১৫
“সাবধান!
সামনে পরীক্ষার্থী!!
নীরবতা বজায় রাখুন!!!
আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ”
দেয়ালে লাগানো সাদা আর্টপেপারে মোটা স্কেচ-পেন দিয়ে বড় বড়
কালো অক্ষরে লেখা এই সতর্কবার্তা দেখে থমকে
দাঁড়ালাম। শিক্ষাজীবনে পরীক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু
সামনে পরীক্ষার্থী আছে সেই কারণে একেবারে নীরবতা বজায় রাখতে হবে - এরকম সাবধানবাণী
আগে কোথাও দেখিনি। একটু আগে আলাওল আর সোহরাওয়ার্দী হল থেকে ঘুরে এসেছি। সেখানেও পরীক্ষার্থী
আছে, কিন্তু এরকম কোন কঠিন নোটিশ সেখানে দেখিনি। শাহজালাল হলের অফিস পার হয়ে পূর্বদিকের
করিডোর ধরে হেঁটে এসে কয়েক ধাপের সিঁড়ি বেয়ে প্রশস্ত বারান্দায় উঠে এলে সামনেই টকটকে
লাল ইটের দেয়াল। দেয়ালের বাম দিকে টয়লেট, আর ডান দিকে কয়েক ফুট গিয়েই প্রশস্ত করিডোর
চলে গেছে সোজা উত্তরদিকে। এই করিডোরে ঢুকার মুখেই দেয়ালে লাগানো হয়েছে এই ত্রিরঙা পোস্টার।
বোঝাই যাচ্ছে উল্লেখিত পরীক্ষার্থী এদিকেই থাকে। “সাবধান” কথাটাতে জোর দেয়ার জন্য লাল
কালি ব্যবহার করা হয়েছে। ফিজিক্সের ছাত্র হিসেবে এটুকু তো জানি যে লাল রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য
বেশি – তাই অনেক দূর থেকেও লাল রঙ দেখা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে লাল ইটের দেয়ালে এই
লাল কালির “সাবধান” কথাটা খুব বেশি জোরালোভাবে চোখে পড়ছে না। যীশু আর প্রদীপ নাথ এটা
দেখেছে কি না জানি না। তারা তাদের হাতের কাগজপত্র আমার হাতে তুলে দিয়ে দ্রুত ঢুকে গেছে
টয়লেটে। হয়তো একটু আগের মধ্যাহ্ন-ভোজের বিরূপ প্রতিক্রিয়া, কিংবা আসন্ন পরীক্ষার প্রভাবে
তাদের পাকস্থলী ঢিলা হয়ে গেছে।
তিন বার পেছানোর পর আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা
অবশেষে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে। ক্লাস সাসপেন্ড হয়ে গেছে মাস খানেক আগে। তারপর
ক্যাম্পাসে খুব একটা আসা হয়নি। আজ এসেছি অ্যাডমিট কার্ড নিতে। প্ল্যান মোতাবেক যীশু
আর প্রদীপ নাথ সকালে আমার মেসে এসেছিল। সেখান থেকে তিনজন এক সাথে ক্যাম্পাসে এসেছি
এগারোটার দিকে। নজরুল আর এখলাস গতকাল এসে তাদের অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে গেছে। আমি আর প্রদীপ নাথ গতকাল শহরে গিয়েছিলাম সিনেমা
দেখতে। পরীক্ষার বাকি আছে আর মাত্র পাঁচদিন, আর আমরা সেখানে সিনেমা দেখে বেড়াচ্ছি।
প্রদীপ নাথের সাথে আমার নামের মিল ছাড়াও আরো অনেক ব্যাপারে
মিল আছে। আমাদের দু’জনেরই লাফিং ডিজিজ আছে। অনেক সময় হাসির কোন জোরালো কারণ ছাড়াই আমাদের
হাসি পায়। তখন একজনের হাসি অন্যজনে সংক্রমিত হয়। লেখাপড়ার ব্যাপারে আমাদের দু’জনের
দৃষ্টিভঙ্গিই রক্ষণাত্মক। মুখস্থ করার ক্ষমতা আমাদের খুবই সীমিত। সিলেবাসের সবটুকুই
পড়তে হবে – এরকম নিয়মে আমাদের একটুও বিশ্বাস নেই। পরীক্ষায় পাস করার জন্য ন্যূনতম যে
নম্বর আমাদের দরকার তা পাবো এ ব্যাপারে নিশ্চিত
হবার পর, বাকিটা আমরা বোনাস বলেই মনে করি। লেখাপড়া সংক্রান্ত কোন ধরনের প্রতিযোগিতা
কিংবা গোপনীয়তার ধারেকাছেও আমরা নেই। আমরা কম পড়ি, কিন্তু যেটুকু পড়ি – সেটুকু বুঝে
পড়ি। ফলে পরীক্ষার আগে কিংবা পরে আমাদের মনের উপর তেমন কোন চাপ থাকে না। লেখাপড়ার জন্য
কোন ধরনের আনন্দ বন্ধ করে দেয়ার পক্ষপাতী আমরা নই। আমরা দু’জনই সিনেমা দেখতে পছন্দ
করি। তবে আমার দৌড় বাংলা সিনেমা পর্যন্ত, ইংরেজি সিনেমা তেমন একটা দেখিনি। কিন্তু প্রদীপ
নাথ ইংরেজি সিনেমাই বেশি দেখে। চট্টগ্রামে দুটো হলে শুধু ইংরেজি সিনেমা চলে – দিনার
আর মেলোডিতে। আলমাসের পাশে দিনার, আর নুপুরের পাশে মেলোডি। প্রদীপ নাথের সাথে গিয়ে
বেশ কিছু ইংরেজি সিনেমাও দেখে ফেলেছি ইতোমধ্যে। আমার ধারণা ছিল চট্টগ্রাম শহরের সবগুলি
সিনেমা হলেই আমি সিনেমা দেখেছি। কিন্তু তার কাছে জানলাম এয়ারপোর্টের কাছে শাহীন সিনেমা
হলে ভারতীয় বাংলা কিংবা হিন্দি সিনেমাও চলে। এই সিনেমা হলের কথা আমার জানা ছিল না।
প্রদীপ না্থের বড় ভাইয়েরা বিদেশে থাকে। তাই এয়ারপোর্টে তার যাতায়াত আছে। সেই সুবাদে
শাহীন সিনেমা তার পরিচিত। আমাকেও সেই সিনেমা হলের পথ দেখালো সে। খুবই সোজা পথ। ফতেয়াবাদ
থেকে তিন নম্বর বাসে উঠলে ঘন্টা দেড়েক লাগে। সরাসরি শাহীন সিনেমার গেটে নামা যায়। সেখানে
গিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখাও শুরু হলো। এতদিন শুধুমাত্র হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। কিন্তু
প্রদীপ নাথের কল্যাণে ভিসি-আরে সিনেমা দেখার সুযোগও পাওয়া গেল। তার বড় দুই ভাই মধ্যপ্রাচ্যে
থাকেন। সেখান থেকে রঙিন টিভি ভিসি-আর আর প্রচুর হিন্দি সিনেমার ভিডিও-ক্যাসেট এসেছে
তাদের বাড়িতে। মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে গিয়েও সিনেমা দেখে আসি। আমাদের কার্যকলাপ দেখলে
মনে হবে – আমাদের মুখ্যকর্ম বিনোদন, আর গৌণকর্ম অধ্যয়ন।
আমানত খান বিল্ডিং-এ বসবাস শুরু করার পর থেকে আমার রুমে প্রায়
প্রতিদিনই আড্ডা জমে। এখলাস অনেকগুলি টিউশনি করে। তাই সে আমাদের সবার চেয়ে ব্যস্ত।
নাটক-সিনেমা দেখার প্রতি তার খুব একটা আগ্রহ নেই। তার প্রধান বিনোদন – রিডার্স ডাইজেস্ট।
সে নিয়মিত রিডার্স ডাইজেস্ট পড়ে এবং নতুন নতুন ইংরেজি শব্দ ডাইজেস্ট করে। কিন্তু শত
ব্যস্ততার মধ্যেও কমপক্ষে একবার রুমে এসে ঢু মেরে যায় সে। নজরুল মাঝে মাঝেই আসে আড্ডা
দিতে। প্রদীপ নাথ বাড়ি থেকে প্রায়ই সকালে চলে আসে সাইকেল নিয়ে। আমার রুমে সাইকেল রেখে
তারপর ইউনিভার্সিটি বা শহরে যাই। অথবা রুমে বসে দুজনে একসাথে পড়াশোনা করি। যত না পড়া
হয়, তার চেয়ে বেশি হয় গল্প। মাঝে মাঝে প্রদীপ নাথের সাথে বিপ্লব, তৌহিদ আর সাইফুলও
আসে। তৌহিদ আর সাইফুলের সাথে প্রদীপ নাথের আবাল্য বন্ধুত্ব। বিপ্লবের সাথে তার বন্ধুত্ব
কলেজে পড়ার সময় থেকে। আমার সাথেও তাদের বন্ধুত্ব হতে সময় লাগলো না একটুও।
গতকাল শহরে গিয়ে মেলোডিতে জেমস বন্ডের ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’
দেখে যীশুর বাসায় গিয়েছিলাম জামাল খানে। পরীক্ষার ব্যাপারে যীশু ভীষণ সিরিয়াস। অবশ্য
শুধু পরীক্ষা কেন, সবকিছুর ব্যাপারেই সে সিরিয়াস। আমরা যেরকম আলমগীর কবিরের সিনেমা
এবং দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর সিনেমা একই রকম আগ্রহ নিয়ে দেখতে পারি, যীশু তা পারে না।
সে মৃণাল সেনের আর্টফিল্ম দেখে, রবি ঘোষকে পছন্দ করে, কিন্তু অন্জু ঘোষকে সহ্যই করতে
পারে না। টিভিতে টেস্ট ক্রিকেট দেখতে পারে ঘন্টার পর ঘন্টা, কিন্তু আধঘন্টার একটা নাটক
দেখতে হলে বিরক্ত হয়ে যায়। সে নিয়মিত “দেশ” পত্রিকা পড়ে, কিন্তু আমার রুমে চিত্রালী
দেখলে “হিহিহি” করে হেসে উঠে। আমরা দুজন সিনেমা দেখে এসেছি শুনে যীশু চোখ দুটি হাসের
ডিমের মতো বড় করে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “তোরা কি ম্যাথম্যাটিক্যাল ফিজিক্সের সবকিছু
একেবারে শেষ করে ফেলেছিস যে সিনেমা দেখে বেড়াচ্ছিস পরীক্ষার আগে!” এখানেই তো সমস্যা।
আমরা তো সবকিছু পড়ি না। যেমন বেসেল ফাংশান আমাদের মাথায় ঢোকে না, তাই ওটার ধারে কাছেও
আমরা যাইনি। কিন্তু যীশু আমাদের মতো নয়, সে সিলেবাসে যা আছে তার সবকিছুই পড়ে। যাই হোক,
আমরা আরো কিছুক্ষণ তার সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী ছিলাম, কিন্তু যীশু ঘরের চৌকাঠ থেকে
আমাদের বিদায় করে দিলো। কথা ছিল আজ সকালে আমার ওখানে আসবে, তারপর একসাথে ক্যাম্পাসে
আসবো অ্যাডমিট কার্ড নিতে।
যথাসময়েই এলো প্রদীপ নাথ আর যীশু। রুমে তালা দিয়ে বের হবার
সময় দেখা হলো শাহেদ ভাইয়ের সাথে। শাহেদ ভাই আমার সামনের রুমে থাকেন। আমাদের দু’ব্যাচ
সিনিয়র। শিবিরের মাঝারি পর্যায়ের নেতা। আমার সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়েছে এখলাস। শিবিরের
নেতাদের কাছ থেকে আমি যথাসম্ভব দূরে থাকতে চাই – এখলাস তা জানে। কিন্তু তার দর্শন অনেক
বেশি বাস্তব। সে বলে, “এখানে শাহেদ ভাই তোমার নিকটতম প্রতিবেশী। বলা তো যায় না, কখন
কী দরকারে লাগে। রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মানুষ তো মানুষই।“ কিন্তু এখলাস
যেভাবে ভাবে, শিবিরের লোকজন কি সেভাবে ভাবে? শাহেদ ভাই আমাদের দেখে কিছু না বলে আবার
নিজের রুমে ঢুকে গেলেন। রাস্তায় এসে যীশু বললো, “ঐ লোক তোর সামনের রুমে থাকে? তাকে
না সেদিন দেখলাম ক্যাম্পাসের গাছ ভেঙে নিয়ে মিছিল করতে?” যীশু ঠিকই ধরেছে। ক্যাম্পাসে
এখন শিবির ছাড়া আর কোন পার্টির তেমন কোন কার্যক্রম নেই। ছাত্রদলের সাথে শিবিরের কিছুটা
ভাবসাব হয়েছে মনে হয়। ছাত্রদল ছোটখাট কয়েকটা মিছিল করেছে, শিবির কিছু বলেনি। কিন্তু
ছাত্রলীগ একদিন মিছিল বের করেছিল। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির সামনে আসার পরেই সেই মিছিলে
হামলা চালায় শিবিরের ছেলেরা। আমরা সায়েন্স ফ্যাকাল্টির দোতলায় দাঁড়িয়ে দেখলাম শিবিরের
ছেলেরা রাস্তার পাশে লাগানো ছোট ছোট সবুজ গাছগুলি মুচড়ে ভেঙে হাতের লাঠি বানিয়ে তেড়ে
মারতে গেলো ছাত্রলীগের ছেলেদের দিকে। ছোট ছোট চারাগাছগুলি ভাঙতে, বাগান লন্ডভন্ড করতে
কি একটুও খারাপ লাগে না শিবিরের? ক্যাম্পাসের চারাগাছ, ফুলের বাগান এসবও কি বেশরিয়তী?
প্রথমেই গেলাম আলাওল হলে। প্রদীপ আলাওল হলের অনাবাসিক ছাত্র।
হলের অফিসে প্রচন্ড ভীড়। ফার্স্ট ইয়ারের এত ছাত্র থাকে এই হলে? ছাত্রদের বেশিরভাগের
পরনেই লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। শিবিরের উত্থানের পর মনে হচ্ছে পোশাক হিসেবে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবিকে
উৎসাহিত করা হচ্ছে। এরমধ্যে স্টাইপ পায়জামা আর টি-শার্টের হাফিজকে আলাদাভাবে চেনা গেলো।
হাফিজের কয় সেট জামাকাপড় আছে আমি জানি না। এপর্যন্ত তাকে আমি এক পোশাকে দু’দিন দেখেছি
বলে মনে পড়ে না।
“কী রে দোস্ত, তোরা সবাই কি এই হলে?” – হাফিজ প্রশ্ন করলো।
“না রে, আমরা তিন জন তিন হলে। আমি এই হলে।“ – বলে প্রদীপ
নাথ অফিসের দিকে চলে গেল।
“ঠিক আছে দোস্ত। আমি যাই। পরীক্ষার দিন দেখা হবে।“ – বলে
হাফিজ চলে গেল হলের ভেতর। পরীক্ষার প্রভাবে সেও খুব সিরিয়াস হয়ে গেছে। প্রায় আধঘন্টা
লাগলো প্রদীপ নাথের অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে বের হতে।
ইউনিভার্সিটির এই কাজগুলি আমার কাছে অহেতুক বাড়াবাড়ি বলে
মনে হয়। এই ইউনিভার্সিটির পরিকল্পনা যাই থাকুক, এটা তো আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়। তাহলে
সব শিক্ষার্থীকে কেন কোন না কোন হলের অধীনে থাকতে হবে? পরীক্ষা তো নেয় ডিপার্টমেন্ট
বা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস। তাহলে অ্যাডমিট কার্ড কেন হলে এসে নিতে হবে? পরীক্ষার ফরমও
কেন হলে জমা দিতে হবে? এগুলি যদি ডিপার্টমেন্ট করে তাহলে আমাদের ভোগান্তি অনেক কমে
যায় না? তাছাড়া আমরা তো ভর্তি হয়েছি – তাহলে পরীক্ষা দেবোই। সেক্ষেত্রে এক অনার্স ডিগ্রির
জন্য প্রতি বছর পরীক্ষার ফরম ফিল আপ করতে হবে কেন? প্রত্যেকটা হলে আবাসিক শিক্ষক, প্রভোস্ট
এসব পদ আছে। শিক্ষকরা এসব পদ-পদবির সুযোগ-সুবিধা নেন। কিন্তু তাতে ছাত্রদের কী লাভ
হয়? কোন আবাসিক শিক্ষক কি আসলেই হলে আবাসিক? মারপিটের সময় কি তাঁকে পাওয়া যায়?
আলাওল থেকে আমার সোহরাওয়ার্দী হলে আসতে আসতে প্রায় একটা বেজে
গেলো। এখানেও অনেক ভীড়। আনন্দ’র সাথে দেখা হলো। দেখলাম সেও লুঙ্গি পরে হলের অফিসের
সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার চুল খুবই ছোট করে ফেলেছে। সম্ভবত পরীক্ষা উপলক্ষে মাথা কামিয়ে
ফেলেছিল। আনন্দ সদাগম্ভীর, নামের সার্থকতা
বজায় রাখার প্রতি কোন চেষ্টাই নেই তার। আমাদের দেখে সামান্য মাথা নেড়ে অফিসে ঢুকে গেল।
মিনিট দশেক পর বের হয়ে এলো হাতে দুটো প্রবেশপত্র নিয়ে। একটি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমারটাও নিয়ে এসেছি।“ আমি অবাক হয়ে আমার প্রবেশপত্র তার হাত থেকে নিতেই সে দ্রুত
নিজের রুমের দিকে চলে গেল। একটা মিনিটও নষ্ট করার মতো সময় নেই তার। আমার সময়ও বাঁচিয়ে
দিয়েছে নিজেরটার সাথে আমার প্রবেশপত্রও নিয়ে এসে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো – এভাবে তো
যে কেউ যে কারো প্রবেশপত্র নিয়ে চলে যেতে পারে। এভাবে যদি কোন প্রবেশপত্র উধাও হয়ে
যায়, তাহলে ভোগান্তিটা তো পোহাতে হবে সেই ছাত্রকে। প্রবেশপত্র ছাড়া কি তাকে পরীক্ষা
দিতে দেয়া হবে? একটা পরিচয়পত্র দিয়েই কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কাজ করা যাবে না?
ক্ষুধা লেগে গেছে। যথাসময়ে খাবার পেটে না গেলে যীশুর মাথাব্যথা
করে। সোহরাওয়ার্দীর মোড়ের ক্যান্টিনের আমরা নিয়মিত খাদক। খাওয়ার পর এলাম যীশুর অ্যাডমিট
কার্ড তুলতে শাহজালাল হলে। এখানের অফিসে খুব বেশি ভীড় নেই। দিলীপ বর্ধন আর আহসান হাবীব
দীপকের সাথে দেখা হলো অফিসের সামনে। দু’জনের মুখেই অনেকদিনের না-কামানো দাড়ি। পরীক্ষার
সময় শেভ না করা খুবই প্রচলিত পদ্ধতি। সময় বাঁচানোর চেয়েও নিজেকে রুমের ভেতর পড়ার টেবিলে
বন্দী করে রাখার কৌশল হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয় এই পদ্ধতি। দীপককে বললাম, “কী রে দোস্ত,
তোকে তো নব্যশিবিরের মতো লাগছে। কখন যোগ দিলি?”
“আস্তে বল দোস্ত। এখানে দেয়ালেরও কান আছে।“ – ফিস ফিস করে
বললো দীপক। দেয়ালের কান না থাকলেও দেয়ালের কাছে দাঁড়ানো শিবিরকর্মীদের কান ও চোখ যে
আমাদের দিকে তা তাদের চোখে চোখ পড়তেই বুঝলাম।
শাহজালাল হলের সামনে সুন্দর একটা ফোয়ারা আছে। যদিও সেই ফোয়ারায়
কোন পানি নেই। কিন্তু তার চারপাশে সুন্দর ফুলের বাগান। গত প্রায় এক মাস ধরে সারাদেশে
এত বৃষ্টি হয়েছে যে অনেক জেলায় বন্যা হয়ে গেছে। কিন্তু শাহজালাল হলের সামনের বাগানে
কোথাও কোন পানি জমে নেই। তবে শিবিরের কর্মীরা পালা করে হল পাহারা দিচ্ছে। কে আসছে কে
যাচ্ছে তার প্রতি কড়া নজর রাখা হচ্ছে হলের বিভিন্ন কর্নার থেকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে জাতীয় ছাত্রসমাজ বিতাড়িত হবার পর সারাদেশের কোথাও তাদের আর কোন প্রভাব থাকলো না।
প্রেসিডেন্ট এরশাদ গতমাসে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয়পার্টির ছাত্রসংগঠনের বিলুপ্তি ঘোষণা
করেছেন। কিন্তু যেসব ছাত্র-ছাত্রী এতদিন ছাত্রসমাজ করেছে, তারা সব গেলো কোথায়? নতুন
শক্তির উত্থান হলে পুরনো শক্তি থেকে অনেকেই নতুন শক্তিতে যোগ দেয়। ছাত্রসমাজের প্রায়
সবাই এখন ছাত্রশিবিরের সমর্থক হয়ে গেছে। তবে তাদের কর্মী হতে গেলে অনেক পরীক্ষা দিতে
হয়। যত সহজে একজন ছাত্রশিবিরের কর্মী ছাত্রলীগে ঢুকে যেতে পারবে, একজন ছাত্রলীগের সমর্থকের
পক্ষে তত সহজে শিবিরে ঢোকা সম্ভব নয়।
অ্যাডমিট কার্ড হাতে নিয়ে যীশু বেশ জোরে হাঁটা দিলো করিডোরের
ভেতরের দিকে। মৃণালের রুমে যাবার প্ল্যান ছিল না, কিন্তু মনে হচ্ছে যীশু সেদিকেই যাচ্ছে।
শাহজালাল হলের স্থাপত্য বেশ সুন্দর। মেইন গেটের ডানে বামে করিডোর। করিডোরের শেষ মাথায়
কয়েক ধাপের সিঁড়ি পার হয়ে উঁচু ফ্লোর। সেদিকের রুমগুলি কিছুটা উঁচুতে। সেখানে এসে যীশু
আর প্রদীপ নাথ টয়লেটে ঢুকে গেল। তারপর আমার চোখে পড়লো এই সাবধানবাণী। আমার ধারণা যদি
ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এই সাবধানবাণী কার রচনা – তা আমি বুঝতে পেরেছি। তার হাতের লেখা
আমার পরচিত। তাকে যদি বলি যে আমরা গতকালও হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছি – কিছুতেই বিশ্বাস
করতে চাইবে না। সিরিয়াস লোকেরা সম্ভবত অন্যদেরকেও সিরিয়াস মনে করে।
পায়ের শব্দে পেছন ফিরে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। এই লোক
কি এই হলেই থাকে? এদিকের কোন রুমে? আমি যীশুর ফাইল দিয়ে মুখ আড়াল করে গভীর মনোযোগে
আবার পড়তে লাগলাম “সাবধান! সামনে পরীক্ষার্থী!!” আসলে বলা উচিত, সাবধান! সামনে পাগল
প্রেমিক!!
সে আমার কাছে এসে শব্দ করে পড়তে লাগলো – “সাবধান! সামনে পরীক্ষার্থী!!”
মুখ আড়াল করে রেখেও কাজ হলো না। সে আমাকে চিনে ফেললো, “আরে তুমি! তোমাকেই তো আমি খুঁজছি।
তুমি পান্নাকে বলেছো আমার কথা? চিঠিটি দিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ দিয়েছি তো। আপনার সাথে দেখা হয়নি তার?”
“না, সে তো ক্যাম্পাসে আসছে না আর। তার ডিপার্টমেন্টে গিয়ে
দেখা পাই না।“
“পাবেন পাবেন। শীঘ্রই পাবেন।“
“পাবো? বলছো?” – তার মুখে বিস্তীর্ণ হাসি। “ঠিক বলছো তো?”
– তার গলার স্বর উপরে উঠছে দেখে মুখে আংগুল দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘সাবধান, সামনে
পরীক্ষার্থী!”
“ওহ্, পরীক্ষার্থী, পরীক্ষার্থী” – বলে অনেকটা পা টিপে টিপে
চলে গেল সে। আমার হাসি পেয়ে গেল তার অবস্থা দেখে। তার নাম প্রভাংশু ত্রিপুরা। আমাদের
সিনিয়র, তবে কয় ব্যাচ সিনিয়র জানি না। তবে প্রেমঘটিত ব্যাপারে এমন অবস্থা হয়েছে যে
পড়াশোনা মনে হয় শিকেয় উঠেছে। তাও আবার একতরফা প্রেম। তার সাথে আমার প্রথমবার দেখা হয়
বেশ কয়েকমাস আগে বেশ নাটকীয়ভাবে।
আমাদের লাইব্রেরিতে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বসে পড়ালেখা করা
যায়। সাতটার পর একটা বাস আছে – যেটা ক্যাম্পাস থেকে শহর পর্যন্ত যায়। আমি কিছুদিন লাইব্রেরিতে
বসে পড়াশোনা করতাম, এবং সেই বাসে ছড়ারকুলে নামতাম। একদিন বিকেলে ক্যাম্পাসে একা একা
হাঁটতে হাঁটতে লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছি। পথে দেখা হয়ে গেলো পান্নার সাথে। পান্নার সাথে
আমার পরিচয় উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় থেকে। সে পড়তো গার্লস কলেজে। আমার বন্ধুর দিদির
ক্লাসমেট ছিল সে। সেভাবে আমার সাথেও পরিচয় হয়। দুর্দান্ত ভালোছাত্রী পান্না। আগে ফরেস্ট্রিতে
কোন মেয়ে ভর্তি হতো না। পান্না ফরেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রথম মেয়ে। অনেক দিন পর ক্যাম্পাসে
দেখা হয়ে সে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। কিন্তু মনে হলো – তার সাথে আমার যতটুকু পরিচয়
– তার চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা দেখাচ্ছে সে। একেবারে হাত ধরে ফেলছে। অনেকটা কাছে এসে আপনজনের
মতো কথা বলতে বলতে পেছনে তাকাচ্ছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম – একটু দূরে দাঁড়িয়ে
আছে মোটাসোটা শরীরের একটা ছেলে। পান্নার আরোপিত অন্তরঙ্গতা দেখে মনে হলো সে এই ছেলেটাকে
কাটানোর জন্য এরকম করছে। “কেমন আছো? সুমন কেমন আছে? ডেইজি কেমন আছে? ফিজিক্সে কেমন
লাগছে? ফরেস্ট্রি আমার খুব ভালো লাগছে।“ এই ক’টা বাক্যের পর প্রসঙ্গ প্রায় ফুরিয়ে এলো
পান্নার। “কালকে আবার দেখা হবে” – ইত্যাদি বলে অনেকটা লোকদেখানো হাসি হেসে পান্না চলে
গেল। প্রায় সাথে সাথেই ছুটে এলো মোটাসোটা ছেলেটা। হাঁপাতে হাঁপাতে কঠিন গলায় বললো,
“তুমি পান্নার কে?”
“বন্ধু।“
“কেমন বন্ধু?”
“ভালো বন্ধু”
“প্রেমিক নও তো?”
“কেন?”
“বলো না, প্লিজ বলো।“
“কারণ না জানলে কীভাবে বলি?”
“কারণ আমি পান্নাকে ভালোবাসি।“
ব্যাপারটা তো গুরুতর মনে হচ্ছে। সিনেমার ডায়লগ বের হচ্ছে।
“আমি গত এক বছর ধরে পান্নার পেছনে ঘুরছি। সে কোনদিন ভালো
করে একটা বাক্য বলেনি আমার সাথে। আর তোমার সাথে কত হাসিখুশিভাবে কথা বললো। তুমি প্লিজ
বলো।“
আমি পান্নার প্রেমিক নই জানার পর কী যে খুশি হয়ে গেল সে।
মনে হলো পারলে সে আমাকে মাথায় তুলে নাচতো। প্রেমে পড়লে মানুষ যে বোকা হয়ে যায় তা এই
মোটাসোটা প্রভাংশু ত্রিপুরার কাজকর্ম থেকে আবারো প্রমাণিত হলো। এরপর সে আমাকে একটি
চিঠি দেয় পান্নাকে দেয়ার জন্য। কতদিন ধরে এই চিঠি পকেটে নিয়ে ঘুরছে কে জানে। এই ১৯৮৭
সালে ১৯৫০ সালের পদ্ধতিতে প্রেম করতে চাইলে কীভাবে হবে? আমি পান্নাকে দিয়েছিলাম চিঠিটি।
প্রভাংশুর ব্যাপারটা শুরুতে তার কাছে কৌতুকের হলেও পরে সেটা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একতরফা প্রেম হতেই পারে। কিন্তু প্রেমের নামে বিরক্ত করার অধিকার তো কারো নেই। কিন্তু
প্রভাংশুকে কে বোঝাবে সে কথা!
“এটা তো মৃণালের কাজ মনে হচ্ছে।“ -প্রদীপ নাথ দেয়ালের পোস্টারের
দিকে তাকিয়ে বললো।
“হাহাহা। তাই তো মনে হচ্ছে।“
“বাথরুমের ভেতরেও লাগিয়ে দিয়েছে এরকম একটা।“
“তাইলে চল, তার রুমে গিয়ে আর কাজ নেই। বিরক্ত হবে।“
“না, একবার দেখে আসি, আর কয়টা পোস্টার আছে এরকম।“
করিডোরের প্রায় কয়েক ফুট পর পর এরকম সাবধানবাণী লাগানো –
“সাবধান! সামনে পরীক্ষার্থী!! ধীরে চলুন!” “কথা আস্তে বলুন”, “আলোচনা সংক্ষেপ করুন।“
“নীরবতাই কাম্য”, ইংরেজি পোস্টারও আছে কয়েকটা “ প্লিজ ডোন্ট ডিস্টার্ব।“ “আওয়ার এক্সাম
ইজ নকিং দ্য ডোর”।
১৩৪ নম্বর রুমের দরজায় নক করার পর ভেতর থেকে মৃণালের গম্ভীর
গলা শোনা গেল, “হু ইজ দেয়ার?”
“এক্সাম ইজ নকিং দ্য ডোর।“
No comments:
Post a Comment