Wednesday, 24 February 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৮

 


০৮

“লুক মাই ফ্রেন্ড, স্মোকিং ইজ ডাইরেক্টলি রিলেটেড টু ফিজিক্স” – কথাগুলি বলার সময় মুখ থেকে অদ্ভুত কায়দায় সিগারেটের ধোঁয়া বের করছে হাফিজ। তার ডান হাতের তর্জনি আর মধ্যমার আগায় আলতো করে লেগে আছে সোনালী ফিল্টার। একটু আগেই সে একটা লম্বা টান দিয়েছে সিগারেটে। এখন কথা বলতে বলতে ধোঁয়া বের করছে। ধোঁয়াগুলি মুখ থেকে বের হতেই সাদা বৃত্তাকার রিং তৈরি করে আস্তে আস্তে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা কীভাবে ঘটছে বুঝতে পারছি না। হাফিজের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে প্রদীপ, স্বপন, ইকবাল আর দিলীপ। ইকবাল আর প্রদীপও ধোঁয়ার রিং তৈরি করছে। মনে হয় ধূমপায়ীরা সবাই এধরনের ধুম্রবৃত্ত তৈরি করতে ওস্তাদ। সিগারেটে কে কীভাবে টান দিচ্ছে তা যদি আভিজাত্য মাপার মাপকাঠি হতো তাহলে বলা যেতো দিলীপের সিগারেট টানার মধ্যে কোন আভিজাত্য নেই। তার মধ্যে কেমন যেন একটা তাড়াহুড়ো আছে। এক এক টানে তার সিগারেটের দৈর্ঘ্য প্রায় এক সেন্টিমিটার করে কমে যাচ্ছে, নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে ইটভাটার চিমনির মতো গলগল করে। মুখ দিয়ে সিগারেট টেনে নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করার কৌশলটাও সহজে আয়ত্বে আসার কথা নয়।

 

“নাকেও আউটলেট?” - আমি অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছি দেখে স্বপন বললো – “আরে এটা কোন ব্যাপার না। ঠিকমতো বের করতে জানলে শরীরের সব ছিদ্র দিয়েই ধোঁয়া বের করা যায়। এমনকি **** দিয়েও।“ স্বপনের মুখে কোন ধরনের ফিল্টার নেই। উচ্চারণ-অযোগ্য যেসব ছিদ্রের কথা সে বললো, তার সেগুলি দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া বের হলে তো বিপদের কথা।

 

ধূমপায়ীদের এত কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে প্যাসিভ স্মোকিং হয়ে যায়। ধোঁয়া থেকে দূরে থাকা দরকার।  কিন্তু হাফিজের কথা বলার স্টাইল এত আকর্ষণীয়, ইংরেজিতে যাকে বলে মেসমেরিক, যে পুরোটা না শুনে ক্লাসে ঢুকতে পারছি না। হাফিজ দাবি করছে ফিজিক্সের সাথে ধূমপান সরাসরি সম্পর্কিত। কিন্তু কীভাবে? এখানে যারা ধূমপান করছে – সবাই ফিজিক্সের ছাত্র। শুধু এটুকুর ভিত্তিতে তো বলা যায় না যে ফিজিক্স আর ধূমপান ক্লোজলি রিলেটেড। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ক্লাসরুমের সাথে লাগানো খোলা বেলকনিতে তো ফিজিক্সের স্টুডেন্টরাই আসবে। ওল্ড ফার্স্ট ইয়ার অর্থাৎ আমাদের সিনিয়র ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। আমাদের ক্লাস এখন নিউট্রন জেনারেটর বিল্ডিং থেকে মেইন বিল্ডিং-এ চলে এসেছে। চেয়ারম্যানের রুমের সামনে করিডোরের বাম পাশে পরপর ক্লাসরুমের সবচেয়ে দূরের রুমটা ফার্স্ট ইয়ারের, আর সবচেয়ে কাছেরটা মাস্টার্সের। ক্লাসরুমের ভেতর ভারী কাঠের তৈরি বেঢপ বেঞ্চ।  সামনের দেয়ালজুড়ে ব্ল্যাকবোর্ড। পাশের ছোট্ট দরজা খুলে ব্যালকনিতে যাওয়া যায়। ধূমপায়ীদের খুব পছন্দের জায়গা এই ব্যালকনি। আজ নুরুল ইসলাম স্যারের ম্যাথম্যাটিক্যাল ফিজিক্স ক্লাস হচ্ছে না। তাই আড্ডা জমেছে ব্যালকনিতে।

 

“লুক, এই যে সিগারেটের ধোঁয়া – এগুলি কী? গ্যাস তো? মুখের ভেতর গিয়ে খাদ্যনালীতে না ঢুকে শ্বাসনালী দিয়ে বের হয়ে আসছে। কেন? সিম্পল ফিজিক্স – কাইনেটিক থিওরি অব গ্যাস।“ – হাফিজ যেগুলি বলছে তা হিট ও থার্মোডায়নামিক্সের কোন্‌ বইতে লেখা আছে জানি না। কিন্তু সেগুলি অস্বীকার করার উপায় নেই। সে খুব সিরিয়াস টোনে বলছে, “ফেমাস ফিজিসিস্টদের সবাই স্মোক করে। আইনস্টাইন, রাদারফোর্ড, নিউটন, গ্যালিলিও, মাদাম কুরি সবাই স্মোক করতেন।“

আইনস্টাইন পাইপ টানতেন তা ছবিতে দেখেছি। কিন্তু বাকিরা স্মোক করতেন কি না জানি না।

“মাদাম কুরি ধূমপান করতেন – এই তথ্য তুই কোথায় পেলি?” – হাফিজকে জিজ্ঞেস করলাম।

“মাদাম কুরি ফ্রান্সের না? ফ্রান্সের মেয়েরা স্মোক করবে – এটাই তো নরমাল।“

 

ফ্রান্সের হোক, কিংবা ক্যাম্পাসের -  মেয়েদের সম্পর্কে হাফিজের জ্ঞান আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। তাই সে যখন বলছে মেরি কুরি ধূমপান করতেন, তাহলে নিশ্চয় করতেন।

 

হাফিজ আরেকটা ধুম্রচক্র বাতাসে ছড়িয়ে সিগারেট ও পদার্থবিজ্ঞানের গভীর সম্পর্ক সম্পর্কিত আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো – সেই সময় মিজান এসে খবর দিলো স্যারদের মিটিং আছে, পরের ক্লাসও হবে না। মিজান আমাদের ক্লাসের আন-অফিসিয়াল নিউজ-সোর্স। কখন কী হবে, কী হবে না সেই খবর সে কীভাবে যেন নিয়ে আসে।

 

ক্লাস হবে না শুনে ক্লাসের মেয়েদের কয়েকজন ব্যালকনিতে চলে এলো। হাফিজের মনযোগ ঘুরে গেল তাদের দিকে। যখন ক্লাস চলে তখন বোঝা যায় না ক্লাসের কার আচরণ কেমন। কিন্তু কোন নির্ধারিত ক্লাস যখন হয় না, তখন একেক জনের একেক রকমের প্রতিক্রিয়া হয়। যেমন এখন সুমন আর আনিস বসে আছে চুপচাপ। ফারুক, মঈন, স্বপন, আর মামুন চলে গেছে ক্লাসের বাইরে করিডোরে। মৃণাল কথা বলছে ইলোরার সাথে। প্রেমাংকর, জামাল, আজিজ, ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা আলোচনা করছে। আনন্দ গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছে তাদের কাছে। আনন্দের নামের সাথে আচরণ খুব একটা মেলে না। সে সারাক্ষণই গম্ভীর থাকে। শাহাবুদ্দিন, তাজুল, আর দুই দুলাল - দৌলতুজ্জামান দুলাল আর দেলোয়ার হোসেন দুলাল ব্যালকনির এক কোণায় চলে গেল। মৃণাল আর দৌলতুজ্জামান দুলালকে দেখতে প্রায় একই রকম লাগে – খুবই সুদর্শন – হিন্দি সিনেমার নায়ক গোবিন্দ’র মতো। শাকিল কবীরকে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। শাকিল পড়াশোনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। হলে একদিন তার রুমে গিয়েছিলাম। ইতোমধ্যেই তার সব পেপারের নোট তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কবীরের মধ্যে এখনই বুদ্ধিজীবীর ভাব স্পষ্ট। এত হৈ চৈ-এর মধ্যেও রুমা বই পড়ছে, মনে হচ্ছে গল্পের বই। রাখী, ইলা, রিনা, পারুল – চার মাথা এক করে ছবির  অ্যালবাম দেখছে। যীশু, প্রদীপ আর অর্পণ কথা বলছে শীলার সাথে। মেয়েদের মধ্যে কেউই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না। কিন্তু শীলা ব্যতিক্রম। সে আমাদের সাথে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলে।

 

একটু পরে মিজান আর দীপক রুমে ঢুকলো। মিজান অনেক খবর নিয়ে এলেও আহসান হাবীব দীপকের মধ্যে সাংবাদিকভাবটা মিজানের চেয়েও প্রবল। দীপক সংবাদপত্রে নিউজ রিপোর্ট এখনো করেনি বটে, কিন্তু সংবাদপত্রে চিঠি লিখেছে অনেকগুলি। এলাকায় নলকূপ চাই, মশার উপদ্রব থেকে বাঁচান, ছিন্নমূলরা কোথায় যাবে, ইভটিজিং ইত্যাদি অনেক বিষয়ে সুন্দর গুছিয়ে চিঠি লিখেছে সে। দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছে। বিশাল এক অ্যালবামে তার প্রকাশিত সব চিঠি সংগ্রহ করে রেখেছে সে। একদিন দেখিয়েছিল আমাকে। দীপক খবর দিল শিক্ষক সমিতির জরুরি মিটিং চলছে। বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে। দাবি পূরণ না হলে শিক্ষকরা ধর্মঘটে যাবেন। আজ আর কোন ক্লাস হবে না।

 

ক্লাসে আর বসে থাকার মানে হয় না। ওল্ড ফার্স্ট ইয়ারের থিওরি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তারা  প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার জন্য ল্যাব প্র্যাকটিস করছে। তাই আমাদের প্র্যাকটিক্যালও হবে না আজ। ক্লাস থেকে বের হয়ে এলাম।

 

লাইব্রেরি কার্ডটা এতদিনে চলে আসার কথা। যীশু আর প্রদীপসহ গেলাম লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরি কার্ড হাতে পেলাম। নামেই লাইব্রেরি কার্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে কোন বই ধার নেয়ার সুযোগ নেই শিক্ষার্থীদের। বই পড়তে হলে লাইব্রেরিতে বসে পড়তে হবে। কিন্তু পড়ার জন্য যে বই – সে বই নিজে বেছে নেয়ার সুযোগও নেই। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির ব্যবস্থাপনা যে এতটা অগোছালো এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে জটিল হতে পারে তা কোনদিন চিন্তাও করিনি। এখানে একটা বই পড়তে হলে প্রথমে বইয়ের কল নাম্বার খুঁজে বের করতে হবে। তারজন্য বইয়ের কার্ডগুলি সব দেখতে হবে একটা একটা করে। তারপর সেখান থেকে কাগজে কল নাম্বার লিখে সেটা দিতে হবে লাইব্রেরির কোন কর্মচারীকে। তিনি গিয়ে ভেতরে বুকশেল্‌ফে খুঁজে দেখবেন। পাঁচ-দশ-পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পর বইটি পেলে তিনি নিয়ে আসবেন, অথবা এসে বলবেন বইটি নেই। আর্থার বাইজারের মডার্ন ফিজিক্স বইটার কলনাম্বার খুঁজে স্লিপ লিখে দিয়ে পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পর জানা গেলো বইটি নেই। বুকশেল্‌ফ থেকে নিজেরা বই বাছাই করে নিয়ে পড়তে না পারলে লাইব্রেরি বলা যায় একে? খুবই হতাশ হয়ে চলে এলাম লাইব্রেরি থেকে।

 

হলে থাকলে কোন কিছুতেই তাড়াহুড়ো করতে হয় না। ট্রেন ধরার তাড়া থাকে না বলে ভীড়বাসে না উঠলেও চলে। প্র্যাকটিক্যাল না থাকলে রুমে গিয়ে খেয়েদেয়ে দিবানিদ্রাও দেয়া যায়। প্রদীপ আর যীশু চলে গেল বাসে উঠে। আমি ক্যাম্পাসে আরো কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে চাকসু ক্যাফেটরিয়াতে খেয়ে হলে এলাম। হলের অফিসের সামনের জানালার কাচে লাগানো সিটবন্টনের তালিকা আবার দেখলাম – যেন বারবার দেখলে সেখানে আমার নাম দেখা যাবে। সিটের দরখাস্ত করেছিলাম। কোন কাজ হয়নি। পুরো সায়েন্স ফ্যাকাল্টি থেকে ফার্স্ট ইয়ারে মাত্র চারজনকে সিট দেয়া হয়েছে। আমার ক্লাসমেটদের অনেকেই এই হলে থাকে। তারা কেউই সিট পায়নি। কিন্তু কোন না কোনভাবে সিট ম্যানেজ করে থাকছে। আমিও তাদের মতোই। কিন্তু মনের ভেতর কেমন যেন খচখচ করতে থাকে সারাক্ষণ।

 

আকাশে মেঘ জমেছে। তুমুল বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। এরকম দুপুর – দিবানিদ্রার জন্য প্রকৃষ্ট সময়। কিন্তু রুমে ঢুকে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আমার বিছানায় আমার লুঙ্গি পরে যে লোকটা ঘুমাচ্ছে তাকে আমি চেনা তো দূরের কথা, এর আগে কোনদিন দেখিওনি। অন্য দুটো বিছানাও খালি নেই। সুসেনভাই আর টিপুভাই ঘুমাচ্ছেন যে যার বিছানায়। সুসেনভাই সেই রাতে আমার উপর হুকুমজারি করার পর কয়েকদিন ধরে এত বেশি সালাম দিয়েছি আর যখন তখন এত পারমিশান নিয়েছি যে বিরক্ত হয়ে গেছে। অনেকদিন সুসেনভাইয়ের ঘুম ভাঙিয়ে বাইরে যাবার পারমিশান নিয়েছি। দরজায় জোরে জোরে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করেছি – মে আই কাম ইন স্যার? অযোগ্য লোক হঠাৎ ক্ষমতা পেয়ে গেলে বিদ্রুপ আর ভক্তির পার্থক্য বুঝতে পারে না। জাতীয় ছাত্রসমাজের এসব ভুঁইফোঁড় নেতাদেরও একই অবস্থা। আমার ‘ভক্তি’তে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে নিজের মতো থাকার দীর্ঘমেয়াদি পারমিশান দিয়ে দিয়েছেন। ক’দিন বেশ আরামেই ছিলাম। কিন্তু আজ হঠাৎ এ কী উপদ্রব! আমার বিছানায় অন্যজন ঘুমাচ্ছে। তবে কি আমাকে বিতাড়িত করা হলো?

 

টেবিলে বইখাতা রাখার সময় যতটুকু শব্দ হওয়া উচিত তার চেয়েও কিছুটা বেশি শব্দ হলো। শব্দের বাহুল্যটা ইচ্ছাকৃত। শব্দে কাজ হলো কিছুটা। বিছানা থেকে মাথা তুলে তাকালেন লোকটা। গোলগাল থলথলে মুখটা বাংলা সিনেমার অভিনেতা হাসমতের মতো।

“আপনার বিছানায় ঘুমাইছি? আপনি ঘুমাইবেন এখন? ঘুমাইলে ঘুমান, আমার পাশে ঘুমান।“ বলে তিনি ইঞ্চিখানেক সরে আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন। অসহ্য। রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। রঘুনাথ আছে কিনা দেখা যাক।

 

রঘুনাথ থাকে ১৪৩-এ দেবাশিসদার সিটে। দেবাশিসদা আমাদের দু’ব্যাচ সিনিয়র। ফার্স্ট ইয়ারে ফার্স্ট হয়েছেন। এখন সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষার্থী। রঘুনাথকে আমি চিটাগং কলেজ থেকেই চিনি। সে ভর্তি হয়েছে কেমিস্ট্রিতে। দেবাশিসদার সাথে ডাবলিং করছে বলে দিনরাত পড়াশোনা করছে। কিন্তু আজ তাকে পাওয়া গেল না। রুমে তালা ঝুলছে। ফিরে আসছিলাম, পথে দেখা হয়ে গেল আশরাফভাইয়ের সাথে। আশরাফভাই ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। আমার সাথে পরিচয় হয়েছিল চিটাগং কলেজের হোস্টেলে। তিনি মাঝে মাঝে সেখানে যেতেন সাংগঠনিক কাজে।

“তুমি কি হলে উঠেছো?” – আশরাফভাই জানতে চাইলেন।

“ডাবলিং করছি ভাইয়া। জাতীয় পার্টির সিটে। আমার জন্য আপনাদের ব্লকে একটা সিটের ব্যবস্থা করেন।“

“কোন সমস্যা নেই। আর এক মাস কোন রকমে কষ্ট করো। তারপর আমার সিটটা খালি হবে। তুমি সেখানে চলে এসো। দুই সপ্তাহ পরে আমার সাথে দেখা করবে।“

বাহ্‌, ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমার সিটে ঘুমন্ত হাসমতমুখি মানুষটা আমার উপকার করেছেন বলা চলে। তিনি ঘুমাচ্ছেন বলেই তো আমার সাথে আশরাফ ভাইয়ের দেখা হলো।

 

হলের আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করার অনেক জায়গা আছে। আলাওল হলের দিকে গিয়েছিলাম। সুন্দর ফুলের বাগান আছে সেদিকে। এ এফ রহমান হলের সামনের রাস্তায় বড় বড় চাঁপাফুলের গাছ আছে। ওদিকে আসার পথে ইউনিভার্সিটির অডিটরিয়ামের সামনে দিয়ে এলাম। বাইরে থেকেই মনে হচ্ছে বিশাল হল। এত বড় ক্যাম্পাসে যে ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চলা উচিত তার কিছুই চোখে পড়লো না। সব জায়গায় কেমন যেন দমবন্ধ করা একটা অনুভূতি। বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় বসে আছে মিলিটারি। ক্যান্টনমেন্ট থেকেই হঠাৎ গজিয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দল। কিছু সুবিধাবাদী ছাত্রের হাতে টাকাপয়সা আর আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়ে রাতারাতি দখল করে নিয়েছে ইউনিভার্সিটিগুলি। এভাবে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ থাকে?

 

সন্ধ্যাবেলা কাটলো টিভি রুমে। মামুনুর রশীদের ধারাবাহিক নাটক ‘সময়-অসময়’ দেখলাম। খুব সিরিয়াস নাটক। ডাইনিং-এ ভাত খেয়ে রুমে এসে বিছানা খালি দেখে শান্তি পেলাম। এলোমেলো বিছানার উপর আমার লুঙ্গিটা ফেলে গেছেন। আবার ধুতে হবে ওটা। বৃষ্টি হচ্ছে। রাতে শুকাবে না। মানুষটা কে ছিলেন, রাতে আবার আসবেন কি না কিছুই জানি না। শ্যামলদা আজকেও নেই। তিনি কোথায় ঘুমান আমি জানি না। আমি আসার পর থেকে ধরতে গেলে তিনি আমাকে সিটটা ছেড়েই দিয়েছেন। এবার একটা তোষকের ব্যবস্থা করতে হবে।

 

ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় সুসেনভাই আর সাজ্জাদভাই এলেন। সাজ্জাদভাই জাতীয় ছাত্রসমাজের সিকিনেতা। সুসেনভাইও তাকে সালাম দেন।

“সালাম ভাই।“

“অ্যাই, কাল সকালে ক্যাম্পাসে থাকবা। মিছিল আছে। যদি মিছিলে না যাও, তাইলে আর এই রুমে আসতে অইব না। জিনিসপত্র সব নিচে ফেইলা দেবো, সেখান থেইকা কুড়াই লইয়া বিদায় হইবা। কথা কিলিয়ার?”

“কিলিয়ার ভাই, সালাম ভাই।“

সিকিনেতা পাশের রুমের দিকে চলে গেলেন। পাতিনেতা গেলেন তার পিছুপিছু।

কাল জাতীয় পার্টির মিছিল করতে হবে? প্রেসিডেন্ট এরশাদ – জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ বলতে হবে? শ্যামলদাও কি কাল এই পার্টির মিছিল করবেন? তিনি তো ছাত্রলীগের নিষ্ঠাবান কর্মী। তিনি যদি মিছিলে না যান, তাঁর জিনিসও কি নিচে ফেলে দেয়া হবে? অবশ্য আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম শ্যামলদার তেমন কিছু নেই এই রুমে। যা যাবার আমার উপর দিয়েই যাবে।

পরদিন সকাল দশটা থেকে ক্যাম্পাসে মিছিল। চাকসু ভবনের সামনে সবাই জড়ো হচ্ছে। নেতাদের অনেকেই চলে এসেছেন। আমার মতো অনেককেই মিছিলে আসা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কবীরের সাথে দেখা হয়ে গেল। সেও যে জাতীয় পার্টির সিটে থাকে জানতাম না। সিকিনেতা সাজ্জাদভাইকে খুঁজে বের করে দর্শন দিতে হবে। লম্বা সালাম দিতে হবে – যেন আমার চেহারা মনে থাকে। তাঁর স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করছে আমার জিনিসপত্রসহ আমি রুমে থাকবো, নাকি জিনিসপত্র নিচের রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে হল ত্যাগ করবো।

“স্লামালাইকুম সাজ্জাদভাই। আমি ২৫২। মিছিলে এসেছি।“

“ঠিক আছে, ঠিক আছে, লাইনে দাঁড়াও।“

লাইনের সামনে দাঁড়ানো নেতাদের আশেপাশে থাকার জন্য হুড়োহুড়ি করছে অনেকেই। আমি আর কবীর যথাসম্ভব লাইনের পেছনে সরতে শুরু করেছি। মিছিল শুরু হলো। আর্টস ফ্যাকাল্টির ভেতর ঢুকলো লাইন ধরে। ভেতরে ঢুকেই মিছিল অনেকটা এলোমেলো হয়ে গেল। স্লোগানের ভাষা শুরুতে কী ছিল জানি না। একটু পরে দেখা গেল – ক্ষীণকন্ঠে কেউ বলছে – বাঘের বাচ্চা – সাথে সাথে আশেপাশের সবাই চিৎকার করে বলছে – এরশাদ। বাঘের বাচ্চা – এরশাদ, সিংহের বাচ্চা – এরশাদ, ঘোড়ার বাচ্চা – এরশাদ, নেকড়ের বাচ্চা – এরশাদ, মুরগির বাচ্চা – এরশাদ। এভাবে বিভিন্ন প্রাণীর বাচ্চার সাথে এরশাদের তুলনা করে গলার জোর দেখাতে দেখাতে শেষপর্যন্ত সবচেয়ে প্রভুভক্ত প্রাণীর বাচ্চাতে এসে স্থিত হলো স্লোগান। এত লম্বা মিছিল দেখে মিছিলের সামনের নেতারা হয়তো খুশি হয়েছেন। কিন্তু মিছিলের পেছনে স্লোগানের ভাষাটা যদি তারা শুনতেন কী করতেন জানি না।

পরের পর্ব >>>>>>>>>>>>>>>>>>

<<<<<<<<<<<< আগের পর্ব

No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts