প্রথম
অধ্যায়
স্যাটেলাইটের
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
পৃথিবী এখন মানুষের
হাতের মুঠোয়। পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে তা ইচ্ছে করলে আমরা সরাসরি দেখতে পারি
বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে। ইচ্ছে করলে ঘটনাস্থল থেকে যে কেউ ছবি তুলে বা ভিডিও করে
মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে দিতে পারে বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর যেখানে কোন মানুষের পক্ষে
যাওয়া সম্ভব নয় সেখানে কী হচ্ছে তাও আমরা ঘরে বসেই দেখতে পারি স্যাটেলাইটের
সাহায্যে। আমাজনের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান এখন ড্রোনের মাধ্যমে মানুষের ঠিকানায়
জিনিসপত্র পৌঁছে দিচ্ছে কোন মানুষ ছাড়াই। বারো হাজারের বেশি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল
প্রতি মুহূর্তে যা সম্প্রচার করছে তা আমাদের টেলিভিশন সেটে এসে
পৌঁছাবার আগে প্রায় ৮০
হাজার কিলোমিটার পথ ঘুরে আসে পৃথিবীর চারপাশে। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে বসে পৃথিবীর
যে কোন জায়গার খবর যে
আমরা পাচ্ছি তার কোন না কোন অংশ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রচারিত। পৃথিবীর পুরো
যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে দিয়েছে স্যাটেলাইট। বর্তমান পৃথিবীর তথ্য আদান প্রদানের জন্য, মানুষের আধুনিক জীবনযাপনের জন্য যা
কিছু দরকার হয় তার বেশিরভাগের সাথেই কোন না কোনভাবে স্যাটেলাইট জড়িত। গতিশীল
পৃথিবীর গতিশীল মানুষকে সত্যিকারের আধুনিক করে দিয়েছে স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা।
স্যাটেলাইট যোগাযোগ এখন একটি বিরাট শিল্প ও ব্যবসা। এর সাথে জড়িত
আছে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো। কোটি কোটি ডলার এখন বিনিয়োগ করা হচ্ছে স্যাটেলাইট ইন্ডাস্ট্রিতে।
বিভিন্ন দেশের সরকারি ও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান এর সাথে জড়িত। এর জন্য তৈরি হয়েছে সুনির্দিষ্ট
বিধিমালা। বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটের পাশাপাশি শক্তিশালী দেশগুলো গড়ে তুলছে আধুনিক
থেকে অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা স্যাটেলাইট। বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য আছে বিভিন্ন ধরনের অত্যন্ত
শক্তিশালী স্যাটেলাইট। মানুষ মহাকাশে স্থাপন করেছে
স্পেস স্টেশান।
পৃথিবীর বাইরে স্যাটেলাইট স্থাপন করার
ধারণা তৈরি হতে মানুষের লেগেছে কয়েক হাজার বছর। আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলো এবং
তাদের উপগ্রহগুলোর গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়ার আগপর্যন্ত মানুষের পক্ষে
কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট সম্পর্কে ভাবার কোন উপায় ছিল না। পৃথিবী সূর্যের
চারপাশে ঘুরে, আবার চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে - মহাকাশের গ্রহ উপগ্রহগুলোর এসব
তথ্য জানার পরেই মানুষ পৃথিবীর বাইরে থেকে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করার কথা ভাবতে
পেরেছে। চলুন দেখি এই ভাবনাগুলো কীভাবে বিবর্তিত হয়ে আধুনিক রূপ ধারণ করেছে।
প্রায় ২৪০০ বছর আগে গ্রিক দার্শনিক
সক্রেটিস বলেছিলেন, "মানুষ যদি বায়ুমন্ডল ভেদ করে আরো অনেক উপরে উঠে পৃথিবীকে
ভালোভাবে দেখতে পারে, তবেই পৃথিবীকে ভালোভাবে বুঝতে পারবে।"
গ্রিক দার্শনিকরা পৃথিবীর বাইরে গিয়ে
পৃথিবীকে দেখার প্রয়োজনীয়তা তথা মহাকাশ পরিক্রমার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও খালি
চোখে আকাশ দেখা ছাড়া সে ব্যাপারে তেমন বেশি কিছু করতে পারেননি পরবর্তী দুই হাজার
বছর। তারপর দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যায় যখন ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও আকাশের দিকে
টেলিস্কোপ তাক করলেন।
১৬১০ সালে গ্যালিলিও তাঁর নিজের তৈরি
টেলিস্কোপ দিয়ে বৃহস্পতি গ্রহের চারপাশে ঘূর্ণনরত চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করলেন।
তাঁর টেলিস্কোপটি আরেকটু উন্নত হলে তিনি দেখতে পেতেন বৃহস্পতি গ্রহের আরো অনেকগুলো
উপগ্রহ আছে। বৃহস্পতি
গ্রহের চাঁদগুলোর গতিপথ দেখার পর গ্যালিলিওর মনে হলো এই উপগ্রহগুলো যেন তাদের মনিব-গ্রহের আদেশে একটি কক্ষপথে থেকে
চাকরের মতো ঘুরছে মনিবের চার পাশে। ল্যাটিন ভাষায় তিনি উপগ্রহগুলোর নাম দিলেন 'satelles' (স্যাটেলিস) - যার অর্থ হলো servant বা
চাকর। satelles থেকে ইংরেজিতে স্যাটেলাইট
(satellite) কথাটি
এসেছে।
আজ মানুষের হাতে ল্যাবোরেটরিতে বানানো এই
স্যাটেলাইটগুলো মানুষের যান্ত্রিক চাকর ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষ এদেরকে বানায়
তাদের কাজে লাগানোর জন্য। যোগাযোগ (communication), সম্প্রচার (broadcasting), দূর অনুধাবন (remote sensing), মহাকাশ পরিক্রমণ (space navigation), আবহাওয়াবিদ্যা (meteorology),
বৈজ্ঞানিক গবেষণা - ইত্যাদি নানারকম কাজের জন্য এখন নানারকম স্যাটেলাইট তৈরি করে মহাকাশে পাঠাচ্ছে মানুষ। কিন্তু
সেটা শুরু হয়েছে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে।
চিত্র ১: গ্যালিলিও টেলিস্কোপের সাহায্যে বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেন
গ্যালিলিও স্যাটেলাইট
শব্দের প্রচলন করলেও তিনি কিন্তু তখনো জানতেন না মহাকাশের নক্ষত্র, এবং গ্রহ-উপগ্রহগুলো
কিসের টানে ঘুরছে। অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণ বল সম্পর্কে তখনো কোন ধারণাই ছিল না কারো।
গ্যালিলিওর বৃহস্পতির স্যাটেলাইট
আবিষ্কারের প্রায় আশি
বছর পরে ১৬৮৭ সালে
স্যার আইজাক নিউটন মাধ্যাকর্ষণ বল এবং তার সূত্র আবিষ্কার করেন। নিউটনের কিছু আগে জোহানেস কেপলার
গ্রহগুলোর গতিপথ ব্যাখ্যা করে তিনটি সূত্র প্রকাশ করেছিলেন। কপার্নিকাস সৌরজগতের
গ্রহ ও উপগ্রহগুলোর গতিপথের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। নিউটন সেগুলোকেও কাজে লাগিয়ে তাঁর প্রিঙ্কিপিয়া ম্যাথাম্যাটিকা (Principia Mathematica)
বইতে ব্যাখ্যা করেছেন
মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে
কীভাবে বস্তু পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে আকৃষ্ট হয়। কোন কিছু উপরে ছুঁড়ে দিলে তা ভূমিতে ফিরে
আসে। কিন্তু কত বেগে ছুড়লে কোন বস্তু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টান অতিক্রম করে চলে
যাবে তার হিসেবও তিনি প্রকাশ করেছিলেন একটি উদাহরণের মাধ্যমে।
নিউটন একটি কাল্পনিক পরীক্ষণের (thought
experiment) বর্ণনা দিয়েছিলেন। অনেক উঁচু একটি পাহাড়ের উপর থেকে যদি কামানের গোলা নিক্ষেপ
করা হয় তবে গতির প্রথম সূত্র অনুযায়ী গোলাটির সোজাপথে সমান বেগে চলে যাওয়ার কথা।
কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের ফলে গোলাটি পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পাহাড়ের কাছাকাছি
মাটিতে পড়ে যাবে (চিত্র ২: A)।
চিত্র ২: নিউটনের ক্যানন-বল পরীক্ষা
এখন গোলাটির বেগ যদি
আরেকটু বাড়ানো হয়, তখন দেখা যাবে গোলাটি আরেকটু দূরে গিয়ে পড়ছে (চিত্র ২:
B)। এভাবে কামানের গোলার বেগ বাড়াতে বাড়াতে এমন একটা পর্যায় আসবে যখন গোলাটি
পৃথিবী থেকে অনেক উপরে গিয়ে মাধ্যাকর্ষণের টানে পৃথিবীর চারপাশে বৃত্তাকার পথে
ঘুরতে থাকবে, কিন্তু পৃথিবীতে আর ফিরে আসবে না (চিত্র ২:
C)। এই বৃত্তাকার কক্ষপথটিই হলো আমাদের ভূ-স্থির কক্ষপথ বা Geostationary
orbit। এই অরবিট বা কক্ষপথ সম্পর্কে পঞ্চম অধ্যায়ে
বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। কামানের গোলার বেগ যদি আরো বাড়ানো হয় দেখা যাবে
গোলাটি পৃথিবী থেকে আরো দূরে গিয়ে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকবে (চিত্র ২:
D)। পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মূল ধারণাটি
আমরা এখান থেকেই পেয়েছি। কিন্তু তা আসলে ঘটার আগে ঘটেছে বিভিন্ন কল্পবিজ্ঞানে
লেখকের কল্পনায়।
বাস্তব স্যাটেলাইট তৈরির আগেই আমরা কাল্পনিক স্যাটেলাইট সম্পর্কে জেনেছি science fiction বা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি থেকে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মূল বিষয় ছিল পৃথিবীর মানুষের মহাকাশে অভিযান। ১৮৬৩ সালে ফরাসি নাট্যকার আকিলে ইরাউদ (Achille Eyraud) লিখলেন 'ভয়েজ টু ভেনাস' (Voyage to Venus), ১৮৬৫ সালে আরেকজন ফরাসি লেখক জুল ভার্ন (Jules Verne) লিখলেন 'ফ্রম আর্থ টু মুন' (From Earth to Moon), ১৮৬৯ সালে আমেরিকান লেখক এডোয়ার্ড হেইল (Edward Everette Hale) লিখলেন 'দি ব্রিক মুন' (The Brick Moon), ১৮৯৭ সালে ইংরেজ লেখক হার্বাট জর্জ ওয়েলস (এইচ জি ওয়েলস) লিখলেন 'দি ফার্স্ট মেন ইন দি মুন' (The First Men in the Moon)।
চিত্র
৩: বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে
স্যাটেলাইটের কথা
সবগুলো বৈজ্ঞানিক
কল্পকাহিনিতেই মানুষের মহাশূন্যে - বিশেষ করে চাঁদে অভিযানের কথা থাকলেও এডোয়ার্ড
হেইলের দি ব্রিক মুনে যে স্যাটেলাইট যোগাযোগের বর্ণনা ছিল তার সাথে বর্তমান
স্যাটেলাইট যোগাযোগের অনেক মিল আছে। তাঁর বইয়ের ঘটনায় একটি কৃত্রিম চাঁদ পৃথিবীর পোলার অরবিটে (polar
orbit) স্থাপন করা হয়
পৃথিবীর আবহাওয়া ও অন্যান্য বিষয়ের দিকে নজর রাখার জন্য। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে
স্যাটেলাইটকে কাজে লাগানোর এমন
চমৎকার ধারণা এর আগে পাওয়া যায়নি। হেইলের বইতে পোলার অরবিটে স্থাপিত স্যাটেলাইটটি
ছিল ইটের তৈরি। ১৭ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা ছিল সেই স্যাটেলাইটে। পৃথিবীর সাথে
যোগাযোগের জন্য তারা মোর্স কোড ব্যবহার করতেন। এখন আমাদের ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি
আছে। মানুষবিহীন স্যাটেলাইটে আমাদের মোর্স কোড ব্যবহার করতে হয় না। কিন্তু মূল ধারণার
জন্য কল্পবিজ্ঞানের অবদানকে আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারি না।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তির স্বর্ণযুগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। নিউটনের গতিসূত্র এবং মাধ্যাকর্ষণ বলের
সূত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারও কয়েক শ' বছর আগে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও আইনস্টাইনের
আপেক্ষিকতার সূত্র আমাদের মহাকাশ অভিযানের সমস্ত হিসেবনিকাশ নিখুঁত করে তুলতে
সাহায্য করেছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে (১৯০৩) উড়োজাহাজ উদ্ভাবিত হয়ে গেছে। উড়োজাহাজ
চলে বাতাসের প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে। বায়ুমন্ডলের খুব বেশি উপরে উড়োজাহাজ উঠে না।
কিন্তু মহাকাশের গ্রহ উপগ্রহগুলোতে যেতে হলে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ অতিক্রম করে যেতে
হবে। তার জন্য অত্যন্ত উচ্চগতিসম্পন্ন আকাশযানের দরকার। উচ্চগতিসম্পন্ন রকেটের
সম্ভাবনা নিয়ে সর্বপ্রথম গবেষণা করেছিলেন রাশিয়ান বিজ্ঞানী কনস্টান্টিন
জিওল্কভস্কি (konstantin Tsiolkovsky)।
চিত্র ৪: রাশিয়ান বিজ্ঞানী কনস্টান্টিন জিওল্কভস্কি
কনস্টান্টিন
জিওল্কভস্কি ছিলেন রাশিয়ার একটি স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক। তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষা তাঁর ছিল না। নিজে নিজে শিখেছিলেন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত। শেষের দিকে
কানেও শুনতে পেতেন না তিনি। ১৮৯৫ সাল থেকেই তিনি গবেষণা শুরু করেছিলেন মহাকাশে
কীভাবে রকেট পাঠানো যায় সে ব্যাপারে। হিসেব নিকেশ করে বের করেছিলেন পৃথিবীর
মাধ্যাকর্ষণ বল অতিক্রম করে যেতে রকেটের মুক্তিবেগ (escape
velocity) হতে হবে সেকেন্ডে প্রায় ৮ কিলোমিটার। [মুক্তিবেগ হিসেব করার পদ্ধতি দেখানো
হয়েছে চতুর্থ অধ্যায়ে]। মহাকাশযান পাঠানোর জন্য কতটুকু জ্বালানি লাগবে তার
তত্ত্বীয় হিসেবও অনেকটুকু করে ফেলেছিলেন কনস্টান্টিন জিওল্কভস্কি।
চিত্র ৫: আমেরিকান বিজ্ঞানী রবার্ট গডার্ড
অন্যদিকে
আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট গডার্ড পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেছিলেন মহাকাশে
রকেট উৎক্ষেপণের বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা সম্পর্কে। শুরুতে তাঁর কার্যকলাপকে সবাই
পাগলামী ভেবে হাসাহাসি করেছিল। কিন্তু ১৯২৬ সালের ১৬ মার্চ তিনি সফলভাবে পৃথিবীর
সর্বপ্রথম মডেল রকেট উৎক্ষেপণ করেছিলেন। ১৯২৬ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে প্রফেসর
গডার্ড ৩৪টি বিভিন্ন ধরনের রকেট উৎক্ষেপণ করেছিলেন। সেই রকেটগুলোর কোন কোনটা
সর্বোচ্চ ২.৬ কিলোমিটার পর্যন্ত উঁচুতে উঠেছিল
এবং ঘন্টায় ৮৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বেগপ্রাপ্ত হয়েছিল। ধরতে গেলে রবার্ট গডার্ডের
হাতেই রকেট প্রযুক্তির গোড়াপত্তন হয়েছিল। এই রকেট ছাড়া মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপন
করা অসম্ভব।
রকেট সায়েন্সে প্রফেসর
গডার্ডের আবিষ্কারের ২১৪টি মেধাস্বত্ব থাকা সত্বেও জীবদ্দশায় তিনি খুব একটা পাত্তা
পাননি। সবার কাছে উপেক্ষিত হয়ে তিনি নিজেকে খুব গুটিয়ে নিয়েছিলেন। নিজের গবেষণা
সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতেনও না। অথচ তাঁর মৃত্যুর পর সবাই মেনে নিতে বাধ্য হন যে
তাঁর আবিষ্কৃত মাল্টিস্টেজ রকেট ও তরল-জ্বালানির রকেটই পথ দেখিয়েছে আধুনিক রকেট
বিজ্ঞানের। তাঁর ১৯১৯ সালে লেখা বই A Method of Reaching Extreme
Altitudes রকেট সায়েন্সের ক্ল্যাসিক বই
হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়
হিটলার পৃথিবীজুড়ে তান্ডব চালিয়েছে। শুধুমাত্র যুদ্ধে জেতার জন্য বিজ্ঞানীদের
বাধ্য করেছে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কার করতে। আকাশপথে ক্ষেপণাস্ত্র
নিক্ষেপের জন্য সেই সময় জার্মান বিজ্ঞানীরা রকেট সায়েন্সে অনেকদূর অগ্রসর হয়।
যুদ্ধের পর সেই সব বিজ্ঞানীদের একটি দলকে নিয়ে যায় আমেরিকা। আমেরিকান রকেট
সায়েন্সে তাঁরা অবদান রাখতে শুরু করে। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে যায় আরেকটি দলকে।
শুরু হয় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডাযুদ্ধ। বৈজ্ঞানিক শক্তিমত্তা
প্রদর্শনের একটি প্রধান ক্ষেত্র হয়ে ওঠে মহাকাশ।
চিত্র ৬: স্যার আর্থার সি ক্লার্ক
১৯৪৫ সালে স্যার আর্থার সি ক্লার্ক (Arthur C Clarke) কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটের ধারণা
দেন একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ব্রিটিশ রাডার
কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তখন থেকেই তিনি মহাকাশের জিওসিন্ক্রোনাস অরবিট (Geosynchronous
orbit) বা ভূ-সমন্বিত কক্ষপথে যোগাযোগ উপগ্রহ বা
কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট স্থাপন করলে কী কী সুবিধা হবে সে ব্যাপারে গবেষণা করছিলেন।
১৯৪৫ সালের জুন মাসে তিনি একটা চিঠিতে এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখে জানান তাঁর
সহকর্মীদের। এর চার মাস পরে অক্টোবর মাসে তিনি Wireless World জার্নালে দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। যোগাযোগ উপগ্রহের উপযোগিতা, কীভাবে তা
কক্ষপথে পাঠানো হবে, সেখান থেকে কীভাবে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হবে
ইত্যাদি সব বিস্তারিত ভাবে প্রকাশ করেন সেই প্রবন্ধে। কিন্তু সেই সময় তাঁর
প্রবন্ধটি কারো কাছেই তেমন কোন গুরুত্ব পায়নি।
স্যার আর্থার ক্লার্ক ৯০
বছর বেঁচেছিলেন। তিনি দেখে যেতে পেরেছিলেন তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং কল্পকাহিনিতে
বর্ণিত মহাকাশের স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা কীভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। তাঁর
সম্মানে মহাকাশের ভূ-স্থির কক্ষপথের (Geostationary orbit) নাম রাখা হয়েছে ক্লার্ক অরবিট।
চিত্র ৭: পৃথিবীর প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিক-১
সত্যিকারের মহাকাশ যুগের শুরু হয় ১৯৫৭ সালের ৭ অক্টোবর। সেদিন সোভিয়েত
ইউনিয়নের বিজ্ঞানীদের তৈরি পৃথিবীর প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিক-১ (Sputnik-1) সফলভাবে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয় এবং কক্ষপথে স্থাপন করা হয়।
অনেক বছর থেকেই আমেরিকা ও
সোভিয়েত ইউনিয়ন আলাদা আলাদাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছিলো স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের।
সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পুটনিক-১ এর সাফল্যে আমেরিকা ভীষণ ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে এবং মরিয়া
হয়ে ওঠে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে মহাকাশে আধিপত্য বিস্তার করতে। মহাকাশ
গবেষণার কাজে গতি আনার জন্য ১৯৫৮ সালে আমেরিকান কংগ্রেসে নতুন আইন পাস করা হয় এবং
গঠিত হয় National Aeronautical and Space Administration সংক্ষেপে NASA.
পরবর্তী চার মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন আরো উন্নত এবং আরো বড় কয়েকটি স্যাটেলাইট
উৎক্ষেপণ করতে সফল হয়। কিন্তু আমেরিকা বার বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে থাকে। শেষ
পর্যন্ত ১৯৫৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আমেরিকা তাদের প্রথম স্যাটেলাইট এক্সপ্লোরার-১ (Explorer-1) উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হয়।
চিত্র ৮: আমেরিকার প্রথম স্যাটেলাইট এক্সপ্লোরার-১
মনে হতে পারে যে প্রথম দিকের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে আমেরিকা যতবার ব্যর্থ
হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ততবার ব্যর্থ হয়নি। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা সেরকম নয়। সেই সময়
সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না। সরকারিভাবে যতটুকু জানতে দেয়া
হতো তার বাইরে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পারতো না বহির্বিশ্ব।
সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ব্যর্থতার কোন খবরই প্রচার করতে দিতো না। অন্যদিকে আমেরিকায়
প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতার কারণে তাদের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সবই জানতে পারতো
সারা পৃথিবী। যে কোন গবেষণা এবং বৈজ্ঞানিক প্রকল্পে সাফল্য এবং ব্যর্থতা দুটোই
আছে। মহাকাশ গবেষণাও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে সেই
সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডাযুদ্ধের ফলে মহাকাশবিজ্ঞানের অনেক
উন্নতি হয়েছে।
চিত্র ৯: প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দিচ্ছেন
১৯৬০ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জন এফ কেনেডির প্রধান নির্বাচনী
প্রতিশ্রুতি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মহাকাশ প্রতিযোগিতায় জেতা। নির্বাচনে জেতার
পর প্রেসিডেন্ট কেনেডি ঘোষণা করেছিলেন ষাটের দশক শেষ হবার আগেই চাঁদে মানুষ পাঠাতে
সক্ষম হবে আমেরিকা । সারাপৃথিবীতে ছড়িয়ে গিয়েছিল সেই উন্মাদনা। মানুষের চাঁদে
অভিযানের আয়োজন, প্রস্তুতি এবং সাফল্য ছিল বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের সবচেয়ে বড়
বৈজ্ঞানিক ঘটনা।[1]
প্রেসিডেন্ট কেনেডি সেই
সময় পুরো পৃথিবীর জন্য একটি গ্লোবাল কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার
ব্যাপারেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ
অধিবেশনে পৃথিবীর সব দেশের সব মানুষের জন্য স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগের অধিকার
নিশ্চিত করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে জাতিসংঘকে আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট
কেনেডি। ফলে জাতিসংঘ পৃথিবীর সব দেশের জন্য স্যাটেলাইট যোগাযোগের নিশ্চয়তা বিধান
করে রেজ্যুলেশন পাস করে। জাতিসংঘের রেজ্যুলেশন ১৭২১ এর সেকশান-পি সবার জন্য
স্যাটেলাইট যোগাযোগের নিশ্চয়তা বিধান করেছে: "communications
by means of satellite should be available to the millions of the world as soon
as possible on a global and non-discriminatory basis".[2]
আমেরিকান কংগ্রেস 'কমিউনিকেশন
স্যাটেলাইট অ্যাক্ট ১৯৬২' পাস করার পর আমেরিকান স্যাটেলাইট করপোরেশন কমস্যাট (Comsat) গঠিত হয়। এর দু'বছর পরেই ১৯৬৪ সালে আমেরিকার নেতৃত্বে গঠিত হয়
আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশান্স স্যাটেলাইট কনসোর্টিয়াম ইন্টেলস্যাট (Intelsat)। শুরুতে আমেরিকান বলয়ের মাত্র কয়েকটি দেশ - আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া,
কানাডা, জাপান এবং ইওরোপের দেশগুলো ইন্টেলস্যাটের সদস্য ছিল। পরে বিশ্বের শতাধিক
দেশ ইন্টেলস্যাটের সদস্য হয়।
এদিকে সোভিয়েত শিবিরও বসে
ছিল না। পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে তারাও সমাজতান্ত্রিক বলয়ের আটটি দেশ - বুলগেরিয়া,
কিউবা, চেকোস্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি, মঙ্গোলিয়া, পোলান্ড এবং
রুমানিয়াকে সাথে নিয়ে গঠন করে 'ইন্টারস্পুটনিক ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশান অব
স্পেস কমিউনিকেশান্স, সংক্ষেপে 'ইন্টারস্পুটনিক' (Intersputnik)।[3]
স্যাটেলাইটের
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যত উন্নত হয়েছে, স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও ততই বেড়ে
গেছে। এই বাণিজ্যের অধিকার যাতে কোন দেশের একচেটিয়া হয়ে না পড়ে সেই লক্ষ্যে
মহাকাশের স্যাটেলাইট যোগাযোগের জন্য বেশ জটিল এবং কঠোর নিয়মনীতি তৈরি করা হয়
ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স ইউনিয়নের উদ্যোগে। পৃথিবীব্যাপী বেতার তরঙ্গের
মাধ্যমে যত ধরনের যোগযোগ ব্যবস্থা চালু হয়েছে তার সবগুলোর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক
সংস্থা হলো ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স ইউনিয়ন বা আই-টি-ইউ (ITU)। বেতার তরঙ্গ বন্টন থেকে শুরু করে মহাকাশে স্যাটেলাইটের স্থান নির্ধারণ
পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে আই-টি-ইউ। এই বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে আই-টি-ইউ
সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
[1] মানুষের চাঁদে অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ইচ্ছে
হলে পড়তে পারেন মীরা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আমার 'চাঁদের নাম লুনা'।
[2] United
nations General Assembly Resolution of Satellite Communications 1961.
[3] এই ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের জন্য কক্ষপথের স্থান ভাড়া নেয়া হয়েছে।
আর আপনার জন্য অভিনন্দন।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ প্রিয় পাঠক।
Deleteলেখাটি ব্লগে পাবলিশ করার জন্য ধন্যবাদ!
ReplyDeleteপড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। সাথে থাকবেন।
Deleteঅসংখ্য ধন্যবাদ।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আপনাকেও।
Delete