০৭
“যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে, সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে
থামিয়া” – রবিঠাকুরের কাব্যিক সন্ধ্যা যেরকম মন্দ মন্থর রাবীন্দ্রিক গতিতে ধীরে ধীরে
নামে – এখানে সেরকম কোন আয়োজন ছাড়াই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে রাত হয়ে গেল। সব সঙ্গীত এখনো
থামেনি, অবশ্য পাশের রুমে যা হচ্ছে তাকে যদি আদৌ সঙ্গীত বলা যায়। পাশের রুমে কেউ একজন
গত দশ মিনিট ধরে “তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে হিদয়ের কুঠুরিতে রাখবো“ বলে যেভাবে চেঁচাচ্ছে
তাতে মনে হচ্ছে রেললাইনের ফাঁকে পা আটকে যাবার
মতো গানের লাইনের ফাঁকে তার গলা আটকে গেছে। ইচ্ছে করলেই বারান্দায় বের হয়ে গলা বাড়িয়ে
দেখে আসা যায় এই ভয়াবহ গান কার গলা দিয়ে বের হচ্ছে। কিন্তু ইচ্ছে করছে না।
আগস্টের শেষে শহরে যেরকম ভ্যাপসা একটা গরম থাকে – এখানে সেই
অস্বস্তিকর ভাবটা নেই। পাহাড়ী এলাকা বলেই হয়তো। ঝিরঝিরে আরামদায়ক বাতাস আসছে জানালা
দিয়ে। আমার পড়ার টেবিলটা জানালার কাছে। দরজা বন্ধ করে বসে আছি চেয়ারে। রেসনিক হ্যালিডের
বই, আর মোবাশ্বের স্যারের ক্লাসে যে নোট নিয়েছি – তা খুলে বসে আছি। স্যার বাড়ির কাজ
দিয়েছেন। স্যার বলেছেন – হোম-ওয়ার্ক। আজ থেকে তো এটাই আমার হোম, সোহরাওয়ার্দী হলের
২৫২ নম্বর রুম। রুমে তিনটি সিঙ্গেল খাট – তিন দিকের দেয়াল ঘেঁষে শুয়ে আছে। পড়ার টেবিলগুলি
সুন্দর, মনে হচ্ছে নতুন বানানো হয়েছে। টেবিলের সাথে লাগানো বইয়ের তাক। তিনটি টেবিলের
কোনটাতেই তেমন কোন বইপত্র দেখা যাচ্ছে না। আমার বইপত্র কিছু আছে শহরে, আস্তে আস্তে
নিয়ে আসতে হবে। সামনের দেয়ালে জেনারেল এরশাদের একটি হাস্যমুখ ছবিযুক্ত পোস্টার লাগানো
আছে। তার পাশেই একটি শ্রীদেবীর পোস্টার। পোস্টার দুটো যে লাগিয়েছে তার রসবোধ ভালোই।
মনে হচ্ছে বঙ্গদেশের মিলিটারি শাসকের দৃষ্টি শ্রীদেবীর বক্ষদেশে স্থির হয়ে আছে। এতগুলি
হলের এতগুলি রুম থাকতে কি না আমি এসে উঠলাম এখানে?
হলে ওঠার সঠিক নিয়মকানুন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে
এখানে রাজনৈতিক দখলদারিত্ব চলছে। এই হলের এই ব্লকটা জাতীয় পার্টির দখলে। আলাওল হল নাকি
জাতীয় পার্টির ঘাঁটি। সব বড় নেতা ওখানে থাকে। বিভিন্ন হলেই কিছু কিছু রুম ছাত্রলীগের,
ছাত্রদলের কিংবা ছাত্রশিবিরের। ছাত্র ইউনিয়নেরও কিছু রুম আছে বিভিন্ন হলে। যারা কোন
রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত নয়, তাদের কী উপায়? তারা যে নিরুপায় – তা নিজেকে দিয়েই বুঝতে
পারছি কিছুটা।
আজ দুপুরে শাহীন যখন বললো ২৫২ জাতীয় পার্টির রুম, আমি আঁৎকে
উঠেছিলাম। তার একটু আগেই জাতীয় পার্টির সশস্ত্র ক্যাডার দেখেছি। আমি সেই পার্টির সিটে
উঠার জন্য এসেছি হলে? কিন্তু আমি তো জানতাম শ্যামলদা – যার সাথে ডাবলিং করার কথা হয়েছে
– তিনি ছাত্রলীগ করেন। কোন্ রুমে উঠছি সে
ব্যাপারে শাহীন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সোহরাওয়ার্দীর কোন্ রুম কোন্ দিকে সে ভালোভাবেই
চেনে। সে আমাকে চারটা বিল্ডিং পার হয়ে পঞ্চম বিল্ডিং-এর দোতলায় নিয়ে এলো। সিঁড়ি থেকে
ডানদিকে ঘুরে বেশ কিছুদূর আসার পর রুম পাওয়া গেল – ২৫২। শ্যামলদা রুমে অপেক্ষা করছিলেন
আমার জন্য।
শাহীন আমার বাক্সটা নামিয়ে রেখেই গিটার দুলিয়ে দ্রুত চলে
গেলো। শ্যামলদা বললেন, “এসো প্রদীপ, তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এইটাই সিট। ট্রাংকটা
খাটের নিচে রাখো। আর এই চেয়ার-টেবিল। ওদিকের দেয়ালে আলমিরা আছে।“
“না, আলমিরা ইউজ করা যাবে না। ওখানে আমাদের জিনিসপত্র আছে।
খবরদার, আলমিরায় হাত দিবা না।“ – কথাগুলি যিনি বললেন তাঁর গলা ফ্যাঁসফ্যাঁসে। দেয়ালে
হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে খাটে বসে আছেন। লুঙ্গি উঠে আছে হাঁটুর উপরে, স্যান্ডো গেঞ্জির
অনেকটাই গুটানো। মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের শরীরে গরম বেশি, তাই ফুলস্পিড ফ্যানের নিচে বসেও
জামা-কাপড় গুটিয়ে রেখেছেন।
“ওহ্, ঠিক আছে। সুসেন যখন বলছে তখন আলমারিতে হাত দেয়া যাবে
না। আলমিরা লাগবে না তোমার।“ শ্যামলদা কথা বলেন নিচুস্বরে, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো।
কিন্তু শুনেছি তিনি নাকি ছাত্রলীগের অনেক বড় নেতা। বড় নেতারা সম্ভবত গলা উঁচিয়ে কথা
বলেন না। সেই হিসেবে মনে হচ্ছে সুসেন সাহেব কিংবা সুসেন ভাই খুব বেশি বড় নেতা এখনো
হয়ে ওঠেননি। একটু পরে আরেকজন মাঝারি নেতা রুমে ঢুকতেই শ্যামলদা “এই নাও চাবি” বলে আমাকে
চাবি দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। মাঝারি নেতা আমার দিকে একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি
নিক্ষেপ করে এরশাদ-শ্রীদেবীর পোস্টারের নিচে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে খাটে বসে গেলেন। পা
টেনে খাটে বসা কি এই রুমে বাধ্যতামূলক? আমি দ্রুত বের হয়ে গেলাম মোবাশ্বের স্যারের
ক্লাস ধরার জন্য।
চাকসু ভবনের সামনে বাস থেকে নেমে নিউট্রন জেনারেটর বিল্ডিং
পর্যন্ত অনেকদূর হাঁটা। রোদের মধ্যে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছি। আমার সামনে রঙিন ছাতা
মাথায় একজন মেয়ে। সেও বেশ জোরেই হাঁটছে। সে সায়েন্স ফ্যাকাল্টির দিকে মোড নিতেই আমি
তাকে ক্রস করে সোজা রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছি। সে পেছন থেকে ডাক দিলো, “অ্যাই, অ্যাই,
ওদিকে যাচ্ছো কেন?”
আমি ফিরে তাকাতেই চিনতে পারলাম। তার চোখে কালো চশমা। সে কয়েক
পা এগিয়ে এলো আমার দিকে।
“তুমি ক্লাসে যাচ্ছো না? ওদিকে গেলে তো অনেক বেশি হাঁটতে
হবে, আর অনেক রোদ। ফ্যাকাল্টির ভেতর দিয়ে গেলে তো রাস্তাও কম, রোদও নেই।“ গম্ভীর মাস্টারের
মতো বললো সে।
“হ্যাঁ, তাই তো।“
“আমার নাম আইরিন। আমি তোমার ক্লাসে পড়ি। আমি তোমাকে চিনি,
কিন্তু নাম ভুলে গেছি।"
"আমার নাম প্রদীপ।“
“হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তুমি মোবাশ্বের স্যারের ক্লাসে পড়া পারোনি
সেদিন। স্যার যে ক্লাসের কোণায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন। আর তুমি কীরকম ফানি ফেইস করে স্ট্যাচুর
মতো দাঁড়িয়ে থাকলে। আমার খুব হাসি পেয়েছিল। আবার স্যারের ভয়ে হাসতেও পারছিলাম না। তুমি
এত আস্তে হাঁটছো কেন? আমি কিন্তু অনেক জোরে হাঁটি। মিলিটারির বউ তো, মিলিটারির সঙ্গে
হাঁটতে হাঁটতে অভ্যাস হয়ে গেছে।“
সায়েন্স ফ্যাকাল্টির
এক মাথা থেকে অন্য মাথায় করিডোর দিয়ে হেঁটে নিউট্রন জেনারেটর বিল্ডিং-এ আসতে
বেশিক্ষণ লাগলো না। আইরিনকে খুব সহজ-সরল সোজাসাপ্টা মানুষ বলে মনে হচ্ছে। আমি যে ক্লাসে
পড়া পারি না, সেটা মনে হচ্ছে ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছে।
মোবাশ্বের স্যার ক্লাসে এত পড়া ধরেন – মনে হয় আমরা ইউনিভার্সিটিতে
নয়, প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। আজকের ক্লাসে অবশ্য খুব বেশি কিছু জিজ্ঞেস করেননি মোবাশ্বের
স্যার। কিছু হোমটাস্ক দিয়েছেন। থার্মোডায়নামিক্সের কিছু সমীকরণ প্রমাণ করতে হবে। পদার্থবিজ্ঞান
কেমন যেন গণিতপ্রবল হয়ে যাচ্ছে। পদার্থবিজ্ঞানের মূল বিজ্ঞান বুঝার বদলে গাণিতিক সমীকরণগুলি
কীভাবে হচ্ছে তা বুঝতেই সময় চলে যাচ্ছে। পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিকের কথা তেমন
আলোচনা করেন না কোন প্রফেসর। নতুন আবিষ্কার সম্পর্কেও কেউ কোনদিন কিছু বলেন না। এই
যে গত মাসের ২৬ তারিখ সাভারে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক চুল্লি স্থাপিত হলো, আমি আশা
করেছিলাম স্যাররা এ সম্পর্কে কিছু না কিছু বলবেন। কিন্তু আজ এক মাস চলে গেলো, কোন স্যার
এ ব্যাপারে টু শব্দটি করলেন না। হয়তো সিনিয়রদের ক্লাসে বলেছেন। কিন্তু আমার তো মনে
হয় এসব ব্যাপারে জুনিয়র স্টুডেন্টদেরকেই তো বেশি করে বলা দরকার, যেন আমরা উৎসাহ পাই।
মোবাশ্বের স্যার সিয়ার্সের বইয়ের রেফারেন্স দিলেন। এই বই
থেকেই মনে হচ্ছে হোমটাস্ক দিয়েছেন। সিয়ার্সের বইয়ের খোঁজে ডিপার্টমেন্টের সেমিনার লাইব্রেরিতে
ঢুকেছিলাম আজ। সেমিনারের প্রথম দিন – স্মরণ থাকবে চিরদিন। সেমিনার লাইব্রেরি ফ্যাকাল্টির
দোতলায়। চেয়ারম্যানের অফিসের পর ক্লাসরুম পার হয়ে করিডোর দিয়ে আরো কিছুদূর গিয়ে বামপাশে
হামিদা বানু ম্যাডামের অফিসের পাশের বড় রুমটাই সেমিনার। সাদার উপর নীল ডোরাকাটা পর্দা
দিয়ে ঘেরা এই রুম। দরজার পর্দা সরিয়ে দেখলাম একটা বড় ডেস্কের সামনে বড় একটা চেয়ারে
গম্ভীরভাবে বসে ‘দৈনিক আজাদী’ পড়ছেন হ্রস্বদেহী একজন মানুষ। সম্ভবত ইনিই লাইব্রেরিয়ান।
“কী চাই?” – পত্রিকার পাতার আড়াল থেকে মুখ বের করে কপাল কুঁচকে
প্রশ্ন করলেন।
“একটা বইয়ের খোঁজে এসেছি।“
“কোন্ ইয়ার? ফার্স্ট ইয়ার?”
“হ্যাঁ।“
“ফার্স্ট ইয়ারেই সেমিনারে ঢুকে পড়েছেন? ফাইনাল ইয়ারে উঠেন,
তারপর আসবেন।“ - বলেই পত্রিকায় মন দিলেন। রুমের
চারদিকে একবার চোখ বুলালাম। জানালায় পর্দা টেনে দিয়ে লাইট জ্বালিয়ে রাখার কী কারণ থাকতে
পারে বুঝতে পারলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কি বিদ্যুৎ-বিল দিতে হয় না? কয়েকটা বড় বড় টেবিলের
পাশে বেঞ্চ পাতা। একজন পাঠকও নেই পদার্থবিজ্ঞানের পাঠকক্ষে। ফার্স্ট ইয়ারের শিক্ষার্থীরা
সেমিনারে ঢুকতে পারবে না – এই আইন কোথায় আছে, কেন আছে জানি না। বের হয়ে এলাম। এরপর
গেলাম লাইব্রেরিতে।
আজ প্র্যাকটিক্যাল ছিল না। যীশুরা সবাই চলে গেছে শহরে। হলে
থাকলে অনেক সময় বেঁচে যায়। আর্টস ফ্যাকাল্টির বাম পাশ দিয়ে ঢুকলাম। এদিকে ফ্যাকাল্টির
বাইরে মাটির নিচে বেশ বড় একটা রুম আছে। ফাইন আর্টসের ওয়ার্কশপ। ফ্যাকাল্টির গেট দিয়ে
ঢুকেই নাট্যকলা বিভাগ। নাটকের প্রতি এক ধরনের আগ্রহ আছে আমার। কিন্তু ফিজিক্স আর সিরিয়াস
নাটক- একসাথে চলে না। আর্টস ফ্যাকাল্টি ফাঁকা হয়ে গেছে দেড়টা বাজার আগেই। এতগুলি ক্লাসরুম
খালি পড়ে থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়। করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে একদম অন্যপ্রান্ত দিয়ে বের
হলাম। এখানে অগ্রণী ব্যাংক। বিল্ডিং থেকে বের হবার মুখে বিশাল এক বটগাছ। দুপুর-রোদে
ঝিম মেরে আছে তার বড় বড় গাঢ় সবুজ পাতা। এর সামনে চারতলা সাদা বিল্ডিং- ছাদে অনেকগুলি
পিলার লোহার ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়নি এখনো। এই
বিল্ডিং-এর চার তলায় লাইব্রেরি। সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। আরো দু’বার এসেছিলাম এখানে।
একবার এসেছিলাম লাইব্রেরি কার্ড করার জন্য ফরম নিতে। যাকেই জিজ্ঞেস করি, আরেকজনকে দেখিয়ে
দেন। এভাবে তিন-চারজন ঘুরে জানা গিয়েছিল ফরম তখনো আসেনি। দু’সপ্তাহ আগে আরেকবার এসে
তাও কয়েকজনের কাছে ঘুরে ফরম নিতে পেরেছিলাম। তারপর লাইব্রেরি কার্ডের জন্য দরখাস্ত
জমা দিয়েছি। একটা লাইব্রেরি কার্ড করার জন্যও দরখাস্তের সাথে কত কিছু জমা দিতে হলো।
ভর্তি হবার সময় লাইব্রেরির জন্য যে টাকা দিয়েছি – সেই রশিদও দিতে হলো। এই ব্যাপারগুলি
কি একবারে একসাথে করে ফেলা যায় না? একজন শিক্ষার্থীর একটা পরিচয় পত্রের সাথেই সবকিছু
যোগ করে দেয়া যায় না?
লাইব্রেরি কার্ড আজ আসার কথা ছিল। চারতলায় উঠে লাইব্রেরির
প্রধান দরজায় ঢুকলাম। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। একপাশে দেয়াল ঘেঁষে ছোট ছোট কাঠের খোপে
এ বি সি ডি এভাবে বই খোঁজার কার্ড। কিন্তু লাইব্রেরি কার্ড ছাড়া কোন কিছুতে হাত দেয়াও
সম্ভবত নিষেধ। লাইব্রেরি তো সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকার কথা। এখানে বইগুলি কোথায়
আছে দেখার কোন সুযোগ নেই। ডেস্কে বইয়ের নাম আর পরিচিতি নম্বর লিখে দিলে লাইব্রেরির
সহকারীরা বই খুঁজে এনে দেন। কিন্তু সবকিছুর আগে দরকার হবে লাইব্রেরি কার্ড। ফ্লোরে
স্যান্ডেলের ঘর্ষণে কিছু শব্দ হলো। ভেতর থেকে খুব ধীরপায়ে একজনকে আসতে দেখা গেল।
“আমার লাইব্রেরি কার্ডটা কি এসেছে?”
“কোন্ ইয়ার? ফার্স্ট ইয়ার?” এরা কি ফার্স্ট ইয়ারদের দেখেই
চিনে ফেলতে পারে? নতুনত্বের কি কোন চিহ্ন আছে যা দূর থেকে দেখা যায়?
“ফার্স্ট ইয়ারের কার্ড এখনো আসেনি।“ – বলে আমার দিকে আর না
তাকিয়েই তিনি চলে গেলেন তাঁর ডেস্কে। সেখানে চেয়ারে বসে ড্রয়ার খুলে একটা গোল আয়না
বের করে নিজের চেহারা দেখতে লাগলেন। মনে হচ্ছে তাঁর মুখের ব্রণ নিয়ে তিনি খুব বিরক্ত।
নখ দিয়ে টিপে ব্রণনাশ করতে চাইছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত প্রেমিক পুরুষ ক্যাসানোভা
নাকি শেষ জীবনে লাইব্রেরিয়ান হয়েছিলেন। এখন চোখের সামনে যাকে দেখতে পাচ্ছি – তিনি কতটুকু
ক্যাসানোভা জানি না, তবে যে অনেকটুকু নার্সিসাস
তা বুঝতে পারছি। সিয়ার্সের বই কখন পাওয়া যাবে জানি না। মোবাশ্বের স্যারের হোম-টাস্ক
আগামী সপ্তাহের মধ্যে করতে হবে।
সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যা হলগুলির সামনে কাটিয়েছি। এখানে
বিকেল হলেই হলের সামনের রাস্তা কেমন যেন বাজার-বাজার হয়ে ওঠে। অনেকে আখ, জাম্বুরা ইত্যাদি
বিক্রি করতে আসে। ছাত্ররা এসব কিনে খায়। রেস্টুরেন্টগুলি জমে উঠে। পান-বিড়ি-সিগারেটের
দোকান আছে অসংখ্য। নতুন জায়গায় এলে শুরুতে কিছুদিন একটা অতিথি-ভাব থাকে। নিজেই নিজের
অতিথি, নতুন জায়গার অতিথি। আমি তো আসলে শ্যামলদার অতিথি।
শ্যামলদা পড়ে কেমিস্ট্রিতে। আমার এক বছরের সিনিয়র। এখন তো
তাঁর ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল দেয়ার কথা। পরীক্ষা কেমন হয়েছে বা হচ্ছে কিছুই তো জিজ্ঞেস
করলাম না। সুসান এবং অন্য নেতার সঙ্গে এখনো তেমন পরিচয় হয়নি। সন্ধ্যায় রাস্তায় দেখেছিলাম
একটু করে, কিন্তু কোন কথা হয়নি। শ্যামলদাও যে সেই গেছেন, আর দেখা নেই। রাতে আসবেন কি
না জানি না। খাটের যে সাইজ, তাতে এই গরমে ডাবলিং কীভাবে করবো জানি না।
হঠাৎ ঠাস্ ঠাস্ করে গুলির শব্দ শোনা গেল। পাশের রুমের
“পুতুলের মতো সাজিয়ে” বন্ধ হয়ে গেল। নিচের তলা থেকে চিৎকার শোনা গেল, “আমানতে, আমানতে
লাগছে। শিবিরের সাথে।“
কয়েক সেকেন্ড পরেই পূর্ব দিক থেকে শুরু হয়ে গেল প্রচন্ড গোলাগুলি।
সম্ভবত আলাওল হল থেকে। হঠাৎ সব আলো নিভে গেল। লোডশেডিং, কিংবা কেউ মেইন সুইচ অফ করে
দিয়েছে। নাকি গোলাগুলি শুরু হয়ে গেলে যুদ্ধাবস্থার মতো ব্ল্যাক-আউট হয়ে যেতে হয়? ভয়ে
আতঙ্কে বুঝতে পারছি না কী করা উচিত। বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়া যায়। কিন্তু দরজা বন্ধ
করে ঘুমিয়ে গেলে অন্যরা কীভাবে ঢুকবে? দরজার হুক না লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম।
ছোট্ট খাটের উপর কোন তোষক নেই। একটা পাতলা চাদর বিছানো ছিল।
আমি তার উপরে আমার নিজের বিছানার একটা চাদর বিছিয়ে নিয়েছি। নিজের বালিশ এনেছিলাম। মশারিটা
যে ময়লা হয়েছে তা অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে। নিজের মশারি বের করে টাঙানো সম্ভব নয় এই অন্ধকারে।
বাইরে গোলাগুলি চলছে। এটা কি শুধুই গোলাগুলি, নাকি সরাসরি আক্রমণ? আমার বাবা এই কারণেই
আমাকে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে দিতে চাননি। বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলে এসেছি। প্রথম রাতেই
গোলাগুলি! এখন অবশ্য গুলির শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। রুমে লাইটের সুইচ অফ করে দিয়েছি।
ফ্যানের সুইচ অন আছে। কারেন্ট এখনো আসেনি। মশারির ভেতর দমবন্ধ হয়ে আসা গরম। কিন্তু
সারাদিনের ক্লান্তির কারণে ঘুম চলে এলো।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। ঘুম ভেঙে গেল বারান্দায় উচ্চস্বরে
কথাবার্তা শুনে। সুসান ভাইয়ের ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা শোনা যাচ্ছে – “আমি এখনি উঠাই দিচ্ছি।
বেয়াদবির শিক্ষা প্রথমরাতেই দিতে হবে। নইলে শেষে সামলানো যাবে না।“
“ঠিক আছে, তুমি তারে নিয়ম-কানুন সব বুঝাই দাও। আমি একটু হামিদ
ভাইয়ের ওখান থেকে ঘুরে আসি। দেখলা তো শিবিরের পোলাপাইন কী শুরু করছে।“ – এটা মনে হচ্ছে
মাঝারি নেতার গলা।
কয়েক সেকেন্ড পরেই দরজা খুলে গেল, লাইট জ্বলে উঠলো। সুসান
ভাই আমার খাটের কাছে এসে এক টানে মশারির এক কোণা উঠিয়ে ফেললেন – “অ্যাই উঠ। কথা আছে
তোমার সাথে।“
একটু আগের গোলাগুলির শব্দে যতটা ভয় পেয়েছিলাম, এখন ভয় লাগছে
তার চেয়ে বেশি। কোন রকমে বিছানায় উঠে বসলাম।
“শোন, শ্যামল মনে হয় এখানকার নিয়ম-কানুন কিছুই তোমাকে বলেনি।
শ্যামল তোমার কেমন আত্মীয়?”
“আমার মায়ের খালাতো বোনের ফুফাতো বোনের ছেলে। সেই হিসেবে
আমার খালাতো ভাই।“
“ওহ্, আমার নিজের আত্মীয়কে সিট না দিয়ে আমি শ্যামলকে সিট
দিয়েছি এখানে। কথাটা মনে রাখবা। আর এখানে সিনিয়রদের সালাম দিতে হয়। আমাকে তুমি সালাম
দাও নাই, তাতে আমি তেমন কিছু মনে করি নাই। কিন্তু সবাই তো আমার মতো না। এই যে তুমি
টিপু ভাইরে সালাম দাও নাই, টিপু ভাই অনেক মাইন্ড করছে।“
“টিপু ভাই কে?”
“এই টাই তো সমইস্যা তোমার। এখানে আসছ, কে কী তা জেনে নিবা
না? টিপু ভাই এই হলের ছাত্রসমাজের ডেপুটি এসিস্টেন সেকেটারি। এই রুমে থাকে। তুমি দুপুরে
তাকে দেখছ, সালাম দাও নাই। সন্ধ্যাবেলা হলের সামনে রাস্তায় তার সামনে দিয়া হেঁটে গেচ,
সালাম দাও নাই। খুব মাইন্ড করছে টিপু ভাই। আমারে তো বলছিল তোমারে বাইর করে দিতে। এই
রাতের বেলা তোমারে বাইর করি দিলে তুমি কোথায় যাবা? আমি অনেক বলে কয়ে টিপুভাইরে বুঝাইছি।
একটু পরে টিপুভাই আসবে। তুমি সালাম দিবা, আর মাফ চাইবা। বলবা, টিপু ভাই, এবারের মত
মাফ করি দেন। তোমার ভালা চাই বলি এসব বলতেছি। আর কেউ হইলে এতক্ষণে বাইর করি দিতাম।
কথা শুনবা, পারমিশান নিয়া কাজ করবা, কোন সমস্যা হলে আমরা দেখব।“
সুসান ভাইয়ের কথা শুনে তাকে ফেরেশতা বলে মনে হওয়া উচিত। কিন্তু
আমার সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না। শুরুতে যে ভয়টা ছিল সেটাও আর নেই। মনে হচ্ছে এরা বাগাড়ম্বর
করে চলে এখানে। বললাম, “সরি সুসান ভাই, আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনাদের পাওয়ার বুঝতে পারি
নাই। আপনারে সালাম দিই নাই। এখন দিতেছি, সালাম ভাই। আমি একটু বাথরুমে যাবার পারমিশান
চাই। যেতে পারি?”
“বাথরুমে যাবা? যাও।“
“জি ভাই। সালাম ভাই।“
No comments:
Post a Comment