Saturday, 26 June 2021

জুমানজি দ্য নেক্সট লেভেল

 


বাচ্চাদেরকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবো এরকম প্রস্তাব রাখার সাথে সাথেই তা নাকচ করে দিল বাচ্চাদের পিতা। বাচ্চাদের মাতা বুদ্ধের মতো নিরপেক্ষতা অবলম্বন করলো - অর্থাৎ কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম হবে এরকমই সিদ্ধান্ত তার। এরকম কিছু একটা যে হবে সে ব্যাপারে বাচ্চারা আমাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছিল। আমি বাচ্চাদের আশ্বাস দিয়ে বলেছিলাম যে তাদের পিতার সম্মতি আদায় করা তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। তারা হাসতে হাসতে বলেছিল – দেখা যাবে।

বাচ্চারা তাদের পিতাকে আমার চেয়ে বেশি চেনে। বাড়ির কর্ত্রীও জানে কর্তাব্যক্তির মতিগতি। এই কর্তাটিকে সিনেমা দেখার ব্যাপারে উদবুদ্ধ করা সম্ভবত স্বয়ং স্পিলবার্গের পক্ষেও সম্ভব নয়। কারণ সে জীবনে কোন সিনেমা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক বসায় দেখেনি। আমরা মোটামুটি একই সময়ে পৃথিবীতে এসেছি। একই রকম দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে পার করেছি আমাদের শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য। একই সাবজেক্টে পড়াশোনাও করেছি। কিন্তু সবকিছু একই রকম হলেও মানুষের শখ, সাধ, ভালো লাগা কিংবা না লাগা এসবে ভিন্নতা থাকেই। যেমন নাটক, সিনেমা – এসব আমার কাছে মৌলিক চাহিদারই কাছাকাছি কিছু। কিন্তু তার কাছে এসব হলো অহেতুক সময় নষ্ট, পয়সা নষ্ট করার অপকর্ম। সে এতটাই শিক্ষানুরাগী যে – যেসব কাজকর্ম সরাসরি শিক্ষার সাথে সংযুক্ত নয় – সেসব কাজ তার কাছে বাধ্যতামূলকভাবে পরিত্যাজ্য।

বাসায় যতটা পারে নিজের ক্ষমতা দেখায় সে। নিজের নিয়ম কঠোরভাবে বলবৎ রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু পুরোটা যে পারে না সে নিজেও জানে। অনেকটা ক্ষোভের সাথে সে আমাকে বলে, “আর বলিস না। যতক্ষণ আমি বাসায় থাকি+ ততক্ষণ বাসার টিভি বন্ধ থাকে, বাচ্চারা পড়াশোনার টেবিলে এমনভাবে ঝুঁকে থাকে যেন পারলে টেবিলের ভেতর ঢুকে যাবে। আর বাচ্চাদের মাও এমন আচরণ করে যেন সিরিয়াল বলতে সে শিশুদের খাবারই বুঝে, টিভি সিরিয়ালের নাম সে জীবনেও শোনেনি। আর যেই আমি বাসা থেকে অফিসের দিকে রওনা দেবো, সাথে সাথে বাসার পরিবেশ দ্রুত বদলে যায়। জি বাংলা, হ্যাঁ বাংলা, স্টার প্লাস, স্টার মাইনাস এরকম যত চ্যানেলে যত সিরিয়াল আছে সেগুলি চালু হয়ে যায়।“

“তোর বাসার তো ডিডিএলজে’র মতো অবস্থা” – আমি বললাম।

“ডিডিএলজে? ওটা কোন্‌ কোম্পানি?” – সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। কর্পোরেট অফিসে কাজ করার অনেক সমস্যার একটি হলো – তাদের চিন্তাভাবনাজুড়ে কোম্পানির নাম, কোম্পানির টার্মগুলি ঘুরতে থাকে। আমার বোঝা উচিত ছিল।

“কোম্পানি নয়। ডিডিএলজে – দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েংগে”

“জাইঙ্গা নিয়ে কী করবি?”

তার প্রশ্নে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারি না। লে জায়েঙ্গে কে যে জাঙিয়া ভাবতে পারে তাকে ডিডিএলজে সম্পর্কে কথা বলা বৃথা।

এহেন মানুষ বাচ্চাদের নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবার প্রস্তাব নাকচ করে দেবে সেটাই তো স্বাভাবিক। প্রত্যেক মানুষের কিছু দুর্বল জায়গা থাকে। তাদের কাবু করতে হলে দুর্বল জায়গায় হাত দিতে হয়। এই মানুষটির দুর্বল জায়গা হলো বন্ধুত্ব। আমার নিজের জন্য কিছু করতে বললে সে যেকোনোভাবেই সেটা করে দেবে। দুরন্ত ছাগলকে ধরতে হলে যেমন হিসি করার সময় ধরতে হয়, তেমনি এই লোককে রাজি করানোর জন্য বললাম, “দ্যাখ, আমি জীবনে কোনদিন ঢাকার সিনেমাহলে সিনেমা দেখিনি। ছোটবেলা থেকে যতবার ঢাকায় এসেছি, সিনেমা দেখতে চেয়েছি। কিন্তু এখনো সেই সাধ মেটেনি। এখন তো সিনেমাহলগুলি সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যে ক’টা আছে সেগুলিও বন্ধ হয়ে যাবার আগে একটা সিনেমা দেখা অবশ্যকর্তব্য। আজ বিকেলটা যখন ফ্রি আছি, একটা সিনেমা দেখার ব্যবস্থা কর।“

তারপর প্রায় আধঘন্টা ধরে শিশুদের মতো আবদার করতে করতে তাকে রাজি করালাম। একা যেতে অস্বস্তি লাগবে, আমি তোদের অতিথি, আমাকে একা পাঠাবি? শুধুমাত্র তুই সাথে যাবি, বাচ্চারা যাবে না তা কি হয়? বউকে একলা ফেলে যাবি? স্টারপ্লেক্সেই যখন দেখাবি – থ্রিডি সিনেমাই দেখি। তুই সিনেমা না দেখিস, কিন্তু থ্রি ডাইমেনশানাল ব্যাপারটা তো দেখা উচিত – এরকম আরো কতকিছু বললাম।

থ্রিডি বলে অবশ্য একটু বেকায়দায়ও পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ সে বললো, “যা কিছু সবসময় দেখি, সবই তো থ্রিডি। ওটা আবার সিনেমাহলে গিয়ে দেখতে হবে কেন?”

বাচ্চাদের পিতা রাজি হলো। কিন্তু তাতেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল না। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে পড়ুয়া বাচ্চাদের মতো ব্যস্ততা সম্ভবত পৃথিবীর আর কোন দেশের বাচ্চাদের নেই। এই বাসার দুই বাচ্চার একজন স্কুলে, অন্যজন কলেজে। দুইজনের স্কুল-কলেজের পর অনেকটা করে কোচিং-ক্লাস। সব সামলে এক সাথে তিন-চার ঘন্টা সময় বের করাও কঠিন তাদের পক্ষে। অনেক কষ্টে একটা কোচিং-ক্লাস বাদ দিতে হলো। এই স্যাক্রিফাইসটা করার সময় বাচ্চা খুবই খুশি, কিন্তু বাচ্চার বাবার অবস্থা হলো শেয়ার মার্কেটে ধ্বস লাগার মতো।

ঠিক হলো আমরা আগে গিয়ে টিকেট করে রাখবো, বাচ্চারা কোচিং শেষে সেখানে যাবে। রওনা হলাম। বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে আসার সময় রিকশায় বসে তাত্ত্বিক কথাবার্তা হচ্ছিল তার সাথে। ছেলে-মেয়েদের সন্তুষ্ট রাখা যে কী কঠিন কাজ তা বর্তমান টিন-এজ মা-বাবার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। আমার সাথে অবশ্য তার ছেলে-মেয়ে দুটোর সম্পর্ক বেশ চমৎকার। ট্যুরিস্টদের কাছে যেমন সব দেশই ভালো, তেমনি আমার কাছেও পৃথিবীর সব ছেলে-মেয়েই অসাধারণ। 

মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভেতর একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে সবসময়। তারা নিজেদের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ঠিকমতো মেনে নিতে পারে না। মনে মনে চায় ধনী হতে। কিন্তু যখন পারে না, তখন আদর্শের দোহাই দেয়। কিন্তু মাঝে মাঝে তারা ধনীদের মতো ধনী এলাকায় যেতে পছন্দ করে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খাওয়া, একটু বেড়াতে যাওয়া, দু-একটা শো-পিস কেনা - এসবেই সীমাবদ্ধ আমাদের মধ্যবিত্তের বিলাসিতা। 

আমরা যারা নিম্ন-মধ্যবিত্তের ঘরে জন্মছি - বাহুল্য বলতে তেমন কিছুই আমাদের ছিল না শৈশবে। তখন আমরা অল্পেই সন্তুষ্ট থাকতাম। উচ্চবিত্তদের জীবনযাপন ছিল আমাদের অপরিচিত। তাই মনে অহেতুক কোন হীনমন্যতা জন্মাবার সুযোগ ছিল না। 

কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েরা - বিশেষ করে মধ্যবিত্তের ছেলে-মেয়েদের কাছেও বাইরের পৃথিবী খুবই পরিচিত। ইলেকট্রনিক্স এখন একেবারে নিম্নবিত্তেরও নাগালের মধ্যে। বিশ্বায়নের কল্যাণে টেলিভিশনের পর্দার ভেতর দিয়ে সারা পৃথিবীর চাকচিক্য ঢুকে পড়ছে আমাদের ছেলেমেয়েদের ভেতর। তারা এখন অল্পতে সন্তুষ্ট হয় না, কিন্তু অল্পতেই মন খারাপ করে ফেলে। তাদেরকে মূল্যবোধের কথা বললে তারা ভাবে তাদের চাহিদার মূল্য দেবার সামর্থ্য নেই বলেই আমরা মূল্যবোধ নামক কিছু বায়বীয় শব্দাবলি প্রয়োগ করে তাদের মনযোগ বিক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করছি। 

বাসা থেকে দূরত্ব বেশি নয়। তাই তাত্ত্বিক আলোচনাও দীর্ঘস্থায়ী হলো না। অবাক হয়ে দেখলাম কী বিপুল সমারোহ এই বসুন্ধরায়।

বাংলাদেশের সিনেমাহলগুলি একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি যেসব সিনেমাহলে সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম, চট্টগ্রামের সেইসব সিনেমাহলগুলির মধ্যে মাত্র চারটি অবশিষ্ট আছে। বাকি দশ-এগারোটি সিনেমাহল এখন সুপারমার্কেট হয়ে গেছে। আধুনিক সুপারমার্কেট - যেগুলিকে শপিং মল বলা হয় - সেখানে আধুনিক থিয়েটারে সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশেও সেরকম কিছু অত্যাধুনিক শপিং মল গড়ে উঠেছে। বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স সেরকমই একটা। সেখানে সবকিছুর দাম অত্যন্ত বেশি। নিম্নবিত্তদের দূরে রাখার জন্যই হয়তো এরকম। বাংলাদেশে কিছু মানুষের হাতে এখন অনেক টাকা। সেই টাকাই এখন মানুষের সাথে মানুষের বৈষম্যের প্রধান নিয়ামক। 




বাংলাদেশের সিনেমাশিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে। একসময় এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য – কোন ধরনের প্রতিযোগিতা যেন করতে না হয় অন্যদেশের সিনেমার সাথে, বিদেশী সব সিনেমা – বিশেষ করে ভারতীয় সিনেমা এদেশের সিনেমাহলে প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কি রক্ষা পেয়েছে এদেশের সিনেমা? একের পর এক ভারতীয় সিনেমা নির্লজ্জভাবে নকল করে সিনেমা বানানো হয়েছে এদেশে। ভিসি-আর ডিভিডি এসব সহজলভ্য হওয়ার পর থেকে আর কোন জারিজুরি খাটলো না। এখন তো সরাসরি আকাশ সংস্কৃতি। প্রত্যেক বাসায় শত শত বিদেশী চ্যানেলে শত শত সিনেমা চলে। ইউটিউব, নেটফ্লিক্সসহ হাজারো প্লাটফরমে সিনেমা দেখার সুযোগ। মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন। প্রতিভা না থাকলে কী প্রদর্শন করবে? আর প্রতিযোগিতা না থাকলে প্রতিভার কি বিকাশ ঘটে? যাই হোক – সেসব তত্ত্ব কথা আপাতত থাক।

জুমানজি’র এটা পার্ট-২। বাচ্চারাই বললো। তারা এর আগের পার্টও অলরেডি দেখে ফেলেছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ  আগে এই মুভি মুক্তি পেয়েছে হলিউডে। আর এর মধ্যেই চলে এসেছে বাংলাদেশে।

স্টারপ্লেক্স থিয়েটারগুলির যান্ত্রিক স্মার্টনেস সম্পর্কে আলাদা করে বলার দরকার নেই। এখন সবকিছুই গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড। বোঝা যাচ্ছে – আমরা গ্লোবাল সিটিজেন হয়ে গিয়েছি, অন্তত সিনেমা হলের ভেতর।

এই সিনেমার কোন ঘটনাই আমার মনে দাগ কাটেনি। বুঝলাম এধরনের সিনেমা আমার ভালো লাগার সিনেমা নয়। আমার পাশে বসে বাচ্চাদের পিতা দেড়ঘন্টার একটা গভীর ঘুম দিলো। বুঝলাম এটা নেট প্রফিট। কারণ বাসায় ঘুমের ওষুধ ছাড়া সে ঘুমাতে পারে না। তবে আমাকে মাঝে মাঝেই মাথা নেড়ে হাত-পা নেড়ে আশেপাশের দর্শকদের বোঝাতে হচ্ছিলো যে গম্ভীর নাসিকাগর্জনের শব্দ আমার নাক থেকে বের হচ্ছে না।

সিনেমার মাঝখানে বাচ্চাদের মাতা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো, “এই দ্যাখো দ্যাখো, প্রিয়াংকা চোপড়ার হাজব্যান্ড।“

তার চিৎকারে তার স্বামীর ঘুম ভেঙে গেল। সে জেগে উঠে বিরক্ত হয়ে বললো, “নিজের হাজব্যান্ডের দিকে ফিরেও তাকায় না, অন্যের হাজব্যান্ডকে দেখে কী করছে দ্যাখ।“ 



No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts