Monday, 12 April 2021

আয়েশা আপা

 আয়েশা আপা

আয়েশা আপার সাথে আমার প্রথম দেখা শাহীন কলেজে। যদিও আমরা একই ইউনিভার্সিটির একই ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করেছি, আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরুর আগেই তাঁদের মাস্টার্স-পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছিলো। শাহীন কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেয়ার পর আয়েশা আপার সাথে আমার পরিচয়। বিভাগীয় প্রধানের স্বাভাবিক গাম্ভীর্য অতিক্রম করে তিনি প্রথম দিন থেকেই আমাকে জুনিয়র সহকর্মী হিসেবে না দেখে ছোটভাইয়ের মতো স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেছেন। শাহীন কলেজের ম্যাডামদের মধ্যে আমার দু'জন ব্যাচমেট ছাড়া আর কেউ আমাকে 'তুমি' বলে সম্বোধন করেননি কখনো। যদিও আমি তাঁদের সবারই জুনিয়র ছিলাম। আয়েশা আপা ছিলেন ব্যতিক্রম।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের যে কোন কাজে আয়েশা আপা চাইলেই আমাকে 'আদেশ' করতে পারতেন। সেই পদাধিকার তাঁর ছিল। কিন্তু তিনি তা কখনো করেননি। শাহীন কলেজে পাঠদান ছাড়াও অন্যান্য দাপ্তরিক কাজের কোন সীমা-পরিসীমা ছিল না। বিমান বাহিনীর অ্যাডুকেশান উইং থেকে প্রায় সময়েই বিভিন্ন নির্দেশনা আসতো। ফলে একই কাজ বিভিন্ন সময়ে একাধিক পদ্ধতিতে একাধিকবার করতে হতো। সময়ের অপচয় ছাড়াও মেজাজ খারাপ হতো খুব। আমি প্রায় সময়েই রেগে যেতাম। আয়েশা আপা ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনতেন। তারপর হাসিমুখে বলতেন, "রাগ করো না প্রদীপ। চলো কাজটা করে ফেলি। তুমি যতটুকু পারো দেখো, বাকিটা আমি দেখছি।"
'কলেজ ইন্সপেকশান' নামে একটা ব্যাপার শাহীন কলেজে ঘটে বছরে এক বা একাধিকবার। সেই সময় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুম হারাম হয়ে যাবার অবস্থা হয়। ক্লাসরুমের জানালাও পরিষ্কার করতে হয়েছে আমাকে এই ইন্সপেকশানের অংশ হিসেবে। একবার এধরনের ইন্সপেকশানের ঠিক আগের দিন পরীক্ষাগারের যন্ত্রপাতির তালিকা তৈরি করার জন্য একটা খাতা পাঠানো হলো হেড অফিস থেকে। খাতাটির সাইজ একটা বালিশের সমান আর ওজন প্রায় দশ কেজি। শরীরের সবটুকু শক্তি জড়ো করে খাতাটি আলগাতে হয়। কলেজ ছুটির ঘন্টাখানেক আগে আমাদের জানানো হলো পুরনো খাতায় আমাদের যন্ত্রপাতির যে তালিকা আছে তা হবে না। এই নতুন খাতায় সব নতুন করে লিখে রাখতে হবে। এবং তা করতে হবে ইন্সপেকশানের আগেই। প্রিন্সিপাল আবদুল মজিদ খুব গম্ভীরভাবে ইংরেজিতে বললেন, "আই ওয়ান্ট দিস টু বি রেডি বাই টুমরো মর্নিং"। আমি জানি আয়েশা আপার শরীর ভালো নেই। আমাদের ডেমোনেস্ট্রেটর আবুল হোসেন আমার সহপাঠী ছিল। তাঁর মেয়ে অসুস্থ। তাঁর পক্ষেও কলেজ ছুটির পর সারা বিকেল সন্ধ্যা রাতপর্যন্ত কলেজে বসে এই 'খাতা-লেখা' সম্ভব নয়। শুধু ফিজিক্স নয়, কেমিস্ট্রি আর বায়োলজিরও একই অবস্থা। ছুটির পর মাছিমারা কেরানির মতো খাতা লিখতে বসলাম। আবুল হোসেন বাসায় চলে গেছে। কিন্তু আয়েশা আপা কাজ শেষ না করে কিছুতেই বাসায় যেতে চাচ্ছেন না। তাঁর শরীর খুবই খারাপ। অসুস্থ শরীরে কলেজে আসাই উচিত হয়নি তাঁর। কিন্তু 'ইন্সপেকশান' উপলক্ষে সব ছুটি বাতিল। আয়েশা আপার ছেলে মুফতি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। মায়ের সাথেই স্কুলে আসা-যাওয়া করে। সেও বাসায় যেতে পারছে না মা যাচ্ছে না বলে। ফাইজা তখন একেবারে ছোট। সে বাসায় অপেক্ষা করে আছে মা কখন ফিরবে। আমার বড়বোনদের ওপর যেভাবে জোর খাটাই সেভাবে জোর করে আয়েশা আপাকে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। দুই তৃতীয়াংশ কাজ শেষ করতেও প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো। সেই সন্ধ্যাবেলা দেখলাম আয়েশা আপা স্টিল মিলের বাসা থেকে রিক্সা নিয়ে কলেজে চলে এসেছেন। টিফিনবক্সে খাবার নিয়ে এসেছেন আমার জন্য। দুপুরে পিয়ন ইদ্রিস সার্জেন্ট মেস থেকে খাবার এনে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলো। আমি তাকে প্রায় ধমকই দিয়েছিলাম। খাবার সময় বা মেজাজ কোনটাই ছিল না তখন। আয়েশা আপা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলেন এরকম কিছু হতে পারে।
তাঁর এরকম স্নেহের পরিচয় আমি অসংখ্যবার পেয়েছি শাহীন কলেজে আমার সাড়ে চার বছরের কর্মজীবনে। একবার জন্ডিজ হলো আমার। প্রায় দেড় মাস শুয়ে থাকলাম বিছানায়। সেই সময় কলেজে আমার ফিজিক্স ক্লাসের সবগুলোই আয়েশা আপা নিয়েছেন। এমনিতেই একেক জনের প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশটা করে ক্লাস থাকে প্রতি সপ্তাহে। তার ওপর আমার ক্লাসগুলোও নেয়া! একটা অ্যাডজাস্টমেন্ট ক্লাস নিতে হলে কত হৈ চৈ করতাম আমি। অথচ আয়েশা আপা দিনের পর দিন এতগুলো এক্সট্রা ক্লাস করে গেছেন কত স্বাভাবিকভাবে।
অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে আসার সুযোগ পেয়েছি জেনে খুব খুশি হয়েছিলেন আয়েশা আপা। ১৯৯৮ সালের ২০ জুন ছিল শাহীন কলেজে আমার শেষ কর্মদিবস; আয়েশা আপার সহকর্মী হিসেবে আমার শেষ দিন। তারপর যে কয়েকবার কলেজে গিয়েছিলাম দেখা হয়েছিল তাঁর সাথে। তিনি আমার খোঁজখবর নিয়েছেন। কিন্তু একবারও নিজের অসুস্থতার কথা বলেননি। আমি খবর পেয়েছি তাঁর অসুস্থতার। শুনে মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য হয়েছি তাঁর সহনশীলতা আর পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি দেখে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি বাস্তবতাকে হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন, নিজের কর্তব্য করে গেছেন নিষ্ঠার সাথে। আয়েশা আপার সাথে আর কখনও দেখা হবে না। কিন্তু আমার এই ভেবে গর্ব হয় যে আমি আয়েশা আপার সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts