০৫
“সেক্সপিয়ার
বলেছেন – হোয়াট ইজ ইওর নেইম? অর্থাৎ নামে কী আসে যায়?”
এক নম্বর গ্যালারির
ঠিক মাঝখানের বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে বেশ উচ্চস্বরে বিদ্যা জাহির করছে ছেলেটা। এতক্ষণ
একটা কাগজ দেখে দেখে পড়ছিল “তুমি বোললে প্রেম হবে, প্রেমের ভুবন যদি আসে, বুকের কুসুম
থেকে দেবে শব্দাবলী, কবিতার বিমূর্ত চন্দন…” উচ্চারণের যা অবস্থা – তাতে কবিতার যে
বারোটা বেজে যাচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। এখন আবার শেকসপিয়ারকে ধরে টানাটানি শুরু
করেছে। তার আশেপাশে যারা আছে, বোঝা যাচ্ছে সবাই তাকে চেনে। তারা তার দিকে খুব একটা
মনোযোগ না দিয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। কিন্তু তার দৃষ্টি গ্যালারির সামনের
দিকের ডান কোণায়, যেখানে দশ বারোজন মেয়ে জটলা করে গল্প করছে। গ্যালারির পেছনের দিকের
বেঞ্চে বসে আমরাও যে সেদিকে তাকাচ্ছি না, তা নয়। তবে তার মতো এতটা গলা উঁচিয়ে আত্মপ্রচার
করার মতো দুরাবস্থা আমাদের এখনো হয়নি। তার মুখে ‘সেক্সপিয়ার’ শুনে সামনের কয়েকজন ঘাড়
ফিরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। তাতে সে দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে শুরু করলো, ‘অ্যা
রোছ ইছ অ্যা রোছ ইছ অ্যা রোছ…”, সামনের দিকের
ডান কোণায় হাসির হুল্লোড় উঠলো।
ছেলেটার নির্লজ্জতার
তারিফ করতেই হয়। অবশ্য আমি যেটাকে নির্লজ্জতা বলছি – সেটাকেই হয়তো সে ভাবছে সাহস।
‘শেক্সপিয়ার’কে অনেকেই ‘সেক্সপিয়ার’ উচ্চারণ করে। অনেকে ধরতেই পারে না এই দুটো উচ্চারণের
মধ্যে কী তফাৎ। শেক্সপিয়ারের ‘হোয়াট্স ইন আ নেম’ যখন ‘হোয়াট ইজ ইওর নেম’ হয়ে যায়
– কেমন যেন ধাক্কা লাগে। এমন জোরে এমন নির্দ্বিধায় এমন ভুল বকতে পারা তো রাজনৈতিক নেতার
গুণাবলি। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো দেখা যাবে এই ছেলে ক্যাম্পাসে মিছিলের নেতৃত্ব দেবে।
ভবিষ্যৎ-নেতার নাম-পরিচয় জেনে নিতে হবে। যতই বলা হোক না কেন – নামে কী এসে যায় - ঠিকমতো
নাম নিতে জানলে অনেক কিছুই আসে, আবার ভুল নাম জপ করলে অনেক কিছুই চলে যায়।
ম্যাথস সাবসিডিয়ারি
ক্লাস করতে এসেছি এই গ্যালারিতে। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, আর স্ট্যাটিসটিক্স ডিপার্টমেন্টের
প্রায় সবারই ম্যাথস সাবসিডিয়ারি আছে। বিশাল গ্যালারি - প্রায় তিন শ স্টুডেন্ট একসাথে
বসতে পারে এই গ্যালারিতে। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির নিচের তলার মাঝামাঝি জায়গায় এই গ্যালারি।
খাড়া উঁচু সিঁড়ি পার হয়ে মেইন কলাপসিবল গেট দিয়ে ঢুকে ডানে ঘুরলেই ডিন অফিস। করিডোর
ধরে এগোবার সময় ডানদিকে তাকালে খাড়া পাহাড়ের
নিচের অংশ দেখা যায়। লম্বা প্রশস্ত করিডোরে আগস্টের ভ্যাপসা গরমেও এক ধরনের শান্ত ঠান্ডা
ভাব। কিছুদূর আসার পর বামদিকে প্রশস্ত র্যাম্প উঠে গেছে দোতলায়। ইচ্ছে করলে যে কেউ
সাইকেল বা মটরসাইকেল চালিয়ে দোতলায় উঠে যেতে পারবে এই পথে। র্যাম্পের নিচে ফটোস্ট্যাট
মেশিনের দোকান।
র্যাম্পের
সামনে করিডোরের ডানদিকে পাশাপাশি দুটো গ্যালারি। সামনে দু’পাশে দুটি দরজা, পেছনে অনেকগুলি
সিঁড়ি পার হয়ে উপরে উঠে আরো দুটি দরজা। আমরা কয়েকজন বসেছি পেছনের দিকের সারিতে পেছনের
দরজার কাছাকাছি। মূল উদ্দেশ্য বোরিং লাগলে ক্লাস থেকে চুপচাপ বের হয়ে যাওয়া। সাবসিডিয়ারি
ক্লাসের পুরোটা করার দরকার আছে কি নেই তা বোঝা যাবে ক্লাসে রোল কল করা হয় কি না, এবং
হলে তা ক্লাসের শুরুতে, নাকি শেষে করা হয় তার ওপর।
গ্যালারি ভরে
গেছে ইতোমধ্যে। সাবসিডিয়ারি ক্লাসে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ছেলে-মেয়েরা একসাথে ক্লাস
করলেও প্রত্যেকেই ছোট ছোট কিছু অদৃশ্য গ্রুপ বা সাব-গ্রুপে ঢুকে গেছে। প্রত্যেকেই আমরা
পরস্পরের সমান সহপাঠী, বন্ধু, আবার এর মধ্যেই কেউ কেউ একটু বেশি বন্ধু। কীভাবে এই গ্রুপিং,
সাব-গ্রুপিং হয় তার কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। কীভাবে যেন পারস্পরিক একটা বোঝাপড়া হয়ে
যায়। বড় ক্লাসে কথাবার্তা, হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব বেশিরভাগ সময়েই এই গ্রুপভিত্তিক হয়ে
থাকে। আজও হচ্ছে। ক্লাসের মাঝখানে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে যে শেক্সপিয়ার আওড়াচ্ছে তার
দিকে শুরুতে কিছুক্ষণ মনযোগ থাকলেও, এখন আর নেই। কিন্তু সে এখনো বকবক করেই চলেছে, কিন্তু
কেউ তার কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। হঠাৎ টেবিলের উপর ডাস্টার ঠোকার প্রচন্ড শব্দ
হলো। বেঞ্চের উপর থেকে দ্রুত নেমে গেলো আমাদের ‘সেক্সপিয়ার’।
“সাইলেন্স,
সাইলেন্স। প্লিজ কিপ কোয়ায়েট।“
“আমার নাম গণেশ
চন্দ্র রায়”
স্যারের নাম
শুনে মনে হলো আসলেই নামে কিছু যায় আসে না। গণেশ বললে যে ধরনের হাতির মাথাযুক্ত পেটমোটা
অবয়বের কথা মনে হয়, গণেশস্যারের সাথে তার কোন মিল নেই। এমন ধবধবে উত্তমকুমারের মত সুবেশ
সুপুরুষের নাম যে গণেশ হতে পারে তা ভাবাই যায় না।
“আমি আপনাদেরকে
ডিফারেন্সিয়েল ক্যালকুলাস পড়াব।“
গণেশস্যার আমাদের
আপনি করে বলছেন! আশ্চর্য লাগছে, তবে খুব একটা ভালো লাগছে না। শিক্ষকরা তুমি করে বললে
যেরকম একটা স্নেহের সম্পর্ক তৈরি হয়, আপনিতে সেই অনুভূতিটা আসে না। স্যার রোল কল করলেন
না। তার মানে ক্লাস করা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু এত পেছনদিকে বসা উচিত হয়নি আমার। ব্ল্যাকবোর্ডের
লেখা ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছি না। স্যারের পড়ানোর স্টাইল গতানুগতিক। বই থেকে একটার পর একটা
অংক বোর্ডে করাচ্ছেন। মাছিমারা কেরানির মতো তা বোর্ড থেকে যে খাতায় তুলবো তার উপায়
নেই। আমি বোর্ডের লেখা ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছি না। নিজে নিজে করারও কোন উপায় নেই। উচ্চমাধ্যমিকে
অঙ্কে যে ফাঁকি দিয়েছি, তার ফলে অংকের ভিত শক্ত হয়নি। এখানে অনেক সহজ ব্যাপারও বুঝতে
কষ্ট হচ্ছে। গণিত নাকি ফিজিক্সের ভাষা। এই ভাষাটাই যদি ঠিকমতো শিখতে না পারি, ফিজিক্স
শিখবো কীভাবে! প্রামাণিক স্যারের ক্লাস যে কিছুই বুঝতে পারি না, তার প্রধান কারণ উচ্চতর
গণিতের উপর দক্ষতা না থাকা। ক্লাস পালানোর সুযোগটাকে মনে হচ্ছে খুব একটা কাজে লাগানো
যাবে না। যীশুর খাতার দিকে তাকালাম। সে খসখস করে লাইনের পর লাইন লিখে ফেলছে। মনে হচ্ছে
গণিতের মূল সুর সে ধরে ফেলেছে। আমার অবস্থা এখন অনেকটা ক্রিকেট খেলার সেই দর্শকের মতো
যে খেলার নিয়মকানুন কিছুই জানে না। গ্যালারির সবাই উঠে যাচ্ছে দেখে বুঝতে পারলাম খেলা
শেষ – মানে ক্লাস শেষ।
“হেই প্রদীপ,
হলে ফরম দিতেছে। গিয়া নিয়ে আসিস।“ – গ্যালারি থেকে বের হবার সময় শাকিল বললো। শাকিল,
প্রেমাঙ্কর, আনন্দ, জামাল, কবীর – সবাই সোহরাওয়ার্দী হলে থাকে। ফার্স্ট ইয়ারে এখনো
সিট দেয়নি কাউকে, কিন্তু এরা সবাই কারো না কারো সাথে ডাবলিং করে থাকছে। আমারও হলে ওঠা
দরকার, কিন্তু পরিচিত কেউ নেই যার রুমে গিয়ে উঠা যায়। তাই সিটের জন্য নিয়ম মাফিক দরখাস্ত
করতে হবে। বিকেলে প্র্যাকটিক্যাল আছে। তাই এখনই হলে গিয়ে ফরমটা নিয়ে আসা দরকার। জমা
দেয়ার সময় আবার অনেক কাগজপত্রও দিতে হবে দরখাস্তের সাথে।
সোহরাওয়ার্দী
হলের সেকশান অফিসারের রুম থেকে সিটের দরখাস্তের ফরম নিয়ে বের হবার সময় দেখলাম আজকের
ক্লাসের সেই ‘সেক্সপিয়ার’ অফিসে ঢুকছে। তার অঙ্গভঙ্গি আর গলার জোর দেখে নিশ্চিত বলা
যায় – সে এই হলের ছোটখাট কোন নেতা। আমার অনুমানের পক্ষে এত তাড়াতাড়ি প্রমাণ পাওয়া যাবে
চিন্তাও করিনি। প্রেমাঙ্কর তাকে নাম ধরে ডাকলো। তার আসল নাম উহ্য থাক। ধরা যাক তার
নাম ওয়াসিম। ওয়াসিম জাতীয় ছাত্রসমাজের একজন পাতিনেতা। এরশাদের মতোই ডান্ডা হাতে কবিতার
সেবা করে।
*****
‘যত গর্জে তত
বর্ষে না’ কথাটা যতটা সত্য, ‘যত বর্ষে তত গর্জে না’ কথাটাও ততটা সত্য। দুপুরের পর থেকে
কোন ধরনের মেঘগর্জন ছাড়াই এত বেশি বর্ষণ শুরু হয়েছে যে তা এখনো থামেনি। সোহরাওয়ার্দীর
মোড় থেকে বাসে উঠতে গিয়ে ভিজে গিয়েছি। ক্যাফেটরিয়ার সামনে বাস থেকে নেমে ফ্যাকাল্টি
পর্যন্ত আসতে আসতে আবার ভিজেছি। এখন ভেজা শার্ট-প্যান্টে কেমন যেন শীত শীত লাগছে।
তিন তলায় প্র্যাকটিক্যাল
রুমের সামনে সবাই এসে জড়ো হচ্ছে একে একে। রুম এখনো খোলেনি। সেদিন আদম শফিউল্লাহ স্যারের
ধমক খাবার পর প্র্যাকটিক্যাল রুমের আশেপাশেও আমরা আর জোরে শব্দ করি না। কিন্তু স্যারের
ধমকের ব্যাপারেও ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’ কথাটা খাটে। সেদিন ধমক খাবার ঘন্টাখানেক পরেই
প্রদীপ চুপি চুপি বলেছিল, স্যার কিন্তু ভালোমানুষ।
“কীভাবে বুঝলি?”
“ঐ দ্যাখ, বারান্দায়।“
জানালা দিয়ে
দেখেছিলাম আদম শফিউল্লাহ স্যার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। যারা সিগারেট টানে,
তারা নাকি রাগী হলেও মানুষ হিসেবে খুব একটা খারাপ হয় না। এটা প্রদীপের থিওরি। এই থিওরির
অকুন্ঠ সমর্থক হাফিজ। এর কারণ সহজেই অনুমেয়। আজও দেখছি বারান্দার রেলিং-এ এক পা তুলে
দিয়ে হাঁটুতে কনুই রেখে নায়কোচিত ভঙ্গিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে হাফিজ আর
প্রদীপ। একটু পরেই তাদের সাথে যোগ দিলো স্বপন আর ইকবাল।
সিগারেটের ধোঁয়া
সহ্য হয় না বলে আমরা দূরে দাঁড়িয়ে আছি। অর্পণ সিগারেটের ব্যাপারে ভীষণ অসহিষ্ণু। সে
প্রায়ই বাসের ভেতর ধুমপানরত যাত্রীর মুখ থেকে বিড়ি-সিগারেট কেড়ে নিয়ে ফেলে দেয়। এখানে
সে ততটা কট্টর হতে পারছে না বলে ছটফট করতে করতে বললো, “তোরা নিজেদের লাংসতো ঝাঁঝরা
করে দিচ্ছিস, আমাদেরও বারোটা বাজাচ্ছিস।“
প্রদীপ সিগারেটে
একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো, “শেক্সপিয়ার সারাজীবনে যা কিছু লিখেছেন
সবই লিখেছেন ইংরেজিতে।“ শেক্সপিয়ার আজ কিছুতেই পিছু ছাড়ছেন না। প্রদীপ বেশ সিরিয়াসলি
বলছে, “কিন্তু একটিমাত্র গান লিখেছিলেন বাংলায়। কোন্ গানটা জানিস?” শেক্সপিয়ার বাংলায়
গান লিখেছিলেন! গুল মারারও একটা সীমা থাকে। কিন্তু অর্পণ সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করলো,
“কোন্টা?”
“এক টানেতে
যেমন তেমন, দু’টানেতে রোগী, তিন টানেতে রাজা-উজির, চার টানেতে সুখি। - বুঝলি?”
No comments:
Post a Comment