স্বপ্নলোকের চাবি – ২২
এই সেদিন পর্যন্তও কবিতার সাথে আমার তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। নিতান্ত বাধ্য না হলে আমি তার ধারে কাছে যেতাম না। স্কুল-কলেজের সিলেবাসে যে কয়টা কবিতা ছিল তার বাইরে অন্য কোন কবিতা পড়ার প্রতি কোন উৎসাহ পাইনি তখন। স্কুলের ক্লাসে কবিতা মুখস্থ করতে হতো বলে খুব বিরক্ত লাগতো। কলেজে পড়ার সময় আ-ফ-ম সিরাজদৌলাস্যার আধুনিক-কবিতা রচনার আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে যেসব কথা বলেছিলেন তাতে মনে হয়েছিল আধুনিক-কবিতা রচনার মতো সহজ কাজ আর নেই। সিরাজস্যার বলতেন, “এক পাতা গদ্য লিখে তাকে কোণাকুনি কেটে দুই টুকরা করে ফেললে দুইটা অত্যাধুনিক কবিতা হয়ে যাবে। কবিতায় যত বেশি দুর্বোধ্যতা, তত বেশি আধুনিকতা।“ কয়েকটা ছোটখাট উদাহরণও দিতেন। যেমন –
“জ্বর হয়েছে, সা
গু খেয়েছি।
চিঠি তোমার স
কালে পেয়েছি।।“
“উপরে আসমান নিচে মাটি
আমার গাল, তোমার চটি।“
“অস্তবেলার সূর্য টুকটুকে লাল,
যেন এক আস্ত মসুরের ডাল।“
সিরাজস্যার নিজেও যে একজন আধুনিক কবি তা সেই সময় জানতাম না।
যে বয়সে আমরা সিরাজস্যারের এই বয়ান শুনেছি ক্লাসে বসে, সেই বয়সেই সুকান্ত ভট্টাচার্য
রচনা করে ফেলেছেন কত কালজয়ী কবিতা। কবিতার আশ্চর্য শক্তি সম্পর্কে জানতে শুরু করেছি
মাত্র কিছুদিন আগে। শিল্পকলা একাডেমিতে কলকাতার আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষের আবৃত্তি শুনে
কবিতার এক নতুন রূপ দেখতে পেলাম। পাঠগুণে কবিতার শক্তি বাড়ে। এরশাদ বাংলাদেশের ‘সিংহাসন’
দখল করার পর রাতারাতি কবি হয়ে গেছেন। দেশের অনেক বিখ্যাত কবিও এরশাদের ‘রাজকবি’ হবার
জন্য এরশাদের দরবারে নিয়মিত কবিতা পাঠ করছেন। কিন্তু তার বিপরীতে জেগে উঠেছে সারাদেশের
প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সমাজ। যে কবিরা কবিতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাঁরা এখন স্বৈরাচারের
বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। ফেব্রুয়ারির ২৫-২৬ তারিখে মুসলিম হলে বসেছিল প্রতিবাদী কবিতার
আসর। সেই দুদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বুঁদ হয়ে ছিলাম সেই অনুষ্ঠানে। মুহাম্মদ নুরুল
হুদা, মহাদেব সাহা, জিয়া হায়দার, মুহাম্মদ রফিক, ইব্রাহিম আজাদ, হেলাল হাফিজ, অজয় দাশগুপ্ত,
বিশ্বজিৎ চৌধুরি, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হকের মতো কবিদের কন্ঠে সরাসরি তাঁদের
নিজেদের কবিতা। তার পাশাপাশি কেয়া চৌধুরি, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রমুখ বাংলাদেশের বিখ্যাত আবৃত্তিকাররা কবিতাকে নিয়ে গেছেন একটি অন্য মাত্রায়। কবিতা
শুনে মনে হয়েছে প্রচন্ড ক্ষমতাশালী সামরিক বাহিনীর ট্যাংকের সামনে দাঁড়ানোর সাহস আর
কারো না থাকলেও কবিতার থাকে। এই ল্যাফটেন্যান্ট জেনারেলের চোখে চোখ রেখে একজন নিরস্ত্র
শামসুর রাহমান লিখে ফেলতে পারেন,
“কিন্তু হে লৌহমানব
আপনি খেয়ালখুশির খেয়া ভাসালেই
নিষিদ্ধ ঘোষিত হবে না সূর্যোদয় কিংবা পূর্ণিমা,
প্রেমিক-প্রেমিকার চুম্বন।
আপনি প্রাণভরে গার্ড অব অনার নিতে পারেন আর
একজন কবিকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন
ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে,
বহ্ন্যুৎসব করতে পারেন তার গ্রন্থরাজি দিয়ে,
পারেন আপনি পারেন;
তবু তার কবিতাবলি বন্দুকের ধমককে
উপেক্ষা করে ঈগলের মতো উড়তে থাকবে,
উড়তে থাকবে, উড়তে থাকবে।“
মানুষের ভেতরের শুভবোধকে জাগিয়ে তোলার জন্য অবাধ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। নাটক, সংগীত, নৃত্য, কবিতা, ইত্যাদি শিল্পকলার যত মাধ্যম আছে সবগুলিরই ভূমিকা আছে একটি দেশের সাধারণ মানুষের মনন তৈরিতে। এসব বন্ধ করে দিলেই মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ মুখ থুবড়ে পড়বে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিবিরের রাজত্ব চলছে। এখানে যা কিছু বাঙালির সংস্কৃতি – তার সবই একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে কোন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চোখে পড়েনি ক্যাম্পাসে। সরাসরি কোন নিষেধাজ্ঞা কেউ জারি করেনি, তবে শুনেছি কেউ কিছু আয়োজন করার পরিকল্পনা করলেই শিবিরের গোয়েন্দা বিভাগ খবর পেয়ে যায়। আর আয়োজনকারীর কাছে শিবিরের ‘হুমকিবার্তা’ পৌঁছে যায়। প্রাণের মায়া তো সবারই আছে। সারাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমাদের ক্যাম্পাস যেন বাংলাদেশের বাইরে – পাকিস্তানের কোন এলাকা। এতগুলি হলের কোথাও কোন সাংস্কৃতিক কাজকর্ম নেই।
সারাদেশে এত আন্দোলনের মধ্যেও এরশাদের আগ্রাসী কাজকর্ম থেমে নেই। মার্চের তিন তারিখ জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়ে গেল। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কিংবা জামায়াত – কেউই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এরশাদের দল জাতীয় পার্টি তিন শ সিটের মধ্যে ২৫১ সিটে জয় লাভ করেছে, যার মধ্যে ১৮টি সিটে কোন প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। বিরোধী দলীয় নেতা হয়েছেন আ-স-ম আবদুর রব। রাজনীতির কী বিচিত্র খেলা। মওদুদ আহমেদ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও আন্দোলন হচ্ছে আর পুলিশের গুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছে। এত কিছু ঘটছে- অথচ তার প্রতিবাদে আমাদের ক্যাম্পাসে কিছুই হচ্ছে না। দেশের কোথাও যদি জামায়াতে ইসলামী বা শিবিরের বিরুদ্ধে কিছু ঘটে তখনই শিবির আমাদের ক্যাম্পাসে অবরোধ ডাকে, মিছিল মিটিং করে, ক্লাস বন্ধ করে দেয়। কিন্তু অন্য কোন পার্টি যদি অবরোধ ডাকে, ক্যাম্পাসে শিবিরের ছেলেরা স্যারদের ডেকে নিয়ে এসে ক্লাস করায়। ক’দিন আগে ঐক্য পরিষদের ডাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবরোধ হবার কথা ছিল। আমরা যাইনি সেদিন। কিন্তু পরদিন শুনলাম রশীদুন্নবী স্যারের ক্লাস হয়েছে।
আমার ব্যক্তিগত পাঠ্যসূচিতে কবিতার বই ঢুকে পড়তে শুরু করেছে। শহরে গেলেই নিউমার্কেটের দোতলায় ‘বইঘর’-এ ঢুকে পড়ি। সারি সারি কাচের বুকশেল্ফ-এ সাজানো কত্তো কবিতার বই। শামসুর রাহমানের অনেক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এই বইঘর থেকে। বইঘরে ভীড় দেখিনি কখনোই। আশেপাশের অন্যান্য মনোহারি বিপনির দাপটের কাছে এই গ্রন্থবিপনি কতদিন টিকে থাকতে পারবে জানি না।
অনেকগুলি লিটল ম্যাগাজিন বের হয় উঠতি লেখকদের উদ্যোগে। বেশিরভাগই একটি দুটি সংখ্যার বেশি বের করতে পারে না। এই ম্যাগাজিনগুলি পাওয়া যায় জলসা সিনেমার পাশে কারেন্ট বুক সেন্টারে। সেখানেও নিয়মিত যাই। গ্রুপ থিয়েটারের নিয়মিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘থিয়েটার’-এর নতুন সংখ্যা বের হলেই কিনে ফেলি। খুব দামি সাদা কাগজে ছাপানো হয় এই পত্রিকা। প্রতিটি সংখ্যাতেই এক বা একাধিক নাটক থাকে। আবদুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ শামসুল হক-এর নাটক মঞ্চস্থ করে ঢাকার থিয়েটার গ্রুপ। চট্টগ্রামে বছরে এক দু’বার মাত্র শো করতে আসে ঢাকার দলগুলি। আমি অপেক্ষা করতে থাকি – কখন তারা আসবে।
কবিতার ক্যাসেট বের হচ্ছে অনেক। নিউমার্কেটের চার তলায় বিভিন্ন দোকানের শোকেসে দেখা যায় কাজী সব্যসাচী, কামরুল হাসান মঞ্জু, পার্থ ঘোষ – গৌরী ঘোষ, ইকবাল বাহার চৌধুরি – এরকম অনেকের কবিতার ক্যাসেট। একটা ক্যাসেট প্লেয়ার কেনার জন্য টাকা জমাতে থাকি। ইলেকট্রনিক্সের ব্যাপারে প্রদীপ নাথের অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। তাদের বাড়িতে সব ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি আছে। সবই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। তাদের গ্রামটাকে মধ্যপ্রাচ্যের গ্রাম বলা চলে। নাথকে নিয়ে একদিন গেলাম নিউমার্কেটে। নিউমার্কেটের চার তলার পুরোটাই ইলেকট্রনিক্সের মার্কেট। তার পরিচিত এক দোকানে গেলাম। আমার প্ল্যান হলো একটা ক্যাসেট প্লেয়ার কেনা। রেডিওর দরকার নেই। কারণ রেডিও সাথে থাকলে তার জন্য লাইসেন্স করাতে হয়। প্রতি বছর সেই লাইসেন্স রিনিউ করতে হয়। এক ব্যান্ডের একটা রেডিও আমার আছে। আরেকটার দরকার নেই। এখন সবচেয়ে কম দামের একটা ক্যাসেট প্লেয়ার হলেই চলে। নাথ আমার হয়ে দোকানদারের সাথে কথাবার্তা বলছে। তাদের কথোপথন থেকে অনেক নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে। বাজারে নাকি দু’নম্বরী ইলেকট্রনিক্সে সয়লাব হয়ে গেছে। লেখা আছে ‘মেইড ইন জাপান’, আসলে মেইড ইন জিঞ্জিরা।
দোকানদার আমার জন্য একটা ‘এক-নম্বরী’ জিনিস বের করলেন। একদাম বারো শ টাকা। আমার পকেটে বাসভাড়া বাদ দিয়ে আছে মাত্র আট শ টাকা। নাথের কাছে আছে মাত্র পঞ্চাশ টাকা। বারো শ টাকা আমার দুই মাসের বাজেট। চার মাস টিউশনি করলে আমি বারো শ টাকা পাই। এতদূর এসে না কিনে চলে যাবো? কিন্তু আরো চার শ’ টাকা কোত্থেকে পাবো? দিদির বাসায় গিয়ে টাকা ধার চাইলে পাবো – কিন্তু উপযুক্ত কারণ দর্শাতে হবে। বই কিনতে হবে বললে সে টাকা দেবে, কিন্তু ক্যাসেট প্লেয়ার কেনার জন্য টাকা সে দেবে না। কিছুদিন পরে কিনতে হবে। কিন্তু দোকানদার সেটা শুনে বললেন, “এই জিনিস কয়েকঘন্টার মধ্যেই চলে যাবে। এই একটাই আছে।“ – এই একটাই কেন এতক্ষণ রয়ে গেছে জানি না, কিন্তু আমার মনে হলো আজকেই এই ‘ক্যাসেট প্লেয়ার কেনা প্রকল্প’ শেষ করে ফেলা দরকার।
রিকশা নিয়ে দ্রুত চট্টগ্রাম কলেজের রেড বিল্ডিং হোস্টেলে
এলাম। জানতাম অজিতকে রুমেই পাওয়া যাবে। তার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে কিছুদিনের
মধ্যে। দেখলাম সে তার সিটের চারপাশে পর্দা দিয়ে ঢেকে ফেলেছে। মনে হচ্ছে তাবুবাসী হয়ে
গেছে পরীক্ষা উপলক্ষে। ধানাইপানাই না করে সরাসরি বললাম, “আমাকে চার শটা টাকা দে।“ সে
নিঃশব্দে টেবিলে লাগানো বুকশেলফের বইয়ের ভেতর থেকে একটা মোটা বই টেনে নিয়ে তার ভেতর
থেকে একতাড়া এক শ টাকার নোট বের করে বললো, “চার শ টাকায় হবে?”
“হ্যাঁ হবে।“
অজিতকে আমার আশ্চর্য লাগে। কী কারণে টাকা লাগবে একবারও জিজ্ঞেস করলো না। তার নিজের কাছে টাকা না থাকলে অন্যের কাছ থেকে ধার নিয়ে হলেও টাকা দেবে। কিন্তু জিজ্ঞেস করবে না কেন লাগবে। হোস্টেলে আমার আরো অনেক বন্ধু আছে। সবার সাথে দেখা করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। নাথকে নিয়ে আবার নিউমার্কেটে গেলাম। ক্যাসেট প্লেয়ারটি কিনলাম। আমার প্রথম ক্যাসেট-প্লেয়ার। এবার একটা আবৃত্তির ক্যাসেট। নিউমার্কেটে কাজী সব্যসাচীর একটা ক্যাসেট এক শ টাকা দাম। নাথ বললো, “তোকে আমি আরো ভালো দোকান দেখাচ্ছি, অনেক কম দামে পাবি।“ মিউনিসিপ্যালটি স্কুলের পাশ দিয়ে হকার্স মার্কেটে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে বের হয়ে এলাম খুরশিদ মহল সিনেমার সামনে। এখানে হকার্স মার্কেটের এদিকের রাস্তার মুখে বেশ বড় ক্যাসেটের দোকান ‘ঝংকার’। কাজী সব্যসাচীর দাম এখানে মাত্র ত্রিশ টাকা।
তারপর থেকে রুমে অনবরত কবিতা চলছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলি ক্যাসেট কিনে ফেলেছি। যতক্ষণ রুমে আমি থাকি এবং কারেন্ট থাকে, ক্যাসেট চলতে থাকে। শুনতে শুনতে অনেক কবিতার অনেকটুকু মুখস্থও হয়ে গেছে। ইদানীং কবিতাচর্চায় একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে – নাথ যার নাম দিয়েছে কাব্যচর্চা। এই কাব্যচর্চার স্বরূপ হলো ছন্দ মিলিয়ে কথা বলা। আগে ক্যাম্পাসে-ক্লাসে মৃণালের রুমের আড্ডায় এরকম কাব্যচর্চা চলতো। এখন নাথ আমার রুমে ওঠার পর এই কাব্যচর্চা আরো বেগবান হয়েছে।
প্রদীপ নাথ বাড়ি ছেড়ে আগে কোথাও এভাবে থাকেনি। সেই অতদূর
মাদার্শা থেকে সাইকেল চালিয়ে সে প্রতিদিন এসে বাস বা ট্রেন ধরে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস
করে আবার বাড়ি ফিরে যায়। এভাবে সে ইউনিভার্সিটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়েছে দুই বছর।
এতদিন পরে তার মনে হলো কিছুদিন বাড়ির বাইরে থেকে দেখার – কেমন লাগে। আমার রুমে এসেছে
মাত্র দু’দিন হলো। এই দু’দিন কেটে গেছে নতুন কিছু করার উৎসাহে। যেমন, পুর্নোদ্যমে রান্না
শুরু করেছি রুমে। চৌধুরি হাট থেকে বাজার করে নিয়ে এসেছি। ডেকসিতে করে চাল ধোয়ার ব্যাপারে
তার উৎসাহ ছোট্ট বাচ্চাদের মতো। কারণ জীবনের প্রথম নিজের হাতে চাল ধোয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে
তার। এখন রান্না বসিয়েছি স্টোভে। তরকারি দেখে সে মন্তব্য করলো,
“দিতে হবে আরেকটু পানি”
আমি বললাম, “জানি, আমি জানি”
সে চুপ করে ভাবতে লাগলো জানি’র সাথে কী মেলানো যায়। আমি বললাম,
“আজকের রান্না”
সে একটুও না হেসে গম্ভীরভাবে বললো, “খেলে আসবে কান্না।“
আমাদের সাবসিডিয়ারি পরীক্ষার ডেট দিয়েছে। নাথ গণিতে খুব দক্ষ। কাব্যচর্চা করতে করতেও আমাদের প্রয়োজনীয় অনেক গণিতচর্চা হয়ে যায়। অনেক রাত পর্যন্ত আমাদের হাহাহিহি চলতে থাকে। কিন্তু তিন রাত যেতেই নাথের গৃহকাতরতা প্রবল হতে শুরু করলো। পাঁচ দিন ঘরের বাইরে থাকার পর তাকে দেখে মনে হলো কারাবন্দী কয়েদিদের মতো। পদ্যে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে গদ্যে উত্তর দিচ্ছে। মনে হচ্ছে তার জীবনের ছন্দ হারিয়ে গেছে। বললাম, ‘একবার বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আয়। তোর তো কোন সমস্যা নেই এখানে, দিব্যি মনের আনন্দে আছিস। কিন্তু তোকে ছাড়া বাড়ির সবাই তো এভাবে থাকেনি কোনদিন। একবার দেখা দিয়ে আয়।“ পরের দিনই সে বাড়ি চলে গেল দেখা দেবার জন্য। আমি ভেবেছিলাম সে একেবারেই চলে গেল। কিন্তু না, পরদিন ফিরে এলো। সেই রাত থাকলো। পরের দিন দেখলাম সে জামাকাপড় গোছাচ্ছে। বুঝতে পারলাম, ‘কাঁদিতেছে তার গৃহগত প্রাণ’। ঘরের বাইরে তার এক সপ্তাহও থাকা হলো না। আবার তার সেই প্রতিদিনের দশ কিলোমিটার যাতায়াত শুরু হলো।
আমাদের আগের ব্যাচের সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে।
আমাদের ক্লাসে তার কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো। যারা ড্রপ করেছে তারা আমাদের সাথে যোগ
দিলো। ক্লাসে এলো মানস চক্রবর্তী, আশিস দাশগুপ্ত, ডল আপা, ঝর্ণা আপা, রানু আপা, এবং
চিত্রলেখা চৌধুরি। ঝর্ণা আপার সাথে স্টাটিসটিক্সের ম্যাক স্যারের প্রেমপর্ব চলছে সেটা
আমরা জানি। ভবিষ্যতে স্যারের বউ হবেন সে কারণে একটা সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখি তার
সাথে। ডল আপা আর রানু আপা নিয়মিত ক্লাস করছেন। মানস চক্রবর্তী আর আশিস দাশগুপ্তকে মানসদা,
আশিসদা বলে ডাকছি – তারা বেশ হাসিমুখেই সায় দিচ্ছে। যীশু অবশ্য তাদেরকে ‘মানইস্যা’,
‘আশিস্যা’ বলছে নির্দ্বিধায়। কিন্তু চিত্রলেখার ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। সে একদিন
ক্লাসে এলো। মনে হলো তাকে অনেকেই চেনে। কী কারণে চেনে জানি না। করিডোরের যেখানে নোটিশ
বোর্ড আছে সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা যথারীতি আড্ডা মারছি – চিত্রলেখা এসে আমাকে বললো, “শোন,
তোমার সাথে কথা আছে।“
“আমার সাথে?”
“তোমার নাম প্রদীপ্ত?”
“আমার নাম প্রদীপ্ত নয়, প্রদীপ।“
“প্রদীপ্ত বলিনি, প্রদীপ তো - বলেছি।“
“ওর নামও প্রদীপ।“ – নাথকে দেখিয়ে বললাম।
“তুমি সুমনের বন্ধু না? চিটাগং কলেজের ইকোনমিক্সের সুমন?”
“হ্যাঁ”
“তুমি তো সব ক্লাস কর। তোমার ক্লাসনোটগুলি কি আমাকে একটু
দেবে? আমি তো ক্লাস করিনি একটাও। আমার নাম চিত্রলেখা চৌধুরি। হয়তো চেনো আমাকে।“
চিত্রলেখা চৌধুরির গলাটা বেশ জোরালো। উচ্চারণে রাবীন্দ্রিক
শুদ্ধতা। চিনলাম। ইনিই চট্টগ্রাম বেতারের রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী চিত্রলেখা চৌধুরি। সুমন
বলেছিল তার কথা। তার ছোটভাই সুমনের ফ্রেন্ড। তাকে কি আমার দিদি বলা উচিত? না, দিদি
বললে পেয়ে বসবে। বাংলার দিদিরা ছোটভাইদেরকে কাজের অর্ডার দিতে একটুও দেরি করে না।
“ও সব ক্লাস করেছে। সব ক্লাসনোট তার সাথেই আছে। আপনি এখনি
নিয়ে নেন।“ – নাথ মহাউৎসাহে আমার খাতা ধরে টানাটানি শুরু করলো। আমি তার দিকে চোখ কটমট
করে তাকানোর পরেও কোন কাজ হলো না।
“না, না, খাতা দিতে হবে না। তুমি খাতাগুলি সব ফটোকপি করে
কালকে নিয়ে এসো আমার জন্য। ঠিক আছে?” – বলে রাজকীয় ভঙ্গিতে করিডোর ধরে হেঁটে চলে গেলেন।
আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না এভাবে কাউকে অর্ডার দেয়া যায়।
No comments:
Post a Comment