Monday, 15 March 2021

সবার জন্য স্যাটেলাইট - পর্ব ৩

 



তৃতীয় অধ্যায়

ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশান ইউনিয়ন

 

মানুষের বিবর্তনের সাথে সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থারও বিবর্তন ঘটছে যুগে যুগে। মাত্র দু'শ বছর আগেও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কোন খবর পাঠানোর দ্রুততম মাধ্যম ছিল অশ্বারোহী দূত। উনবিংশ শতাব্দীতে বিদ্যুৎ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা যখন শুরু হলো - তখন বৈদ্যুতিক উপায়ে সংকেত পাঠানোর ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন ইওরোপের বিজ্ঞানীরা।

          ১৮৩৯ সালে লন্ডনে পৃথিবীর সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক টেলিগ্রাফ সার্ভিস চালু হয়। ১৮৪৪ সালে আমেরিকার স্যামুয়েল মোর্স নিজের উদ্ভাবিত কোডের সাহায্যে প্রথম টেলিগ্রাফ ম্যাসেজ পাঠান। ক্রমেই টেলিগ্রাফ হয়ে ওঠে যোগাযোগের দ্রুততম মাধ্যম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তখন টেলিগ্রাফের তার লাগানো শুরু হয়। ১৮৫০ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে সাগরের নিচ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার সংযোগ স্থাপিত হয়। ১৮৫৮ সালে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মধ্যে প্রথম ট্রান্স-আটলান্টিক টেলিগ্রাফ তার সংযোগ দেয়া হয়। এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে টেলিগ্রাফ পাঠানো সহজ হয়ে যায়। কিন্তু তাতে কিছু রাজনৈতিক সমস্যা শুরু হয়।

          এক দেশ থেকে অন্য দেশে টেলিগ্রাফ যাওয়ার সময় কোন গোপনীয় তথ্য পাচার করা হচ্ছে কি না দেখার জন্য নিয়ম করা হয় যে যখন যে দেশের উপর দিয়ে টেলিগ্রাফ যাবে - সেই দেশে টেলিগ্রাফের তথ্যগুলো অনুবাদ করা হবে এবং তারপর যাচাই করার পর টেলিগ্রাফ যেতে দেয়া হবে পরবর্তী গন্তব্যে। এতে টেলিগ্রাফ পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যে সমমনা দেশগুলোর মধ্যে সমঝোতা চুক্তি করা হয়। ইওরোপের বিশটি দেশ ১৮৬৫ সালের ১৭ মে প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল টেলিগ্রাফ কনফারেন্সে মিলিত হয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেদিনই গঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল টেলিগ্রাফ ইউনিয়ন (আই-টি-ইউ)।[1] ১৮৬৮ সালে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে আই-টি-ইউ'র সদর দপ্তর হবে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে।

          ১৮৭৬ সালে আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল টেলিফোন আবিষ্কার করার পর যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে। ১৮৮৫ সালে বার্লিনে ইন্টারন্যাশনাল টেলিগ্রাফ কনফারেন্সে টেলিফোনের আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি ঠিক করে আইন পাস করা হয়। টেলিফোনের তার বসানো হয় দেশে দেশে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে থাকেন - তারহীন যোগাযোগ ব্যবস্থা আবিষ্কারের জন্য।

          সেই সময় ব্রিটেনের বিজ্ঞানী ডেভিড হিউজ (David Hughes), আমেরিকার নিকোলা টেসলা, আমাদের জগদীশচন্দ্র বসু, রাশিয়ার আলেক্সান্ডার পোপোভ, ইতালির গুগলিয়েলমো মার্কনি আলাদা আলাদাভাবে বেতার যোগাযোগের জন্য গবেষণা করে সফল হয়েছেন।

 

চিত্র ১৭: আই-টি-ইউ বেতার যোগাযোগের অন্যতম আবিষ্কারক হিসেবে বিজ্ঞানী ডেভিড হিউজ, নিকোলা টেসলা, আলেকজান্ডার পোপোভ, মার্কনি ও জগদীশচন্দ্র বসুকে স্থান দিয়েছে তাদের ইতিহাসের পাতায়।

          

বেতার যোগাযোগ শুরু হওয়ার পর ১৯০৬ সালে বিশ্বের প্রথম রেডিও ব্রডকাস্টিং বা বেতার সম্প্রচার শুরু হয়। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নিয়ম নির্ধারণ করার জন্য সেবছরই প্রথম আন্তর্জাতিক রেডিওটেলিগ্রাফ কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় বার্লিনে। পৃথিবীর ২৯টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দেন সেই কনফারেন্সে। রেডিওটেলিগ্রাফ সংক্রান্ত একটি নতুন বিভাগ চালু হলো আই-টি-ইউ'তে। বেতার সম্প্রচারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নীতিমালা তৈরি করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বেতারযন্ত্র এবং বেতার অনুষ্ঠান।

          ১৯২৭ সালে ওয়াশিংটনে আই-টি-ইউ'র কনফারেন্সে বিভিন্ন ধরনের বেতার সম্প্রচারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড নির্ধারণ করে দেয়া হয়। স্থায়ী সম্প্রচার কেন্দ্রের জন্য এক ধরনের ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড, সামুদ্রিক জলযানের জন্য এক ধরনের ব্যান্ড, উড়োজাহাজের জন্য এক ধরনের, পরীক্ষামূলক কেন্দ্রের জন্য এক ধরনের, আবার বাণিজ্যিক বেতার কেন্দ্রের জন্য এক ধরনের।

          বেতার যোগাযোগব্যবস্থা এত বেশি এবং এত দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছিল যে ইন্টারন্যাশনাল টেলিগ্রাফ ইউনিয়নের নাম বদলে ১৯৩২ সালে মাদ্রিদ কনফারেন্সে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশান ইউনিয়ন রাখা হয়। ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এই নতুন নাম কার্যকর হয়।

          ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ (United Nations) প্রতিষ্ঠিত হবার পর ১৯৪৭ সালে আই-টি-ইউ'র সাথে জাতিসংঘের চুক্তি হয় যে আই-টি-ইউ বিশ্বের টেলিকমিউনিকেশান বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ এজেন্সি হিসেবে কাজ করবে। ১৯৪৯ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে আই-টি-ইউ জাতিসংঘের এজেন্সি হিসেবে কাজ শুরু করে। প্রতিষ্ঠার বছর হিসেব করলে আই-টি-ইউ হলো জাতিসংঘের সবচেয়ে পুরনো এজেন্সি।

          স্কটিশ ইঞ্জিনিয়ার জন বেয়ার্ড টেলিভিশন উদ্ভাবন করেন ১৯২৫ সালে। ১৯২৬ সালে লন্ডনে তিনি তাঁর মেকানিক্যাল টেলিভিশন কীভাবে কাজ করে তা প্রদর্শন করেন। তারপর থেকে শুরু হয় টেলিভিশন প্রযুক্তি ও সম্প্রচারের যাত্রা। ১৯২৮ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত টেলিভিশন কোম্পানি সর্বপ্রথম ট্রান্স-আটলান্টিক টেলিভিশন সম্প্রচারে সমর্থ হয়।

          ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে টেলিভিশন প্রযুক্তির উন্নতিও হচ্ছিলো দ্রুত। জন বেয়ার্ডের মেকানিক্যাল টেলিভিশন সিস্টেমের জায়গা নিয়ে নেয় আমেরিকান ক্যাথোড রে টিউব প্রযুক্তির টেলিভিশন। তারপর কালার পিকচার টিউব, তারপর সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি, অ্যানালগ টেলিভিশন সম্প্রচার থেকে ডিজিটাল টেলিভিশন সম্প্রচারে বিবর্তন। আই-টি-ইউ টেলিভিশন সম্প্রচারের নীতিমালা গ্রহণ করে ১৯৪৯ সালে। বর্তমানে আই-টি-ইউ পৃথিবীর সব ধরনের টেলিভিশন সম্প্রচারের নিয়ম-নীতি নিয়ন্ত্রণ করে।

          ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পুটনিক-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্যদিয়ে স্যাটেলাইট যুগের সূচনা হয়। টেলিকমিউনিকেশানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে শুরু করে স্যাটেলাইট। ১৯৬২ সালে আমেরিকা-ফ্রান্স-ব্রিটেনের টেলস্টার-১ (Telstar-1) স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইওরোপ ও আমেরিকার মানুষ একই সাথে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান দেখতে পায়।

 

 

চিত্র ১৮: বিশ্বের প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার স্যাটেলাইট - টেলস্টার-১

   

কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটগুলোকে মহাকাশের যে কক্ষপথে স্থাপন করা হয় সেই কক্ষপথের স্থান সীমিত। কক্ষপথের স্থান বন্টনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকলে আন্তর্জাতিক বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। আবার বিভিন্ন টেলিভিশন স্টেশন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য একই স্যাটেলাইট ব্যবহার করে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটি স্টেশনের জন্য আলাদা আলাদা তরঙ্গ না থাকলে সম্প্রচারে বিরাট কারিগরী সমস্যা দেখা দেবে। এই সমস্যা যেন না হয় সেজন্য স্যাটেলাইট সম্প্রচারের নিয়মনীতি প্রবর্তন এবং  কঠোরভাবে প্রয়োগ করার দায়িত্ব নেয় আই-টি-ইউ।

         

স্যাটেলাইটের কক্ষপথে স্থান ও কম্পাঙ্ক বন্টনে আই-টি-ইউ'র ভূমিকা

স্যাটেলাইট যোগাযোগব্যবস্থার দুটো অপরিহার্য বিষয় হলো: কক্ষপথে স্যাটেলাইটের অবস্থান (orbital position) এবং সুনির্দিষ্ট বেতার তরঙ্গ (radio frequency)। কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটগুলোর জন্য নির্দিষ্ট কক্ষপথ হলো জিও-স্টেশনারি আর্থ অরবিট বা ভূ-স্থির কক্ষপথ।[2] এই কক্ষপথে প্রায় হাজারখানেক কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট আছে। কক্ষপথে এই স্যাটেলাইটগুলোর একটির সাথে আরেকটির সংঘর্ষ যেন না ঘটতে পারে সেজন্য কক্ষপথে স্যাটেলাইট পাঠানোর আগেই তার জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করতে হয়। আর কক্ষপথে স্থাপনের পর স্যাটেলাইট থেকে যে বেতার তরঙ্গ পৃথিবীতে পাঠানো হবে এবং পৃথিবীর গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে যে তরঙ্গ স্যাটেলাইটে পাঠানো হবে সেগুলো হতে হবে সুনির্দিষ্ট। এক স্টেশনের তরঙ্গের সাথে অন্য স্টেশনের তরঙ্গ মিলে গেলে সিগনাল কোয়ালিটি খারাপ হয়ে যায়, সম্প্রচারে বিঘ্ন ঘটে। তাই বেতার কম্পাঙ্ক বন্টনে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। সেজন্য স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের অনেক আগে থেকেই আই-টি-ইউ'র কাছ থেকে অবস্থান ও কম্পাঙ্কের অনুমোদন নিতে হয়। এই অনুমোদন নেয়ার প্রক্রিয়া বেশ জটিল। স্যাটেলাইট সংক্রান্ত যে কোন অনুমোদনের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন হয় আই-টি-ইউ'র সদস্য হওয়া।

 

আই-টি-ইউর সদস্যপদ

মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপন করার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশান ইউনিয়ন বা আই-টি-ইউ'র সদস্য হওয়া। দুই ধরনের সদস্যপদ আছে: স্টেট মেম্বারশিপ বা রাষ্ট্রীয় সদস্যপদ এবং সেক্টর মেম্বারশিপ। জাতিসংঘের যে কোন সদস্যরাষ্ট্র আই-টি-ইউ'র স্টেট মেম্বার হতে পারে। আর যে কোন সদস্যদেশের টেলিকমিউনিকেশান কোম্পানি প্রয়োজনীয় শর্তপূরণ সাপেক্ষে আই-টি-ইউ'র সেক্টর মেম্বার হতে পারে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর ১৯৩টি দেশ আই-টি-ইউ'র স্টেট মেম্বার হয়েছে এবং ৭০০ কোম্পানি সেক্টর মেম্বার হয়েছে। বাংলাদেশ আই-টি-ইউ'র সদস্য হয়েছে ১৯৭৩ সালে। আই-টি-ইউ'র সদস্যপদ চিরকালীন। একবার সদস্যপদ পাওয়ার পর সেই সদস্যপদ কখনোই স্থগিত করা বা বাতিল করা যায় না। তবে আই-টি-ইউ'র শর্ত ভঙ্গ করলে আই-টি-ইউ'র কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোন দেশ বা কোম্পানিকে আই-টি-ইউ'র মিটিং ও কনফারেন্সে যোগদানের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে।

 

আই-টি-ইউ'র উদ্দেশ্য ও মূল কাজ 

আই-টি-ইউ'র স্যাটেলাইট সংক্রান্ত বিভাগের মূল উদ্দেশ্য হলো:

  • টেলিকমিউনিকেশান বা বেতারযোগাযোগ সংক্রান্ত সব ধরনের কার্যকলাপে সদস্যদেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা রক্ষা করা এবং বাড়ানো।
  • উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য টেলিকমিউনিকেশানে প্রযুক্তি-সহযোগিতা বাড়ানো।
  • টেলিকমিউনিকেশানের কারিগরি উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।
  • আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার মধ্যে টেলিকমিউনিকেশান সংক্রান্ত তথ্য-অর্থনীতিক (information economy) সহযোগিতা বাড়ানো।

 

এই উদ্দেশ্যগুলো পূরণের জন্য আই-টি-ইউ'র মূল কাজ হলো:

  • বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ব্যান্ড বন্টন করা
  • বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্ক রেজিস্ট্রেশন করা
  • জিও-স্যাটেলাইট অরবিট বা ভূ-স্থির উপগ্রহের কক্ষপথের স্থান বন্টন করা এবং রেজিস্ট্রেশন করা
  • বেতার তরঙ্গের ইন্টারফিয়ারেন্স (interference) বা ব্যতিচার ঘটলে তার প্রতিকার করা
  • বিশ্বব্যাপী টেলিকমিউনিকেশানের মানের উন্নয়ন ও সমন্বয় করা
  • উন্নয়নশীল দেশেও টেকিকমিউনিকেশানের উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহে সহযোগিতা করা

 

কক্ষপথে স্যাটেলাইটের স্থান ও বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্ক বন্টন করা হয় কীভাবে

কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট সংক্রান্ত আই-টি-ইউ'র আন্তর্জাতিক নিয়মের উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীর সকল জাতির জন্য কক্ষপথে স্যাটেলাইট বসানোর সমান অধিকার নিশ্চিত করা এবং সেই স্যাটেলাইটের সিগনাল সম্প্রচারে যেন কোন অসুবিধা না হয় তা নিশ্চিত করা। সেজন্য প্রত্যেক স্যাটেলাইটের জন্য কক্ষপথে জায়গা নির্দিষ্ট করা যেমন জরুরি তেমনি তাদের জন্য বেতার তরঙ্গের আলাদা আলাদা কম্পাঙ্ক বন্টন করাও জরুরি।

          আই-টি-ইউ'র বিধিমালার অনুচ্ছেদ-৪৫ অনুযায়ী:

  • সকল রেডিওস্টেশন এমনভাবে স্থাপন করতে হবে এবং তাদের কার্যপদ্ধতি এমন হতে হবে যেন এক স্টেশনের বেতার তরঙ্গ কোনভাবেই অন্য স্টেশনের বেতার তরঙ্গের সাথে ব্যতিচার না ঘটাতে পারে।
  • আই-টি-ইউ'র প্রত্যেক সদস্যকে টেলিকমিউনিকেশানে যেন কোন ধরনের ব্যতিচার না ঘটতে পারে তার জন্য যা যা যান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় সবই করতে হবে।
  • আই-টি-ইউ'র প্রত্যেক সদস্য এই নিয়মগুলো মানতে বাধ্য থাকবে।

 

বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্কগুলোর মধ্যে যেন ব্যতিচার না ঘটতে পারে সেজন্য আই-টি-ইউ'র কাছ থেকে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বা বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্ক অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। কক্ষপথের একটি স্যাটেলাইটের সাথে অন্য স্যাটেলাইটের যেন সংঘর্ষ না ঘটতে পারে সেজন্য কক্ষপথের অক্ষাংশ রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিতে হয় আই-টি-ইউ'র কাছ থেকে।

          পৃথিবীব্যাপী অবিচ্ছিন্নভাবে ব্যতিচারহীন বেতারতরঙ্গের কম্পাঙ্ক বন্টনের জন্য আই-টি-ইউ পৃথিবীর দেশগুলোকে মোট তিনটি অঞ্চলে ভাগ করেছে।

  • অঞ্চল-১: ইওরোপ, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য
  • অঞ্চল-২: আমেরিকা ও গ্রিনল্যান্ড
  • অঞ্চল-৩: অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, নিউ জিল্যান্ড, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চল, ও এশিয়া

 

চিত্র ১৯: রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বন্টনের জন্য পৃথিবীর ভৌগোলিক অঞ্চল

 

আই-টি-ইউ সংজ্ঞায়িত বেতার তরঙ্গের ব্যান্ড ও কম্পাঙ্কের বিন্যাস

বেতার তরঙ্গ ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ওয়েভ বা তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের অদৃশ্যমান অংশ। বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্ক দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গের কম্পাঙ্কের চেয়ে কম। সাধারণত মানুষের শরীরের ওপর বেতার তরঙ্গের সরাসরি কোন প্রভাব নেই, তাই পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বেতার তরঙ্গের সম্প্রচারে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণির শারীরিক স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি হয় না। সবচেয়ে উচ্চ কম্পাঙ্কের বেতার তরঙ্গও আমাদের দৃশ্যমান আলোর চেয়ে কম শক্তিশালী। তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের কমাঙ্ক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একটি চিত্র নিচে দেয়া হলো।

 

চিত্র ২০: তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের বিভিন্ন অংশের কম্পাঙ্ক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্য

 

বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্কগুলোকে আই-টি-ইউ মোট বারোটি ব্যান্ডে বিন্যস্ত করেছে। নিচের সারণি-১এ রেডিও-ব্যান্ডগুলো এবং তাদের ব্যবহারের বর্ণনা দেয়া হলো।

 

সারনি : ITU বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্ক বন্টন

ITU ব্যান্ড

ব্যান্ডের নাম

কম্পাঙ্ক

তরঙ্গদৈর্ঘ্য

ব্যবহার

1

Extremely Low Frequency (ELF)

 3 - 30 Hz

99,930.8 - 9,993.1 km

সাবমেরিন যোগাযোগ

2

Super Low Frequency (SLF)

30 - 300 Hz

9,931.1 - 999.3 km

সাবমেরিন যোগাযোগ

3

Ultra Low Frequency (ULF)

300 - 3,000 Hz

999.3 - 99.9 km

সাবমেরিন যোগাযোগ, খনির ভেতর যোগাযোগ

4

Very Low Frequency (VLF)

3-30 kHz

99.9 - 10.0 km

ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয়, পারমাণবিক ঘড়ির সময় সঙ্কেত, সাবমেরিন যোগাযোগ, হার্ট-রেট মনিটর, ভূ-পদার্থবিজ্ঞান

5

Low Frequency (LF)

30 - 300 kHz

10.0 - 1.0 km

ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয়, পারমাণবিক ঘড়ির সময় সঙ্কেত, AM রেডিও, অপেশাদার রেডিওস্টেশন

6

Medium Frequency (MF)

300 - 3,000 kHz

1.0 - 0.1 km

AM  রেডিও, অপেশাদার রেডিওস্টেশন, অ্যাভ্যালাঞ্চ বিকন্‌স (বরফের ভেতর চাপা পড়া মানুষ বা যন্ত্রপাতি খুঁজে বের করার জন্য ব্যবহার করার জন্য যে রেডিও সিগনাল ব্যবহার করা হয়)।

7

High Frequency (HF)

3 - 30 MHz

99.9 - 10.0 m

শর্টওয়েভ রেডিও, সিটিজেন ব্যান্ড রেডিও, অ্যামেচার রেডিও, মেরিন রেডিও, মোবাইল রেডিও

8

Very High Frequency (VHF)

30 - 300 MHz

10.0 - 1.0 m

FM রেডিও, টেলিভিশন সম্প্রচার, বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থেকে  বিমানে যোগাযোগ, বিমান থেকে বিমানে যোগাযোগ, ল্যান্ড মোবাইল থেকে জাহাজের মোবাইলে যোগাযোগ, অপেশাদার রেডিও, আবহাওয়া রেডিও

9

Ultra High Frequency (UHF)

300 - 3,000 MHz

1.0 - 0.1 m

টেলিভিশন সম্প্রচার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি, মোবাইল ফোন, ব্লুটুথ, জিপিএস, রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম, স্যাটেলাইট রেডিও

10

Super High Frequency (SHF)

3 - 30 GHz

99.9 - 10.0 mm

রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি, মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশান, রাডার, কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট, ক্যাবল ও স্যাটেলাইট টেলিভিশন, অ্যামেচার রেডিও, স্যাটেলাইট রেডিও

11

Extremely High Frequency (EHF)

30 - 300 GHz

10.0 - 1.0 mm

রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি, হাই ফ্রিকোয়েন্সি মাইক্রোওয়েভ রেডিও, মাইক্রোওয়েভ রিমোট সেনসিং, ওয়ারলেস লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক (LAN)

12

Tremendously High Frequency (THF)

300 - 3000 GHz

1.0 - 0.1 mm

ফিজিক্স রিসার্চ, কম্পিউটিং, রিমোট সেনসিং

         

স্যাটেলাইট যোগাযোগের মাধ্যম হলো বেতার-তরঙ্গ। আই-টি-ইউ নির্দেশিত বেতার-তরঙ্গের ব্যান্ড 9 থেকে 12 পর্যন্ত কম্পাঙ্ক (300 MHz - 1 THz) স্যাটেলাইট যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটগুলো অনেকসময় একই ব্যান্ড ব্যাবহার করলেও তাদের কম্পাঙ্কে পার্থক্য থাকে। ফলে সিগনালে ইন্টারফিয়ারেন্স ঘটে না।

          আই-টি-ইউ নির্দেশিত ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডগুলোকে ইন্সটিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার্স (IEEE) এবং ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন (EU) ও ন্যাটোভুক্ত (NATO) দেশগুলো আরো কয়েকটি উপব্যান্ডে বিন্যস্ত করেছে। নিচের সারণি-২তে সেই কম্পাঙ্ক বিন্যাস দেখানো হলো।

 

সারণি ২: বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্ক বিন্যাস

ITU ব্যান্ড

IEEE ব্যান্ড

EU/NATO ব্যান্ড

কম্পাঙ্ক[3]

1

 

 

 

 

 

A

3 Hz - 30 Hz

2

 

30 Hz - 300 Hz

3

 

300 Hz - 3 kHz[4]

4

 

3 kHz - 30 kHz

5

 

30 kHz - 300 kHz

6

 

300 kHz - 3 MHz[5]

7

HF

3 MHz - 30 MHz

8

VHF

30 MHz - 250 MHz

B

250 MHz - 300 MHz

 

 

9

UHF

300 MHz - 500 MHz

C

500 MHz - 1 GHz[6]

L

D

1 GHz - 2 GHz

S

E

2 GHz - 3 GHz

 

10

F

3 GHz - 4 GHz

C

G

4 GHz - 6 GHz

H

6 GHz - 8 GHz

 

X

I

8 GHz - 10 GHz

 

J

10 GHz - 12 GHz

Ku

12 GHz - 18 GHz

K

18 GHz - 20 GHz

 

K

20 GHz - 27 GHz

Ka

27 GHz - 30 GHz

 

 

 

11

30 GHz - 40 GHz

V

L

40 GHz - 60 GHz

M

60 GHz - 75 GHz

W

75 GHz - 100 GHz

 

100 GHz - 110 GHz

mm

 

110 GHz - 300 GHz

12

 

 

300 GHz - 3 THz[7]

 

কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রচলিত কম্পাঙ্ক বা ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড হলো C ব্যান্ড ও Ku ব্যান্ড। সারণি-২ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি C  ব্যান্ডের কম্পাঙ্ক হচ্ছে ৫০০ মেগাহার্টজ থেকে ১ গিগা হার্টজ পর্যন্ত। K ব্যান্ডের নামকরণ করা হয়েছে জার্মান শব্দ কুর্জ (Kurz) থেকে, যার অর্থ হলো শর্ট বা হ্রস্ব। সারণি-২ থেকে দেখতে পাচ্ছি ১২ গিগাহার্টজ থেকে ৪০ গিগাহার্টজ পর্যন্ত কম্পাঙ্ক K  ব্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত। K ব্যান্ডের নিচের দিকের কম্পাঙ্ক অর্থাৎ ১২ থেকে ১৮ গিগাহার্টজ পর্যন্ত কম্পাঙ্কের ব্যান্ডকে বলা হচ্ছে Ku মানে Kurz-under,  আর K ব্যান্ডের উপরের দিকের কম্পাঙ্ক অর্থাৎ ২৭ থেকে ৪০ গিগাহার্টজ পর্যন্ত কম্পাঙ্কের ব্যান্ডকে বলা হচ্ছে Ka অর্থাৎ Kurz-above। আই-টি-ইউ থেকে স্যাটেলাইটের কম্পাঙ্ক ব্যবহার করার জন্য রেজিস্ট্রেশন নিতে হয়।

 

কক্ষপথে স্যাটেলাইটের স্থানের জন্য রেজিস্ট্রেশন করার পদ্ধতি

আই-টি-ইউ'র কোন সদস্যরাষ্ট্র বা সেক্টর মেম্বার যদি কোন স্যাটেলাইট স্থাপন করতে চায় তাহলে অনেক আগে থেকেই তার বিস্তারিত পরিকল্পনা করতে হয়। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সর্বোচ্চ সাত বছর আগে এবং সর্বনিম্ন দু'বছর আগে আই-টি-ইউতে বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণসহ রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করতে হয়। আবেদনের জন্য দু'ধরনের পদ্ধতি আছে - সাধারণ পদ্ধতি ও বিশেষ পদ্ধতি।

          সাধারণ পদ্ধতি হলো - ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভড অর্থাৎ আগে এলে আগে পাবেন পদ্ধতি। তার মানে হলো যে দেশ আগে আবেদন করবে সে দেশ আগে রেজিস্ট্রেশন পাবে। আর বিশেষ পদ্ধতি হলো বিশেষ বিশেষ স্যাটেলাইটের সুবিধার জন্য পরিকল্পিত পদ্ধতিতে দরখাস্ত করা।

          মহাকাশের কক্ষপথ আন্তর্জাতিক। পৃথিবীর সব দেশেরই সমান অধিকার আছে মহাকাশে। কিন্তু সেই অধিকার কাজে লাগানোর জন্য যে অর্থনৈতিক সামর্থ্য দরকার হয় সেটা সব দেশের থাকে না। মহাকাশে আমাদের বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ পাঠাতে খরচ হয়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। আমেরিকা এক হাজারেরও বেশি স্যাটেলাইটের মালিক। আমাদের সামর্থ্য থাকলে আমরাও পাঠাতে পারতাম যত খুশি - তাতে আইনগত কোন বাধা নেই। তবে কিছু কারিগরি বাধা আছে। যেমন, কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটগুলো সাধারণত পাঠানো হয় ভূ-স্থির কক্ষপথে। সেই কক্ষপথ পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৬,০০০ কিলোমিটার দূরে। সেই কক্ষপথে যত খুশি স্যাটেলাইট রাখার সুযোগ নেই। মাত্র ১৮০০ স্যাটেলাইট সেই বৃত্তাকার কক্ষপথে স্থাপন করা যাবে একটার পর একটা; যেন একটার সাথে আরেকটার সংঘর্ষ না ঘটে। কিন্তু এর বেশি একটিরও জায়গা নেই।

 

 

চিত্র ২১: ভূ-স্থির কক্ষপথে কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটগুলোর অবস্থান

           

আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তির সুযোগে পৃথিবীর বড় বড় দেশগুলো এবং স্যাটেলাইট বাণিজ্য-সংস্থাগুলো কক্ষপথের স্যাটেলাইটের দরকারি অরবিটাল স্পটগুলো নিজেদের নামে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিয়েছে। এখন তারা নিজেদের স্পটগুলো আমাদের মতো দেশের কাছে ভাড়া দিচ্ছে টাকার বিনিময়ে। আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের জন্য কক্ষপথের স্পট ভাড়া নিতে হয়েছে ইন্টারস্পুটনিক ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশান অব স্পেস কমিউনিকেশান্স বা সংক্ষেপে 'ইন্টারস্পুটনিক' (Intersputnik) সংস্থার কাছ থেকে। সেজন্য আমাদের খরচ হয়েছে ২১৯ কোটি টাকা। অথচ এই কক্ষপথের জন্য কোন ভাড়া দিতে হতো না যদি কক্ষপথের জায়গা খালি থাকতো।

          চিত্র-২১ যদি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেন - দেখতে পাবেন কক্ষপথের বাম দিকে কিছু জায়গা এখনো খালি আছে, কোন স্যাটেলাইট সেখানে নেই। সেখানে স্যাটেলাইট নেই - কারণ পৃথিবীর সেদিকে তেমন কোন দেশ নেই, এবং থাকলেও জনসংখ্যার ঘনত্ব খুব কম সেখানে। সেদিকে স্যাটেলাইট বসালে তা তেমন কোন কাজে আসবে না, অথবা ব্যবহারকারীর সংখ্যা এত কম হবে যে স্যাটেলাইটের খরচ উঠে আসবে না।

          স্যাটেলাইটের অরবিটাল স্পটের বিস্তারিত তথ্য অর্থাৎ স্যাটেলাইটটি ঠিক কোথায় স্থাপন করা হবে দরখাস্তের সাথে সরবরাহ করতে হয়। দরখাস্ত জমা হওয়ার পর সমস্ত নিয়মকানুন ঠিক আছে কি না চেক করে দেখে আই-টি-ইউ'র রেগুলেশন বোর্ড সাপ্তাহিক বুলেটিনে স্যাটেলাইটের তথ্যগুলো প্রকাশ করে। এই নতুন প্রস্তাবিত স্যাটেলাইটটির আগে যেসব স্যাটেলাইট স্থাপিত হয়েছে বা স্থাপনের জন্য দরখাস্ত জমা দিয়েছে সেইসব দেশ বা সংস্থা ভালো করে হিসেব করে দেখবে নতুন স্যাটেলাইটটি উৎক্ষিপ্ত হয়ে কক্ষপথের প্রস্তাবিত স্থানে স্থাপিত হয়ে কাজ শুরু করলে তাদের স্যাটেলাইটের সম্প্রচারের কোন অসুবিধা হবে কি না। যদি কোন ইন্টারফিয়ারেন্স হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তাহলে চার মাসের মধ্যে তারা আপত্তি জানাতে পারে। যদি কেউ আপত্তি জানায় তাহলে আপত্তিকারী দেশ বা সংস্থার সাথে আবেদনকারী দেশ বা সংস্থা আলোচনা করে প্রয়োজনীয় কারিগরী পরিবর্তন ঘটিয়ে আপত্তির নিষ্পত্তি করে ফেলে। তারপর সবকিছু ঠিক থাকলে স্যাটেলাইটের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয় মাস্টার ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিকোয়েন্সি রেজিস্টার (MIFR)-এ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে।

          বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ও ভূ-স্থির কক্ষপথে স্থান অসীম নয়। এগুলো কোন দেশের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোও যেন এই স্যাটেলাইটসুবিধা পেতে পারে - সেজন্য বিশেষ বিশেষ স্যাটেলাইটের সুবিধার জন্য পরিকল্পিত পদ্ধতিতে দরখাস্ত করার নিয়ম আছে। যেমন, বিমানের মোবাইল সার্ভিসের জন্য কম্পাঙ্ক বন্টন, যেসব ব্রডকাস্টিং স্যাটেলাইট সার্ভিসে ১২ গিগাহার্টজের বেশি কম্পাঙ্ক ব্যবহার করা হয় - তাদের রেজিস্ট্রেশন করার জন্য 'আগে এলে আগে পাবেন' ভিত্তির বদলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দরখাস্ত করতে হয়। দরখাস্তের অন্যান্য সব শর্ত প্রায় একই। অর্থাৎ স্যাটেলাইট পাঠানোর কমপক্ষে দুই বছর আগে এবং সর্বোচ্চ সাত বছর আগে দরখাস্ত জমা দিতে হয়। দরখাস্ত পরীক্ষা ও অনুমোদনের পদ্ধতিও প্রায় একই। মাস্টার ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিকোয়েন্সি রেজিস্টার-এ অন্তর্ভুক্তির আগপর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে বলা যায় না।

          পৃথিবীর সব জায়গাতেই যে কোন নিয়ম এবং সুযোগের অপব্যবহার করে মানুষ। অনেক বছর ধরে অনেক দেশ ও সংস্থা অনেকগুলো স্যাটেলাইটের স্থান ও কম্পাঙ্ক নিজেদের নামে রেজিস্ট্রেশন করে রাখতো। এতে যারা পরে আসতো তারা ভালো জায়গা পেতো না। এখানে ভালো জায়গা মানে কক্ষপথে ভৌগোলিক অবস্থান বরাবর জায়গা। যেমন বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান হলো ৮৮ ডিগ্রি থেকে ৯৪ ডিগ্রি পূর্ব অক্ষাংশে। আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি যদি আমরা এই অক্ষাংশের ভেতর স্থাপন করতে পারতাম তাহলে ওটা সরাসরি আমাদের দেশের উপর থাকতো। কিন্তু সেই অক্ষাংশের উপর কোন স্পট খালি ছিল না। আমাদের কাছাকাছি যে স্পট আমরা পেয়েছি তা হলো ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব অক্ষাংশে। তাও আমাদের ভাড়া নিতে হয়েছে। কোন কোন দেশ বা সংস্থা ভবিষ্যতে বেশি দামে স্পট বিক্রি করার জন্য বা ভাড়া দেয়ার জন্য নিজেদের নামে স্পট রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিলে কী করা যাবে?

          আই-টি-ইউ স্যাটেলাইটের ভুয়া রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করার জন্য কিছু কঠোর আইন পাস করেছে। কোন দেশ বা সংস্থা রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার সাত বছরের মধ্যে যদি স্যাটেলাইট স্থাপন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে সেই স্পট নতুন দরখাস্তকারীকে বন্টন করে দেবে। আর দরখাস্ত যে ভুয়া নয়, সেটা প্রমাণের জন্য দরখাস্ত করার সময়েই স্যাটেলাইটের বিস্তারিত বিবরণ দাখিল করতে হয়। যে সব তথ্য ও প্রমাণ দাখিল করতে হয় তাদের মধ্যে আছে:

  • স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের পরিচিতি
  • দেশ বা সংস্থার বিস্তারিত তথ্য
  • দেশের প্রতীক
  • সম্প্রচার কম্পাঙ্কের বিস্তারিত তথ্য
  • কক্ষপথের বর্ণনা
  • স্যাটেলাইট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত বিবরণ
  • স্যাটেলাইট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ
  • স্যাটেলাইট সরবরাহের আনুমানিক তারিখ
  • স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত বিবরণ
  • স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ
  • স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের আনুমানিক তারিখ
  • স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী রকেটের বিবরণ
  • স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের স্থান

সদস্যদেশ ও সংস্থার দায়িত্ব

কক্ষপথে স্থাপিত প্রত্যেকটি স্যাটেলাইটের সম্প্রচার যেন নির্বিঘ্নে ঘটতে পারে সেজন্য স্যাটেলাইটের মালিক দেশ ও সংস্থাগুলোকে আই-টি-ইউ'র  স্যাটেলাইট সম্প্রচার বিধিমালা কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়।

          স্যাটেলাইটের তরঙ্গের সম্প্রচার এমনভাবে হওয়া উচিত যেন অন্য স্যাটেলাইটের তরঙ্গের সাথে ইন্টারফিয়ারেন্স না ঘটে। অপ্রয়োজনীয় তরঙ্গের সম্প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শক্তির বিকিরণ যেন না ঘটে। কোন ভাবেই অন্য স্যাটেলাইটের সম্প্রচার তরঙ্গ আটকে দেয়া যাবে না, মানে অন্য স্যাটেলাইট জ্যাম করে দেয়া সম্পূর্ণ বে-আইনি।

          কিন্তু তারপরেও দেখা যায় অনেক দেশ ও সংস্থা এসব বে-আইনি কাজ করে। বিভিন্ন দেশ অন্যদেশের গোয়েন্দা-স্যাটেলাইটগুলো জ্যাম করে দেয়ার চেষ্টা করে। ২০০৯ সালে ইরান ইচ্ছাকৃতভাবে ইউরোপের ইউটেলস্যাট স্যাটেলাইট জ্যাম করে দেয় - ফলে ইওরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক টেলিভিশন সম্প্রচার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরকম ঘটলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয় এবং সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করতে হয়।


ইউনুসা (UNOOSA)

শান্তিপূর্ণভাবে মহাকাশ গবেষণা চালানো এবং বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে মহাকাশ-গবেষণা সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে ইউনাইটেড ন্যাশন্‌স অফিস ফর আউটার স্পেস অ্যাফেয়ার্স (United Nations Office for Outer Space Affairs) বা ইউনুসা। উন্নয়নশীল দেশের জন্য মহাকাশ কার্যক্রমের আইনগত ও কারিগরী সহায়তা প্রদান করা হয় জাতিসংঘের এই সংগঠনটির পক্ষ থেকে। ১৯৫৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর এই প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। শুরুতে এটা জাতিসংঘ সচিবালয়ের অধীনে কাজ করছিল। ১৯৬২ সালে এটা জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড সিকিউরিটি কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৬৮ সালে আউটার স্পেস অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন গঠিত হয়। ১৯৯২ সালে এই ডিভিশন জাতিসংঘের পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯৩ সালে ইউনুসার সদর দপ্তর নিউ ইয়র্ক থেকে ভিয়েনায় স্থানান্তরিত হয়।

          ইউনুসার হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে প্রায় ৪,৭০০ স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। এদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি স্যাটেলাইট অকেজো। প্রায় হাজার খানেক কার্যকর কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট পৃথিবীতে টেলিভিশন সম্প্রচার ও অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থায় অবদান রাখছে। প্রায় ছয় শ' স্যাটেলাইট পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করছে। শতাধিক জিপিএস স্যাটেলাইট কাজ করে যাচ্ছে মোবাইল টেলিফোন ও ন্যাভিগেশানের কাজে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মালিকানাধীন স্যাটেলাইটের সংখ্যার তালিকা নিচের সারণিতে দেয়া হলো।


সারণি ৩: বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের স্যাটেলাইটের সংখ্যা

দেশ

স্যাটেলাইটের সংখ্যা

দেশ

স্যাটেলাইটের সংখ্যা

আলজেরিয়া

আরব স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন অর্গানাইজেশন 

১৩

আর্জেন্টিনা

১৮

এশিয়া স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন কোম্পানি (ASIASAT)

অস্ট্রেলিয়া

২১

আজারবাইজান

বাংলাদেশ

বেলারুশ

বলিভিয়া

ব্রাজিল

১৭

বুলগেরিয়া

কানাডা

৪৮

চিলি

চীন ও ব্রাজিল যৌথ

কমনওয়েলথ অব ইন্ডেপেন্ডেন্ট স্টেটস (ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন)

১৫০৪

চেক রিপাবলিক (ভূতপূর্ব চেকোস্লোভাকিয়া)

ডেনমার্ক

ইকুয়েডর

মিশর

এস্টোনিয়া

ইউরোপিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল স্যাটেলাইট

ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি

৮২

ফ্রান্স

৬৮

ফ্রান্স/জার্মানি যৌথ

ফ্রান্স/ইতালি যৌথ

জার্মানি

৫২

গ্লোবালস্টার

৮৪

গ্রিস

ভারত

৮৮

ইন্দোনেশিয়া

১৬

ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল স্যাটেলাইট অর্গানাইজেশান (INMARSAT)

১৭

ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন

ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন স্যাটেলাইট অর্গানাইজেশান

৮৫

ইরাক

ইরান

ইজরায়েল

১৭

ইতালি

২৭

জাপান

১৭২

কাজাকিস্তান

লাওস

লাটভিয়া

লিথুয়ানিয়া

লুক্সেমবার্গ

মালয়েশিয়া

মেক্সিকো

১২

মরক্কো

নেদারল্যান্ডস

নাইজেরিয়া

ন্যাটো

উত্তর কোরিয়া

নরওয়ে

O3B নেটওয়ার্ক

১৬

ORBCOMM

৪১

পাকিস্তান

চীন

২৯৭

পেরু

ফিলিপাইন

পোলান্ড

পর্তুগাল

আফ্রিকান স্যাটেলাইট কমিউনিকেশান অর্গানাইজেশান

সৌদি আরব

১৩

সিঙ্গাপুর

সিঙ্গাপুর/তাইওয়ান যৌথ

স্লোভাকিয়া

ইওরোপিয়ান সোসাইটি (SES)

৫৫

দক্ষিণ আফ্রিকা

দক্ষিণ কোরিয়া

২৪

স্পেন

২৩

সুইডেন

১২

তাইওয়ান

থাইল্যান্ড

তুরস্ক

১৪

তুর্কমেনিস্তান/মোনাকো

আরব আমিরাত

যুক্তরাজ্য

৪২

যুক্তরাষ্ট্র

১৬১৬

উরুগুয়ে

ভেনেজুয়েলা

ভিয়েতনাম

আমেরিকা/ব্রাজিল যৌথ

উৎস: www.n2yo.com

 

এবার দেখা যাক এই স্যাটেলাইটগুলোর মূল বিজ্ঞান কী, মহাকাশে কীভাবে পাঠানো হয়, কীভাবে কাজ করে, কোন্‌ কক্ষপথে থাকে ইত্যাদি।



[1] এই দিনের স্মরণে প্রতিবছর ১৭ মে পালিত হয় বিশ্ব টেলিযোগাযোগ ও তথ্য সমিতি দিবস (World Telecommunication and Information Society Day)।

[2] স্যাটেলাইটের কক্ষপথ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে।

[3] কম্পাঙ্ক বা ফ্রিকোয়েন্সি হলো প্রতি সেকেন্ডে কয়টি তরঙ্গ অতিক্রম করে তার সংখ্যা। তরঙ্গের একক হার্টজ (Hz)। 30 Hz  মানে এক সেকেন্ডে তিরিশটি বেতার তরঙ্গ। শূন্য মাধ্যমে বেতার তরঙ্গের বেগ আলোর বেগের সমান, অর্থাৎ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। যেহেতু সব কম্পাঙ্কের জন্যই এই বেগ সমান, সেহেতু তরঙ্গের কম্পাঙ্ক যত বেশি হয়, তরঙ্গের দৈর্ঘ্য তত ছোট হয়। আবার কম্পাঙ্ক যত বেশি হয়, অর্থাৎ এক সেকেন্ডে যত বেশি তরঙ্গ, সেই তরঙ্গের শক্তি তত বেশি। সোজা কথায় বলা চলে, তরঙ্গের কম্পাঙ্ক যত বেশি, তার দৈর্ঘ্য তত ছোট, এবং তার শক্তি তত বেশি।

[4]  1000 Hz = 1 kHz (kilo Hertz)

[5] 1000 kHz = 1 MHz (Mega Hertz)

[6] 1000 MHz = 1 GHz (Giga Hertz)

[7]  1000 GHz = 1 THz (Tera Hertz)


No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts