১২
বটতলি স্টেশনে এসে দেখলাম ইউনিভার্সিটির ট্রেন এক নম্বর প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে আছে। খুব একটা ভীড় নেই আজ। ট্রেনের গায়ে রাজ্যের ধুলো। জানালাগুলিতে এত ধুলো জমেছে যে বাইরে থেকে ভেতরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে ধুলোবালি জমেছে এই ট্রেনের ভেতরে-বাহিরে। অথচ মাত্র আড়াই মাস বন্ধ ছিল এই ট্রেনের চলাচল। অবশ্য তখনো যে ট্রেন ধুলিমুক্ত ছিল তা নয়। ছিয়াশির নভেম্বরের ২৬ থেকে আজ সাতাশির ফেব্রুয়ারির সাত, মাঝখানে কেটে গেছে বাহাত্তর দিন। বাহাত্তর দিন ধরে এই ট্রেনটি মনে হয় ডকে পড়েছিল এভাবেই। অনির্দিষ্টকালের ছুটি শেষ হলো বাহাত্তর দিন পর। মানুষ কিংবা আশেপাশে তেমন কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। চেনা মুখগুলিকে অচেনা মনে হচ্ছে না একটুও। একটু পর ক্লাসের অনেককেই পেয়ে গেলাম। আশফাক, স্বপন, মামুন, যীশু, অর্পণ, সাঈদ উঠলাম এক বগিতে। সবজায়গায় ধুলোবালি থিকথিক করছে। ট্রেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য রেলওয়েতে মানুষের অভাব নেই, মানসিকতার অভাব আছে। আমাদের সামনের সিটের নিচে দুটো কুনো ব্যাঙ চুপচাপ পাশাপাশি বসে আছে। মনে হচ্ছে এতদিন পর হঠাৎ এত হৈ চৈ শুনে তারা কিছুটা বিরক্ত। সিটের উপর এখনো অনেক ছেঁড়া কাগজ আর ইটের টুকরো পড়ে আছে। হয়তো এভাবেই সিট রিজার্ভ করেছিল সেদিন দেড়টার ট্রেনে। শিবিরের আক্রমণ শুরু হবার পর সেই যে ট্রেন চলে এসে ডকে ঢুকেছিল, আজ এতদিন পর বের হলো। কিছু ছেঁড়া কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে সিট মুছে শুরুতে একটু সংকোচের সাথে বসলেও, একটু পরে ধুলোবালি ময়লার কথা সবাই ভুলে গেল। এতক্ষণ বগির ভেতর ধুলোর একটা অস্বস্তিকর গন্ধ ছিল। এখন সেটাও চলে গেছে। আমাদের ফুসফুস বাতাসের সাথে সাথে টেনে নিয়েছে সূক্ষ্ম ধুলোবালি। তার প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই সশব্দে গলা পরিষ্কার করছে। কন্ঠ থেকে উঠে আসা দলা দলা থুতু অকুন্ঠে ছুঁড়ে দিচ্ছে জানালার শিক গলিয়ে বাইরে। জনসমক্ষে কিংবা নির্জনে, যেখানেই হোক, থুতুনিক্ষেপে আমাদের জুড়ি নেই।
“অ্যাই, পরীক্ষা কি মার্চের আঠারো তারিখে হবে?” – অর্পণের
গলায় উদ্বেগ। শিবিরের নারকীয়তার আগে আমাদের ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার তারিখ দিয়েছিল
১৮ মার্চ। ওটা ছিল প্রথম তারিখ। সিনিয়রদের মুখে শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কমপক্ষে
দুইবার পেছানোর পর তৃতীয় তারিখে পরীক্ষা হয়। প্রথম তারিখটি নাকি দেয়া হয় বাংলা বিভাগের
রেজাল্ট দেয়ার জন্য। দ্বিতীয় তারিখটি দেয়া হয় পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করার জন্য। আর
তৃতীয়বার তারিখ দেয়ার পর সাধারণত পরীক্ষা হয়।
কয়েক বছর আগেও তিন বছরের অনার্স কোর্সের প্রথম দু’বছর কোন পরীক্ষাই হতো না। তৃতীয় বছরে
সবগুলি পেপারের পরীক্ষা হতো একের পর এক। কেউ ইচ্ছে করলে সাবসিডিয়ারি বিষয়গুলির পরীক্ষা
দুই বছর পর দিয়ে কাজ কিছুটা এগিয়ে রাখতে পারতো। কিন্তু অনেকেই তা করতো না। তৃতীয় বছরেই
সব পরীক্ষা দিতো। সেক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে গায়ে হাওয়া-পানি-ধোঁয়া-খুশবু যা
খুশি লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো যেতো। তারপর এখন যে নিয়মে চলছে সেই নিয়ম চালু করা হলো। এখন
প্রত্যেক বর্ষের শেষে ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যায়। সেই পরীক্ষার সবগুলি বিষয়ে আলাদা আলাদাভাবে
পাস করলে তবে পরের বর্ষে ওঠা যায়। কোন একটা বিষয়ে ফেল করলেও সেই বর্ষে সম্পূর্ণ ফেল।
ধরা যাক, আমি ফার্স্ট ইয়ারের সব পেপারে ফার্স্ট ক্লাস মার্কস পেলাম। কিন্তু ১০ নম্বরের
ভাইভাতে পাস মার্কস পেলাম না, তাহলে আমি ফার্স্ট ইয়ারে সম্পূর্ণ ফেল। তখন আমার একটা
শিক্ষাবর্ষ পুরোটা নষ্ট হবে। আমাকে পরবর্তী ব্যাচের সাথে আবার সবগুলি পরীক্ষা দিয়ে
পাস করতে হবে, আগে পাওয়া নম্বরগুলির কিছুই তখন অবশিষ্ট থাকবে না। ভয়ে আঁৎকে ওঠার মতো
অবস্থা। কারণ এই পদ্ধতিতে স্যার-ম্যাডামদের হাতে এত বেশি ক্ষমতা যে তাঁরা চাইলেই যে
কাউকে ফেল করিয়ে দিতে পারেন। ভাইভাতে ফেল করালেই তো ফেল। ভাইভাতে কী জিজ্ঞেস করা হলো,
কী উত্তর দিলাম – তার কোন রেকর্ড তো থাকে না। এই কারণেই সম্ভবত আমাদের স্যার-ম্যাডামদের
সাথে কথা বলার সময় সবাই হিসেব করে কথা বলে, পাছে তাঁরা রুষ্ট হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস পরীক্ষাগুলি নেয়ার
ব্যবস্থা করেন। সবগুলি বিভাগের পরীক্ষা একই সাথে হয়, কিন্তু রেজাল্ট একই সাথে হয় না।
অনেক বছর থেকে দেখা যাচ্ছে – বাংলা বিভাগের রেজাল্ট দেয় সবার শেষে। অনেক সময় পরের ব্যাচের
পরীক্ষার তারিখ দেয়ার পর আগের ব্যাচের রেজাল্ট দেয়া হয়। সেই ব্যাচে যারা ফেল করে তারা
পরের ব্যাচের সাথে পরীক্ষা দেয়। সেজন্য তাদেরকে মাস দুয়েক সময় দিতে হয়। এসব করতে করতে
এক বছরের শিক্ষাবর্ষ অনেক সময় দুই বছর গড়িয়ে যাবার পরেও শেষ করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষাবর্ষের হিসেবে আমাদের অনার্স ফাইনাল শেষ হবার কথা ১৯৮৮ সালের মধ্যে। এখন ১৯৮৭’র
ফেব্রুয়ারি। অথচ আমরা এখনো ফার্স্ট ইয়ারে। আমাদের আগের ব্যাচের ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা
হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো তাদের রেজাল্ট দেয়নি।
অর্পণের সাথে কথা বলে জানা গেলো সে ইতোমধ্যে সিলেবাসের অনেককিছুই
পড়ে ফেলেছে। শহরে কোন্ স্যার নাকি অনার্সের ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট পড়ান। অর্পণ প্রাইভেট
পড়েছে এই অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে। আমার ধারণা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট
পড়তে হয় না। কিন্তু যারা প্রাইভেট পড়ে – তারা মনে হয় সবকিছুর জন্যই প্রাইভেট পড়বে।
আমি এই ছুটিতে পড়াশোনা যে একদম কিছুই করিনি তা নয়, হুমায়ূন আহমেদের গল্পের বই পড়েছি,
উদীচি সত্যেন সেন রচনাবলি প্রকাশ করছে – তার প্রথম খন্ড বের হয়েছে – সেটা পড়েছি। আর
ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ পর্যন্ত মেডিকেল ভর্তি-গাইড পড়েছিলাম – যেটা কোন কাজে আসেনি।
ষোলশহর স্টেশনে দেখলাম আমাদের বগির সামনেই প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে
আছে রানা আর জাফর। তার একটু দূরে শবনম। তারা তিনজনই ফরেস্ট কলোনিতে থাকে। রানা আর জাফরকে
ডেকে তুললাম আমাদের বগিতে। যীশু শবনমের নাম ধরে ডাকলো কয়েকবার। কিন্তু শবনম আমাদের
দেখার পরেও আমাদের বগিতে উঠলো না, চলে গেলো সামনের বগিতে। যীশু রেগে গেলো রানার ওপর।
ড্যাশিং হিরো সোহেল রানার মতো গোঁফ আছে আমাদের আবদুল আওয়াল রানার। কিন্তু সোহেল রানার
সাথে আর কোন মিল নেই তার। সে ইংরেজিতে কথা বলতে খুব পছন্দ করে। তাকে মাঝে মাঝে আবদুল
মান্নান রানা ডাকলে সে গোঁফের ফাঁকে মৃদু হাসে। রানার বপু আর গুম্ফ দুটোই বেশ পুষ্ট
হয়েছে এই ছুটিতে। যীশু রানার পেটে গুঁতা দিয়ে বললো, “তোর জন্যই শবনম ওদিকে চলে গেল।“
যীশু রেগে গিয়ে যখন দাঁত কিড়মিড় করে – কেমন যেন ইঁদুরের মতো লাগে। অন্য সময় হয়ে তার
রাগে ইন্ধন জোগাতাম, কিন্তু এই মুহূর্তে রানাকে আমার দরকার। শুনেছি ফরেস্ট কলোনির সরকারি
বাসাগুলিতে যারা থাকেন, তাদের অনেকে সাবলেট দেন। রানার বাবা বন গবেষণাগারের মস্তবড়
অফিসার তা রানার কাছেই শুনেছি। তার কাছে সাবলেটের খবর থাকতে পারে, বা সে খোঁজ নিতে
পারে। স্বার্থ আদায় করার জন্য মানুষ যেরকম অতিরিক্ত মোলায়েম হয়ে যায়, তারচেয়েও মোলায়েমভাবে
রানাকে বললাম, “আমাকে একটা রুম জোগাড় করে দে দোস্ত, তোর পেটে পড়ি।“
“ডু ইউ লাইক টু স্টে ইন সার্ভেন্টস কোয়াটার?”
“মানে?”
“অফিসারদের বাসাগুলি তো অনেক বড় বড়। বাসার সাথে সার্ভেন্টস
কোয়ার্টার, ড্রাইভার্স কোয়ার্টার, গার্ডেনার্স কোয়ার্টার – অনেক কিছু থাকে। সবগুলি
তো লাগে না। ওগুলি অনেকে ভাড়া দিয়ে দেয়।“
“কোন সমস্যা নেই দোস্ত। আমি একটা খাট ও টেবিল বসানোর জায়গা,
আর একটা বাথরুম হলেই আমার চলবে।“
“এত কষ্ট করে কেন থাকবি? আই উইল ফাইন্ড সামথিং বেটার ফর ইউ।
ভালো ফ্যামিলির সাথে থাকবি। লজিং থাকতে আপত্তি নেই তো? ওয়ান অফিসার আংকেল লুকিং ফর
অ্যা লজিং মাস্টার ফর হার ডটার। মেয়ে ইস্পাহানিতে পড়ে – ক্লাস টেনে। পড়ানোর বদলে থাকা
খাওয়া ফ্রি। দেখবো কি না বল।“
“দেখবি মানে? চল এক কাজ করি, চৌধুরিহাট স্টেশনে নেমে যাই।
এখনই গিয়ে সেই অফিসারের সাথে দেখা করে আসি। দেরি হয়ে গেলে যদি আর কাউকে নিয়ে নেন।“
“নো নো, ডোন্ট ওয়ারি। রানা ইজ হিয়ার। আই উইল কনফার্ম ইউ টুমরো।“
আমার মনে হচ্ছে চাঁদ হাতে পেতে যাচ্ছি। স্টেশনের এত কাছে,
থাকা-খাওয়া ফ্রি, সরকারি কোয়ার্টার। মাস্টারকে নিশ্চয় সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে থাকতে
দেবেন না। দিলেও কোন সমস্যা নেই। হল থেকে শিবির কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে মনে হচ্ছে ভালোই
হয়েছে আমার জন্য।
উৎফুল্লচিত্তে ইউনিভার্সিটি স্টেশনে নামলাম। প্লাটফরমের ইটের
ফাঁকে ফাঁকে ঘাস গজিয়ে গেছে। গাছগুলি সব একই রকম আছে, কেবল গাছের গায়ে যেখানে এরশাদের
পোস্টার ঝুলতো – সেখানে এখন ছাত্রশিবিরের রঙিন পোস্টার। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে গেটে।
বিশাল লোহার গেট দিয়ে ক্যাম্পাসের ভেতর আর বাইরের সীমানা দেয়া হয়েছে। বাসগুলির কিছু
রাখা হয়েছে ভেতরে। হেঁটে গেট পার হয়ে ভেতরে রাখা বাসে উঠতে হবে। সেই বাসগুলি যাবে ক্যাম্পাসে।
এদিকে গেটের বাইরে যে বাসগুলি আছে সেগুলি স্টেশন থেকে ১নং গেট পর্যন্ত যাতায়াত করছে।
যারা শহর থেকে বাসে এলে আগে ১নং গেটে নেমে বাসে উঠে সরাসরি ক্যাম্পাসে চলে যাওয়া যেতো।
কিন্তু এখন ট্রেন স্টেশনের কাছে এসে নেমে যেতে হবে। তারপর হেঁটে গেট পার হয়ে আবার বাসে
উঠতে হবে। শুধু তা নয়, স্টেশনের ভেতরে অস্থায়ী পুলিশফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে। এই পুলিশরা
শিবিরের আক্রমণ ঠেকাবে, নাকি শিবিরের দখলদারিত্ব রক্ষা করবে তা পরিষ্কার নয়। তবে এটুকু
বলা যায়, এই পুলিশ এখান থেকে আর কোথাও যাচ্ছে না। কারণ এত আরামের ডিউটি অন্য কোথাও
পাবে না। তবে এখানে পোস্টিং – পুলিশের জন্য শাস্তির মতো হবে। কারণ এখানে কোন উপরিপাওনার
সম্ভাবনা নেই।
গেট পার হয়ে বাসে উঠতে যাচ্ছি, জাফর দৌড়ে এলো। রানা খুব ধীরে
হাঁটে, অনেক পেছনে পড়ে গেছে সে। জাফর বললো, “তুমি কি রানার কথা বিশ্বাস করেছো নাকি?”
“বিশ্বাস করবো না? কী বলছো?” – জাফরের কথায় বেশ অবাক হলাম।
“বিশ্বাস করলে ঠকবে।“ – জাফর কথা খুব কম বলে। কিন্তু যতটুকু
বলে সত্যি বলে। রানার আশ্বাসে বিশ্বাস না রাখতে পরামর্শ দিলো সে। এতক্ষণ ধরে কতকিছু
পরিকল্পনা করে ফেলেছিলাম। জাফরের কথায় ভেবে দেখলাম – রানা যেসব আশ্বাস দিয়েছে তা একটু
বেশি ভালো, অনেকটা সিনেমার মতো। দেখা যাক – সে কী বলে। আমাকে অন্য চেষ্টাও করতে হবে।
সোহরাওয়ার্দীর মোড়ে নেমে গেলাম। হলের গেটে পুলিশ বসে আছে।
পরিচয়পত্র চেক করছে যারা তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে শিবিরের কর্মী। প্রভোস্ট স্যারের রুমের
সামনে ছাত্রদের ভীড় জমে গেছে। সিটের ব্যাপারে এসেছে সবাই। এখানে আগে যারা ছিল, তাদের
সবাইকে সিট দেয়া হবে এমন কোন প্রতিশ্রুতি দেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিলেন প্রভোস্ট
স্যার। হলে সিটের জন্য দরখাস্ত যখন জমা নেয়া হবে তখন দরখাস্ত করতে হবে। মেধার ভিত্তিতে
সিটবন্টন করা হবে। ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের মেধা কীভাবে যাচাই করা হবে জানি না। এইচএসসির
মার্কশিট দেখে? প্রভোস্টের রুমের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পূর্বদিকে চোখ তুলে তাকালেই
আমি আগে যেখানে থাকতাম সেই ব্লকের বারান্দা দেখা যায়। দেখলাম আমাদের ক্লাসের কবীর সেই
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে ঠিকই তার আগের সিটে এসে উঠেছে। তবে কি সে এখন
জাতীয় পার্টি থেকে শিবিরে রূপান্তরিত হয়েছে?
জাফরের কথাই ঠিক হলো। পরদিন রানাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী বললেন
তোর অফিসার আংকেল?”
“আংকেল তো রাজি। কিন্তু আন্টি রাজি না। ছেলে টিউটর রাখবে
না। তুই মেয়ে হলে কোন সমস্যা ছিল না।“ – রানার ঝটপট উত্তর।
“আমার পক্ষে তো এখন আর মেয়ে হওয়া সম্ভব না।“
“আই নো। দেয়ার আর মেনি প্রোবলেমস টু বি এ ম্যান ইন দিস ওয়ার্ল্ড।“
– রানার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে স্বয়ং সক্রেটিসের কাছে প্রাইভেট পড়ে সে।
ক্লাস পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বড় একটা
ঘটনা ঘটে গেলো, শিবিরের অভ্যুত্থান ঘটলো – তাতে কোন স্যারেরই কিছু এলো গেলো বলে মনে
হচ্ছে না। কেউ এ ব্যাপারে একটা শব্দও করছেন না। শুধুমাত্র প্রামাণিক স্যার বললেন,
“তোমাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হলেন সবচেয়ে
বেশি সুবিধাভোগী। বছরের পর বছর ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলেও আমাদের সুযোগ-সুবিধার কিছুই
বন্ধ থাকে না। এই বন্ধের মধ্যে কিছু না করেও আমাদের ইনক্রিমেন্ট হয়েছে, প্রমোশন হয়েছে,
শিক্ষকদের রাজনীতি হয়েছে। কেবল তোমাদেরই জীবন থেকে অনেকগুলি দিন নষ্ট হয়ে গেল।“
টিউটোরিয়াল পরীক্ষার ডেট দিয়েছেন সাহা স্যার আর মোবাশ্বের
স্যার। পড়াশোনা করা দরকার, কিন্তু দিদির বাসায় পড়াশোনা হচ্ছে না। আমার পড়াশোনার জন্য
টেবিল চেয়ার সব ঠিক করে দিয়েছে সে, কিন্তু আমার কিছুতেই মন বসছে না সেখানে। আমার নিজের
একটা জায়গা দরকার, ছোট্ট একটা রুম – যেখানে আমার ইচ্ছামতো পড়তে পারবো, আবার না-পড়তেও
পারবো।
চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেলে যাই সময় পেলে। সুমন তো আগে থেকেই
হোস্টেলে ছিল। অজিতও এখন হোস্টেলে থাকছে। সময় পেলে হোস্টেলে গিয়ে আড্ডা মেরে আসি। এখানেই
একদিন দেখা হয়ে গেল শ্যামলদার সাথে। হলত্যাগ করার পর এতদিন দেখা হয়নি আর। শ্যামলদার
সাথে কথা হলো যৌথভাবে একটা বাসা দেখার। হলে তাঁর সিটে ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে দু’জনে
মিলে একটা বাসা ভাড়া করে থাকা যায়। কিন্তু ব্যাপারটা যে মোটেও সহজ নয় তা ইতোমধ্যেই
টের পাচ্ছি।
চট্টগ্রাম শহরে বাসা খুঁজতে হয় হেঁটে হেঁটে। বাড়ির গায়ে
‘টু লেট’ ‘বাসা ভাড়া হইবে’ ইত্যাদি বোর্ড লাগানো দেখলে দারোয়ানের কাছে খোঁজ নিতে হবে।
তবে যেসব বাসায় দারোয়ান থাকে সেসব বাসার ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই। আমাদের বাজেট
আরো কম। শ্যামলদার সামর্থ্য অনেক। তিনি ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে, ইচ্ছে করলে একটা বাড়ি কিনেও
ফেলতে পারবেন। কিন্তু আমি দরিদ্র দোকানদারের ছেলে, আমার বাবা আমাকে মাসে পাঁচ শ টাকা
দেন। এতদিন সে টাকায় চলে যেতো। কিন্তু এতদিন তো হোস্টেলে বা হলে থেকেছি। থাকার জন্য সেরকম কোন খরচ লাগেনি। আমার যেহেতু কোন
উপার্জন নেই, তাই বাজেটও নেই। কোন ধরনের বাজেট ছাড়াই বাসা খুঁজতে বের হলাম শ্যামলদার
সাথে।
শুক্রবার হলো বাসা খোঁজার জন্য ভালো দিন। কারণ সেদিন বাড়িওয়ালা
বাসায় থাকে। শ্যামলদার কথা মতো সকালে দেখা করলাম তাঁর সাথে হোস্টেলে। তিনি প্রথমে নিয়ে
গেলেন মুরাদপুর। সেখানে মোহাম্মদীয়া ট্রেডিং- একটা লোহা-সিমেন্টের দোকানে ঢুকলেন। সোলেমান
সাহেবকে খুঁজলেন। বিশালবপু সোলেমান সাহেব আমাদের যেতে বললেন পাশের গলির এক পানের দোকানে।
গেলাম। সেই দোকানে পাওয়া গেল যে বাড়িতে ঘর খালি আছে সেই বাড়ির ঠিকানা। মনে হচ্ছে ফেলুদার
গোয়েন্দাগিরির অবস্থা। ঠিকানা নিয়ে মুরাদপুরের বাসস্ট্যান্ড ফেলে রেললাইন ধরে হাঁটতে
লাগলাম। মনে হচ্ছে শ্যামলদা জানেন – কোথায় যেতে হবে। একটা ছোট্ট কাদামাখা গলির সামনে
‘টু লেট’ দেখে খুশি হয়ে গেলাম। চারতলা জরাজীর্ণ বাড়ি। এত ভেতরে রিকশা ছাড়া অন্য কোন
গাড়ি আসার কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। গণি প্রফেসরের বাড়ি। প্রফেসর গণি থাকেন তিন
তলায়। তিন তলায় উঠলাম। কলিংবেল টিপলেন শ্যামলদা।
“এতক্ষণে আইয়রদে নে” – বলতে বলতে দরজা খুলে আমাদের দেখে ভীষণ
বিরক্ত হলেন মাঝবয়সী মোটাসোটা ভদ্রমহিলা।
“গণি স্যার কি আছেন?” – শ্যামলদা প্রশ্ন করলেন।
“কেন? প্রাইভেট পড়তে আসছো?”
মনে হচ্ছে প্রফেসর গণি প্রাইভেট পড়িয়ে অনেক টাকাপয়সা উপার্জন
করেন। কিন্তু বাড়িটার বয়স দেখে তো মনে হচ্ছে গণি সাহেবের পৈত্রিক সম্পত্তি। অথবা পুরনো
বাড়ি কিনেছেন, তাও হতে পারে।
“না, বাসা ভাড়ার ব্যাপারে এসেছিলাম।“
“ফ্যামিলি?”
আমি ব্যাচেলর বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু শ্যামলদার সাবধানবাণী
মনে পড়লো। তিনি পই পই করে মানা করেছেন যেন কিছুতেই ব্যাচেলর না বলি। কারণ ব্যাচেলরদের
বাসাভাড়া দিতে চায় না কেউ। কিন্তু তাই বলে বিবাহিত বলবো? উনিশ বছর বয়সে বিয়ে করে ফেলেছি
বললে কেউ বিশ্বাস করবে?
“জ্বি ফ্যামিলি” – শ্যামলদা খুব ভদ্রভাবে সুন্দর করে মিথ্যা
কথা বললেন। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
“নাম কী?”
“শ্যামল”
“পুরা নাম কী?”
“শ্যামল দাস।“
“হিন্দু?”
“জ্বি”
“এখানে ভাড়া হবে না। আমি হিন্দুদের ঘরভাড়া দিই না।“
মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন ভদ্রমহিলা।
No comments:
Post a Comment