Tuesday, 20 April 2021

মগজে জিপিএস

 


আমরা কীভাবে পথ চিনি? পরিচিত জায়গায় গেলে কীভাবে বুঝি যে ওখানে আমরা আগেও এসেছিলাম? কিংবা একেবারে নতুন পরিবেশে গেলে কীভাবে বুঝি যে পরিবেশটা নতুন? পরিবেশের জটিল স্মৃতি আমরা কীভাবে ধরে রাখি? এসব প্রশ্নের মোটামুটিভাবে যে উত্তর আমরা সবাই জানি তা হলো আমাদের মগজের মেমোরি সেল বা স্মৃতিকোষে জমা থাকে এসব তথ্য। আমরা যখন নতুন কিছু দেখি আমাদের মস্তিষ্ক নতুন তথ্যগুলি ধারণ করে স্মৃতিকোষে জমা রাখে। আমরা এটাও জানি যে বিভিন্ন প্রাণির স্মৃতিধারণ ক্ষমতা বিভিন্ন - যেমন হাতির স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর, কিন্তু গোল্ডফিশের স্মৃতিশক্তি প্রায় নগণ্য। মানুষেরও মস্তিষ্কের স্মৃতিধারণ ক্ষমতা সবার সমান নয়। বয়স, অনুশীলন এবং অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে স্মৃতিধারণ ক্ষমতাও তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়। যে পথ আমরা ছোটবেলায় কিছুতেই চিনতে পারতাম না, বড় হয়ে সেই পথ চিনতে আমাদের সমস্যা হয় না।

 

পথ ও অবস্থান খুঁজে বের করার জন্য এখন কত ধরনের যান্ত্রিক ব্যবস্থা আছে। গ্লোবাল পজিশানিং সিস্টেম বা জি-পি-এস এখন সুলভ এবং বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি। গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে এখন জি-পি-এস বিশেষ পথ-প্রদর্শকের কাজ করে। উপগ্রহের মাধ্যমে আমরা আমাদের অবস্থান এবং গন্তব্যের দিক-নির্দেশনা পাই জি-পি-এসের সাহায্যে।

 

মানুষের ক্ষেত্রে পথ খুঁজে বের করার পদ্ধতি সম্পর্কে একটা ভাসা ভাসা ধারণা পাওয়া গেলো। ভাসা ভাসা বললাম এই কারণে যে মস্তিষ্কের সবগুলো কোষের কার্যপদ্ধতি নিশ্চিন্তভাবে জানা যায়নি এখনো। আমরা এখনো জানি না ঠিক কী কারণে আলজেইমার্‌স জাতীয় রোগ হয়, বা স্মৃতি-বিনাশ ঘটে। বিজ্ঞানীরা এটুকু নিশ্চিতভাবে জানতে পেরেছেন যে আলজেইমার্‌স রোগীর হিপোক্যাম্পাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষের রোগের কারণ সম্পর্কিত গবেষণার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানীদের নির্ভর করতে হয় ইঁদুর বা অন্যন্য প্রাণী নিয়ে গবেষণালব্ধ ফলের ওপর।

 

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে ইঁদুর বা অন্যান্য প্রাণিরা পথ বা পরিবেশ কীভাবে চেনে বা মনে রাখে? সব প্রাণির মগজেই কি আছে কোন না কোন ধরনের জি-পি-এস? এ সংক্রান্ত ব্যাপক গবেষণা করে যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন আমেরিকান-ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন ও'কিফ এবং নরওয়ের বিজ্ঞানী দম্পতি মে-ব্রিট মোজার ও এডভার্ড মোজার। ২০১৪ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছেন এই তিনজন বিজ্ঞানী।

 

চিত্র-১ চিকিৎসাবিজ্ঞানে ২০১৪ সালে নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী জন ও'কিফ, মে-ব্রিট মোজার ও এডভার্ড মোজার।

 

যেভাবে শুরু

আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী এডোয়ার্ড টলম্যান ১৯৪৮ সালে ফিজিওলজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত তাঁর 'কগনিটিভ ম্যাপ্‌স ইন র‍্যাট্‌স অ্যান্ড ম্যান' শিরোনামের গবেষণাপত্রে [১] প্রাণী কীভাবে পথ চেনে তার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন। তিনি দেখান যে প্রাণিরা স্থান ও ঘটনার সমন্বয় ঘটিয়ে পরিবেশের চিত্র মনে রাখতে পারে। ক্রমঘটমান ঘটনা ও ক্রম-অগ্রসরমান অবস্থানের সমন্বয়ে প্রাণির মগজের মধ্যে ক্রমান্বয়ে একটা সামগ্রিক মানসিক ম্যাপ তৈরি হয়। ওই মানসিক ম্যাপ দেখেই প্রাণিরা পথ চেনে। টলম্যানের তত্ত্ব পথ চেনার প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটা বৈজ্ঞানিক ধারণা দেয় ঠিকই, কিন্তু মগজের ঠিক কোন্‌ জায়গায় এবং ঠিক কী প্রক্রিয়ায় এই মানসিক ম্যাপ তৈরি হয় সে সম্পর্কে কোন ধারণা দেয় না।



চিত্র-২ এডোয়ার্ড টলম্যান


পরবর্তী বিশ বছর ধরে অনেক বিজ্ঞানীই অনেক রকমের গবেষণা করেছেন এ ব্যাপারে। কিন্তু ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তেমন সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালে বিজ্ঞানী জন ও'কিফ প্রাণির মস্তিষ্কে প্লেইস সেল বা স্থানিক কোষ আবিষ্কার করে প্রাণির পথ চেনার পদ্ধতি সম্পর্কিত গবেষণায় নতুন পথের সন্ধান দেন।

 

জন ও'কিফ এবং প্লেইস সেল

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর জন ও'কিফের ইচ্ছে হলো মনের দর্শন (ফিলোসফি অব দি মাইন্ড) সম্পর্কে পড়াশোনা করার। ১৯৬০ সালে ভর্তি হয়ে গেলেন নিউইয়র্ক সিটি কলেজে। ১৯৬৩ সালে সাইকোলজিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন জন। তারপর চলে যান কানাডায়। ফিজিওলজিক্যাল সাইকোলজি (শারীরতাত্ত্বিক মনোবিজ্ঞান) বিষয়ে  মন্ট্রিয়েলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন অধ্যাপক রোনাল্ড মেলজ্যাকের তত্ত্বাবধানে। তাঁর পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল 'সেন্সরি প্রপার্টিজ অব অ্যামিগডালা'। প্রাণির ঘ্রাণ নেবার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে অ্যামিগডালার কোষগুলো।



চিত্র-৩ মস্তিষ্কে অ্যামিগডালা ও হিপোক্যাম্পাসের অবস্থান।

 

পিএইচডি করার পর ১৯৬৭ সালে ইউ এস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেল্‌থ এর পোস্টডক্টরাল ফেলো হিসেবে যোগ দেন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে। শুরুতে অ্যামিগডালার কোষ নিয়ে গবেষণা করলেও লন্ডনে এসে তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র প্রসারিত হয় হিপোক্যাম্পাসে। প্রাণির জীবনে হিপোক্যাম্পাসের ভূমিকা কী? প্রাণির স্মৃতি সংরক্ষণে মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসের একটা ভূমিকা আছে তা জানা গেছে ১৯৫৭ সালে। হেনরি মোলেইসন নামে এক রোগীর মৃগীরোগ সারানোর জন্য দুটো হিপোক্যাম্পাসই কেটে বাদ দেয়ার পর দেখা গেছে যে হেনরি তাঁর স্মৃতিশক্তির অনেকখানিই হারিয়েছেন।

 

হিপোক্যাম্পাসের সুনির্দিষ্ট ভূমিকার ব্যাপারটা কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়নি তখনো। ইঁদুরের হিপোক্যাম্পাস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ও'কিফ। ইঁদুরের হিপোক্যাম্পাসের পরিবর্তন ঘটিয়ে (আস্তে আস্তে কিছুটা করে কেটে নিয়ে) তিনি ইঁদুরের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি দেখেন হিপোক্যাম্পাসের ক্ষতি হলে ইঁদুর আর জায়গা চিনতে পারছে না। নতুন জায়গায় গেলে ইঁদুরের যে উত্তেজনা বাড়ে তা হিপোক্যাম্পাসের অনুপস্থিতিতে কমে যায়। অনেক পরীক্ষা করে ও'কিফ দেখেন যে হিপোক্যাম্পাসের কিছু কোষ শুধুমাত্র প্লেইস বা জায়গার পরিবর্তন হলে উত্তেজিত হয়। তিনি এই কোষগুলির নাম দিলেন 'প্লেইস সেল'। প্লেইস সেলগুলো শুধুমাত্র জায়গা পরিবর্তন বা দিক পরিবর্তনের সময় উত্তেজিত হয়। ১৯৭১ সালে তিনি তাঁর ছাত্র জনাথন ডস্ট্রভিস্কির সাথে প্লেইস সেলের ফলাফল প্রকাশ করেন 'ব্রেইন রিসার্চ' জার্নালে। তাঁর পেপার থেকে আমরা জানতে পারি হিপোক্যাম্পাস ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রাণী জায়গা চিনতে পারে না, পথ ভুলে যায়। 

 


চিত্র-৪ প্লেইস সেল। ডান পাশে ইঁদুরের মগজের হিপোক্যাম্পাসে প্লেইস সেলের অবস্থান। ডান পাশের ধূসর বর্গক্ষেত্রে একটি ইঁদুর মুক্তভাবে ছোটাছুটি করছে। এলোমেলো লাইনগুলো ইঁদুরের গতিপথ নির্দেশ করছে। সবুজ বৃত্তের মধ্যে ডটগুলোতে এলে ইঁদুরের মগজে প্লেইস সেল উদ্দিপ্ত হয়।

 

প্লেইস সেলগুলোর উত্তেজনা জন ও'কিফের আগে আর কেউ পর্যবেক্ষণ করেননি। ও'কিফ আবিষ্কার করলেন যে প্লেইস সেলগুলো শুধুমাত্র পরিচিত পরিবেশে পেলেই উদ্দিপ্ত হচ্ছে, বিভিন্ন প্লেইস সেল মিলে পরিবেশ সম্পর্কে একটা সুনির্দিষ্ট ছক তৈরি হচ্ছে মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে। তিনি আরো দেখালেন যে হিপোক্যাম্পাসে বিভিন প্লেইস সেলের সমন্বয়ে বিভিন্ন পরিবেশের অসংখ্য মানসিক ম্যাপ সংরক্ষিত থাকতে পারে।

 

জন ও'কিফের আবিষ্কার স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। সারা পৃথিবীতে অসংখ্য বিজ্ঞানী প্লেইস সেল সংক্রান্ত তত্ত্বীয় ও পরীক্ষামূলক গবেষণায় লিপ্ত হন। এসব গবেষণার ফল থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় যে প্লেইস সেলগুলো মগজে স্থানিক পরিবেশের একটা ম্যাপ তৈরি করে তা স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে। স্মৃতি সংরক্ষণে হিপোক্যাম্পাসের ভূমিকা মানুষের মানসিক রোগের কারণ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণায় নতুন পথের সন্ধান দেয়। আলজেইমার্‌স রোগীদের মস্তিষ্কের এম-আর-আই স্ক্যান পরীক্ষা করে দেখা গেছে তাদের  হিপোক্যাম্পাস ক্ষতিগ্রস্ত। গবেষণা চলতে থাকে।

 

মে-ব্রিট মোজার ও এডভার্ড মোজার এবং গ্রিড সেল

১৯৯৫ সালে জন ও'কিফের ল্যাবে পোস্টডক্টরেট রিসার্চ করতে এলেন নরওয়েজিয়ান তরুণ দম্পতি মে-ব্রিট ও এডভার্ড মোজার। তখনো পর্যন্ত ধারণা ছিল যে পরিবেশ চেনার ব্যাপারে মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসের সামনের দিক ও পেছনের দিন সমান ভূমিকা রাখে। মে-ব্রিট ও এডভার্ড আবিষ্কার করলেন যে হিপোক্যাম্পাসের সামনের দিকের চেয়ে পেছনের দিকটা বেশি ভূমিকা রাখছে ইঁদুরের পরিবেশ চেনার ক্ষেত্রে। এই আবিষ্কার তাঁদের পরবর্তী গবেষণায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। জন ও'কিফের ল্যাবে তাঁরা শিখলেন হিপোক্যাম্পাসের প্লেস সেল রেকর্ডিং সিস্টেম।

    

১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে তাঁরা নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের পদে যোগ দিয়ে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করলেন পরীক্ষাগার তৈরি করার কাজ। ইউনিভার্সিটির একটা বিল্ডিং-এর বেসমেন্টের কয়েকটা ঘর নিয়ে তৈরি হলো ল্যাব। শুরুতে বায়োলজিক্যাল রিসার্চের সবচেয়ে জরুরি অংশ - 'অ্যানিম্যাল হাউজ', টেকনিশিয়ান, মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ কিছুই ছিল না তাঁদের। সব কাজই নিজেদের করতে হয়েছে। সবকিছু নিজেদের হাতে করাতে সবকিছু নিজেদের মনের মতো করে তৈরি করে নিতে পেরেছেন। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রমের ফল পেতে শুরু করেছেন বছর দুয়েক পর থেকে। ১৯৯৮ সালে তাঁরা প্রথম গবেষণা-শিক্ষার্থী পেলেন। ১৯৯৯ সালে পেলেন প্রথম আন্তর্জাতিক রিসার্চ গ্রান্ট - ইউরোপিয়ান কমিশন থেকে। নরওয়েজিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স থেকে পান 'ইয়ং সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড'। তারপর থেকে একদিনের জন্যও গবেষণা বন্ধ রাখেননি মে-ব্রিট ও এডভার্ড। তাঁরা গবেষণা কাজ এমন ভাবে ভাগ করে নিয়েছেন যেন একটুও সময় নষ্ট না হয়। মে-ব্রিট দেখেন ল্যাবোরেটরি ও প্রশাসন। এডভার্ড দেখেন কারিগরি দিক। কাজের ক্ষতি এড়াতে পারতপক্ষে কোন কনফারেন্সেই দু'জন এক সাথে যান না।

 


চিত্র-৫ মে-ব্রিট ও এডভার্ড মোজার। তাঁদের ল্যাবে

 

পথ ও পরিবেশের স্মৃতি সংরক্ষণে প্লেস সেলের ভূমিকার ব্যাপারটা গত শতাব্দীর শেষে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও প্লেস সেলগুলো শুধুমাত্র হিপোক্যাম্পাসেই থাকে নাকি হিপোক্যাম্পাসের বাইরেও থাকে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি তখনো। মোজাররা গবেষণা শুরু করলেন এ ব্যাপারে।

ইঁদুরের হিপোক্যাম্পাসে ইলেকট্রোড স্থাপন করে একটা বড় (দেড় মিটার দৈর্ঘ্য ও দেড় মিটার প্রস্থের) কাঠের বাক্সের ফ্লোরে ছেড়ে দেয়া হলো। বাক্সের ফ্লোর জুড়ে চকলেটের গুড়ো ছড়িয়ে দেয়া হলো যেন ইঁদুর খাবারের লোভে বাক্সের মধ্যে ছোটাছুটি করে। বাক্সের ফ্লোরের সাথে কম্পিউটারের সংযোগ ঘটানো হলো। ইঁদুরের হিপোক্যাম্পাসের প্লেইস সেলে কোন উত্তেজনা তৈরি হলে সেখানে স্থাপিত ইলেকট্রোডের সাহায্যে কম্পিউটার সেই ব্রেইন-সিগনাল রেকর্ড করতে পারে। ফ্লোরের কোন পথে গেলে ইঁদুরের প্লেইস সেলে উত্তেজনা তৈরি হয় তাও রেকর্ড হয়ে যায়।

 

চিত্র - ৬। বাক্সের মধ্যে ইঁদুরের গতিপথ ও মস্তিষ্কের এন্টোরাইনাল কর্টেক্সে সিগনাল।

 

মোজার দম্পতি আবিষ্কার করলেন যে হিপোক্যাম্পাসের বাইরে এন্টোরাইনাল কর্টেক্সেও প্লেইস সেলের সিগনাল পাওয়া যায়। তার মানে শুধু মাত্র হিপোক্যাম্পাসের প্লেইস সেলগুলিই যে পরিবেশের স্মৃতি তৈরি করছে তা নয়, এন্টোরাইনাল কর্টেক্সের সেলগুলোর ভূমিকাও আছে সেখানে। তাঁরা দেখলেন ইঁদুরের মগজের এন্টোরাইনাল কর্টেক্স থেকে যে সিগনাল আসছে তা ষড়ভুজের মত প্যাটার্ন তৈরি করছে। বোঝাই যাচ্ছে যে হিপোক্যাম্পাসের প্লেইস সেল ছাড়াও এন্টোরাইনাল কর্টেক্সের এক ধরনের সেলও কাজ করছে যা এই প্যাটার্ন তৈরি করছে। মোজাররা এই সেলের নাম দিলেন গ্রিড সেল।

 


চিত্র - ৭। গ্রিড সেল। ইঁদুর যখন পরিচিত পরিবেশে পৌঁছায় তার এন্টোরাইনাল কর্টেক্সের গ্রিড সেল উদ্দীপ্ত হয়ে সিগনাল পাঠায়।

 

গ্রিড সেল আবিষ্কারের ফলাফল প্রকাশিত হয় ন্যাচার জার্নালে ২০০৫ সালে। প্লেইস সেল ও গ্রিড সেলের সমন্বয়ে প্রাণির মস্তিষ্কে পরিবেশের স্মৃতি বা এপিসোডাল মেমোরি কীভাবে তৈরি হয় তার একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া গেল [চিত্র ৮]।

 


চিত্র- ৮। হিপোক্যাম্পাসের প্লেইস সেল (নীল) ও এন্টোরাইনাল কর্টেক্সের গ্রিড সেল (হলুদ)।

 

মানুষের মগজে প্লেইস সেল ও গ্রিড সেল

ইঁদুর ও অন্যান্য প্রাণি যেভাবে পথ দেখে বা পরিবেশ মনে রাখে - মানুষের বেলায় তা কিন্তু আরো অনেক জটিল। মানুষ বহুমাত্রিক তথ্য ব্যবহার করতে পারে। ছবি, শব্দ, সময়, দূরত্ব ইত্যাদি অনেকগুলো অপেক্ষক মানুষ ব্যবহার করতে পারে। তাই মানুষের বেলায় প্লেইস সেল ও গ্রিড সেলগুলোর ভূমিকা আরো অনেক বেশি জটিল। কিন্তু তারপরেও অনেকগুলো পরীক্ষায় মানুষের হিপোক্যাম্পাসের প্লেইস সেলের পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। লন্ডনের ট্যাক্সি-ড্রাইভারদের মগজের এম-আর-আই স্ক্যান করে দেখা গেছে - যেসব ড্রাইভার দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের পর ট্যাক্সি ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছেন - তাদের হিপোক্যাম্পাসের আয়তন    ও গঠন সাধারণ মানুষের হিপোক্যাম্পাসের আয়তনের তুলনায় বেশ কিছুটা বদলে গেছে। ড্রাইভিং ট্রেনিং শুরুর আগের হিপোক্যাম্পাস আর ট্রেনিং শেষের হিপোক্যাম্পাসে অনেক পার্থক্য দেখা গেছে। কোষের জৈব বিবর্তনের সরাসরি প্রমাণ হিপোক্যাম্পাসের এই পরিবর্তন।

 

চিকিৎসাবিজ্ঞানে ও'কিফ এবং মোজারদের আবিষ্কার ব্যাপক সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। আলজেইমার্‌স, ডিমেনসিয়া সহ আরো অনেক মানসিক রোগের কারণ নির্ণয় ও তাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণায় দ্রুত উন্নতি হবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

 

তথ্যসূত্র

[১] E. C. Tolman, Cognitive maps in rats and men. Psychological Review, 55, 189-208 (1948).

[২] J. O'Keefe,  and J. Dostrovsky, The hippocampus as a spatial map, Preliminary evidence from unit activity in the freely-moving rat. Brain research 31, 573-590 (1971).

[৩] J. O'Keefe, and L. Nadel, The Hippocampus as a cognitive map, Oxford University Press (1978).

[৪] May-Britt Moser and Edvard I Moser, Crystals of the Brain, EMBO Mol Med 3, 69-71 (2011).

[৫] T. Hafting, M. Fyhn, S. Molden, M-B, Moser, E. I. Moser, Nature 436, 801-806 (2005).

[৬] K. Woollett, and E. A. Maguire, Acquiring "the Knowledge" of London's layout drives structural brain changes. Current Biology,, 21 (24), 2109-2114 (2011).

[৭] E. A. Maguire, D. G. Gadian, I. S. Johnsrude, C. D. Good, J. Ashburner, R. S. Frackowiak, and C. D. Frith, Navigation related structural change in the hippocampi of taxi drivers. PNAS, 97 (8), 4398-4403 (2000). 



মাসিক বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত। 

5 comments:

  1. আপনি লিখেছেন ইঁদুরের মগজের এন্টোরাইনাল কর্টেক্স থেকে যে সিগনাল আসছে তা ষড়ভুজের মত প্যাটার্ন তৈরি করছে , এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে এইটা কি ত্রিভুজের মত প্যাটার্ন তৈরি করে নাকি ষড়ভুজের মত? নাকি দুইটাই, কারণ কিছু কিছু জায়গায় এইটাকে ত্রিভুজের মত প্যাটার্ন বলে আখ্যায়িত করেছে

    ReplyDelete
    Replies
    1. দুটোই হতে পারে।

      Delete

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts