Monday, 5 April 2021

বাবা - ১


 


লাইব্রেরি বলতে এখন যা বুঝি, ছোটবেলায় অন্যকিছু বুঝতাম। ক্লাস নাইন পর্যন্ত লাইব্রেরি বলতে বুঝতাম বইয়ের দোকান, যেখানে বই বিক্রি করা হয়। আমার বাবার একটি লাইব্রেরি ছিল, অর্থাৎ বইয়ের দোকান ছিল। আমার জন্মের আগে থেকেই ছিল। মুক্তিযদ্ধের সময় রাজাকাররা সব পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল। আমার বাবা সর্বস্বান্ত হয়েও আবার তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর দোকান, আর দোকানের এক কোণায় ছোট্ট লাইব্রেরি। তাই আমার শৈশব, বেড়ে ওঠার অনেকটুকু জুড়ে ছিল স্কুলের নানা ক্লাসের বই। বই ঘাঁটাঘাটি করতে করতে কীভাবে যেন পড়তে শিখে গিয়েছিলাম। সবকিছু বাদ দিয়ে যে সারাক্ষণ বই পড়তাম – তা নয়, বরং উল্টো। রাজ্যের খেলাধুলা দুষ্টুমি সব করার পর মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে বাবার লাইব্রেরিতে বসতে হতো – সাহায্যকারী হিসেবে।

কৌতূহলের শুরু ওখান থেকেই। তারপর আস্তে আস্তে ওয়ান থেকে নাইন পর্যন্ত সব ক্লাসের বাংলা বইতে যত গল্প ছিল সবগুলি পড়া হয়ে গিয়েছিল একটার পর একটা। যেগুলি ভালো লাগতো বার বার পড়তাম। আর যেগুলি পড়তে ভালো লাগতো না, সেগুলি একবারের বেশি উল্টেও দেখতাম না। আনন্দের জন্য পড়ায় কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। এদিকে হাইস্কুলে উঠার পর আমার বাবা শুরু করলেন নতুন উৎপাত। তখন ইংলিশ র্যাপিড রিডার বোর্ড থেকে প্রকাশিত হতো না। বিভিন্ন প্রকাশক বিভিন্ন ক্লাসের ইংলিশ র্যাপিড রিডারের নমুনা কপি দিতেন আমার বাবাকে। তিনি সেই ইংরেজি গল্পগুলি আমাকে পড়তে বলতেন। নিজে সেই ব্রিটিশ আমলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিলেন। ইংরেজি অক্ষরগুলিও ঠিকমতো চিনতেন না, কিন্তু ইংরেজি বইগুলির কোন্‌টি কোন্‌ ক্লাসের তা কীভাবে যেন চিনতেন। আমি বাধ্য হয়ে বানান করে করে ইংরেজি গল্পের শব্দগুলি পড়তাম। বাবা ইংরেজি বুঝতেন না, ভাবতাম বিরক্ত হয়ে আমাকে মুক্ত করে দেবেন। বাবা আমাকে মুক্তি দিতেন – তবে বিরক্ত হয়ে নয়। দোকানে কোন ক্রেতা এলে তবেই আমার মুক্তিলাভ হতো।
কিছুদিন পর শুরু হলো উৎপাতের দ্বিতীয় পর্যায়। এবার ইংরেজি গল্পগুলি পড়ার সাথে সাথে তার বাংলা অনুবাদও শোনাতে হবে। আমি সবগুলি ইংরেজি শব্দের অর্থ জানতাম না। বাবার তো জানার প্রশ্নই ওঠে না। পড়ার সময় বার বার ডিকশনারি খুঁজতে হলে সারাদিন চলে যাবে, আমার অত সময় নেই। মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলার আকর্ষণ -দি বয়েজ অ্যান্ড দি ফ্রগ্‌স পড়ার চেয়ে বেশি। তাই কোন শব্দের অর্থ ঠিকমতো না জানলে নিজের মতো করে বানাতে শুরু করলাম। তাতে গল্পের হাত-পা ভেঙে গেলেও সেটা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা ছিল না। একদিন পড়ছিলাম – দি বয় এন্ড দি উল্‌ফ। পর্যায়ক্রমে ইংরেজি-বাংলা বাক্যপঠন-বাক্যগঠন চলছিলো। মিথ্যাবাদী রাখালের ‘বাঘ বাঘ” ডাক যখন মিথ্যা বলে ধরে ফেললো সবাই, তখন শেষবার যখন সত্যিকারের বাঘ এলো – তখন কেউই তার কথা বিশ্বাস করলো না। কেউই এগিয়ে এলো না তাকে সাহায্য করার জন্য। বাঘ তাকে খেয়ে ফেললো। গল্প শেষ। আমি বই বন্ধ করে উঠে চলে যাচ্ছি – বাবা বললেন, “ছেলেটার বাবাও ছেলেটার ডাকে এগিয়ে এলো না?”
“কেন আসবে? এর আগে কয়েকবার এসে ফিরে গেছে না? ছেলেটা তো মিথ্যা বলছিল।“
“মিথ্যা বলুক। আগে এতবার আসতে পারলে আর একবার আসতে পারলো না?”
“কেন আসবে? মিথ্যাবাদীকে কে বিশ্বাস করবে?”
“অন্য কেউ না করুক, তার বাবার তো করা উচিত ছিল। আর একবার এগিয়ে এলে তো ছেলেটার জীবন বাঁচতো। সন্তান মিথ্যা বললেও – বাবা কেন তার ডাকে এগিয়ে আসবে না? আরেকবার বিশ্বাস করলে কী এমন ক্ষতি হতো? ছেলেটার জীবন তো বাঁচতো। এ কেমন গল্প লেখে ওরা?”
তখন বুঝিনি আমার বাবার কথা। এখন বুঝি, পৃথিবীর সব বাবাই মনে হয় আমার বাবার মতোই ভাবেন। মা-বাবারা সন্তানের উপর থেকে কখনোই বিশ্বাস হারান না।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৩৭-৪১

  ----------------------------------- রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫ ________________________...

Popular Posts