বুদ্ধদেব গুহ প্রথমবার ইওরোপ ভ্রমণে গিয়েছিলেন উনিশ শ সত্তরের দশকে। লন্ডনে তাঁর আত্মীয়-ভাই টবীর বাসায় কিছুদিন আতিথ্য গ্রহণ করে একটা কনডাক্টেড ট্যুরে চলে গিয়েছিলেন জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া এবং আরো অনেক দেশে। ট্যুর কোম্পানির বাসে বারোদিন ধরে ঘুরেছেন তিনি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে চলার পথে। এরই সরস বর্ণনা তাঁর প্রথম প্রবাস বইতে। ভূমিকায় তিনি উল্লেখ করেছেন ভারতের জরুরি অবস্থার সময় তাঁর লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায়। সেই সময় তিনি দেশের সমালোচনা করেছেন এই অজুহাতে তাঁর লেখার অনেক অংশ সেন্সরড হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। পুলিসের নজরদারিতেও থাকতে হয়েছিল। তাঁর বাড়িতে তল্লাশিও চালানো হয়েছিল। সেই যাই হোক।
আমাদের দেশের মানুষ – বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের মানুষ উন্নত দেশে ভ্রমণ করার সময় নিজের অজান্তেই তুলনা করতে শুরু করে নিজের দেশের সাথে। কোন ব্যবস্থায় যখন আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই – অনেক সময় আমাদের সুযোগও থাকে না এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা কী হতে পারে তা জানার। কিন্তু সেই সুযোগটা আসে উন্নত দেশে ভ্রমণ করতে গেলে। তবুও আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে – দেশপ্রেমের নামে দেশের দোষগুলি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা। কোন কারণ ছাড়াই আমরা যদি আমাদের দেশকে পৃথিবীর সেরা দেশ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকি – সেটাকেই দেশপ্রেমের প্রমাণ বলে মনে করা হয়। আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত যারা – তারা তো গলা ফুলিয়ে বলবেনই যে আমাদের দেশের মতো এমন ভালো দেশ আর কোথাও নেই – যেখানে এরকম খোলামেলাভাবে দুর্নীতি করা যায়। কিন্তু যারা এর শিকার, ভুক্তভোগী – তারা কী কারণে নিজের দেশকে পৃথিবীর সেরা দেশ বলে মনে করবে – যদি নিজের দেশে হাজারো অনিয়ম থাকে? লেখক এই প্রশ্নগুলি বিভিন্ন জায়গায় তুলেছেন।
অনেক পুরনো দিনের ভ্রমণকাহিনি পড়লে সেই ভ্রমণকাহিনি অনেকটা ইতিহাসের কাজও করে। যেই সময়ে তিনি ভ্রমণ করেছিলেন ১৯৭৪-৭৫ সালে – মাত্র ৮ ডলার সাথে নিয়ে যেতে দেয়া হতো। তার স্থানীয় মুদ্রায় দাম ছিল ৫৬ টাকা। অর্থাৎ তখন এক ডলারের দাম ছিল ৭ টাকা। ২০২১ সালে তা বেড়েছে প্রায় দশ গুণ।
ডিসি টেন প্লেন ছিল তখন আধুনিকতম প্লেন। তখন প্লেনে পাইপ টানা যেতো। ধুমপান পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে আরো অনেক বছর পর। তখনো প্লেনে সিনেমা দেখানো হতো। তবে তা দেখানো হতো ছোট্ট প্রজেক্টরে।
বিদেশী প্লেনের ঝলমলে চঞ্চলা এয়ার-হোস্টেসদের দেখে বুদ্ধদেব আক্ষেপ করেছেন এয়ার-ইন্ডিয়ার এয়ার-হোস্টেসদের ব্যাপারে। “এত টাকা মাইনে দিয়ে, এমন সুন্দর সাজপোশাক পরিয়ে এমন রাম-গরুডের ছানাদের কেন ইন্ডিয়ান এয়ার-লাইনসে রাখা হয় তা সাধারণ বুদ্ধির বাইরে।“
লন্ডনে পৌঁছে লেখক তার ভাইয়ের বাড়িতে উঠেছেন। তারা ব্যস্ত দম্পতি। তবুও যথাসম্ভব সাথে করে নিয়ে গিয়ে পথঘাট দেখিয়ে দিয়েছেন। পরে লেখক নিজে নিজেই ঘুরেছেন লন্ডনে। তাঁর ভাই শুরুতে জার্মানিতে গিয়েছিলেন। সেখানে অনেক বছর অনেক ধরনের কষ্ট করে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রবাসীদের কষ্ট বুঝতে চেষ্টা করেছেন লেখক। আবার প্রবাসী বাঙালীদের সমালোচনাও আছে – “পাঁচজন বাঙালি এই দূরদেশে এসেও মিলে মিশে থাকতে পারে না। পরনিন্দা, পরচর্চা, দলাদলি, ঈর্ষা, এইই সব।“ – পৃথিবীর সব দেশেই প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে এই ব্যাপারটা আছে। কিন্তু শুধুমাত্র কি বাঙালিদের মধ্যে? আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে – অন্যান্য জাতির মধ্যেও এই ব্যাপারগুলি কমবেশি আছে।
ইংরেজরা আমাদের উপমহাদেশ শাসন করেছিল। তাদেরকে ভারত থেকে তাড়ানোর পরেও কিন্তু আমাদের ইংরেজ-প্রীতি যায়নি। লেখক সেই প্রসঙ্গে বলছেন – “প্রভুত্ব করাতে তাদের যতটুকু বাহাদুরি ছিল, দাসত্ব সীকারে আমাদের বাহাদুরি তার দেয়ে প্রবলতর ছিল।
আমাদের দেশের হ্যাভ আর হ্যাভ-নটদের শ্রেণিবিভাজনের ব্যাপারে লেখক বলছেন – “আমাদের দেশে রাজার ছেলে প্রায়শই রাজা হয়, মন্ত্রীর ছেলে মন্ত্রী হয়, মসৃণভাবে না হলে এই ঘটনা অমসৃণভাবে ঘটানো হয়। এবং চাষার ছেলে হয় চাষা।“ – লেখকের ক্ষোভটা এখানে বোঝা যায়। কিন্তু তিনি যেখানে গিয়ে এই উপলব্ধিটা প্রবলভাবে বুঝতে পারছেন – সেখানেই কিন্তু রাজা-বাদশাদের সমারোহ। ইওরোপে এখনো যত রাজা আছে আর কোন মহাদেশে এত রাজা নেই। সেখানে কিন্তু রাজার ছেলেরাই রাজা হয়।
কসমস কোম্পানির
বাসে করে ইউরোপ ট্যুরে বের হয়ে লেখক মিশেছেন বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে। তার মধ্যে
সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়েছেন ইজরায়েলি তরুণী সারা, আর অস্ট্রেলিয়ান তরুণী ক্যারল ও জেনির
প্রতি। এই বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন ক্যারল ও জেনিকে। তবে সারার সাথে তিনি একটি রাত
একই ঘরে কাটিয়েছেন, শরীর বিনিময়ও করেছেন। তিনি হয়তো ঠিকই উপলব্ধি করেছেন – “ওদের দেশে
কোনো মেয়েকে চুমু খেলেই সঙ্গে সঙ্গে তার সতীত্ব নষ্ট হয়ে যায় না এবং চুমু খেলেই ভালোবাসাও
হয়ে যায় না।“
আবার এটাও উপলব্ধি করেছেন – পৃথিবীর সব মানুষই কিছু কিছু ব্যাপারে একই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখায় – যেমন, “তার পা মাড়িয়ে দিলে, তার স্বার্থে, আরামে বা মানিব্যাগে হাত পড়লে পৃথিবীর সব মানুষই সমান।“
শিল্পের শহর প্যারিসে গিয়ে লেখক আর্ট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে কথা বলেছেন তা সঠিকভাবে নিয়ে এসেছেন – প্রয়োজনের অতিরিক্তটাই আর্ট। অর্থাৎ পেটের ক্ষুধা মিটানো প্রয়োজন। কিন্তু মনের ক্ষুধা মেটানোর জন্য যা করি – সেটা আর্ট।
প্যারিসে স্টেজ শো দেখতে গিয়ে দেখেছেন স্টেজে একেবারে নিরাবসনাদের প্রাচুর্য। তার প্রেক্ষিতে তিনি মন্তব্য করেছেন – “পৃথিবীতে মেয়েদের সমুদয় সাজপোশাকের আড়ম্বর শুধু খুলে ফেলার জন্যই।“ আমি জানি না লেখক পরিণত বয়সেও তা মনে করেন কি না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে এখানে লেখক যথেষ্ট উদার হতে পারেননি।
ভ্রমণকাহিনি
পড়তে ভালো লাগে আমার। তাতে অন্য আরেকজন ভ্রমণকারির মনের ভেতরটাও দেখার সুযোগ পাওয়া
যায়। আর সেই ভ্রমণকারি যদি বুদ্ধদেব গুহর মতো লেখক হন – তাহলে তো কথাই নেই। লেখকরা
ভ্রমণ কাহিনিতেও অনেক কাহিনি তৈরি করেন সেটা করেন আর্টের কারণে। সেই আর্টটুকু তো সহ্য
করতেই হয়।
আমি আপনার "পার্থিব: অপার্থিব বিশ্বাসের নির্মোহ ব্যবচ্ছেদ" লেখাটার কমেন্ট বক্সে একটা অনুরোধ জানিয়েছি। এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ। দেখবো এখন।
Delete