স্বপ্নলোকের চাবি – ১৯
আজাদীর প্রথম পৃষ্ঠার মাঝখানে দুই কলাম জুড়ে ছাপানো হয়েছে
নুর হোসেনের ছবি। উশকোখুসকো ঝাঁকড়া চুল, হাড় বের হওয়া অপ্রশস্ত পিঠ। সেখানে মোটা তুলিতে
সাদা হরফে লেখা “গণতন্ত্র মুক্তি পাক”। স্বৈরাচার হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য
রাজপথ কাঁপিয়ে মিছিল করেছেন তিনি গতকাল। সেই মিছিলেই তাকে গুলি করে মেরেছে স্বৈরাচারী
এরশাদের দাঙ্গাপুলিশ। তাকে নিশানা করে গুলি চালিয়েছে তারা। তার বুকে-পিঠে এই স্লোগান
লেখা না থাকলে কি তিনি বেঁচে যেতেন? যুবলীগের একটি ওয়ার্ডের প্রচার সম্পাদক ছিলেন নুর
হোসেন। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়স হয়েছিল তার। আমার চেয়ে মাত্র ছয় বছরের বড়। নিজেকে কেমন
যেন অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছে। সারাদেশে নুর হোসেনের মতো অসংখ্য তরুণ-তরুণী সংগ্রাম
করছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। আর আমি সেইসব সংগ্রাম থেকে নিরাপদ দূরত্বে চায়ের দোকানে
বসে মুকিতভাইয়ের সাথে সিঙাড়া খেতে খেতে সেই খবর পড়ছি।
ঢাকা অবরোধে
অংশ নেয়ার জন্য সারাদেশ থেকে অনেকেই ঢাকায় গিয়েছে। আমি যাইনি কেন? বাবা মানা করেছেন
– তাই? রাজপথের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার জন্য কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন আমার বাবা সেই
কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে। এর পেছনে সঙ্গত কারণ ছিল। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বন্দুকের
নলের সাহায্যে ক্ষমতা দখল করার পর থেকে এরশাদ বাংলাদেশকে একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক দেশে
পরিণত করার সব রকমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই বছরই সামরিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী
মজিদ খান নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব করেন – যেখানে প্রথম শ্রেণি থেকেই আরবি শিক্ষা
বাধ্যতামূলক এবং দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি বাধ্যতামূলক করে পুরো শিক্ষাব্যবস্থায়
উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিভেদ তৈরির সব উপাদান আছে। সারাদেশের প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলি
এই শিক্ষানীতির প্রতিবাদ জানায়। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে
স্মারকলিপি দেয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে মিছিল করে ছাত্রছাত্রীরা
যখন সচিবালয়ের দিকে যাচ্ছিলো তখন সেই মিছিলে সরাসরি গুলি চালায় এরশাদের পুলিশবাহিনী।
চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেলে আমরা সেই রাতেই খবর পেয়েছিলাম ঢাকায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জন ছাত্রছাত্রীকে
গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। আমাদের শেরে বাংলা বি ব্লকের সিনিয়র ছাত্রনেতারা – ছাত্র
ইউনিয়নের মিলটনদা, ছাত্রলীগের স্বপনদা, মিলনদা মিটিং ডেকে আমাদের জানালেন পরের দিন
প্রতিবাদ মিছিল বের হবে। পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি শেরেবাংলা মেইন ব্লক এবং সোহরাওয়ার্দী হোস্টেলের প্রায় সব ছাত্রই নেমে এলাম হোস্টেলের
পাশের সিরাজদৌল্লা রোডে। এর মাত্র কয়েক মাস আগে আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি। প্রথম মিছিলে
যাবার এক তীব্র উন্মাদনায় ছটফট করছি। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদ করতে হবে। ঢাকায় যাদেরকে
গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে তারা তো আমারই অগ্রজ। আমার ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম
করতে গিয়ে তাঁরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। এরকম অনেক ভাবনা তখন মন জুড়ে। সিরাজদৌল্লা
রোড ধরে কয়েক শ ছাত্রের মিছিল চলেছে শহীদ মিনারের দিকে। স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক
শাসনের বিরুদ্ধে স্লোগানে গলা মিলাচ্ছি তীব্র স্বরে। মিছিলে হাঁটার আলাদা একটা ছন্দ
আছে। নিজেকে একটা আন্দোলনের অংশ ভাবতে ভীষণ ভালো লাগছিলো। বৈপ্লবিক আন্দোলনের নেশা
অন্য সব নেশার চেয়েও তীব্র। মিছিল আন্দরকিল্লার মোড়ে গিয়ে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের
ভবন অতিক্রম করে সোজা লালদীঘির পাড়ে গিয়ে ডানে মোড় নিলো। এখানে পুলিশের ব্যারিকেডে
গতি কমে গেল মিছিলের, কিন্তু স্লোগানের গতি গেল বেড়ে। ট্রাকভর্তি পুলিশ রাস্তার দুপাশে।
হ্যান্ড-মাইক নিয়ে ঘোষণা করা হচ্ছে – সামরিক আইনের এই এই ধারায় মিছিল মিটিং বে-আইনী।
আর সামনে এগোলে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হবে। কিন্তু আমরা শহীদ মিনারে না গিয়ে ফিরে
যাবো না। শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হবে পরবর্তী কর্মসূচি।
পুলিশের
ব্যারিকেড ঠেলে মিছিল সামনে এগিয়ে গেল। আমি, সুমন, মানব, থোয়াই, তাপস ছিলাম মিছিলের
মাঝামাঝি। সিনেমা প্যালেস পর্যন্ত যাবার সাথে সাথেই শুনলাম গুলির শব্দ। নিউমার্কেটের
ওদিক থেকে সিটি কলেজের ছাত্ররা আসছিলো শহীদ মিনারের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে
ছাত্ররা এসে জড়ো হয়েছে শহীদ মিনারের সামনে। ওখানে শহীদ মিনারের উল্টো দিকে মুসলিম হলের
সামনে পুলিশের ট্রাক থেকে গুলি করা হয়েছে। আরেকটু
সামনে এগুতেই দেখলাম হঠাৎ সবকিছু সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। নাক-মুখ জ্বালা করছে, চোখ দিয়ে
পানি বের হতে শুরু করলো। তাহলে এই সেই টিয়ার গ্যাস। জীবনের প্রথম টিয়ার-গ্যাসের অভিজ্ঞতা।
এতক্ষণের তীব্র শক্তিশালী স্রোতের ধারার মতো জনজোয়ারে মুহূর্তেই ভাটা নেমে গেল। কে
কোন্খান দিয়ে ছুটে পালালো বুঝতেও পারলাম না। রাস্তার যেপাশে শহীদ মিনার – সে পাশে
উঁচু পাহাড়। ট্রাকের পর ট্রাকভর্তি পুলিশ এসে অন্য সবদিক ঘিরে ফেলেছে। মিছিলে গিয়ে
বিপ্লব করার যে উদ্দীপনায় এতক্ষণ দপদপ করছিলাম – সেই উদ্দীপনা উবে গিয়ে এখন প্রাণভয়
এসে ভর করেছে। কীভাবে যে সেই খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে অন্যদিকে ছুটে নেমে গিয়েছি হকার্স
মার্কেটের ভেতর – তা ভাবারও সময় পাইনি। আশেপাশের ত্রস্ত লোকজনের কথা কানে এলো – ‘কমপক্ষে
দশজনকে মেরে ফেলেছে গুলি করে।‘ কয়েক মিনিট আগেই যে পাহাড় অতিক্রম করে এদিকে এসেছি
– সেখান থেকেও নাকি গুলি করে কয়েকজনকে ফেলে দেয়া হয়েছে। ভয়ে শিউরে উঠলাম। মৃতদের দলে
তো আমিও থাকতে পারতাম!
বিপ্লব ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে বিপ্লবীরা একা হয়ে যায়। একাই ফিরলাম
হোস্টেলে। দেখলাম নেতারা আমার আগেই ফিরে এসেছেন। জানতে পারলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
মোজাম্মেল মারা গেছেন একটু আগে পুলিশের গুলিতে। তিনি আমাদের মিছিলের সামনের সারিতে
ছিলেন।
কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। হোস্টেল ছাড়তে হলো সেদিনই। বাড়িতে ফিরে এই ঘটনা কাউকে না জানানোই উচিত ছিল আমার। কিন্তু প্রথম প্রেমের মতো প্রথম বিপ্লবের ঘটনাও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলতে ইচ্ছে করে। আমারও করলো। বাবা সেই বর্ণনা শুনে আমার হাত ধরে খুব শক্তভাবে বললেন, “আমাকে ছুঁয়ে কথা দে, এধরনের বিপজ্জনক রাজনৈতিক মিছিলে আর যাবি না।“ বেশ সিনেমার মতো আবেগময় দৃশ্য ও সংলাপ।
কিন্তু তারপর কেটে গেছে আরো চার বছর। ষোল বছর বয়সের আবেগের প্রাবল্য বিশ বছর বয়সে অনেকটাই কমে গেছে। এখন আমি বুঝি আমার বাবার মতো প্রত্যেক মধ্যবিত্ত বাবাই তাঁদের সন্তানদের এরকমই বলে থাকেন। তাঁরা চান – তাঁদের সন্তানরা সব ধরনের বিপদ থেকে দূরে থাকবে। যে বিপ্লবে বিপদের সম্ভাবনা আছে, তার ধারে কাছেও যাবে না। কিন্তু বিপ্লবের ফল পুরোপুরিই ভোগ করবে। প্রাণ যদি দিতে হয়, সে অন্য কারো সন্তান দেবে – কিন্তু নিজের সন্তান যেন বেঁচে থাকে। কিন্তু শুধু বাবাদের দোষ দিচ্ছি কেন? আমি নিজে কী? বাবার দোহাই দিয়ে নিজেকে বিপ্লব থেকে দূরে রাখছি। এ ব্যাপারে একেবারে বাপের সুপুত্র হয়ে গিয়েছি। অথচ বাপের দশটা নিষেধের মধ্যে একটাও মানি না। এখন আরামে থাকার জন্য মধ্যবিত্তের দোহাই দিয়ে বাপের কথায় যুক্তি খুঁজছি। অথচ নুর হোসেনের বাবাও কি মধ্যবিত্ত নন? তিনি ট্যাক্সি চালান। তিনি নিশ্চয় তাঁর ছেলেকে বলেননি – “যা বাবা, মিছিলে যা, গুলি খেয়ে মর।“
“দেখবেন, লোকে শুধু নুর হোসেনের নামই মনে রাখবে। অন্য দু’জনের
নাম কেউ মনেও রাখবে না।“ – মুকিতভাই দার্শনিকের মতো কথা বলেন।
পুলিশের গুলিতে নুর হোসেন এবং আরো দুজন যুবলীগ নেতা নুরুল
হুদা বাবুল এবং আমিনুল হুদা টিটু নিহত হয়েছেন। এঁদের মতো অসংখ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে
যে সংগ্রামের সাফল্য আসে – সেই সাফল্যের ভাগিদার আমরা সবাই হই, কিন্তু অনেকসময় শহীদদের
রক্তের প্রতি সামান্য কৃতজ্ঞতাও দেখাই না। তা যদি দেখাতাম তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধের মাত্র
ষোল বছরের মধ্যেই দেশের এই অবস্থা হয়ে যায়!
চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে ছড়ার কুলের ব্রিজে উঠে দেখলাম আজ হরতাল হলেও এখানকার সব দোকানই খোলা। রাস্তায় অবশ্য কোন গাড়ি চলছে না। কিন্তু একটু আগে একটা মিলিটারির জিপ ছুটে গেল তীব্র গতিতে।
মুকিতভাই হাঁটছেন আমার আগে আগে। তিনি কথা বলেন আস্তে আস্তে, হাঁটেন তার চেয়েও আস্তে। কোনকিছুতেই তাঁর তাড়াহুড়ো নেই, কেবল বইপড়া ছাড়া। তিনি প্রচুর বই পড়েন, বই কেনেন। হুমায়ূন আহমেদের সব বই তাঁর সংগ্রহে আছে। হুমায়ূন আহমেদের নতুন বই বের হলেই তিনি তা দ্রুত কিনে নিয়ে এসে দ্রুত পড়ে ফেলেন। তারপর সেই বই আমাকেও পড়তে দেন। এই বিল্ডিং-এ এসে মুকিতভাইয়ের সাথে পরিচয় হওয়াও আমার একটা বড় পাওয়া।
মুকিতভাই নিজের সম্পর্কে তেমন কিছুই বলেন না। হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি তাঁর প্রিয় চরিত্র, এবং নিজেকেও অনেকটা মিসির আলির মতোই করে ফেলছেন। এখলাসের কাছে যেটুকু শুনেছি এবং যেটুকু দেখছি তাতে বুঝতে পারছি কয়েক বছরের ব্যবধানে বিরাট বিবর্তন ঘটে গেছে মুকিতভাইয়ের মধ্যে। সিলেটের সুনামগঞ্জে বাড়ী তাঁর। দু-তিন বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ফিজিক্সে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন সম্ভবত তাবলিগ করতেন। লম্বা দাড়ি, মাথায় পাগড়ি, পরনে সালোয়ার-পাঞ্জাবি। তারপর এক বছরের মধ্যে কী যেন হয়ে যায় তাঁর। ফিজিক্স ছেড়ে দেন, সাথে দাড়ি, পাগড়ি, সালোয়ার-পাঞ্জাবি সব। ক্লিনশেভড, আধুনিক প্যান্ট-শার্টের নতুন মুকিতভাই ভর্তি হলেন বাংলা বিভাগে। পদার্থবিজ্ঞান থেকে বাংলায় ভর্তি হতে আমি আরো কয়েকজনকে দেখেছি। আমার চিটাগং কলেজের বন্ধু সেতার – এক বছর ফিজিক্স পড়ার পর বাংলায় ভর্তি হয়েছে। আমারও অবশ্য বাংলা ভালোই লাগে – তবে ফিজিক্স ছাড়ার কথা আমি কখনো ভাবিনি।
নভেম্বরের আরামদায়ক রোদ চারদিকে। বিল্ডিং-এর ছাদটা বেশ বড়। ছাদের দরজা সবসময় খোলাই থাকে। ছাদের উপরেও আরো একটা উঁচু জায়গায় জমানো পানির ট্যাংক। দেয়ালে লাগানো লোহার আংটায় পা রেখে এই ট্যাংকের উপরে উঠে বসা যায়। মুকিতভাইসহ উঠে এলাম ট্যাংকের উপর। নলকূপ থেকে পাম্পের মাধ্যমে পানি তোলা হয় এই ট্যাংকে। পানিতে প্রচুর আয়রন। সেই লোহার পরিমাণ কমানোর বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা আছে এই ট্যাংকে। পানি মূল ট্যাংকে আসার আগে প্রথমে পাথরের নুড়ির একটা ছোট্ট ট্যাংকে আসে, সেখান থেকে কিছুটা পরিশ্রুত হয়ে একটা বালির ট্যাংকে আসে, তারপর বালির ভেতর দিয়ে পরিশ্রুত হয়ে সেই পানি মূল ট্যাংকে আসে। পানি পরিশোধনের এরকম পদ্ধতির ব্যাপারটা পড়েছিলাম ক্লাস সিক্সের বিজ্ঞান বইতে। এখানে এসে দেখলাম। এত উপর থেকে আশেপাশের অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। চারপাশের ধানক্ষেত এখন শূন্য। ধান কাটা হয়ে গেছে। এই শূন্য ক্ষেতে এখন শীতকালীন শাকসব্জির চাষ হবে।
“ইউনিভার্সিটি বন্ধ হয়ে যাবে আবার। এখানে থাকবেন, নাকি বাড়ি চলে যাবেন?” – মুকিত ভাইয়ের প্রশ্নে সত্যিই ভাবনা হতে থাকে। ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার পর থেকে কেবল বন্ধের পর বন্ধ। ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হবার পর আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখনো বুঝতে পারছি না কী করবো। বিল্ডিং-এর প্রায় সবাই বাড়ি চলে গেছে। মাহমুদভাই বাড়ি চলে গেছেন বেশ কয়েকদিন হলো। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পাকিস্তানের হেরে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। এমন গালিগালাজ শুরু করেছিলেন যে মনে হচ্ছিল ইমরান খানকে সামনে পেলে খেয়েই ফেলবেন। তারপর রুমে তালা দিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। টিভিটা রেখে গেছেন মুকিত ভাইয়ের রুমে। ফলে সন্ধ্যায় টিউশনি থেকে এসেই টিভি দেখতে বসে যাই। তবু ভালো যে বিকেল পাঁচটার আগে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয় না। নইলে হয়তো সারাদিনই টিভি দেখতাম। বিটিভি এখন এরশাদের গুণকীর্তন করার পাশাপাশি ভারত পাকিস্তানের সিনেমাও দেখাতে শুরু করেছে। আর খবর যা দেখায় তাতে মনে হয় বাংলাদেশের মতো শান্তির দেশ পৃথিবীতে আর একটিও নেই, আর এরশাদ হচ্ছেন পৃথিবীর সবচেয়ে গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট।
“আপনি কী করবেন? বাড়ি যাবেন?” – মুকিতভাইকে জিজ্ঞেস করলাম।
মুকিতভাই কিছু বলার আগেই সাইফুলের গলা শোনা গেল – “প্রদীপ, তুমি কই?”
ট্যাংক থেকে নিচে নেমে এলাম। সিঁড়ির কাছে সাইফুলের পেছনে প্রদীপ নাথও আছে। সাইফুল প্রদীপ নাথের বাল্যবন্ধু। সে হিসেবে আমারও বন্ধু হয়েছে। সাইফুল, প্রদীপ নাথ দু’জনই সিগারেট ধরালো। আমার রুমে সিগারেট খেতে আমি মানা করিনি একবারও, কিন্তু তারা কেউই আমার রুমে সিগারেট খায় না। ইচ্ছে হলে বাইরে বারান্দায় গিয়ে খায়, অথবা ছাদে চলে আসে।
মুকিতভাই আমাদের কথা বলতে দিয়ে নিচে চলে গেলেন। আমরা আমাদের ইউনিভার্সিটি আবার বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনায় উদ্বিগ্ন হলাম, নুর হোসেনের আত্মত্যাগ নিয়ে কথা বললাম, আরো হাজারো হাবিজাবি বিষয়ে কথাবার্তা বলতে বলতে দুপুর পার করে ফেললাম। তারপর তারা চলে গেলো। মাহমুদমিয়া মুকিতভাই আর আমার জন্য রান্না করেছেন। এখলাস কোথায় যেন গেছে।
দুপুরে শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ রেডিও শুনলাম। একটা এক ব্যান্ডের রেডিও কিনেছিলাম কলেজের স্কলারশিপের টাকা দিয়ে। ওটাতে বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়ার কয়েকটি স্টেশন ধরে। আকাশবাণীর সংবাদে জানতে পারলাম শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করা হয়েছে। সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উচ্ছৃঙ্খলতা দেখলেই পুলিশকে গুলি চালানোর অধিকার দেয়া হয়েছে। দেশের অবস্থা খুবই খারাপ।
পরপর এক সপ্তাহ ধরে হরতাল চললো। আমাদের ইউনিভার্সিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। বিবিসিতে এরশাদের কুকীর্তি প্রচার করার অপরাধে বিবিসির সংবাদদাতা আতাউস সামাদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২৭ নভেম্বর দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হলো। নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার আবারো রদ করা হলো। হরতাল প্রতিরোধ সবকিছু ঠান্ডা করে দেয়া হলো জরুরি অবস্থার জরুরি আইন দিয়ে। অন্ধকারের দিকে আমাদের যাত্রা আরো ত্বরান্বিত হলো।
No comments:
Post a Comment