০০
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে
আমার ছাত্রজীবন শুরু হয়েছিল ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে, শেষ হয়েছে ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে;
আজ থেকে প্রায় সাতাশ বছর আগে। আমরা ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১তম ব্যাচ। আমাদের অনার্সের
শিক্ষাবর্ষ ছিল ১৯৮৫-৮৬। সেশনজট না থাকলে আমাদের অনার্স পাস করার কথা ছিল ১৯৮৮ সালে।
কিন্তু শেষ হতে হতে ১৯৯০ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে অবরুদ্ধ।
এক বছরের মাস্টার্স শেষ হতে লাগলো আরো তিন বছর।
সাত বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনেক ঘটনাই এখন কালের নিয়মে স্মৃতি থেকে মুছে গেছে একেবারে। কিছু
কিছু অপ্রিয় স্মৃতি জোর করে মুছে ফেলেছি। কিন্তু আরো অনেক ছোট-বড় স্মৃতি ছড়িয়ে আছে
মগজের কোষে কোষে, যারা এখনো মাঝে মধ্যেই উঁকি দিয়ে আমাকে স্মৃতিকাতর করে তোলে। যেসব
দিনগুলিকে একসময় মনে হতো দুঃস্বপ্নের মতো, আজ কালের পরশে মনে হচ্ছে সেইসব দিনগুলিও
কত মধুর ছিল। এখনো কী উজ্জ্বল সেইসব দিনগুলি। মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা।
০১
ষোলশহর স্টেশন
গিজগিজ করছে এই সকালে। প্লাটফরমে পা ফেলার
জায়গা নেই। জুলাই মাসের প্রচন্ড গরম। প্লাটফরমের কিছু অংশে টিনের ছাউনি আছে। রোদের
তেজে এর মধ্যেই তাপ ছড়াচ্ছে। এই ভীড়ের মধ্যে আমার চোখ ঘুরছে পরিচিত কাউকে দেখার আশায়।
অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর মধ্যে কারা ফার্স্ট ইয়ার – সেটা একটু চেষ্টা করলেই মনে হয় বোঝা
যায়। পরিচিত কাউকে দেখলে তারা একটু বেশি রকমের উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছে। কান খুলে রাখলেই
শোনা যাচ্ছে, “তুইও কেমিস্ট্রিতে, দোস্ত!” “তুমি ইকোনমিক্সে? শৈবাল কোথায়? ফাইনার্টসে?
হাহাহা।“ শৈবাল ফাইন আর্টস-এ পড়ে শুনে হাসছে তা কিন্তু নয়। হাসার জন্যই এই হাসি। আমি
কান খাড়া করে আছি কোথাও ফিজিক্স শব্দটি উচ্চারিত হয় কি না শোনার জন্য। না, মনে হচ্ছে
কেউই এখানে ফিজিক্সে ভর্তি হয়নি, কিংবা যারা ফিজিক্সে ভর্তি হয়েছে তারা এখন থেকেই গম্ভীর
হয়ে গেছে।
“ফার্স্ট ইয়ার?”
কানের কাছে
প্রশ্নবোধক বাক্য শুনে ফিরে তাকালাম। আমারই উচ্চতার একজন ছেলে হাসিমুখে প্রশ্নটা করেছে
আমাকেই।
“জি, আপনি?“
“এত আপনি আজ্ঞে
করতে হবে না। আমিও ফার্স্ট ইয়ার। ফিজিক্সে।“
“ফি-জি-ক্স”
– মনে হচ্ছে অঘটন আজো ঘটে।
“আমিও ফিজিক্সে।
আমার নাম প্রদীপ।“
“আমি কফিল।
তুমি চিটাগং কলেজ না? তোমাকে হোস্টেলে দেখেছি মনে হচ্ছে।“
“তুমি কি হোস্টেলে
থাকতে?”
“না, আমার বাসা
তোমাদের হোস্টেলের কাছে। তুমি শেরে বাংলা বি ব্লকে থাকতে না? আমি রঘুর রুমে গিয়েছিলাম
কয়েকবার।“
কফিলের সাথে
বন্ধুত্ব হতে দেরি হলো না। ট্রেন প্লাটফরমে ঢুকতেই ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। বটতলি আর
ঝাউতলা স্টেশন থেকেই শাটল ট্রেনের প্রায় সব কম্পার্টমেন্ট ভর্তি হয়ে আসে। ষোলশহর স্টেশন
থেকে উঠে সিট পাওয়া অনেকটা লটারি পাওয়ার মতো। কফিল এ ব্যাপারে হোমওয়ার্ক করে এসেছে।
সে বললো, “চলো, ইঞ্জিনে গিয়ে উঠি।“
দৌড়তে দৌড়তে
ইঞ্জিনের কাছে। তেলতেলে কালো চিটচিটে ছোট্ট ধাতব সিঁড়ি বেয়ে ইঞ্জিনে উঠে গেলো কফিল।
আমি একটু ইতস্তত করছি দেখে দিলো এক ধমক। তুমি থেকে সরাসরি তুই-তে চলে এলো, “খাউপ্পাঅরদে
কিল্লাই? খাউপ্পাইলে আর আজিয়া যাইতে পারবি না।“ ইতস্তত করার প্রতিশব্দ যে খাউপ্পানো
তার বিশুদ্ধ ব্যবহার থেকেই বোঝা যায় কফিল চট্টগ্রামের ধুলো-মাটি-কাদা-ভাষায় মানুষ।
ট্রেনের ইঞ্জিনের পাশে ছোট্ট জায়গায় বিপজ্জনকভাবে দাঁড়িয়ে হাওয়া খেতে খেতে দুপাশের
প্রকৃতি দেখতে দেখতে প্রথম ইউনিভার্সিটিতে
যাওয়া একটা অন্যরকম অনুভূতি। একটাই অসুবিধা, কথা বলার সময় অনেক জোরে বলতে হয়, নইলে
বাতাস আর ইঞ্জিনের শব্দে কিছু শোনা যায় না।
স্টেশন বললে
ষোলশহরের কিছুটা মানহানি হয়। কারণ মানের দিক থেকে ষোলশহর একটি জংশন। এখান থেকে দুটি
রেললাইন চলে গেছে দু’দিকে। একটি দোহাজারির দিকে, অন্যটি নাজিরহাটের দিকে। ইউনিভার্সিটির
শাটল ট্রেন যায় নাজিরহাট লাইনে। ট্রেনের চালকের সিটের পাশেও দাঁড়িয়ে আছে অনেক ছাত্র।
আমরা দাঁড়িয়েছি ইঞ্জিনের পাশে। আমাদের কারণে চালকের পথ দেখতে অসুবিধা হবার কথা। কিন্তু
মনে হচ্ছে তাতে কিছুই যায় আসে না। রেলপথ যেদিকে গেছে ট্রেন সেদিকেই যাবে, তাতে অন্যকিছু
দেখার দরকার নেই। শুধু সিগনাল ঠিকমতো দেখা গেলেই হলো। অবশ্য ট্রেনের গতিবেগ ঘন্টায়
তিরিশ কিলোমিটারের বেশি হবে বলে মনে হচ্ছে না।
ষোলশহর স্টেশনের
পরে ট্রেন থামলো ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে। এখান থেকেও অনেক ছাত্র-ছাত্রী উঠলো। বাম পাশে
ক্যান্টনমেন্টের মাঠে সৈনিকদের অনুশীলন চলছে। মাঠজুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে খাঁকি হাফ প্যান্ট
আর সাদা গেঞ্জি। স্টেশনের কাছে অনেক নারকেল গাছ দেখা যাচ্ছে। সব গাছের গোড়া থেকে কয়েকফুট
পর্যন্ত সাদা রঙ করা। শুনেছি ক্যান্টনমেন্টের গাছের জন্যেও নাকি প্রতিবছর অনেকটাকা
বরাদ্দ করা হয় জাতীয় বাজেটে।
ক্যান্টনমেন্টের
পরের স্টেশন চৌধুরি হাট। এখান থেকেও উঠলো কয়েকজন। স্টেশনের বাম পাশে শ্যাওলা জমা পুকুর।
পুকুরঘাটে একজন আধবুড়ো মানুষ ভেজালুঙ্গি হাঁটুর উপর তুলে বিরক্ত মুখে তাকিয়ে আছেন ট্রেনের
দিকে। দুপাশে ধানক্ষেত, রেললাইন ঘেঁষে পায়ে চলে পথ; ছবির মতো সুন্দর প্রকৃতি এদিকে।
চৌধুরি হাটের পরের স্টেশন ফতেয়াবাদ। না, স্টেশন বলা ঠিক হচ্ছে না। খুব ছোট হলেও ফতেয়াবাদ
জংশন। এখান থেকে একটা লাইন চলে গেছে নাজিরহাটের দিকে। অন্য লাইন চলে গেছে ইউনিভার্সিটির
দিকে। পরের স্টেশনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ট্রেন প্লাটফরমে
ঢুকে থামতে না থামতেই হুড়মুড় করে নামতে শুরু করেছে সবাই। নেমেই কেমন যেন ছুটছে সবাই।
কফিল তাড়া দিলো, “দৌড় লাগা। নইলে বাসে সিট পাবি না।“
রাস্তায় সারি
সারি বাস দাঁড়িয়ে আছে। একটার পর একটা বাস ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। এই বাসে চড়ে যেতে হবে ক্যাম্পাসে।
স্টেশনের সামনে বেশ কিছু ছোট ছোট টুকটাক খাবারের দোকান। হাটহাজারি রুটের ঝরঝরে সব বাস ইউনিভার্সিটির ভেতরে
চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন ভাড়া দেয় এসব বাসের। কিছু বাস এখানে স্টেশনে
থাকে, আবার কিছু বাস থাকে ১নম্বর গেটে। শহর থেকে যারা বাসে আসে, তারা এক নম্বর গেটে
নামে। সেখান থেকে ক্যাম্পাসের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার হবে। এই বাসে চড়ে ক্যাম্পাসে
আসতে হয়। ভর্তি হতে এসে এই বাসে চড়েছিলাম।
রেলস্টেশনের
সামনে থেকে বাস রওনা হয়ে বামে শাহজালাল ও শাহ আমানত হল এবং ডানে সোহরাওয়ার্দী হল পার
হয়ে একটানে চলে এলো ক্যাম্পাসে। ডানপাশে চারতলা প্রশাসনিক ভবন ও লাইব্রেরি। তার পাশেই
আর্টস ফ্যাকাল্টি। এখানেই বাস প্রায় খালি হয়ে গেলো। আমরা নামলাম চাকসু ভবনের সামনে।
এখান থেকে কিছুদূর হেঁটেই সায়েন্স ফ্যাকাল্টি। সামনে খোলা সবুজ মাঠ। ছোট ছোট কিছু সুপারি
গাছের মতো গাছ লাগানো হয়েছে পথের দুপাশে।
‘চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়’ লেখা ঝকঝকে নতুন বাস এসে থামলো ফ্যাকাল্টির সামনের রাস্তায়। শিক্ষকদের
জন্য নির্ধারিত এই বাস। বাস থেকে নেমে স্যার-ম্যাডামরা গম্ভীরভাবে চলেছেন ফ্যাকাল্টির
দিকে। শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার-ম্যাডামরা
হলেন রাজা-বাদশাহ টাইপের। মেজাজ ভালো থাকলে দিলদরিয়া, আবার মেজাজ খারাপ হলে শূলে চড়াবার
আদেশ দিতে পারেন। শূলে চড়াবার আদেশ অবশ্য এ যুগে দেয়া যায় না, কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায়
ফেল করানো যায়। সবকিছুতে পাস করার পরেও যদি কেউ মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করে – তাহলে পরের
বছর আবার সব পরীক্ষা দিতে হবে। তাই মনে হচ্ছে স্যার-ম্যাডামদের কাছ থেকে যত দূরে থাকা
যায় ততোই ভালো। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। কিন্তু কফিল তাড়া দিলো। তার ভেতর একটা ড্যামকেয়ার
ভাব আছে। সারাক্ষণ ছটফট করছে, সবকিছু নিয়ে মজা করছে।
দোতলায় ফিজিক্স
ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের অফিসের সামনের বারান্দায় একটা ব্ল্যাকবোর্ডে টাইপ করা
ক্লাসরুটিন টাঙানো আছে। সাবসিডিয়ারির রুটিনও একসাথে দেয়া আছে। গণিত আর পরিসংখ্যান সাবসিডিয়ারি
নিয়েছি। আজ ফিজিক্সের কোন ক্লাস নেই। পরিসংখ্যানের সাবসিডিয়ারি আছে ফার্স্ট পিরিয়ডে।
কফিল পরিসংখ্যান নেয়নি, কেমিস্ট্রি নিয়েছে। সে চলে গেলো কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের
দিকে। আমাকে যেতে হবে চার তলায় পরিসংখ্যান বিভাগে।
বেশ বড় ক্লাসরুম।
বেঞ্চগুলি অদ্ভুত ধরনের। বেশ ভারী কাঠের তৈরি বেঞ্চ আর টেবিল একসাথে লাগানো। ফিজিক্স
আর ম্যাথের স্টুডেন্টরা ছাড়াও ইকোনমিক্সেরও অনেকে পরিসংখ্যান নিয়েছে সাবসিডিয়ারি হিসেবে।
প্রথম দিনের ক্লাসে যে যার পাশে বসেছে কিছুটা আলাপ-পরিচয় করে নিচ্ছে। আমি বসেছি একেবারে
পেছনের দিকের একটা বেঞ্চে। এখান থেকে সামনের ব্ল্যাকবোর্ডকে মনে হচ্ছে অনেক দূরে দিগন্তের
কাছাকাছি কোথাও। সেখানে কিছু লেখা হলে এখান থেকে দেখতে পাবো বলে মনে হয় না। চশমার পাওয়ার
বদলাতে হবে মনে হচ্ছে। পরেরদিন থেকে সামনে গিয়ে বসতে হবে।
“একটু স-স-স-সরে
বসো তো।“
ফর্সা, লিকলিকে
ছেলেটি এখনো হাফাচ্ছে। মনে হচ্ছে ছুটতে ছুটতে এসেছে। ক্লাসের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস
বলে মনে হচ্ছে তাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পরিচয় হয়ে গেলো অর্পণের সাথে।
“গুড মর্নিং
এভরিওয়ান। আমার নাম মোহাম্মদ আবদুল করিম – সংক্ষেপে ম্যাক। তোমরা আমার কাছে শিখবে ব্যাসিক
স্টাটিসটিক্স।“
সরু পা-লেপ্টা
নীল জিন্স আর লাল টি-শার্টে স্যারকে বাংলা সিনেমার প্রতিনায়কের মতো লাগছিলো – যারা
নায়িকার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যায়, কিন্তু নায়িকার দৃষ্টি থাকে অন্যদিকে। ম্যাক
স্যারের বাম হাতে মোটা ধাতব শিকল – মনে হয় এটা সাম্প্রতিক ফ্যাশন। টি-শার্টের ফাঁক
দিয়ে গলার সোনালী চেনও উঁকি মারছে। হাতের আঙুলে আংটিও দেখা যাচ্ছে কয়েকটা। এরকম সালংকার
সুবেশ শিক্ষক আগে বেশি দেখিনি।
No comments:
Post a Comment