স্বপ্নলোকের চাবি – ২১
সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস পুরোদমে শুরু হবার পর ক্লাসের বন্ধুবান্ধবদের
সাথে আবার নিয়মিত দেখা হচ্ছে ক্লাসে, ক্যাম্পাসে, ক্যান্টিনে, ট্রেনে। সকাল থেকে দুপুর
পর্যন্ত ক্লাস, তারপর প্র্যাকটিক্যাল – এর মাঝেই আড্ডা জমছে। দীর্ঘ ‘এরশাদ ভ্যাকেশান’-এ
সবার ভেতরেই কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়েছে। শুনলাম এই ছুটিতে শিবিরের কোন কোন নেতা নাকি
বিয়ে-শাদী করে ফেলেছেন। আমাদের ক্লাসেও একজন আছে সেরকম নেতা। ইচ্ছে করছিলো তাকে জিজ্ঞেস
করে খবরের সত্যতা যাচাই করতে। বন্ধুদের কাছে ইচ্ছের কথাটা প্রকাশ করতেই হাফিজ ঠোঁটের
সিগারেট হাতে নিয়ে বললো, “খবরদার, এই কাজটি
করিস না। হুজুরের কাছে কখনোই তার বিবির খবর জানতে চাইবি না। বলার হলে সে নিজেই বলবে।
প্রশ্ন করলে ভাববে ইচ্ছে করে বেয়াদবি করছিস। ধরে পায়ের রগ কেটে দিলে সারাজীবন আতুর
হয়ে থাকতে পারবি।“
তাই তো,
শিবিরের নেতারা বেয়াদবি সহ্য করেন না বলে শুনেছি। এখন তারা কথায় কথায় রেগে গিয়ে রগ
কেটে দেয়। সম্প্রতি আমানত হলের একজনকে ধরে দোতলার বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিয়েছে।
সে অবশ্য বিবির খবর জানতে চায়নি, তবে ফার্স্ট ইয়ারের কোন্ ছেলেকে নাকি মার্ক্সবাদের
উপকারিতা বোঝাচ্ছিল।
ফার্স্ট
ইয়ারের কথা ওঠাতে বুঝতে পারলাম ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে একটা সিনিয়রিটির ভাব চলে এসেছে।
সেকেন্ড ইয়ারে উঠে আমরা যে কিছুটা সিনিয়র হয়ে গিয়েছি সেই ব্যাপারটাতে এখনো অভ্যস্ত
হয়ে উঠিনি। কারণ আমাদের পরের ব্যাচের সাথে আমাদের সেভাবে দেখা হবার সুযোগই হয়নি। এই
ব্যাপারটা নিয়ে খুব আক্ষেপ করছিল হাফিজ।
“দ্যাখ,
এই লম্বা ছুটিটা আমাদের কী সর্বনাশ করেছে। ফার্স্ট ইয়ারের কেউ আমাদেরকে ঠিকমতো চেনারও
সুযোগ পেলো না। পপির সাথে এখনো পরিচয়ই হলো না।“
“পপি কে?”
“ফার্স্ট
ইয়ারের বিউটি কুইন উইথ ফুল অব ব্রেইন”
সাথে সাথে
মিজান, প্রেমাংকর, দেলোয়ার, দুলাল সবাই পপি নামের একজন ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ের প্রশংসায়
পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে পপি রূপে সোফিয়া লরেন, মেধায় আলবার্ট আইনস্টাইন।
কিন্তু তারা সবাই তাকে দেখলো, আমি মিস করলাম
কীভাবে?
আমাদের ফার্স্ট
ইয়ারের সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা এখনো হয়নি, তার আগেই সেকেন্ড ইয়ার সাবসিডিয়ারির ক্লাস শুরু
হয়ে গেছে। ইউনিভার্সিটির ব্যাপার-স্যাপার এরকম জগাখিঁচুড়ি কেন বুঝতে পারছি না। সেকেন্ড
ইয়ারের সাবসিডিয়ারিতে আবার দুইটি করে পেপার। ইউনিভার্সিটি যখন বন্ধ ছিল, তখন মনে হচ্ছিল
ক্লাস কেন হচ্ছে না। এখন সব ক্লাস একসাথে শুরু হবার পর মনে হচ্ছে এত বেশি ক্লাস কেন?
সেকেন্ড
ইয়ারের অনার্সের সিলেবাস দেখে সেটাকে যতটা নিরীহ মনে করেছিলাম, ক্লাস করতে এসে দেখলাম
সেটা ততটাই ভয়ানক। তবে সেটা যতটা না টপিকের কারণে, তার চেয়ে বেশি স্যারদের পড়ানোর ধরনের
কারণে। ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স পড়াচ্ছেন ফরাজি কামালস্যার। স্যার দুর্দান্ত পড়ান। ফার্স্ট
ইয়ারে তাঁর প্রোপার্টিজ অব ম্যাটার খুব ভালোভাবে বুঝেছিলাম। কিন্তু এখন ক্লাসিক্যাল
মেকানিক্স সেভাবে বুঝতে পারছি না। স্যার ফলো করতে বলছেন গোল্ডস্টাইনের বই। বইটা নাকি
ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের ক্লাসিক বই। ক্লাসিক বই ক্লাসিক গানের মতোই দুর্বোধ্য বিরক্তিকর।
স্যার সাধ্যমতো বুঝাচ্ছেন, কিন্তু এত বেশি গাণিতিক সমীকরণ ব্ল্যাকবোর্ড থেকে খাতায়
তুলতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছি। হাত আর মস্তিষ্ক একসাথে কাজ করছে না। এক সমীকরণ থেকে অন্য
সমীকরণ কীভাবে এলো তা বুঝতে চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম স্যার ইতোমধ্যে ব্ল্যাকবোর্ড ভর্তি
করে তা আবার মুছতেও শুরু করেছেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর বিএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর
ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের বই কেন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন তা এখন বুঝতে পারছি।
সেকেন্ড
পেপার ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজম পড়াচ্ছেন রশীদুন্নবীস্যার। স্যারের গায়ের রঙ
ধবধবে ফর্সা। মুখভর্তি লম্বা দাড়ি, মাথায় মৌলানা-টুপি - স্যারকে প্রফেসর কম পীর বেশি
লাগে। স্যারের হাতের লেখা খুব সুন্দর। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা শুরু করেন ব্ল্যাকবোর্ডের
একেবারে উপরের অংশ থেকে। স্যারও সুন্দর করে বোঝান, বোর্ডে কার্শফ ল’এর সার্কিট আঁকেন।
কিন্তু মাথায় খুব একটা ঢুকতে চায় না। সমস্যাটা কোথায় ঠিক বুঝতে পারছি না। ইলেকট্রিসিটির
মতো প্র্যাকটিক্যাল সাবজেক্টকে খুব বায়বীয় মনে হতে থাকে। সমস্যা কী? সমস্যা হলো – এই
তত্ত্বগুলির কোন প্রাত্যহিক ব্যবহারের উদাহরণ আমাদেরকে দেয়া হয় না। যে বইগুলি থেকে
আমাদের পড়ানো হচ্ছে – লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখেছি – সেই বইগুলি সব ১৯৬০-৬৫ সালের সংস্করণ।
এর চেয়ে ভালো বই কি লেখা হয়নি এর মধ্যে? আবার এটাও ঠিক – নিজে বুঝতে পারছি না বলেই
হয়তো স্যারের দোষ খুঁজছি, কিংবা বইয়ের দোষ। যে ক্যাপাসিট্যান্স, এল-আর, সি-আর, এল-সি-আর
সার্কিট নিয়ে কথা হচ্ছে – সেগুলির মূল পদার্থবিজ্ঞান তো একশ বছরের পুরনো।
থার্ড পেপার
রেডিয়েশান অ্যান্ড স্টাটিস্টিক্যাল মেকানিক্স। স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্স পড়াচ্ছেন
বিকিরণস্যার। রেডিয়েশান অংশটা যদি তিনি পড়াতেন তাহলে বলা যেতো – বিকিরণ পড়াচ্ছেন বিকিরণস্যার।
ডক্টর বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া চট্টগ্রাম কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে ছিলেন। আমি যখন
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছি তখনো তিনি সেখানেই ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটিতে এসেছেন।
শুনেছি তাঁর সাথে চট্টগ্রাম কলেজের আরো একজন স্যার ডক্টর তপন চৌধুরীও বিশ্ববিদ্যালয়ে
যোগ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সরকারি কলেজের শিক্ষক হবার কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়
থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। বিকিরণস্যার ছাড়পত্র নিতে পেরেছিলেন, তাই তিনি এখন এখানে। আর
তপনস্যার ছাড়পত্র পাননি – তাই তিনি এখনো কলেজে।
বিকিরণস্যার
নায়ক আলমগীরের মতো লম্বা, সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান। পোশাকের ব্যাপারে খুবই সচেতন আধুনিক।
সুন্দর করে আস্তে আস্তে কথা বলেন। কথা বলার সময় খেয়াল রাখেন যেন এক শব্দের সাথে অন্য
শব্দ লেগে না যায়। আর প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন। এ ব্যাপারে তিনি আমাদের সরাসরি
উপদেশ দিলেন, “ইউ মাস্ট রিড ইংলিশ ম্যাগাজিন্স, লাইক রিডার্স ডাইজেস্ট, নট বাংলা বিচিত্রা।“
আমার মনে হলো বিচিত্রা বলার সময় স্যার আমার দিকে তাকিয়েই বললেন। কিন্তু আমি যে প্রতি
সপ্তাহে বিচিত্রা কিনতে শুরু করেছি তা তো স্যারের জানার কথা নয়। আর ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’
শব্দ দুটো এমনভাবে উচ্চারণ করলেন যে শুনেই মনে হলো সবকিছু হজম হয়ে যাচ্ছে। এখলাস ক্লাসে
থাকলে বেশ খুশি হতো, কারণ সে রিডার্স ডাইজেস্ট পড়ে। কিন্তু এখলাস ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা
ড্রপ দিয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে সে কি পপির সাথে পড়ার জন্যই ড্রপ দিয়েছে?
বিকিরণস্যার
গুপ্ত-কুমারের বই থেকে হুবহু পড়াচ্ছেন স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্স। বোস-আইনস্টাইন
স্ট্যাটিস্টিক্স পড়ানোর সময় আশা করেছিলাম সত্যেন বসু সম্পর্কে অন্তত কিছু বলবেন। কিন্তু
খুবই হতাশ হলাম। আমাদের দেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে যে বিশ্ববিখ্যাত তত্ত্বের
সৃষ্টি হয়েছে, যে বোসন কণার নামকরণ করা হয়েছে সত্যেন বসুর নামে – সেই বিজ্ঞানী সত্যেন
বসু সম্পর্কে আমাদের ক্লাসের শিক্ষকরা কোন কথা বললেন না। তবে কি তাঁদের তেমন কোন আগ্রহ
নেই আমাদের নিজেদের দেশের বিজ্ঞানীদের সম্পর্কেও? অন্যান্য বিষয়েও কোন বিজ্ঞানীর জীবন
ও কর্ম নিয়ে কোন আলোচনা হয় না।
সবচেয়ে বড়
ধাক্কাটা খেলাম রেডিয়েশানের ক্লাস নিতে যখন সিরাজস্যার ক্লাসে এলেন। শুরুতে স্যারকে
দেখে মনে হয়েছিল ভীষণ সিরিয়াস কোন অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর। কিন্তু স্যার যখন কথা
বলতে শুরু করলেন – মনে হলো কিছু একটা গন্ডগোল আছে কোথাও। স্যারের ব্যক্তিত্ব, আচরণ
কোনটাই ঠিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসুলভ নয়। স্যার বোর্ডে কিছু একটা লিখতে শুরু করেছেন
– এর মধ্যেই কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে ক্লাসের মধ্যে। প্রেমাংকর কবি মানুষ। মানুষের মনের
খবর রাখে। সে ফিসফিস করে বলতে শুরু করলো সিরাজস্যারের অতীত ইতিহাস। সে কীভাবে এসব জানে
কে জানে। সিরাজস্যার নাকি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড হয়েছিলেন। তার রেজাল্ট দেখে তার
প্রেমে পড়ে যায় কোন এক রূপবতী ধনবতী ছাত্রী। তারপর রূপকথার গল্পের মতো ‘তাহারা সুখে
শান্তিতে প্রেম করিতে লাগিল’ হবার কথা ছিল। কিন্তু সেরকম হয়নি। প্রেম ভেঙে গেলো। সিরাজস্যারের
মগজের জগত এলোমেলো হয়ে গেল। মাস্টার্স পরীক্ষা ভালো হলো না। এরপর সিরাজস্যার অনেক বছর
হাটহাজারি কলেজে পড়িয়েছিলেন। সম্প্রতি ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছেন। প্রেমাংকরের কথার সত্যমিথ্যা যাচাই করার কোন উপায় নেই। সিরাজস্যার নিজে
যদি না বলেন, তাহলে অন্য কারো পক্ষেই এই তথ্য ভুল কিংবা সত্য প্রমাণ করার উপায় নেই।
কিন্তু যেভাবেই হোক স্যারের মস্তিষ্কের জগত যে দোদোল্যমান তাতে কোন সন্দেহ নেই। অনেক
সময় দেখা যায়, আচরণ এলোমেলো হলেও অনেক চমৎকার পড়ান এরকম অনেকে। সিরাজস্যারের ক্ষেত্রেও
ব্যাপারটা সেরকম হলে ভালো লাগতো। কিন্তু কিছুতেই ব্যাপারটা সেরকম হলো না। আমার মনে
হলো স্যারের পড়ানোর কিংবা বোঝানোর ক্ষমতা নেই। অবশ্য বইয়ের পাতা থেকে লাইনের পর লাইন
বোর্ডে লিখে দেয়ার নাম যদি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ক্লাসে পড়ানোর মাপকাঠি হয়ে থাকে
– তাহলে ভিন্ন কথা।
সেদিন সিরাজস্যার
ক্লাস থেকে বের হবার পর সবাই অভ্যাসমতো দুপাশের বারান্দায় বের হয়ে গেলো। দেখলাম দিলীপ
বর্ধন ক্লাসে ঢুকছে। তাকে এ ক’দিন ক্লাসে দেখিনি। একটু পরে মিজান বাইরে থেকে আমার কাছে
এসে বললো, “প্রদীপ, দোস্ত, তোমার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে।“
“কী দুঃসংবাদ?”
“তুমি আজ
সকাল পর্যন্ত সেকেন্ড ছিলে, এখন থার্ড হয়ে গেছ।“
“মানে কী?”
“মানে সকাল
পর্যন্ত হারুন ফার্স্ট ছিল, তুমি সেকেন্ড ছিলা। এখন দিলীপ ফার্স্ট, হারুন সেকেন্ড,
তুমি থার্ড।“
ফার্স্ট
ইয়ারের রেজাল্টে এ জাতীয় কোন হিসেব প্রকাশ করা হয় না। আমি মার্কশিট নিয়েছি কয়েকদিন
হলো। দুই পেপারে ফার্স্ট ক্লাস মার্কস আছে, কিন্তু থার্মোডায়নামিক্স আর প্র্যাকটিক্যালে
সেকেন্ড ক্লাস মার্কস। গড়ে ফার্স্ট ক্লাস মার্কস আছে। কিন্তু খুব কাছের কয়েকজন বন্ধু
ছাড়া আর কে কত পেয়েছে সেটা নিয়ে কোন আগ্রহ অনুভব করিনি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এ ব্যাপারে
মিজানদের আগ্রহ সীমাহীন।
দিলীপের ব্যাপারে যেটা জানা গেল সেটা আসলেই খুব চমকপ্রদ।
দিলীপ খুবই মেধাবী ছাত্র। কথাবার্তা খুব একটা বলে না। যেটুকু বলে তাতে সিলেটি টান প্রচন্ড।
সে হাঁটেও জোরে, সিগারেটও টানে প্রচন্ড বেগে। রেজাল্ট বের হবার পর দেখা গেলো সে পাস
করেনি। এতে স্বাভাবিকভাবেই খুব হতাশ হয়েছিল সে। মার্কশিট আসার আগে বোঝার উপায় নেই কী
হয়েছে। রঞ্জুও ফেল করেছে। মার্কশিট আসার পর দেখা গেছে রঞ্জু ফেল করেছে মৌখিক পরীক্ষায়।
মাত্র দশ নম্বরের একটি অংশে পাসমার্ক দেয়া হয়নি তাকে। অন্য সব বিষয়ে সে পাস করেছে। এখন তাকে পুরো ফার্স্ট
ইয়ারের সবগুলি সাবজেক্টের আবার পরীক্ষা দিয়ে পাস করে সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে হবে। দিলীপ
দেখলো তার মার্কশিটে প্র্যাকটিক্যালের কোন নম্বর বসানো হয়নি। মার্কশিট নিয়ে ছুটে গেছে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান আদম শফিউল্লাহস্যারের
কাছে। আদম শফিউল্লাহস্যার রাফ অ্যান্ড টাফ, কিন্তু খুবই নীতিবান স্যার। তিনি টেবুলেশান
শিট খুলে দেখলেন দিলীপ প্র্যাকটিক্যালে অনেক মার্কস পেয়েছে। আরও দেখলেন সব বিষয়ে সে
অত্যন্ত চমৎকার নম্বর পেয়েছে। বিশেষ করে আদম শফিউল্লাহস্যার আমাদের যে পেপারে দুটো
ক্লাস নিয়েছিলেন সেই প্রোপার্টিজ অব ম্যাটারে হাইয়েস্ট মার্কস পেয়েছে দিলীপ। এত ভালো
করার পরেও দাপ্তরিক ভুলের কারণে দিলীপের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার নম্বর যোগ হয়নি। ফলে
তাকে প্র্যাকটিক্যালে ফেল ধরে নিয়ে ফার্স্ট ইয়ারে ফেল দেখানো হয়েছে। এতে দিলীপের যে
কষ্ট এবং অপমান হয়েছে তা পুষিয়ে দেয়ার জন্য পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে স্যার
তার প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার নম্বরের সাথে আরো দশ নম্বর যোগ করে দিয়েছেন। দিলীপের ফার্স্ট
ইয়ারের নম্বর এখন ক্লাসের সবার চেয়ে বেশি।
দিলীপকে
দেখে বোঝার উপায় নেই তাকে এই ক’দিন কী টেনশানে কাটাতে হয়েছে। সে গম্ভীর স্বভাবের মানুষ,
কোন অভিব্যক্তিই তার চেহারায় ফুটে উঠে না। কিন্তু হারুনের চেহারায় একটা বিষাদমিশ্রিত
ক্রোধের ছায়া দেখা যাচ্ছে।
বেশ কয়েকজন
বন্ধু ড্রপ দিয়েছে ফার্স্ট ইয়ারে। মেয়েদের মধ্যে ইলোরাকে দেখা যাচ্ছে না ক্লাসে। সম্ভবত
সেও ড্রপ করেছে। কিছুদিন পর সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা হয়ে গেলে সেখান থেকেও কেউ কেউ আমাদের
সাথে যোগ দেবে। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় যারা ড্রপ দেয়, তারা দেখা যায় ড্রপ দিয়েই পরের
বারের জন্য খুব উঠেপড়ে লাগে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় – অনেক আগে থেকে লাফালাফি
করার কারণে শেষের দিকে আর দম থাকে না। উঠেপড়ে লাগার প্রাথমিক পদক্ষেপ হলো তার বন্ধুদের
কাছ থেকে নোট সংগ্রহ করা। তার প্রমাণ পেলাম রুমে এসে। আমি প্র্যাকটিক্যাল শেষ করে পাঁচটার
ট্রেনে ফতেয়াবাদ স্টেশনে নেমে হেঁটে হেঁটে বিল্ডিং-এ এসে দেখি একজন বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে
বিল্ডিং-এর সামনের রাস্তায়।
“কী রে, তুই এখানে?”
“তোর কাছে এলাম।“
রুমে আসার পর তার প্রথম বাক্যটিই হলো, “তোর সবগুলি নোট আমাকে
দিয়ে দে।“
ইউনিভার্সিটিতে এই নোটের ব্যাপারটা অদ্ভুত। শুনেছি কারো কারো নোট নাকি বছরের পর বছর হলগুলিতে ঘুরতে থাকে। আমি নোট করেছি আমার নিজের জন্য। খুব সোজা করে না লিখতে পারলে আমি কিছু বুঝতে পারি না। আমি নিজে না বুঝলে তা লিখতে পারি না। ফলে বেশ কিছু বইপত্র ঘাঁটতে হয়। আমার নোটের কোন চাহিদা কারো কাছে থাকবে এটা আমি আশা করিনি। কিন্তু এই বন্ধুটি হলে তার আরো পঞ্চাশ জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকতে আমার কাছে কেন এলো? এলোই যদি এতদিন আসেনি কেন? পরীক্ষা শেষ হয়েছে চার মাস আগে। এটা কি তবে মিজানদের হিসেবের প্রতিক্রিয়া? তবে কি গায়ে তথাকথিত ভালোছাত্রের তকমা লেগে যাচ্ছে? এই ভালোছাত্রের ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে। পরীক্ষার রেজাল্টের ভিত্তিতে এই অদৃশ্য সিলমোহর লাগানো হয়। কিন্তু তা সজ্ঞানে গায়ে লাগতে দিলে তা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, একটা অপ্রয়োজনীয় মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে যেতে হয়। আমি এই মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে চাই। বন্ধু সব নোট নিয়ে চলে গেল।
ক্লাস চলছে পুরোদমে। ক্লাসে বেশ কিছু নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। মেয়েদের সংখ্যা আরো বেড়ে গেছে। তিনজন নতুন মেয়ে এসেছে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ট্রান্সফার নিয়ে। তাদের সাথে আমার এখনো কথা বলার সুযোগ হয়নি। তবে তাদের নাম জেনেছি – সুপর্ণা লিপি, রোখসানা লিপি, আর রেহানা। হাফিজ, স্বপন, মামুন, ইকবাল ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে, ক্লাসের বাইরে যথারীতি ঘিরে রাখছে তাদের। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস শুরু হবার আগে হাফিজ, প্রদীপ নাথ, দিলীপ, স্বপন, ইকবাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে একসাথে সিগারেট টানে। এটা অনেকটা রুটিন হয়ে গেছে। আজ দেখলাম সুপর্ণা লিপিও তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। সে অবশ্য সিগারেট টানছে না, কিন্তু সিগারেট টানার সমর্থনে কথা বলছে – “একটা দুটো সিগারেট না টানলে ছেলেদের ঠিক ম্যানলি লাগে না।“
এ কথা শুনে স্বপন তো পারলে খুশিতে ডিগবাজি খায়। সে আমার উদ্দেশ্যে
বললো, “অ্যাই প্রদীপ, শুনলি তো, এখনো সময় আছে – টানতে শিখ।“
“প্রদীপ, তোর সাথে লিপির পরিচয় হয়নি?” – হাফিজ দুই আঙুলে
সিগারেট রেখে মুখ থেকে ধুম্রচক্র নির্মগন করতে করতে বললো।
আমি কিছু বলার আগেই সুপর্ণা লিপি গম্ভীরভাবে বললো, “না, সে
আমার সাথে কেন কথা বলবে? ভালো ছাত্রের একটা অহংকার আছে না?”
‘ভালো ছাত্র’ এবং ‘অহংকার’ দুটোই আমার কাছে গালির মতো লাগে।
মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। এখন কথা বললে প্রথম
আলাপেই ঝগড়া লেগে যাবার সম্ভাবনা আছে। ক্লাসে ঢুকে গেলাম।
প্র্যাকটিক্যাল শেষ হবার পর পাঁচটার ট্রেনে পৌঁছে দেখি একটা
কম্পার্টমেন্টে আমাদের ক্লাসের অনেকেই উঠে বসেছে। হাফিজও দেখলাম শহরে যাচ্ছে। ফারুক,
মামুন, স্বপন, ইকবাল, শাকিল, কবীর, গিয়াস, মিজান সবাই দলবেঁধে এক কম্পার্টমেন্টে। দেখলাম
সুপর্ণা লিপিও বসে আছে তাদের সাথে। তাদের কাছে যেতেই সুপর্ণার সাথে চোখাচোখি হলো। বললাম,
“তোমার সাথে কথা আছে আমার।“
সে সিট থেকে উঠে এলো।
“বলো”
“তুমি আমাকে অহংকারী বললে কেন?”
“তুমি কারো সাথে কথা বলো না, তাই।“
“আমি কারো সাথে কথা বলি না, কে বললো তোমাকে?”
“ক্লাসের মেয়েরা বলেছে। তুমি পুরো ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের ক্লাসের
কোন মেয়ের সাথে কথা বলেছো?”
“অবশ্যই বলেছি। আর না বললেও কী প্রমাণিত হয়? আমি অহংকারী?”
“তুমি অহংকারী নও?”
“না।“
“প্রমাণ দিতে হবে।“
“কীভাবে?”
“আমার সাথে সহজভাবে কথা বলতে হবে।“
“আমি কি এখন কঠিনভাবে কথা বলছি?”
“হ্যাঁ বলছিস তো।“ – আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হেসে ফেললো সে।
No comments:
Post a Comment