Saturday, 19 June 2021

কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞান

 



বিংশ শতাব্দীর পুরোটাই ছিল পদার্থবিজ্ঞানের দখলে। শতাব্দীর শুরুতেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আগমণ বিগত কয়েক শত বছর ধরে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের আধিপত্যে ব্যাঘাত ঘটায়। নিউটনিয়ান মেকানিক্সের দুর্বলতাগুলো কাটানোর জন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্স অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীতেই আমরা পেয়েছি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার নীতি। আমরা পেয়েছি পরমাণুর নিউক্লিয়াস। আমরা বুঝতে পেরেছি নিউক্লিয়াসের ভেতরের উপাদানগুলোর গতিপ্রকৃতি।  অনেক মৌলিক কণা আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। সেজন্য তৈরি হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড মডেল। আমাদের হাতে এসেছে পারমাণবিক শক্তি, নিউক্লিয়ার শক্তি। আমরা মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহে নভোযান পাঠিয়েছি। চাঁদের বুকে হেঁটে এসেছেন বারো জন নভোচারী। পুরো বিংশ শতাব্দীজুড়ে পদার্থবিজ্ঞান দাপট দেখিয়েছে। তারপর বিজ্ঞানীরা ধারণা দিয়েছেন একবিংশ শতাব্দী হবে জীববিজ্ঞানের শতাব্দী। কিন্তু দেখা যাচ্ছে একবিংশ শতাব্দীতে এসে জীববিজ্ঞানের ভূমি দখল করতে শুরু করেছে পদার্থবিজ্ঞান। এই শতাব্দীর বিজ্ঞানের সম্ভাবনাময় নতুন শাখার নাম কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞান।

একসময় মনে করা হতো পদার্থবিজ্ঞানের সাথে জীববিজ্ঞানের তেমন কোন সম্পর্ক নেই। যাঁরা জীববিজ্ঞান নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করতেন তাঁদের অনেকেই পদার্থবিজ্ঞানের ধারেকাছেও ঘেঁষতেন না। কিন্তু এখন সেসব দিন আর নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখায় বিশেষ করে ক্যান্সার চিকিৎসায় ও মস্তিষ্কের কোষের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি লাগে সেগুলো সব পদার্থবিজ্ঞানের অবদান। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগ শুরু হয়েছে আসলে প্রায় একশ বছর আগে থেকে - যখন ১৮৯৫ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করেছিলেন। এক্স-রে'র হাত ধরে পরবর্তীতে কম্পিউটার টমোগ্রাফি বা সিটিসহ আরো অনেক চিকিৎসা-প্রযুক্তি মানুষের হাতে এসেছে। কিন্তু জীববিজ্ঞানের মৌলিক বিষয় ভালোভাবে বুঝতে গেলে যে পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হবে, তাও আবার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো খটমট পদার্থবিজ্ঞান - তা বিশ বছর আগেও মানুষ তেমন করে ভাবেনি। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে পদার্থবিজ্ঞানীরা তো বটেই - জীববিজ্ঞানীরাও বুঝতে শুরু করেছেন যে জীববিজ্ঞানের অনেক প্রতিষ্ঠিত বিষয় সঠিকভাবে বুঝতে গেলে ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্স নয় - কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দরকার।

ধরা যাক সালোক সংশ্লেষণের ব্যাপারটা। আমাদের ছোটবেলার বিজ্ঞান বইতেই আমরা পড়েছি উদ্ভিদের পাতায় সূর্যের আলো পড়লে সেখান থেকে উদ্ভিদের খাদ্য তৈরি হয়। আরেকটু বড় হয়ে আমরা জেনেছি উদ্ভিদের পাতায় যে ক্লোরোফিল আছে তার সাথে সূর্যালোকের বিক্রিয়ার কয়েকটি ধাপ আছে। আমাদের পরিবেশে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প বা পানির কণা ভেসে বেড়াচ্ছে। গাছের পাতার ক্লোরোফিল সূর্যের আলোর সাথে বিক্রিয়া করে অর্থাৎ সূর্যের আলোর ফোটন কণার শক্তি কাজে লাগিয়ে পানি থেকে ইলেকট্রন বের করে নিয়ে আসে। সেই ইলেকট্রন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সাথে যুক্ত হয়। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় কার্বোহাইড্রেড বা গ্লুকোজ। ইলেকট্রনের আদান-প্রদানের ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমতে থাকে এবং অক্সিজেন তৈরি হতে থাকে। আমরা উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন ও গ্লুকোজ তৈরির রাসায়নিক সমীকরণও জানি: 6CO2 + 12H2O + ফোটন (সূর্যের আলো) = C6H12O6 + 6O2 + 6H2O. সালোকসংশ্লেষণের এই ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক বছর আগে। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় একটি ফাঁক রয়ে গেছে। সেটা হলো আলোর ফোটন এখানে কীভাবে কাজ করে। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্স দিয়ে আলোর ধর্ম পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না। আলো একই সাথে কণা ও তরঙ্গ আকারে থাকতে পারে। একটি ফোটন একই সময়ে একাধিক জায়গায় থাকতে পারে। বিশ্বাস হয় না? এই অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে।

সব সালোকসংশ্লেষণেই যে অক্সিজেন উৎপন্ন হবে এমন কোন কথা নেই। সাধারণত উদ্ভিদ, শৈবাল এবং কিছু ব্যাকটেরিয়া (সায়ানোব্যাকটেরিয়া) সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপন্ন করে। আবার কিছু বেগুনি ও সবুজ ব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষণ ঘটিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমায় ঠিকই, কিন্তু অক্সিজেন তৈরি করে না। সেখানে আসলে পানির বদলে অন্য পদার্থ ব্যবহৃত হয়। সেধরনের সালোকসংশ্লেষণের রাসায়নিক সমীকরণ লেখা যায় এভাবে: CO2 + 2H2A + ফোটন (আলো) = [CH2O] + 2A + 2H2O. এখানে A হলো এমন একটি যৌগ যেটা থেকে ফোটনের বিক্রিয়ায় ইলেকট্রন বের হয়ে আসবে। আলোর ফোটন কী প্রক্রিয়ায় পদার্থ থেকে ইলেকট্রন বের হয়ে আসতে সাহায্য করে সেই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে হলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ছাড়া চলবে না।

বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি গবেষণাগারে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণ ঘটিয়ে প্রত্যেকটি ধাপ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যে এই ধাপগুলো ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন ফোটনগুলো শোষিত হবার পর কোষের ভেতর একটি কেন্দ্রে গিয়ে মিলিত হচ্ছে - যাকে রিঅ্যাকশান সেন্টার বলা চলে। এই কেন্দ্রেই সালোক সংশ্লেষণ ঘটে। ফোটনগুলো এই কেন্দ্রে সরাসরি যায় না। একই সাথে অনেকগুলো পথে এই ফোটনগুলো রিঅ্যাকশান সেন্টারে যায় - যা কোয়ান্টাম সুপারপজিশান, অর্থাৎ একই সাথে একাধিক অবস্থায় থাকা। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিখ্যাত 'শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল' - যা একই সাথে মৃত বা জীবিত যে কোন অবস্থায় থাকতে পারে - কোয়ান্টাম সুপারপজিশানেরই উদাহরণ।

আমরা এনজাইম বা উৎসেচকের কথা জানি। এগুলো মূলত প্রোটিন। জীবকোষের ভেতর যত রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে সেগুলোকে ত্বরাণ্বিত করতে সাহায্য করে এনজাইম। কিন্তু কীভাবে এই কাজ করে এরা? কোষের মেমব্রেন বা কোষের আবরণ ভেদ করে কীভাবে এরা ইলেকট্রনের আদান-প্রদান ঘটায়? এই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে হলেও আমাদের দরকার হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স - যেখানে আমরা পাই 'কোয়ান্টাম টানেলিং'। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের সূত্র মেনে কোন একটি বাধা পার হয়ে যেখানে ইলেকট্রনের যাওয়ার কোন উপায় নেই, সেখানেও দেখা যায় কিছু ইলেকট্রন সেই বাধা অতিক্রম করে ফেলেছে। বোঝার সুবিধার্থে বলা যায় - যদি ইলেকট্রনের সামনে বিরাট উঁচু একটা দেয়াল থাকে, সেই দেয়াল ডিঙিয়ে যদি ইলেকট্রনের যাওয়ার শক্তি না থাকে- তখন ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স বলে যে দেয়ালের ওপাশে কোন ইলেকট্রন যেতে পারবে না। কিন্তু দেখা যায় অনেক সময় ইলেকট্রন দেয়ালের ওপাশে চলে গেছে। তখন ধরে নেয়া হয় দেয়াল পার হয়ে নয়, দেয়ালে সুড়ঙ্গ বা টানেল তৈরি করে ইলেকট্রনগুলো গিয়েছে।  ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সে কোয়ান্টাম টানেলিং সম্ভব নয়। জীবকোষের কোটি কোটি কোষের ভেতর অনবরত চলছে কোয়ান্টাম টানেলিং। ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্স দিয়ে কি তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব?

আমরা কীভাবে গন্ধ পাই? আমাদের ঘ্রাণ-ইন্দ্রীয় বা অলফ্যাক্টরি নার্ভ অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ বুঝতে পারে। পশুপাখিরাও গন্ধ বুঝতে পারে। কুকুরের ঘ্রাণ চেনার ক্ষমতা মানুষের চেয়েও বেশি। কিন্তু কীভাবে কাজ করে এই ঘ্রাণ ইন্দ্রীয়? জীববিজ্ঞানের সাধারণ ব্যাখ্যা হলো গন্ধ উৎপাদনকারী অণুগুলোর আকার ও আকৃতির উপর নির্ভর করে আমরা কী ধরনের গন্ধ পাবো। আমাদের নাকের মধ্যে আছে গন্ধ চেনার সেন্সর বা সংবেদী কোষ যাদের বলা হয় স্মেল রিসেপ্টর। এই কোষগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির সেন্সর। গন্ধ উৎপাদনকারী অণুগুলোর আকার ও আকৃতি যে সেন্সরের আকার ও আকৃতির সাথে মিলে যাবে সেই গন্ধের সিগনাল চলে যাবে মস্তিষ্কে। তখন মস্তিষ্কের অলফ্যাক্টরি নার্ভ সেই সিগনাল প্রসেস করে আমাদের গন্ধের অনুভূতি দেয়। কিন্তু আসল ব্যাপারটা এত সোজা নয়। আমাদের নাকের মধ্যে আছে মাত্র চারশ রকমের স্মেল রিসেপ্টর। অথচ আমরা কয়েক হাজার রকমের গন্ধ পাই। যদি একেক গন্ধের জন্য একেক রকমের রিসেপ্টর নির্দিষ্ট থাকতো তাহলে আমরা চারশ রকমের বেশি গন্ধ পেতাম না কোনভাবেই। অথচ লক্ষ রকমের গন্ধ আমরা বুঝতে পারি। তাছাড়া একই গন্ধের অণুর ভিন্ন ভিন্ন গঠন হতে পারে, কিন্তু তাদের সবার গন্ধ একই রকম। যেমন হাইড্রোজেন ও সালফারের যৌগের বিভিন্ন রকমের আকৃতি হতে পারে, কিন্তু তাদের সবারই একই রকম পচা ডিমের গন্ধ।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স এই গন্ধরহস্য ভেদ করতে পেরেছে। কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞান এই গন্ধ তত্ত্বের নাম দিয়েছে ভাইব্রেশান থিওরি অব অলফেকশান। গন্ধ উৎপাদনকারী অণুর পারমাণবিক বন্ধন বা অ্যাটমিক বন্ড তরঙ্গের মত কাজ করে। আর আমাদের নাকের সেন্সর এই তরঙ্গের কম্পন শনাক্ত করে। গন্ধের তীব্রতা ও প্রকৃতিভেদে বিভিন্ন অসংখ্য কম্পাঙ্কের গন্ধ-তরঙ্গ তৈরি হবার সম্ভাবনা থাকে। এই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুযায়ী আমরা অসংখ্য ধরনের গন্ধ পেতে পারি। মাঝে মাঝে অনেকেই কোন গন্ধ বস্তুর উপস্থিতি ছাড়াই গন্ধ পায়। আমাদের মস্তিষ্ক কিছু কিছু গন্ধ-তরঙ্গের স্মৃতি ধরে রাখে। সেই স্মৃতি মাঝে মাঝে ফিরে আসে গন্ধ হয়ে। একটু রহস্যময় মনে হতেই পারে। কারণ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগত রহস্যময়। পদার্থবিজ্ঞান ছাপিয়ে এখন জীববিজ্ঞানের দিকেও সফলভাবে অগ্রসর হচ্ছে কোয়ান্টাম বিজ্ঞান। এই শতাব্দীতে কোয়ান্টাম জীববিজ্ঞান জীবকোষের আরো অনেক নতুন রহস্যের জট খুলে দেবে। 


বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ ২০১৯  সংখ্যায় প্রকাশিত



2 comments:

  1. দারুন তথ্য পেয়েছি, সাধারণত বাংলা ভাষায় এরকম সাইন্টিফিক লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয় না না, লেখক কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই ।‌

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ অনন্য।

      Delete

Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts