আলমা মাহ্টার (alma mater) – ল্যাটিন এই শব্দযুগলের আক্ষরিক অর্থ হলো পুষ্টিদাত্রী মা, আর ব্যবহারিক অর্থ হলো আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখান থেকে আমরা জ্ঞান লাভ করে পুষ্ট হয়েছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমার আলমা মাহ্টার – জ্ঞানদাত্রী মা। আজ তার জন্মদিন – চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। ১৯৬৬ সালের আজকের দিনে এই বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমরা ছিলাম ২১তম ব্যাচ; ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষ। আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছিল ১৯৮৬র দ্বিতীয়ার্ধে। তিন বছরের অনার্স আর এক বছরের মাস্টার্স – মোট চারটি শিক্ষাবর্ষ শেষ করতে আমাদের লেগেছিল সাতটি বাস্তব বছর। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই সাত বছরের কোন বছরই বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কথা শুনিনি। আমাদের এখনকার সতীর্থদের তাই খুবই ঈর্ষা হয়। মনে হয় তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কত কাছের, অনুষ্ঠানে আনন্দে উদ্যাপনে কত না মুখরিত তাদের ক্যাম্পাসের দিনগুলি। ছেলেমেয়েরা যেমন মা-বাবা থেকে আলাদা হয়ে যাবার আগ-পর্যন্ত ঠিক বুঝতে পারে না, তেমনি শিক্ষার্থীরাও মনে হয় পাস করার আগে ঠিক বুঝতে পারে না ক্যাম্পাসের একেবারে নিরস দিনগুলিকেও একসময় মিস করতে শুরু করবে। প্রায় সাতাশ বছর হয়ে গেলো ক্যাম্পাস ছেড়েছি। অথচ এখনো কিছু কিছু স্মৃতি কত পরিষ্কার। সেইসব দিনগুলি কেবল স্মৃতিতেই পাওয়া যাবে এখন। কারণ সময়ের একমুখী তীর ছুটে চলেছে ভবিষ্যতের দিকে। তাকে থামানো যেমন অসম্ভব, তেমনি ফেরানোও সম্ভব নয়। কেবল মস্তিষ্কের নিউরনে অনুরণন ঘটিয়ে স্মৃতির পুননির্মাণ ঘটানো যায়। আমরা অনেকেই একই সময়ে একই ব্যাচে একই ক্লাসে পড়াশোনা করলেও – আমাদের স্মৃতির প্যাটার্ন একেক জনের একেক রকম। চিন্তার গোড়ায় যে যেমন সার-জল পেয়েছে, তার চিন্তার প্রসারও সেভাবেই ঘটেছে। আর চিন্তার স্বাধীনতা? বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য তো সেটাই – স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটানো। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানের মাটি থেকে কতটুকু পুষ্টি শুষে নিয়ে কতটুকু বিকাশ ঘটাতে পেরেছি তা তো জানি না।
আমরা যেসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম – দেশজুড়ে গণতান্ত্রিক ছদ্মবেশে সামরিক শাসনই চলছিল। চিন্তার স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তার কিছুই সম্ভব ছিল না ক্যাম্পাসে। স্বাধীনতা নামক বোধের কত রকমের বিকৃতি যে ঘটানো হয়েছিল সেই সময় – এখন পেছনে ফিরে তাকালে এক ধরনের ভোঁতা কষ্ট হয়। কী দমবদ্ধ অবস্থায় কেটেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। তার ভেতরেই আমরা ছোট ছোট আনন্দে হেসেছি, বড় বড় কষ্টেও পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসিনি। আজ বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে সব স্মৃতি যেন একসাথে হুড়মুড় করে চলে আসতে চাইছে। মনে হচ্ছে সময়ের তীরকে যদি একবার পেছনে ফেরানো যেতো মুহুর্তেই ফিরে যেতাম সেইসব দিনগুলিতে, ক্যাম্পাসের দিন, শাটল ট্রেনের দিনগুলিতে।
১৮/১১/২০২০
No comments:
Post a Comment