটি বছর আগে থেকে
বর্তমান পর্যন্ত বিস্তৃত আমাজনিস পর্যায়।
প্রাক-নোয়াচিস পর্যায়
বর্তমান সময় থেকে ৪৫০ থেকে ৪১০ কোটি বছর আগপর্যন্ত
সময়কালকে প্রাক-নোয়াচিস পর্যায় ধরা হয়। এই সময়ের মধ্যে উত্তর গোলার্ধ ও দক্ষিণ
গোলার্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য সৃষ্টি হয়। মঙ্গল গ্রহের উত্তর মেরুতে
ক্রাস্টের গড় পুরুত্ব ৩২ কিলোমিটার, কিন্তু দক্ষিণ মেরুতে ক্রাস্টের পুরুত্ব ৫৮
কিলোমিটার। ধারণা করা হচ্ছে উত্তর মেরুতে বিশাল আকৃতির এক গ্রহাণু - (যার আয়তন
চাঁদের আয়তনের ৬০%) এসে আঘাত হানে। ফলে উত্তরমেরু প্রায় ২৬ কিলোমিটার দেবে গিয়ে
সমতল হয়ে যায়। উত্তর মেরুর বরিয়ালিস বেসিন বা বরিয়ালিস অববাহিকার সৃষ্টি হয়েছে
এভাবে। সৌরজগতের সবচেয়ে বড় অববাহিকা এই বরিয়ালিস অববাহিকা, যার দৈর্ঘ্য ১০,৬০০
কিলোমিটার, আর প্রস্থ ৮,৫০০ কিলোমিটার। এতবড় একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মঙ্গলের আদি
বায়ুমন্ডলের বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
চিত্র:
বরিয়ালিস অববাহিকা
উত্তর মেরুতে ১০০০ কিলোমিটারের বেশি ব্যাসের ২০টির বেশি
অববাহিকা সৃষ্টি হয়েছে। খুব কম সময়ের মধ্যে এগুলো তৈরি হয়েছে। মঙ্গলের বয়স মাত্র
২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি বছর হবার আগেই ২০টার মধ্যে ১৮টা অববাহিকা সৃষ্টি হয়ে
গিয়েছিল। মঙ্গল গ্রহের আরো তিনটি প্রধান
অববাহিকা হলো: দক্ষিণ
গোলার্ধের হেলা বেসিন (ব্যাস ২৩০০ কিলোমিটার), দক্ষিণ গোলার্ধের আরগ্যার বেসিন
(ব্যাস ১৮০০ কিলোমিটার), উত্তর গোলার্ধের ইসিদিস (ব্যাস ১৫০০ কিলোমিটার)।
প্রাক-নোয়াচিস
পর্যায়ের শেষ এক কোটি বছর আগে প্রচুর গ্রহাণুঝড়ের কারণে মঙ্গলের চৌম্বকক্ষেত্র
নষ্ট হয়ে গেছে। এই চৌম্বকক্ষেত্র মহাজাগতিক রশ্মি ও সৌরঝড়ে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয়
বিকিরণ থেকে মঙ্গল গ্রহকে রক্ষা করতো। চৌম্বকক্ষেত্র নষ্ট হয়ে যাওয়াতে মঙ্গল গ্রহে
তেজস্ক্রিয় বিকিরণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে মঙ্গল
গ্রহে প্রাণ ধারণের পরিবেশ যতটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও মুছে যায়।
নোয়াচিস পর্যায়
৪১০ থেকে ৩৭০ কোটি বছর - এই চল্লিশ কোটি বছর সময়কালকে
মঙ্গল গ্রহের নোয়াচিস পর্যায় ধরা হয়। এই সময়ে মঙ্গল গ্রহ উষ্ণ ও আর্দ্র ছিল।
মঙ্গলের কিছু কিছু জায়গার ভূমি এখনো সেই সময়ের সাক্ষ্য দেয়। মঙ্গলের বিষুবরেখা
বরাবর ৯৫ ডিগ্রি পশ্চিমে ১২০ ডিগ্রি অক্ষাংশ ও ৮০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে আগ্নেয়গিরির
অগ্নোৎপাতে বিশাল এক মহাদেশ আকৃতির অঞ্চল ভূমির উপরে ফুলে উঠেছে - যার নাম দেয়া হয়েছে
থারসিস বাল্জ।
চিত্র: থারসিস বাল্জ
নোয়াচিস পর্যায়ে মঙ্গলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তরল পানিতে
পূর্ণ ছিল। তখন মঙ্গলে অনেক নদী ও সাগর সৃষ্টি হয়েছে। বিশাল হেলাস অববাহিকা সৃষ্টি
হয়েছে এই সময়ে। নোয়াচিস পর্যায়ের শেষ ভাগে বায়ুমন্ডলে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। ফলে উপরিস্তরের
পানি শুকিয়ে যায়, পানির স্তর নেমে যায় ক্রাস্টের অনেক নিচে।
হেস্পেরিয়া পর্যায়
৩৭০ থেকে ৩০০ কোটি বছর - এই ৭০ কোটি বছর সময়কালকে মঙ্গল
গ্রহের হেস্পেরিয়া পর্যায় ধরা হয়। এই সময়কালের মধ্যে মঙ্গল গ্রহের সবচেয়ে বড়
আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ ঘটে এবং সীমাহীন লাভাস্রোত ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে ভূস্তরে লাভার
সমতল স্তর তৈরি করেছে। আবার ভূস্তর ঠেলে উপরের দিকে বেরিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনেক
পাহাড়-পর্বত। মঙ্গল গ্রহে আছে সৌরজগতের সবচেয়ে উঁচু পর্বত - অলিম্পাস মন্স, যার
উচ্চতা প্রায় ২২ কিলোমিটার যা এভারেস্ট পর্বতের প্রায় তিন গুণ। এভাবে আরো সৃষ্টি
হয় অ্যালবা পর্বত, যার উচ্চতা প্রায় ৬.৮
কিলোমিটার। প্রচন্ড প্রাকৃতিক দুর্যোগে আগ্নেয়গিরির অগ্নোৎপাতে মঙ্গল গ্রহের
তাপমাত্রা এবং বায়ুচাপ বেড়ে যায়। ভয়ানক বন্যার পানিতে ডুবে যায় নিচু এলাকা।
চিত্র:
মঙ্গল গ্রহের অলিম্পাস পর্বত
আমাজনিস পর্যায়
৩০০ কোটি বছর আগে থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়কালকে আমাজনিস
পর্যায় ধরা হয়। এই তিনশ কোটি বছরে মঙ্গলে ক্রাস্টের পরিবর্তন হয়েছে অপেক্ষাকৃত
ধীরগতিতে। আগ্নেয়গিরির উৎপাত আস্তে আস্তে থেমে গেছে। তরল পানি উধাও হয়ে গেছে।
তাপমাত্রা ও বায়ুচাপ কমে গিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এই পর্যায়েই মানুষ
মঙ্গলে মহাকাশযান পাঠিয়েছে, রোভার পাঠিয়ে মঙ্গলের ভূমি জরিপ করে তৈরি করা হয়েছে
মঙ্গল গ্রহের নিখুঁত ম্যাপ।
No comments:
Post a Comment