স্বপ্নলোকের চাবি – ১৩
ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের
একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হবার পর ক্যাম্পাসের পরিবেশ মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতো থমথম করছে।
জাতীয় ছাত্রসমাজের দৌরাত্ম্যের সময়ও ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রদল মিটিং-মিছিল করতো
মাঝে মাঝে। কিন্তু ছাত্রশিবির যখন থেকে ক্যাম্পাস আর হলগুলি দখল করেছে, অন্য সব দলের
সাংগঠনিক কার্যক্রম ধরতে গেলে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আড়াই মাস বন্ধ থাকার পর ইউনিভার্সিটি
খুলেছে। জোরেশোরে ক্লাস চলছে। কিন্তু কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটে গেছে। আমাদের ক্লাসে অনেক
অপরিচিত মুখ দেখা যাচ্ছে। উনারা আমাদের সিনিয়র। রাজনৈতিক কারণে এতদিন ক্যাম্পাসে আসতে
পারেননি, পরীক্ষাও দিতে পারেননি। এখন আমাদের সহপাঠী হলেও ক্লাসের অনেকেই তাদের ‘আপনি’
করে বলছে, ‘ভাই’ সম্বোধন করছে দেখে বুঝতে পারছি ছাত্রশিবিরের নেতা উনারা। ক্লাসের ভেতর
এক ধরনের চাপা অস্বস্তি। বন্ধুদের সাথে কথাবার্তা বলার সময়ও মনে হতে থাকে – কেউ যেন
নজর রাখছে আমাদের ওপর। পরিবর্তনটা খুব সূক্ষ্ম, কিন্তু একটু সচেতন হলেই বোঝা যায়।
আমাদের ফার্স্ট ইয়ার
ফাইনাল পরীক্ষার ডেট মার্চের ১৮ তারিখ থেকে পিছিয়ে জুনের ২৮ তারিখে চলে গেছে। এরজন্য
কোন আন্দোলন করতে হয়নি। এপ্রিলের মাঝামাঝি ফরম ফিল আপের ডেট দিয়েছে। এপ্রিলের শেষে রমজানের ছুটি শুরু। তার আগেই স্যাররা
তাড়াতাড়ি সিলেবাস শেষ করে দিতে চাচ্ছেন। প্রামাণিক স্যার ম্যাথম্যাটিক্যাল ফিজিক্স
প্রায় শেষ করে ফেলেছেন। ক্লাসে এসে স্যার সমীকরণের পর সমীকরণ লিখে বোর্ড ভরিয়ে ফেলেন।
আমি মাছিমারা কেরানির মতো তা খাতায় লিখতে চেষ্টা করি কোন রকমের বোঝাবুঝি ছাড়াই। স্যার
অনবরত বলতে থাকেন, “না বুঝলে বুঝে নেবে।“ কিন্তু কোত্থেকে বুঝে নেবো জানি না। পদার্থবিজ্ঞানের
ভাষা গণিত তা জানি, কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের সাথে তার ভাষার মূল সম্পর্কটাই যেন ধরতে
পারছি না। বুঝতে না পারলে মুখস্থ করার একটা প্রবণতা তৈরি হয়। মুখস্থ করে আর যাই হোক,
পদার্থবিজ্ঞান শেখা যায় না। এভাবে চলতে থাকলে আদৌ কিছু শিখতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না।
স্যার পড়াচ্ছেন স্পাইজেলের বই থেকে। সেই বই ঠিকমতো বুঝি না বলে এম জি মোস্তফার বই থেকে
বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু তেমন কোন কাজ হচ্ছে না।
প্রামাণিক স্যার ক্লাস
থেকে বের হবার পর সবাই আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে আড়চোখে মেয়েদের বেঞ্চের দিকে তাকাচ্ছে। সেদিকে
মেয়েরা সবাই মৌমাছির মতো ভীড় করেছে রাখীর চারপাশে। যীশু কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস
করে বললো, “রাখী তো বিয়ে করে ফেললো।“
“কীভাবে বুঝলি?”
“শাখা-সিঁদুর পরে এসেছে
দেখছিস না?”
মনে হচ্ছে রাখীর বিবাহকার্য
সম্পাদিত হওয়ায় যীশু বিশেষভাবে মর্মাহত। আহসান হাবীব দীপক যীশুর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা
দিতে বললো, “রাখী চৌধুরী তো বিয়ে করে ফেললো। যীশুখ্রিস্ট চৌধুরী, তোমার কী হবে বন্ধু?”
রাখীর সাথে যীশুর পদবীর
মিল ছাড়া আর কোনকিছু ছিল বলে আমার জানা নেই। কিন্তু দীপক লেখক মানুষ, নাম পদবী থেকেই
অনেককিছু মিলিয়ে ফেলে। এদিকে কবিতাপ্রেমিক ফারুক রাখীর উদ্দেশ্যে কবিতা ছাড়লো, “ঘরেতে
এলো না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া। পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।“
শুধু শাখা-সিঁদুর নয়,
ঝলমলে নতুন শাড়ি-গয়নায় অপরূপ লাগছে রাখীকে। প্রামাণিক স্যারের ক্লাস শুরু হবার পর ক্লাসে
ঢুকেছে রাখী। সেই সময় উচ্ছ্বাস আটকে রেখে অপেক্ষা করছিল সবাই কখন ক্লাস শেষ হবে। ক্লাস
শেষ হবার সাথে সাথেই রাখীর চারপাশে ভীড় জমে গেছে। হাফিজ, মৃণাল, কবীর, মিজান, স্বপন
আর ইকবালকেও দেখা যাচ্ছে ভীড়ের কাছাকাছি।
একটু পরে মৃণালের কাছ
থেকে জানা গেল অনেক কিছু। সংবাদ-আহরণে মৃণালের বিশেষ দক্ষতা আছে। যেসব প্রশ্ন অনেকে
করতে পারতে না, মৃণাল সে সব প্রশ্নও করে ফেলে। তার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম রাখী
বিয়ে করেছে ফেব্রুয়ারিতে। তার স্বামী বিসিএস প্রশাসনের লোক – নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
এখন কোথায় পোস্টিং, রাখীর শ্বশুরবাড়ি কোথায় – ইত্যাদি এত তথ্য এত কম সময়ে সে কীভাবে
সংগ্রহ করলো সেটাই আশ্চর্যের।
পরের ক্লাস নুরুল মোস্তফা
স্যারের। টকটকে লাল টী-শার্ট পরে ক্লাসে এসেছেন স্যার। সাউন্ড পড়াচ্ছেন তিনি। যা বলেন
তা বোর্ডে লাইনের পর লাইন সুন্দর করে লিখে দেন। “সাউন্ড ওয়েভ ইজ মেকানিক্যাল ওয়েভ।
ইট্ নিড্স মিডিয়াম টু প্রপাগেট।” স্যারের ইংরেজি উচ্চারণে একটা বিদেশী টান আছে। অনেক
বছর কানাডায় থাকার পর দেশে ফিরেছেন তিনি। শিক্ষাছুটি নিয়ে পিএইচডি করতে গিয়েছিলেন।
ছুটি শেষ করে এসেছেন, কিন্তু পিএইচডি শেষ করেননি। তিনি নিজেই এসব তথ্য দিয়েছেন ক্লাসে
এসে। আবার যাবেন এটাও জানিয়ে রেখেছেন। আমাদের সিলেবাস শেষ করার আগে যাবেন না আশা করি।
নুরুল মোস্তফা স্যারের
ক্লাসের পর দ্রুত চারতলায় গেলাম পরিসংখ্যান সাবসিডিয়ারি ক্লাসে। খুব বেশি স্টুডেন্ট
নেই ক্লাসে। সানজিদা আর চন্দনা বসে আছে পেছনের দিকের একটি বেঞ্চে। অর্থনীতির আর কেউ
পরিসংখ্যান সাবসিডিয়ারি নিয়েছে কি না জানি না। তবে এরা দু’জন আর্টস ফ্যাকাল্টি থেকে
আসে পরিসংখ্যান ক্লাস করার জন্য। এদের সাথে কীভাবে যেন পরিচয় হয়ে গেছে। ক্লাসের বাইরেও
তারা দেখা হলে হাসিমুখে কথা বলে। তাদের আরেক বন্ধু হালিমার সাথেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল
তারা একদিন। হালিমা ‘সংবাদ’-এ জটিল উপসম্পাদকীয় লেখে। “সংবাদ” এর মতো সংবাদপত্রে প্রবন্ধ
লেখা চাট্টিখানি কথা নয়। তাই হালিমা একটু গম্ভীর প্রকৃতির। কিন্তু সানজিদা আর চন্দনা
খুব হাসিখুশি মানুষ। আমরা তাদের পাশে বসলাম।
“পরীক্ষা কি জুনে হবে,
জানো কিছু?” – সানজিদা জিজ্ঞেস করলো।
“কেন, আবার পেছানোর
সম্ভাবনা আছে?”
“সম্ভবত পেছাবে। মে
মাস পুরাই রমজানের ছুটি। ঈদের পরপর পরীক্ষা হবে? দেখো, পরীক্ষা আবার পেছাবে।“
পরীক্ষা আবার পেছাবে
শুনে খুশি হবো, না দুঃখ পাবো বুঝতে পারছি না। ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠতেই
তো মনে হচ্ছে তিন বছর চলে যাবে।
পরিসংখ্যানের নতুন স্যার
এসেছেন। মিজানুর রহমান লস্কর। বেশ লম্বা চওড়া – লস্করই বটেন। স্যারের চোয়ালটা অনেক
বড়। কথা বলার সময় মাঝে মাঝে হা করে নিশ্বাস নেন। তখন কেমন যেন হাঙরের মতো লাগে। এই
ব্যাপারটা খেয়াল করার পর প্রদীপ নাথকে যখন দেখালাম, তার হঠাৎ এমন হাসি পেয়ে গেল – দেখলাম
সে কিছুতেই হাসি থামাতে পারছে না। হাসি সংক্রামক জানি, কিন্তু এত বেশি সংক্রামক তা
জানতাম না। তার হাসি আমাতেও সংক্রমিত হলো, এবং সে হাসি কিছুতেই থামাতে পারছি না। এ
তো মহাবিপদ! পাশাপাশি বসে দু’জন ছাত্র ক্লাসে হাসাহাসি করছে – এটা কোন্ স্যার সহ্য
করবেন? দুইহাতে মুখ ঢেকে হাসি চাপার চেষ্টা করছি। প্রদীপ নাথের দিকে তাকিয়ে দেখলাম
সে ডানহাতের সবগুলি আঙুল মুখের ভেতর দিয়ে দাঁত দিয়ে চেপে রেখেছে – যেন হাসির শব্দ বের
হতে না পারে। সেটা দেখে আমার হাসির বেগ আরো বেড়ে গেল। হাসির দমকে চোখ দিয়ে পানি বের
হয়ে আসছে। মুখ থেকে হাত সরাচ্ছি না শব্দ বের হবার ভয়ে। স্যারের দিকে তাকাচ্ছি না, কারণ
স্যারের মুখ দেখলেই হাসির বেগ বেড়ে যাচ্ছে। স্যার স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশান সম্পর্কিত
অনেক তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন – সেগুলি কানে এসে লাগছে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ
স্যার চুপ করে গেলেন। চোখ তুলে তাকাতেই স্যারের সাথে চোখাচুখি হয়ে গেল। স্যার আমাদের
দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। ধমক দেয়ার পূর্বমুহূর্ত। আমি মনে মনে ধমক খাবার জন্য
রেডি হলাম। কিন্তু স্যার ধমক না দিয়ে – “আজ এপর্যন্তই “ বলে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেন।
আমার হাসি সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। কেমন যেন খারাপ লাগতে শুরু করলো। স্যার কী মনে
করলেন কে জানে। প্রদীপ নাথ এরকম হাসির নাম দিয়েছে ‘লাফিং ডিজিজ’।
এপ্রিলে ফরম ফিল আপ
হয়ে গেল। পরীক্ষার ফরম ফিল আপ করার ব্যাপারটা কী কারণে এত জটিল করে রেখেছে আমার জানা
নেই। প্রথমে হল থেকে ফরম নিতে হবে। তারপর সেটা পূরণ করে ডিপার্টমেন্টের সাইন নিতে হবে।
ডিপার্টমেন্টের অফিসের কর্তা ফরিদ ভাই। তিনি হিসেব করে রেখেছেন আমাদের ক্লাসে উপস্থিতি
ঠিকমতো আছে কি না। শতকরা পচাত্তর ভাগ উপস্থিতি থাকতে হবে ক্লাসে। আমি ক্লাস খুব একটা
মিস করিনি। কিন্তু ব্যাপারটা গোলমেলে। যেমন আদম শফিউল্লাহ স্যার ক্লাস নিয়েছেন মোট
চারটা। কোন ক্লাসেই রোলকল করেননি। তাঁর ক্লাসের উপস্থিতি কীভাবে মাপা হবে? অনার্স ক্লাসের
শিক্ষার্থীরা ক্লাস করলো কি করলো না তাতে আসলেই কি কারো কিছু যায় আসে? আর যারা ক্লাসে
ভর্তি হয়েছে – সবাই তো পরীক্ষা দেবে। এর জন্য আবার আলাদা করে পরীক্ষার ফরম ফিল আপ করার
দরকার কী? অফিস থেকে চেয়ারম্যানের দস্তখত নেবার পর সেই ফরম হলে গিয়ে জমা দিতে হলো।
এবার হলের প্রভোস্টের দস্তখত হবার পর সেই ফরম ব্যাংকে যাবে। ব্যাংকে পরপর দু’দিন গিয়ে
ফেরত আসতে হলো। বলা হলো হল থেকে ফরম যায়নি ব্যাংকে। আবার হলে গিয়ে খবর নিতে হলো। প্রভোস্ট
স্যার ফরম সাইন করার সময় পাননি। এদিকে টাকা জমা দেয়ার শেষদিন উপস্থিত। শিক্ষার্থীদের
এরকম ভোগান্তির মাধ্যমে কী শিক্ষা দেয়া হচ্ছে আমি জানি না। সম্ভবত এই শিক্ষা দেয়া হয়
যেন আমরা পাস করার পর যদি কখনো কোথাও পৌঁছতে পারি, তাহলে সুযোগ পেলেই এর চেয়ে বেশি
ভোগান্তিতে ফেলতে পারি – সে জনগণ হোক, কিংবা শিক্ষার্থী হোক, কিংবা পরীক্ষার্থী।
পরীক্ষার ফরম ফিল আপ
হয়ে গেছে। এবার সিরিয়াসলি পড়াশোনা করা দরকার। কিন্তু নিজের মতো করে থাকার একটা জায়গা
নেই আমার। সোহরাওয়ার্দী হলে আরো কয়েকবার গিয়ে ঘুরে এসেছি। এবছর সিট পাওয়ার কোন সম্ভাবনা
নেই। মৃণাল শাহজালাল হলে উঠেছে। কীভাবে সিট পেয়ে গেছে জানি না। সে জোরেশোরে বিএনসিসি
করছে। অনেক জানাশোনা তার। আমার জনসংযোগ ক্ষমতা খুবই কম। সিনিয়র যাদেরকে চিনি – তাদের
কাছে গিয়ে নিজের জন্য কিছু চাইতে খুব সংকোচ হয়। আমার বড়ভাইয়ের স্কুলজীবনের সহপাঠী এখন
ছাত্রশিবিরের বড় নেতা। শাহজালাল হলের সামনে একদিন ডেকে জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছি ইত্যাদি।
ছাত্রশিবিরের নেতা যখন কুশলসংবাদ জিজ্ঞেস করে তখন ভয়ের কারণ ঘটে। সেখানে একটা ম্যাসেজ
থাকে। ম্যাসেজটা হলো – আমি তোমাকে চিনি, আমার কর্মীরাও তোমাকে চেনে, তোমার গতিবিধি
আমরা খেয়াল রাখছি। শিবিরের এরকম নজরদারির ভেতর আমি হলে থাকতে পারবো না। আমাকে বাইরেই
বাসা দেখতে হবে।
শ্যামলদার সাথে বাসা
দেখতে গিয়ে ব্যাচেলরের বদলে ফ্যামিলি বলেও
বাসা ভাড়া পাইনি হিন্দু বলে। শ্যামলদা আবার বাসা খুঁজতে যেতে বলছেন। আগের বার ব্যাচেলরের
বদলে ফ্যামিলি বলেছেন। এবার কি তবে হিন্দুর বদলে মুসলমানের নাম বলবেন? আমি সাফ জানিয়ে
দিলাম – কোন ধরনের মিথ্যা কথা বলতে পারবো না। শ্যামলদা রাজনীতিতে ক্রমশ দক্ষ হয়ে উঠছেন।
রাজনৈতিক নেতাদের মতো স্মিতমুখে বললেন, “তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। যা বলার আমিই বলবো।“
বিবিরহাট এলাকাটি গরুর
হাটের জন্য বিখ্যাত। মুরাদপুর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এদিক দিয়েই হাটহাজারি নাজিরহাটের
বাসগুলি যায় – যেগুলি দিয়ে ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া যায়। এখানে বাসা দেখতে গেলাম। একতলা টিনের ছাউনি পাকা বাড়ি। লম্বা স্কুলের মতো পাশাপাশি
লাগানো পাঁচ-ছয়টি বাসা। বাসার সামনে একটি টিউবওয়েল আছে। দু’জন বাচ্চা ছেলেমেয়ে অনেক
কসরৎ করে টিউবওয়েল দাবছে, খুবই শীর্ণ ধারায় পানি বের হচ্ছে। বাড়িওয়ালা ফরিদ সওদাগর
গরুর ব্যবসায়ী - পরিবার নিয়ে এখানেই থাকেন। তাঁর অংশটা তুলনামূলকভাবে অনেক বড় মনে হচ্ছে।
বারান্দায় শাড়ী আর জামা-কাপড় ঝুলছে। ফরিদ সওদাগরের বিশাল শরীর, অনেকটা অভিনেতা অমল
বোসের মতো। তিনি হাসিমুখে একটা লম্বা টুলে আমাদের বসতে দিলেন। নিজে বসলেন একটা বড় মোড়ায়।
“আপনাদের মধ্যে সম্পর্ক
কী?”
বাড়িওয়ালারা সাধারণত
যেভাবে প্রশ্ন করেন – ফ্যামিলি না ব্যাচেলর, হিন্দু না মুসলমান, উপার্জন কত – এসব কিছু
জিজ্ঞেস না করে ফরিদ সওদাগর জানতে চাচ্ছেন আমাদের দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক কী?
“আমরা খালাতো ভাই।“
“আপনারা দুইজন থাকবেন?”
শ্যামলদা কিছু বলার
আগেই আমি বললাম, “জ্বি, আমরা দু’জন থাকবো।“
“আপনারা তো ছাত্র –
তাই না?”
“জ্বি”
“বিয়ে-শাদী তো করেন
নাই।“
“জ্বি না, করি নাই।“
“ভাল, ভাল বেশ ভাল,
কম বয়সে বিয়ে না করাই ভাল।“ – মনে হচ্ছে ফরিদ সওদাগর আমাদের উপর সদয় হচ্ছেন। আমি আগবাড়িয়ে
বলে ফেললাম, “আমরা হিন্দুর ছেলে।“
“ভাল, হিন্দুর ছেলে
তো ভাল।“
“তবে কি আমাদের বাসা
ভাড়া দেবেন?” – আমি বেশ আশান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“আপনাদের বাসা-ভাড়া
দিতে আমার তো কোন আপত্তি নাই। তবে এখানে সবাই পরিবার নিয়া থাকে। আমার নিজের পরিবারে
চাইরটা মাইয়া। আমার কোন ছেলেসন্তান নাই। মাইয়া বড়টা ম্যাট্রিক ফেইল করছে গতবার। এইবার
আবার পরীক্ষা দেবে।“
“আমরা কিন্তু কাউকে
ডিস্টার্ব করবো না তার গ্যারান্টি দিতে পারি।“ – শ্যামলদা বললেন।
“আপনারা ডিসটাব করবেন
না সেই গেরান্টি আপনারা দিতে পারেন। কিন্তু আমার মাইয়ারা আপনাদের ডিসটাব করব না, সেই
গেরান্টি ত আমি আপনাদের দিতে পারব না। মাইয়ারা যদি আমারে কয় আপনাদের কাউরে ভালা লাগছে
– আমি কিন্তু বিয়া পড়াইয়া দেব।“
“আমরা তো হিন্দু।“
– শ্যামলদা যুক্তি দেন।
“তাতে ত কোন সমইস্যা
নাই। বিয়ার আগে কলমা পইরা মুসলমান হইবেন। তারপর বিয়া। রাজি থাকলে আজকেই বাসার চাবি
দিয়া দেব।“
বুঝতে পারছি ব্যাচেলরদের
বাসা ভাড়া না দেয়ার এটা অন্যরকম যুক্তি। তবে ফরিদ সওদাগরের এই পদ্ধতিটা বেশ মজার মনে
হলো, অনেকটা নাটকীয়তা আছে। সালাম দিয়ে চলে এলাম।
ঠিক হলো এবার গ্রামের
দিকে গিয়ে দেখতে হবে। চৌধুরিহাট, ফতেয়াবাদ, নন্দীরহাট – ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি এসব
গ্রামে অনেক ছাত্র থাকে ঘর ভাড়া নিয়ে। ওখানে গিয়ে দেখতে হবে।
প্রদীপ নাথকে বললাম
চৌধুরি হাটে বাসা দেখতে। সে চৌধুরি হাট মোটামুটি চষে ফেললো। ছোট বাসা কোথাও নেই। মদুনাঘাটের
ওদিকে কিছু বাসা আছে – কিন্তু সেখান থেকে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ক্লাস করা অনেক ঝামেলার
ব্যাপার।
নন্দীরহাটে একটা বাসার
খবর পাওয়া গেল চকবাজারের উপহার স্টুডিওর পূজন বাবুর কাছে। এক শুক্রবার বিকেলবেলা রওনা
হলাম নন্দীরহাটের উদ্দেশ্যে। হাটহাজারির বাসে উঠে ফতেয়াবাদের পর নন্দীর হাট। এখানে
বিখ্যাত সুরকার সত্য সাহাদের পৈত্রিক বাড়ি। মেইন রোডে বাস থেকে নেমে পশ্চিম দিকের ছোট
মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রাচীন জমিদারবাড়ির অনেক নিদর্শন দেখলাম পথের দুপাশে।
যে বাড়িতে ঘর ভাড়া দেয়া হবে বলা হয়েছে – সেটা মোটামুটি বড় একটা মাটির ঘর। মনে হচ্ছে
ছোট ছোট রুমে অনেক ছাত্রই থাকে এই বাড়িতে। ভাড়া দেয়ার জন্য একটা বারান্দা, আর অন্য
একটি রুমে একটি সিট খালি আছে। বাড়ির পেছনে একটি পুকুর আছে – সেখানেই গোসল ইত্যাদি।
আর পুকুরের পাড়ে ভাঙা টিনের ঘেরা দেয়া ছোট্ট একটা টয়লেট। রান্নাবান্না করার জন্য কেরোসিনের
স্টোভ ব্যবহার করতে হবে। যার রান্না সে করে নেবে যার যার রুমের ভেতর। মনে হচ্ছে আমাদের
গ্রামের বাড়ির চেয়েও খারাপ ব্যবস্থা এখানে। পূজন বাবু আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন।
এখানে এসে বেশ গর্বের সাথে বললেন, “দেখছেন তো কত ভালো ব্যবস্থা। এখানের সব ছাত্রই কিন্তু
হিন্দু। আমরা কোন মুসলমানকে বাড়িতে ঢুকতে দিই না।“ পূজন বাবুর কথায় আমি শিউরে উঠলাম।
এরকম সাম্প্রদায়িকতা যেখানে – সেখানে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। শ্যামলদাকে বললাম,
“আমি এখানে থাকবো না। আপনার ইচ্ছা হলে আপনি থাকতে পারেন।“
না, শ্যামলদারও ইচ্ছে
হলো না। তিনি হলে উঠবেন সিদ্ধান্ত নিলেন। তার মানে আমার নিজের ব্যবস্থা এখন আমাকেই
করতে হবে। আমি কিছুটা খুশিও হয়ে গেলাম। কিন্তু রমজানের ছুটির আগে কিছুই হলো না। রমজানের
ছুটিতে বাড়িতে চলে গেলাম। সানজিদার কথাই ফলে গেলো। আমাদের পরীক্ষা আবার পিছিয়ে দেয়া
হয়েছে। এবার ডেট দিয়েছে সেপ্টেম্বরে। ঈদের পর ইউনিভার্সিটি খুললো জুনের শেষের দিকে।
ক্লাস শুরু হয়েছে। দিদির বাসায় যতটুকু পারি ঘাড়্গুঁজে পড়াশোনা করার চেষ্টা করি। কিন্তু
সেখানে তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নানারকম ঝামেলা লেগেই আছে। সেসব ঝামেলার কথা বলাও
যায় না, সহ্য করাও যায় না। ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে সময় পেলেই ব্রিটিশ কাউন্সিলে চলে
যাই, বইপত্র নাড়াচাড়া করি। একদিন ব্রিটিশ কাউন্সিলে দেখা হয়ে গেল এখলাসের সাথে।
এখলাস চিটাগং কলেজে
আমার উচ্চমাধ্যমিকের সহপাঠী। ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সে ভর্তি হয়েছে আমার আগের ব্যাচে।
কিন্তু পরীক্ষা দেয়নি। এখন সে আবার আমার সহপাঠী। অনেকদিন পর দেখা। অনেক কথাবার্তা বললাম।
জানলাম সে ফতেয়াবাদের কাছে ছরারকুলে একটি বাড়িতে থাকে। অনেক ছাত্র থাকে সেখানে।
“তোমাদের ওখানে কি রুম
খালি আছে?”
“আছে মনে হয়।“
“আমার একটা জায়গা দরকার।
তুমি কি একটু দেখবে তোমাদের ওখানে?”
“রুম খালি আছে মনে হয়।
তুমি কালকে এসে দেখে যাও।“
“তুমি কি বাড়িওয়ালাকে
একটু জিজ্ঞেস করে দেখবে হিন্দুর ছেলেকে ঘরভাড়া দেবেন কি না?”
এখলাস আমার কথা শেষ
হবার আগেই তার লম্বা দু’বাহু বাড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “ওখানে আমার রুম আছে। তুমি
আমার সাথে থাকবে। তুমি আমার ভাই।“
No comments:
Post a Comment