১৬
চৌধুরি হাট রেলস্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর বারোটা। প্লাটফরমে
কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। বনানী, রানু, প্রদীপ নাথ – কেউ আসেনি এখনো। রেললাইনের ওপাশে
পুকুরে সাঁতার কাটছে কেউ একজন। ছোট্ট স্টেশনের একতলা পাকা অফিস। চারপাশে প্রচুর খালি
জায়গা। বাংলাদেশ রেলওয়ের জায়গার অভাব নেই। রেলওয়ের অনেক জায়গা অনেক প্রভাবশালীর দখলে
চলে গেছে। প্লাটফরমের উত্তরদিকে বেশ বড় একটা শিমুল গাছ। অক্টোবরের মাঝামাঝি এখন, শীত
শুরুই হয়নি, অথচ শিমুলের পাতা ঝরতে শুরু করেছে।
ঝলমলে দুপুরের রোদে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে এই রেলস্টেশন। অনেক বছর আগে ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার
শুটিং হয়েছিল এখানে।
“ভিতরে গিয়ে বসেন। দরজা খোলা আছে।“ – পরিচিত গলায় চিৎকার
করে বললো কেউ। শব্দ অনুসরণ করে তাকালাম পুকুরঘাটের দিকে। দুলালকে চিনতে পারলাম। ঘাটে
উঠে লুঙ্গি বদলাচ্ছে। দুলালকে দেখলে মনে হয় রেলের চাকরির মতো সুখের চাকরি আর একটিও
নেই। চৌধুরি হাট রেলস্টেশনে দুলাল ঠিক কোন্ পদে চাকরি করে জানি না, তবে স্টেশন মাস্টারের
অফিসের সামনে প্লাটফরমের উপর রাখা বড় বড় চাকা ঘুরিয়ে ট্রেনের সিগনাল আপ-ডাউন করতেও
তাকে দেখা যায়, স্টেশনের বারান্দায় লাগানো রেলের পাতের লোহার টুকরায় ঘন্টাও বাজায়,
আবার স্টেশন মাস্টারের অফিসে ঢুকে টেলিফোনও রিসিভ করে। গত চার মাস ধরে এই স্টেশনে আসছি।
দুলাল ছাড়া আর কাউকে দেখিনি এখানে কোন কাজ করতে। অথচ খবর নিলে দেখা যাবে – স্টেশন মাস্টার
থেকে শুরু করে এধরনের স্টেশনে যত পদ থাকে – তার সবগুলি পদেই লোক আছে।
অপরিচিত মানুষের সাথে পরিচিত হবার বিশেষ দক্ষতা আছে প্রদীপ
নাথের। স্টেশনের কর্মী দুলালের সাথে পরিচয় করে নিতে বেশি সময় লাগেনি তার। তার এই জনসংযোগ
ক্ষমতার প্রশংসা করলে সে বলে, “সিগারেট খেলে এসব ক্ষমতা এমনিতেই চলে আসে। যারা সিগারেট
খায়, তারা নিসংকোচে অন্যকে সিগারেট অফার করতে পারে, আবার অন্যের কাছ থেকে সিগারেট নিতেও
পারে। দুলালকে একটা সিগারেট অফার করলাম, সাথে সাথে কাজ হলো। ধূমপান ভাতৃত্ববোধ সুদৃঢ়
করে। দেখবি যারা একসাথে সিগারেট খায়, তাদের বন্ডিং কত শক্ত।“ তবে কি আমি ধূমপান করি
না বলে – আমার সাথে বন্ডিং-টা শক্ত হয়নি এখনো? এই যুক্তি দেখাতে পারতাম – কিন্তু কিছু
বলিনি। যুক্তি থাকলেই তা প্রয়োগ করতে হবে – এমন কোন কথা নেই। তবে তার কথায় সত্যতা আছে।
সে স্টেশনে এসে নিজে সিগারেট ধরাবার সময় দুলালকেও একটা দেয় – সেটা আমি প্রায়ই দেখি।
আবার অনেক সময় সিগারেট শেষ হবার আগেই ট্রেন চলে এলে – অর্ধসমাপ্ত সিগারেটটাও দুলালকে
দিয়ে ট্রেনে উঠে। প্রদীপ নাথের বন্ধু হিসেবে আমাকেও কিছুটা খাতির করে দুলাল। তাই স্টেশন
মাস্টারের অফিসে গিয়ে বসতে বলছে। প্রদীপ নাথ থাকলে বলার দরকার হতো না, সে নিজেই গিয়ে
বসে যেতো ভেতরের চেয়ারে। চেয়ারে বসে টেলিফোন তুলে গান শুনতো। অনেকদিন আমাকেও শুনিয়েছে।
এই স্টেশনের টেলিফোনটা অদ্ভুত। রিসিভার কানে দিলে ওদিক থেকে বাংলা সিনেমার গান শোনা
যায়। সম্ভবত রেলওয়ের নিজস্ব কোন বেতারতরঙ্গের সাথে যুক্ত এই টেলিফোন।
রোদের তেজ অনেক বেশি আজ। যাত্রীদের বিশ্রামের জায়গা আছে একটা।
কোন আসবাবপত্র নেই। চারপাশের দেয়ালের সাথে জমানো পাথরের বেঞ্চে যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা।
কোন যাত্রী নেই এখন। একটি পেটমোটা ছাগল পা লম্বা করে শুয়ে আছে পাথরের বেঞ্চের নিচে।
পাশেই ছড়ানো তার সদ্য-নি:সরিত মল-মার্বেল - উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। টিকেট ঘর আছে একটা,
কখনো খোলার দরকার হয় বলে মনে হয় না। ইউনিভার্সিটির ট্রেনে টিকেট লাগে না, কিন্তু নাজিরহাট
লাইনের ট্রেনে যারা চড়েন, তারাও সম্ভবত টিকেট কিনেন না, অন্তত এই স্টেশন থেকে তো নয়।
বনানী আর রানুকে দেখা যাচ্ছে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে। একটা
রোদ-ছাতায় দুই বন্ধু হাঁটছে পাশাপাশি। প্রদীপ নাথ থাকলে হয়তো টুকটাক কথা বলা হতো তাদের
সাথে। ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়ার সূত্রে তারা প্রদীপ নাথের বন্ধু। সোয়া বারোটা বেজে গেছে।
প্রদীপ নাথ আজ দেরি করছে। অন্যদিন এতক্ষণে এসে যায়। পরীক্ষা বলেই আমরা এই স্টেশন থেকে
উঠছি। অন্যসময় পরের স্টেশন ফতেয়াবাদ থেকে উঠি। দুপুর একটা থেকে পরীক্ষা শুরু। আমাদের
প্রতি পেপার পঞ্চাশ মার্কের, সময় দু’ঘন্টা। পরীক্ষার সময় যত কম হয়, আমার ততই ভালো লাগে।
কারণ পরীক্ষাটা অনেকটা বিভীষিকার মতো – যত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় – ততই ভালো। আজ থিওরি
পরীক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে সেই আনন্দেই আগেভাগে চলে এসেছি।
বনানী আর রানু প্লাটফরমের একেবারে সামনের দিকে গিয়ে গাছের
নিচে দাঁড়িয়ে বই খুলে পড়ছে। অনেকে পরীক্ষার হলে ঢোকার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পড়তে থাকে।
আমি পরীক্ষার আগের রাতেও ঠিকমতো পড়তে পারি না। আর পরীক্ষার দিন তো মাথায় কিছুই ঢোকে
না। লেখাপড়ার ব্যাপারে একেক জনের মস্তিষ্ক সম্ভবত একেক ভাবে কাজ করে।
“আজ ঐ দাদা আসেনি?” – দুলাল পুকুর থেকে ফিরেছে খালি গায়ে
একটা গামছা জড়িয়ে। স্টেশনের দুটো পিলারের সাথে বাধা তারে ভেজা লুঙ্গি শুকাতে দিলো দুলাল।
কে বলবে – এই স্টেশন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, কারো ব্যক্তিগত বাসস্থান নয়। স্টেশন মাস্টারের
রুমে ঢুকে একটু পরেই দ্রুত বের হলো দুলাল। গায়ে একটা সাদা শার্ট জড়িয়ে নিয়েছে। সিগনালের
চাকা ঘুরিয়ে সিগনাল ডাউন করছে। ট্রেন আসার সময় হয়েছে। প্রদীপ নাথের কী হলো আজ? তার
আগে ট্রেন চলে এলে তো সমস্যা। ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। আরো কয়েকজন ছাত্রছাত্রী
এসে গেছে। এসময় ঝড়ের বেগে একটা মোটরসাইকেল উঠে এলো প্লাটফরমে। সিনেমার নায়কের মতো তৌহিদ
আমাকে দেখার পরেও মোটর সাইকেল না থামিয়ে চলে গেল আরো সামনে বনানীদের দিকে। তারপর ঘুরে
এলো আমার কাছে।
“প্রদীপ চলো, তোমাদের ক্যাম্পাসে পৌঁছে দিয়ে আসি।“ – তৌহিদ
বললো।
“ট্রেন তো চলে এসেছে। আজ ট্রেনেই যাই। অন্যদিন হবে।“
ট্রেন প্লাটফরমের কাছে চলে এসেছে দেখে তৌহিদ আর জোর করলো
না। আমরা ট্রেনে উঠে পড়লাম। পুরো ট্রেনে সবাই ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষার্থী। সিট পেতে
সমস্যা হয় না। আজ হৈ-হুল্লোড় কম, গান-বাজনা করছে না কেউ, প্রায় সবাই খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে
কিছু না কিছু পড়ছে। পরীক্ষা না থাকলে মনে হয় শুধুমাত্র জ্ঞানলাভ করার জন্য কেউ পড়াশোনা
করতো না। কম্পার্টমেন্টেই দেখা হয়ে গেল সেতারের সাথে। বাদ্যযন্ত্রের নামে নাম সেতার
উদ্দীনের। সেতার আর আমি একই সাথে চট্টগ্রাম
কলেজে ফিজিক্স পড়েছিলাম কিছুদিন। আমি চট্টগ্রাম কলেজ ছাড়লেও ফিজিক্স ছাড়িনি। কিন্তু
সেতার কলেজ এবং ফিজিক্স দুটোই ছেড়েছে। ফিজিক্স ছেড়ে এখন সে বাংলায় পড়ছে। আমার মনে হচ্ছে
– জগতের সমস্ত আনন্দযজ্ঞে কেবল তাদেরই নিমন্ত্রণ এখন। আজ তাদের পরীক্ষা শেষ। শেষ মানে
শেষ। আর আমাদের থিওরি পেপারও বেশি। এরপর আছে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা। সার্বিক ভাইভা
তো আছেই, তার উপর প্র্যাকটিক্যালের ভাইভাও আছে। সেতার বললো, “তোমার জন্যও তো পথ খোলা
ছিল। বাংলা না পড়ে আবার ফিজিক্স পড়তে গিয়েছ কেন? একই ভুল মানুষ দুইবার করে?”
সেতারের প্রশ্নের উত্তরে প্রামাণিক স্যারের যুক্তি প্রয়োগ
করা যেতো, কিন্তু করলাম না। বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনার ব্যাপারে প্রামাণিক স্যার আমাদের ক্লাসে অনেকবার বলেছেন
– “সাহিত্যে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা না করেও কেউ চেষ্টা করলে সাহিত্যিক হতে পারে। ইতিহাস
তুমি নিজে নিজে পড়েও শিখতে পারবে। কিন্তু বিজ্ঞানে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বিকল্প নেই।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে পপুলার সায়েন্স পড়ে তুমি বিজ্ঞানের সুগারকোটেড অংশগুলিই
শুধু জানতে পারবে। কিন্তু বিজ্ঞানের কঠিন অংশগুলি প্রাতিষ্ঠানিক চাপে না পড়লে কেউ পড়ে
না।“ কথাগুলিতে কেমন যেন একটা অহংকারের আভাস আছে। যেন বলা হচ্ছে বিজ্ঞান বিষয়ে যারা
পড়াশোনা করে তাদের গুরুত্ব অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু আসলেই কি ব্যাপারটা তাই?
বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করে – ক’জন বিজ্ঞানী হয়েছেন আমাদের দেশে? আর সাহিত্য পড়েও বা
কতজন সাহিত্যিক হয়েছেন? সৃষ্টির ব্যাপারটা কি শুধুমাত্র বইপড়ে বা ডিগ্রি অর্জন করে
লাভ করা যায়? আমি সঙ্গীতের বই গুলে খেয়ে ফেললেও তো সুর তাল লয় এসব আমার গলায় আসবে না।
অথচ আমি বিজ্ঞানের বই বার বার পড়ে কিছুটা হলেও বিজ্ঞান শিখতে পারবো।
থিওরি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। পরীক্ষা কেমন হয়েছে – এই প্রশ্ন
অনেকেই করে। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর আমি ঠিকমতো কোনদিনই দিতে পারিনি। পরীক্ষার ভালো-খারাপ
মাপার মাপকাঠি হচ্ছে রেজাল্ট। কিন্তু সেটাও আপেক্ষিক। আমার জন্য যেটা ভালো, অনেকের
কাছে সেটা মধ্যমানের। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি – পাস করবো। ফার্স্ট পেপার ও সেকেন্ড
পেপারে স্যাররা ক্লাসে যা পড়িয়েছেন – সেখান থেকেই প্রশ্ন করেছেন। সুতরাং খুব একটা সমস্যা
হয়নি। প্রপার্টিজ অব ম্যাটারে আদম শফিউল্লাহ স্যার দুটি মাত্র ক্লাস নিয়েছিলেন। ভিসকোসিটির
উপর একটা দেড় পৃষ্ঠার নোট দিয়েছিলেন। সেই নোটে দুটো সমীকরণ ছিল। পরীক্ষায় সেই সমীকরণদুটি
হুবহু তুলে দিয়েছেন। বুঝতে পারছি – আদম শফিউল্লাহ স্যারের কোন ক্লাস মিস দেয়া যাবে
না ভবিষ্যতে। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল থার্ড পেপারে। মোবাশ্বের স্যার থার্মোডায়নামিক্সের
প্রশ্নগুলিকে এত ঘুরিয়েছেন – যে মাথা ঘুরে গেছে উত্তর দিতে গিয়ে।
পরের দুই সপ্তাহ ধরে সবগুলি প্র্যাকটিক্যাল আবার প্র্যাকটিস
করতে হলো। তারপর প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা। পঞ্চাশ নম্বরের জন্য একটানা ছয় ঘন্টার প্র্যাকটিক্যাল
পরীক্ষা। অথচ আমরা ছয় ঘন্টায় দেড় শ মার্কের থিওরি পরীক্ষা দিয়েছি। ছয় ঘন্টায় দুইটি
এক্সপেরিমেন্ট করতে হলো। ল্যাবে প্র্যাকটিক্যাল করার সময় আমার কোন সমস্যা কোনদিন হয়নি।
অথচ পরীক্ষার সময় দেখা গেলো যন্ত্রপাতিগুলি আমার হাতে ঠিকমতো কাজই করছে না। লটারিতে
আমার গ্রুপ-এ’র এক্সপেরিমেন্ট উঠলো সারফেস টেনশান অব ওয়াটার বাই ক্যাপিলারি টিউব মেথড।
ক্যাপিলারি টিউবের নাড়িনক্ষত্র আমার জানা। অথচ পরীক্ষার হলে দেখা যাচ্ছে ক্যাপিলারি
টিউবে পানিই উঠছে না। মনে হচ্ছে ফিজিক্সের সব নিয়ম-নীতি বদলে গেছে আমার জন্য। যে স্যারদের
কোনদিন ল্যাবে দেখিনি – তাঁরা সবাই চলে এসেছেন পরীক্ষা নিতে। ডাটা নেয়ার আগেই ডাক দিচ্ছেন
ভাইভা নেয়ার জন্য। মোবাশ্বের স্যার কাছে এসে জ্যামিতি-বাক্স খুলে দেখছেন, “নকল নিয়ে
এসেছো নাকি” বলে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে ভীষণ অপমানজনক
মনে হলো। কিছু কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রতি ন্যূনতম সৌজন্যও কেন দেখান না, আমি
জানি না। তাঁরা ইচ্ছে করলেই যে কাউকে ফেল করাতে পারেন – এই ক্ষমতাই কি তাঁদেরকে এমন
করে তোলে? প্রত্যেকটা আইটেমে আলাদা আলাদাভাবে পাস করতে হবে – নইলে সব বিষয়েই ফেল বলে
ধরা হবে। পরের বছর আবার সবগুলি বিষয়ের পরীক্ষা দিতে হবে। এই ব্যবস্থাটা অন্যায্য বলে
মনে হয়। বি-গ্রুপে লটারিতে উঠলো ‘ভেরিফিকেশান অব দি ল’জ অব ট্রান্সভার্স ভাইব্রেশান
অব অ্যা স্ট্রিং উইথ এ সনোমিটার’। আমার বেশ দখল ছিল এই সনোমিটার যন্ত্রের উপর। ডাটা
নিতে শুরু করলাম। কিন্তু মোবাশ্বের স্যার এসে সব ভন্ডুল করে দিলেন। টিউনিং ফর্ক আমি
তারের যেখানে ধরি – তিনি সরিয়ে দেন। তারের উপর এক টুকরা কাগজ রেখে দিলে রেজোরেন্স ঘটলে
সেই ছোট্ট কাগজের টুকরাটি পড়ে যাবে। কিন্তু তিনি কাগজটিকে দিলেন তারের সাথে প্যাঁচিয়ে।
আমার সাথে তাঁর কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি কেন আমার পেছনে লেগে
রইলেন আমি বুঝতে পারলাম না। আমাকে দেখলেই তাঁর কেন মনে হচ্ছিলো যে আমি চুরি করছি! সকাল
দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একটানা পরীক্ষা। এই ছয় ঘন্টার মধ্যে দুটো এক্সপেরিমেন্ট
করে, দু’বার ভাইভা দিয়ে, দুটো রিপোর্ট সাবমিট করতে হবে। এর মধ্যে একজন ল্যাব সহকারী
এসে বিশ টাকা নিয়ে গেলো নাস্তা আনার জন্য। এটাই নিয়ম – শিক্ষার্থীরা টাকা দেবে, তারা
সবার জন্য এক সাথে নাস্তা নিয়ে আসবে। বিশ টাকার বদলে একটা কলা আর এক পিস পাউরুটি এসেছে
– যেগুলির স্বাভাবিক মূল্য তিন টাকা। তবুও ভালো যে এখানে কলেজের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার
মতো যন্ত্রপাতির জন্য টাকা দিতে হয় না। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায়
ল্যাবের টেকনিশিয়ানদের নগদ টাকা না দিলে কিছুই পাওয়া যায় না। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের পরীক্ষায়
একটি জবা ফুলের জন্য আমাকে বিশ টাকা দিতে হয়েছিল।
প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার কয়েকদিনের মধ্যেই জেনারেল ভাইভা
হয়ে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন স্যার এসেছিলেন এক্সটার্নাল হিসেবে। ভাইভা বোর্ড
বসলো আদম শফিউল্লা স্যারের রুমে। জানা গেলো আদম শফিউল্লাহ স্যার হলেন আমাদের পরীক্ষা
কমিটির চেয়ারম্যান। ভাইভাতে কত দেবেন সেটা নাকি তাঁর উপর নির্ভর করে।
প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ হলো। পরীক্ষার সময় দেখলাম অনেক
নতুন মুখ – যারা আগের বছর খারাপ করেছে বা ড্রপ করেছিল। এবার আমাদের ব্যাচ থেকেও আমার
ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু পরীক্ষা ড্রপ দিলো। যারা ড্রপ দিয়েছে – তারা সবাই অত্যন্ত ভালো
ছাত্র। কোন একটা পেপার হয়তো মনপুত হয়নি, পরের পেপারটা আর দিলোই না। ভালো ছাত্রদের অনেক
ধরনের মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়। অনেক সময় নিজেরাই নিজেদের উপর এই চাপ তৈরি করে তারা।
সত্যজিত রায়ের নিজের কথায় পড়েছিলাম – কলেজের পরীক্ষা শেষ
হবার পর তিনি ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের বই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন আর কোনদিন ধরবেন না
এই প্রতিজ্ঞা করে। পরীক্ষা শেষে রুমে ফিরে আমার ওরকম বই ছুঁড়ে ফেলার ইচ্ছে হয়নি, তবে
ফার্স্ট ইয়ারের সমস্ত বই-খাতা বুকশেলফের নিচের তাকে সরিয়ে ফেললাম। আমার রুমে বাঁশের
তৈরি একটা বুকশেল্ফ হয়েছে ইতোমধ্যে।
“পরীক্ষা কেমন হয়েছে প্রদীপ?” – সন্ধ্যাবেলা মাহমুদভাই রুমে
এসে প্রশ্ন করলেন। মাহমুদভাই সাধারণত অন্য কারো রুমে আসেন না। মেসের সবাই তাঁর রুমেই
যাই টেলিভিশন দেখতে। এই বিল্ডিং-এ একটি চৌদ্দ ইঞ্চি সাদা-কালো টেলিভিশন আছে। সেটা মাহমুদভাইয়ের
রুমে থাকে।
“তোমার চৌকি তো অনেক উপরে তুলে ফেলেছো।“ – খাটে বসতে বসতে
বললেন মাহমুদভাই।
খাটের পাঁচ পায়ের নিচে দুটো করে ইট দিয়েছি। কারণ বর্ষায় ফ্লোর
ঘেমে পানি জমে যায় রুমের ভেতর। খাটের নিচে টিনের ভাঙা ট্রাংকটাও রেখেছি ইটের উপর।
“তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।“
মাহমুদভাইয়ের হাবভাব দেখেই বুঝতে পারছি তিনি কিছু বিশেষ কথা
বলার জন্য এসেছেন। প্রথমেই মনে হলো – শিবিরের কেউ কি আমার নামে কোন অভিযোগ করেছেন?
আমাকে কি মেস ছাড়ার নোটিশ দেয়া হচ্ছে? নিচের তলায় কারো সাথে আমার সরাসরি কোন বিরোধ
এখনো হয়নি। তবে একজনকে ক’দিন আগে একটা ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম। ঘটনাটির কথা আমি কাউকে বলিওনি।
আমার থিওরি পরীক্ষার পর দিদি এসেছিল প্রথমবারের মতো এই বিল্ডিং-এ আমি কোথায় কীভাবে
থাকি দেখার জন্য। তার ফাউন্ডেশান ট্রেনিং শুরু হয়েছে। সে ঢাকা চলে যাচ্ছে চার মাসের জন্য।
পরীক্ষার কারণে আমি অনেকদিন তার বাসায় যেতে পারিনি। তাই সে যাবার আগে একবার দেখে
গেছে আমাকে। সে চলে যাবার সময় তার সাথে বের হয়ে নিচের করিডোর দিয়ে যাবার সময় দেখলাম
একজন বাজে মন্তব্য করলো। দিদিকে টেক্সিতে তুলে দিয়ে সেই মন্তব্যকারীর রুমে গিয়ে ঠান্ডাগলায়
বলেছি চোখ আর জিভ সংযত করতে না পারলে ওগুলি হারানোর সম্ভাবনা আছে। এখন তারা কি দলবদ্ধভাবে
কিছু বলেছে আমার বিরুদ্ধে? মাহমুদভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার মাহমুদভাই?”
“আমি তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করবো, তুমি না বলতে পারবে না।“
“কী ব্যাপার না শুনে কীভাবে বলবো ভাইয়া?”
“না, অসম্ভব কোন রিকোয়েস্ট আমি তোমাকে করবো না। তোমার হেল্প
আমার দরকার।“
“বলেন ভাইয়া, আমার সাধ্যের ভিতর থাকলে আমি করবো।“
“তুমি তোমার ভাবীকে একটু পড়াবে।“
“ভাবী?”
“মানে, এখনো ভাবী হয়নি, তবে হবে। তাদের বাসায় গিয়ে একটু পড়াবে।
সপ্তাহে তিন-চারদিন গেলে হবে।“
“ভাবী কী পড়েন?”
“ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। সায়েন্সে। তুমি তার ফিজিক্স আর ম্যাথস
একটু দেখিয়ে দেবে। প্লিজ ভাই।“ মাহমুদভাই আমার হাত ধরে ফেলেছেন। টিউশনি জোগাড় করার
জন্য অনেককে এভাবে হাত ধরতে দেখেছি। কিন্তু টিউশনি করার জন্য এভাবে অনুরোধ করতে তো
দেখিনি আগে।
“কোন সমস্যা নেই ভাইয়া। আমি অবশ্যই পড়াবো।“
“তাহলে চল, রেডি হও। এখনই যাই।“
“এখনই?”
“হ্যাঁ, আমি তোমাকে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিই। তারপর কাল থেকে
তুমি তোমার মতো যাবে।“
“ঠিক আছে, চলেন। বাসা কোথায়?”
“এই তো কাছেই। খান সাহেবের বাড়ি।“
“খান সাহেব?”
“খান সাহেব, আমাদের বাড়িওয়ালা।“
মাহমুদভাই আমাদের বাড়িওয়ালার হবু জামাই? এই তথ্য তো জানতাম
না।
“তুমি দায়িত্বটা নিচ্ছ দেখে টেনশানমুক্ত হলাম। যার তার হাতে
তো এই দায়িত্ব দেয়া যায় না। তোমার ভাবী কিন্তু ভীষণ সুন্দর।“
মাহমুদভাই এ কী দায়িত্বের মধ্যে আমাকে ফেলছেন জানি না। আমি
স্যান্ডেল বদলে রুম থেকে বের হয়ে দরজায় তালা লাগাচ্ছি – মাহমুদভাই আবার বললেন, “তোমার
ভাবীর একটা বোন আছে, ক্লাস নাইনে পড়ে, তাকেও একটু পড়াতে হবে।“
No comments:
Post a Comment