স্বপ্নলোকের চাবি – ২৭
জানুয়ারি মাস এসে গেলো। আরেকটি নতুন বছর শুরু হলো। শীত এখনো
খুব একটা বেশি নয়। এ মাসেই সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষা না পেছানোর জন্য আমরা
যে মিছিল করেছিলাম তা কার্যকর হয়েছে। তখন ভেবেছিলাম হাতে যেটুকু সময় আছে তার সবটুকু
কাজে লাগাবো, দিনরাত শুধু পড়বো আর পড়বো। কিন্তু আমার এরকম ভাবনার সাথে ভাব খুব একটা
হয় না, ভাব না-ই থেকে যায়। পরীক্ষা যতই এগিয়ে আসছে আমার অবস্থা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের
ফুলবালার মতো – “কে কোথায় সব গেল সে ভুলিয়া, আপন ভাবনা-ভরে!”
পরীক্ষা যতই এগিয়ে আসছে, ততই অন্যান্য বিষয়ের দিকে মন চলে
যাচ্ছে। টেলিভিশনের নাটকগুলিও মনে হচ্ছে এই সময়েই অনেক বেশি ভালো হয়ে উঠছে। হুমায়ূন
আহমেদের নতুন ধারাবাহিক ‘বহুব্রীহি’ ক্রমশই জমে উঠছে। এমন মজার নাটক বাদ দিয়ে বসে বসে
‘হ্যামিলটনিয়ান ইকুয়েশান অব মোশান’ পড়া অসম্ভব। এদিকে আরেকটি ধারাবাহিক ‘সংশপ্তক’ বাদ
দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। শুধু মঙ্গলবারের ধারাবাহিক নাটক নয়, সাপ্তাহিক নাটক, সিনেমা,
ম্যাকগাইভার, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, সঙ্গীতানুষ্ঠান কিছুই বাদ যাচ্ছে না। মাহমুদভাই একদিন
সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “প্রদীপ, তোমার না সামনে পরীক্ষা?”
আমার চোখের সামনে তখন টেলিভিশনের পর্দা ছাড়া আর কিছু নেই।
বহুব্রীহির প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি সংলাপ যেরকম মনযোগ দিয়ে গিলছি, সেরকম মনযোগ দিয়ে
পড়াশোনা করলে সিলেবাসের সবকিছু এতদিনে আমার নখদর্পণে চলে আসতো।
মাহমুদভাইয়ের প্রশ্নের কোন উত্তর দিলাম না। তাঁর ছোটভাই ফজলু
আর ফজলুর বন্ধু সাইফুদ্দিন আমাদের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছে। আমাদের দু’ব্যাচ
জুনিয়র। এই বিল্ডিং-এ আছে তারা। মাহমুদভাই সম্ভবত তাদেরকে বলেছেন যে ফিজিক্সে পড়লে
ভালোভাবে পড়াশোনা করতে হয়, টিভি দেখতে হয় না ইত্যাদি। বড়ভাইরা সুযোগ পেলে ছোটভাইবোনদের
উপর যেরকম খবরদারি করেন আর কী। কিন্তু তাদের চোখের সামনে আমি পরীক্ষার আগেও যেভাবে
হা করে টিভি দেখছি, তাতে একটা বাজে উদাহরণ তৈরি হচ্ছে। মাহমুদভাই তাই আমাকে সতর্ক করার
চেষ্টা করছেন।
আমাদের ব্যাচের কেমিস্ট্রির হারুন টেলিভিশনের ধারে কাছেও
আসছে না পরীক্ষার তারিখ দেয়ার পর থেকে। নিচের তলায় শিবিরের কেউই টেলিভিশন দেখে না।
তাদের কাছে সম্ভবত টিভি দেখা হারাম। নজরুলও হলে চলে গেছে কয়েক মাস আগে।
ক্লাস সাসপেন্ড হয়ে যাবার পর থেকে ক্যাম্পাসে যাচ্ছি না মাসখানেক
হলো। প্রদীপ নাথ আসে মাঝে মাঝে। তখন আলোচনা শুরু হয় সিরিয়াস পড়াশোনা নিয়ে, মিনিট দশেক
পরেই সেই আলোচনা কীভাবে যেন মোড় নেয় অন্যদিকে, আর দু’জনই হাহা করে হাসতে থাকি। মাঝে
মাঝে নাথের সাথে বিপ্লব, সাইফুদ্দিন, তৌহিদ এরাও আসে। আড্ডা জমে যায়।
মাঝে মাঝে বিপ্লব একাই চলে আসে। ইদানীং তার নৃত্যানুশীলনের
দিকে ঝোঁক জন্মেছে। আমার রুমে এসে সে আক্ষরিক অর্থেই নাচে। মৃগীরোগীর মতো ছটফট করতে
করতে সে যা করে তার নাম নাকি ব্রেক-ড্যান্স। মাইকেল জ্যাকসন নাকি এভাবে নাচে। আমি মাইকেল
জ্যাকসনের নাচ এখনো দেখিনি – তাই ঠিক বলতে পারি না এই নাচ নাচতে গেলে হাত-পা ভাঙার
চান্স আছে বলেই এর নাম ব্রেক-ডান্স কি না। তবে বিপ্লব এই নাচ সম্ভবত আরো কাউকে দেখিয়েছে।
সম্প্রতি সে জানালো কেউ একজন তার প্রতি অনুরাগ ব্যক্ত করে চিঠি লিখেছে। তাহলে শুধু
হাত-পা ভেঙে পড়ার চান্স নয়, প্রেমে পড়ার চান্সও আছে এই নাচে!
একদিন মুরাদ এসেছিল দুপুরবেলা ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের ‘ক্যানোনিক্যাল
ট্রান্সফরমেশান’-এর নোট করেছি কি না দেখতে। আমার হাতে শংকরের ‘নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি’
দেখে সে ভাবলো এটা গবেষণা-সংক্রান্ত কোন বই। উপন্যাস বলার পরেও সে বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলো
না। মুরাদ খুব সহজসরল ছেলে। অক্সিজেন এলাকায় তাদের বাড়ি। ‘ক্যানোনিক্যাল ট্রান্সফরমেশান’
চ্যাপ্টারটাই আমি বাদ দিয়েছি শুনে সে আতঙ্কিত হয়ে উঠলো।
“এটা বাদ দেয়া তো রিস্কি হয়ে যাবে। এখান থেকে তো প্রশ্ন অবশ্যই
আসবে।“
পরীক্ষার জন্য আমি সিলেক্টিভ পড়াশোনা করি। আটটি প্রশ্ন থেকে
যে কোনো পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর লিখতে হয়। আমার টার্গেট থাকে চারটি প্রশ্নের উত্তর ঠিকমতো
লেখার। ফার্স্ট ইয়ারের কোন পরীক্ষায় আমি ফুল আনসার করতে পারিনি। সেকেন্ড ইয়ারেও কোন
রকমে ফার্স্ট ইয়ারের মতো করতে পারলেই হবে।
প্রদীপ নাথ সেব্যাপারে খুবই আশাবাদী। জানুয়ারির পহেলা তারিখে
যীশু আর সে একসাথে এসেছিল। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আমরা তিনজন একসাথে ছিলাম মাস খানেক।
গৃহগত প্রাণের কারণে গৃহের টানে গৃহে ফিরতে হয়েছে তাদের। তবে যাওয়া-আসা একই রকম আছে।
তারা দু’জন এলে দরকারি আলোচনাগুলি সিরিয়াসলি সেরে ফেলার চেষ্টা করি। কারণ আলোচনার মোড়
লেখাপড়া থেকে অন্যদিকে ঘুরে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা মুশকিল।
আমার রুমে সারাক্ষণই কবিতা নয় তো গানের ক্যাসেট বাজতে থাকে।
প্রদীপ নাথ কিছুদিন পরপর আমার জন্য বিদেশী ক্যাসেট নিয়ে আসে। ভারতীয় শিল্পীদের গানের
ক্যাসেট তার কাছে আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। যীশুর বাসায়ও মধ্যপ্রাচ্য বিরাজমান। তার দিদি-দাদা
মধ্যপ্রাচ্যে ডাক্তারি করেন। যীশু লেখাপড়ার ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। ইদানীং রুমে এলে
প্রথমেই আমার ক্যাসেট বন্ধ করে দেয়। গান শুনতে শুনতে লেখাপড়া করা তার পক্ষে অসম্ভব।
“পরীক্ষার আর দুই সপ্তাও নাই, তুই গান উনর দে নে?” – গজগজ
করতে করতে ক্যাসেট বন্ধ করে যীশু।
“টেনশান করিস না, টেনশান করিস না” - আমি তাকে আশ্বস্ত করার
চেষ্টা করি অন্যভাবে। বলি, “রাখীর কথা চিন্তা কর। তাকে সংসার করতে হচ্ছে, তার মেয়ের
দেখাশোনা করতে হচ্ছে, সবকিছু করতে করতেই সে পরীক্ষার জন্য লেখাপড়াও করছে। সেও তোর মতো
এত টেনশান করছে না।“
রাখীর কথা বললে যীশু এখনো কিছুটা উদাস হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ঝুলি থেকে খাতাপত্র বের করলো। প্রদীপ নাথ হঠাৎ উঠে পেন্সিল দিয়ে
আমার দেয়ালে লাগানো ১৯৮৯ সালের নতুন ক্যালেন্ডারের প্রথম তারিখের চার পাশে গোল দাগ
দিতে দিতে বললো, “ডিসিশান নিয়ে ফেলেছি।“
আমি জানি সে কিসের ডিসিশানের কথা বলছে। আমি হাসিমুখে তার
দিকে তাকিয়ে রইলাম। যীশু জিজ্ঞেস করলো, “কিয়র ডিসিশান ওডা?”
“আজিয়া বছরর পইলা তারিখত্থুন সিগারেট ছারি দিয়ম।“ – প্রদীপ
নাথ সিরিয়াসলি উত্তর দেয়। যীশু চৌকির উপর বসেছিল। নাথের সিগারেট ছেড়ে দেয়ার কথা শুনে
সে এতটাই আনন্দিত হয়ে উঠে যে চৌকির উপর দাঁড়িয়ে যেতে গিয়ে মাথায় বাড়ি খেয়ে আবার বসে
পড়লো। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘খুব ভালো ডিসিশান নিয়েছিস।“
আমি কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। তিনজনের সামনে খোলা নোটের
পাতা উল্টাতে লাগলাম। আধঘন্টার মধ্যেই প্রদীপ নাথ উশখুস শুরু করলো।
“কী রে বাইরে যাবি?” – জিজ্ঞেস করলাম।
“একটু এক নম্বর করে আসি।“ – খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রকৃতির
ডাকে সাড়া দিতে গেল। কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখেই বুঝলাম সে ফিরে এসে কী করবে।
ড্রয়ার থেকে ইরেজার খুঁজে বের করে রাখলাম টেবিলের উপর।
পাঁচ মিনিট পরেও প্রদীপ নাথ আসছে না দেখে যীশু প্রশ্ন করে,
“প্রদীপ্যা এতক্ষণ ক্যান গরের দে ওডা? এক নম্বর গইর্ত যাই দুই নম্বর গরের নে ক-ন?”
“টাইন্ত গেইয়ে দে।“
“কী কস্? – যীশুর চোখ কপালে ওঠার অবস্থা।
“দেখবি এখন এসে কী বলে সে।“
আরো মিনিট পাঁচেক পর প্রদীপ নাথ ফিরলো। আমি তার দিকে তাকাতেই
সে হেসে ফেললো। বললাম, “ইরেজার টেবিলের উপর আছে।“
সে ইরেজার নিয়ে একটু আগে ক্যালেন্ডারে দেয়া পেন্সিলের দাগ
মুছতে মুছতে বললো, “ভেবে দেখলাম পরিবহন ধর্মঘটের সময় সিগারেট ছাড়া ঠিক হবে না।“
চার তারিখ থেকে সারাদেশে বাস শ্রমিকরা অনির্দিষ্ট কালের জন্য
ধর্মঘট ডেকেছে বাসভাড়া বাড়ানোসহ আরো অনেকগুলি দাবিতে। কিন্তু তার সাথে প্রদীপ নাথের
সিগারেট ছাড়া না ছাড়ার কী সম্পর্ক থাকতে পারে তা বোঝার সাধ্য আমাদের কারোরই নেই।
এরকম সিগারেট ছাড়ার প্রতিজ্ঞা প্রদীপ নাথ এর আগে আরো অনেকবার
করেছে। প্রতিবারই সেই প্রতিজ্ঞা ভেঙেছে। প্রতিবারই সে ক্যালেন্ডারের কোন না কোন পাতায়
এভাবে পেন্সিল দিয়ে দাগ দেয়। পরে আবার ইরেজার দিয়ে সেই দাগ মুছে ফেলে। একুশে ফেব্রুয়ারি,
২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর – সবগুলি তারিখেই সে এরকম দাগ দিয়েছিল একের পর এক। এখন জানুয়ারির
এক তারিখে দিয়েছে। আর আধঘন্টার মধ্যেই তা মুছেও ফেলেছে। এরপর আরেকদিন হয়তো অন্য কোনো
তারিখ সে খুঁজে বের করবে সিগারেট ছাড়ার মোক্ষম তারিখ হিসেবে উদ্ভট কোন যুক্তিতে।
দু’দিন পর যীশু আবার এলো অর্পণকে সাথে নিয়ে। অর্পণও পড়াশোনার
ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। পরীক্ষার অনেক আগে থেকেই সে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
সিলেবাসের কোন অংশই সে বাদ দেয় না। কোন টপিক ক্লাসে পড়ানো না হলেও সে পড়ে ফেলে। এ ব্যাপারে
সে অঞ্জনের অনুসারী। অঞ্জনও সারাবছর সিরিয়াসলি পড়াশোনা করে, এবং সবকিছুই অত্যন্ত গুছিয়ে
করে। শাহজালালে অঞ্জন ও মৃণাল এক রুমে থাকে। তারা দুজনই এত গোছালো যে আমরা মাঝে মাঝে
তাদের রুমে গিয়ে যতটা পারি এলোমেলো করে দিয়ে আসি। তারা হাসিমুখে সহ্য করে আমাদের অত্যাচার।
অর্পণরা অনেক ধনী। তার বাবা হাইকোর্টের ব্যস্ত উকিল। লালদিঘীর
পাড়ে তাদের নিজেদের বাড়ি। অর্পণ এমনিতে খুব হাসিখুশি মানুষ। কিন্তু যখন রেগে যায় –
খুবই মারাত্মকভাবে রাগে। তখন ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে যায়। আমার সাথে তার প্রথম পরিচয়ের
দিনেই সে খুব রেগে গিয়েছিল। সে মাঝে মাঝে তোতলায়। তার প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় একটা
শব্দ আমার আটকে গিয়েছিল। সে ভেবেছে আমি তাকে বিদ্রুপ করেছি। অনেক মানুষ নিজেদের দুর্বলতার
ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতার জন্য তারা অনেক সময় মানুষকে
ভুল বোঝে। অর্পণও আমাকে ভুল বুঝেছিল। পরে অবশ্য তার ভুল ভাঙে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের দিকে
গেলে তাদের বাসায় মাঝে মাঝে যাওয়া হয়।
অর্পণ রুমে ঢুকেই প্রশ্ন করলো, “তোর দরজায় সাইদীর পোস্টার
কেন?”
এই উৎপাত শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন থেকে। সম্ভবত নিচের তলার
শিবিরের নতুন কর্মীদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যেভাবে পারে আমাকে বিরক্ত করতে। অন্য কোন
মেস হলে হয়তো এতদিনে আমাকে মেরে তাড়িয়ে দিতো। এখানে সেটা করতে পারছে না, কিন্তু সুক্ষ্মভাবে
বিরক্ত করছে। আমার দরজায় শিবিরের পোস্টার লাগিয়েছিল। আমি সেটা ছিঁড়ে ফেলে তার উপর আমি
কমরেড ফরহাদের ছবি লাগিয়ে দিয়েছিলাম। তারা কমরেড ফরহাদের মুখে দাড়ি-টুপি এঁকে তাকে
হুজুর বানিয়ে দিয়েছিল। ক’দিন আগে দেখলাম তার উপর দেলোয়ার হোসেন সাইদীর তাফসিরুল কোরান
মাহফিলের বড় একটা পোস্টার লাগিয়ে দিয়েছে।
“কে লাগিয়েছে আমি দেখিনি।“ – অর্পণকে ঠান্ডা করার চেষ্টা
করলাম।
“তুই ছিঁড়ে ফেলছিস না কেন? এবছর কোথাও সাইদীর মাহফিল করতে
দিচ্ছে না দেখছিস না?” – অর্পণ উত্তেজিত।
আমিও শুনেছি দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাইদীকে প্রতিরোধ করার
ডাক দেয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় মাহফিল বন্ধও করে দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলের
মাঠে এসময় সাইদীর যে মাহফিল হয় প্রতিবছর, এবছর
তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়েছে শুনেছি। অর্পণের বাবা উকিল। তার কাছে এ ব্যাপারে
হয়তো আরো বেশি খবর আছে। সে বেশ জোর দিয়ে বলছে, “দেখিস, এবছর সাইদীর মাহফিল হবে না।“
চট্টগ্রাম শহরে জামায়াত শিবিরের যেরকম শক্ত অবস্থান, তাতে
অর্পণের কথায় আমার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। পরীক্ষার ব্যাপারে অর্পণ আমার কাছে
যা জানতে এসেছিল – তা জেনে কিছুটা সন্তুষ্ট, অনেকটা অসন্তুষ্ট হয়ে যীশুকে টেনে নিয়ে
চলে গেল। এক মিনিট সময়ও এখন তার কাছে অনেক মূল্যবান। আমি ছড়ার কুলের রেস্টুরেন্ট থেকে
সিঙাড়া খাওয়াবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। অর্পণ বাইরের খাবারের ব্যাপারে খুবই রক্ষণশীল।
বাস আসার সাথে সাথেই দ্রুত উঠে গেল।
আমাদের খাবারের মেস বন্ধ হয়ে গেছে। ভেতরের গন্ডগোল কী তা
ঠিক জানি না। সবাই যে যার মতো রান্না করে খাচ্ছে। মুকিতভাই আর তৌহিদভাই রান্না করছেন
নিজেদের রুমে। আমি মাঝে মাঝে রান্না করি, মাঝে মাঝে চৌধুরিহাটে গিয়ে হোটেলে খেয়ে আসি।
অর্পণ আর যীশু চলে যাবার পর রান্না বসালাম। ডাল, চাল একসাথে
সিদ্ধ। ভাত-ডাল ফুটে পানি শুকিয়ে এলে তার উপর একটা কাঁচা ডিম ভেঙে দিয়ে ঢাকনা দিয়ে
রাখলে ডিমটা সেখানে শক্ত হয়ে যায়। ডিম সিদ্ধ করার সময় বাঁচে, ডিমের খোসা ছাড়াতে হয়
না – কত্তো সুবিধা। আগে চাল-ডালের সাথে একটা আস্ত ডিমও দিয়ে দিতাম ডেকসির ভেতর। সব
এক সাথে সিদ্ধ হয়ে যেতো। কিন্তু ডিমকে ভাতের ভেতর থেকে বের করে আবার খোসা ছাড়াতে হতো।
খোসা ছাড়ানোর চেয়েও একটা বড় সমস্যা হয়েছিল একদিন। সেদিন খাবার সময় মনে হলো কেমন যেন
একটু গন্ধ-গন্ধ লাগছে যা ভাত, ডাল, কিংবা ডিমের গন্ধের চেয়ে একটু আলাদা। একটু পরেই
গন্ধটার কারণ বুঝতে পারলাম। এখানে যেসব ডিম পাওয়া যায় – সেগুলিকে বিক্রি করতে দেয়ার
সময় ভালো করে ধোয় না কেউ। ডিমের গায়ে হাস-মুরগির বিষ্টা লেগে থাকে। ডেকসিতে দেয়ার সময়
ডিম ভালো করে ধুয়ে দিই বলেই আমার ধারণা। কিন্তু সেদিন সম্ভবত ডিম ঠিকমতো ধোয়া হয়নি।
রান্না শেষ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শংকরের ‘নিবেদিতা রিসার্চ
ল্যাবরেটরি’র যেটুকু বাকি ছিল সেটুকু পড়তে শুরু করলাম। গল্প-উপন্যাস পড়ার সময় নিজের
মতের সাথে কোন কিছু মিলে গেলে খুব ভালো লাগে। এই বইতে শংকর লিখছেন, “পরীক্ষায় ফার্স্ট
সেকেন্ড হওয়াটাই বড় কথা নয়। ইংরেজির ফার্স্ট সেকেন্ডরাই যেমন ইংরেজি সাহিত্যের কর্ণধার
হয়নি, তেমনি সায়েন্সের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টরাই বিজ্ঞানের বৃহৎ আবিষ্কার করেনি।“
তাই তো, প্রতিযোগিতায় জেতা আর মৌলিক কিছু করা তো এক কথা নয়।
কিন্তু মৌলিকত্ব অর্জন করা তো ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার চেয়েও অনেক বেশি কঠিন।
দরজায় টোকা পড়ার শব্দ হলো। এটা পরিচিত হাতের শব্দ নয়। উঠে
দরজা খুলে যাকে দেখলাম – তিনি যে আমার এখানে কখনো আসবেন আমি কোনদিন ভাবিনি। আমার এই
ঠিকানা তিনি কোথায় পেলেন তা-ও বুঝতে পারছি না।
“আরে প্রাণেশদা, আপনি কোত্থেকে?”
“এই তো, শহর থেকে এলাম।“
ছাদে মাথা ঠেকে যাবার ভয়ে মাথা নিচু করে রুমে ঢুকলেন প্রায়
সাত ফুট লম্বা প্রাণেশদা।
প্রাণেশদা অর্থাৎ প্রাণেশ বড়ুয়া। তিনি অরিজিনালি আমার কত
বছরের সিনিয়র জানি না। আমার বড়ভাই যখন চট্টগ্রাম কলেজে গণিতে অনার্স পড়ছিল তখন প্রাণেশদা
তার ব্যাচমেট ছিল ফিজিক্সে। তারপর কীভাবে কীভাবে যেন প্রাণেশদা এখন আমার ব্যাচমেট হয়ে
গেছেন। প্রাথমিক অভ্যর্থনার পর মূল কথায় এলেন তিনি। এসেছেন আমার কাছ থেকে সেকেন্ড ইয়ারের
নোট নিয়ে যেতে। আর ক’দিন পরে যে পরীক্ষা আমি দেবো, তিনিও সেই পরীক্ষাই দেবেন। চট্টগ্রাম
কলেজের হোস্টেলে আমার যে ক’জন বন্ধু আছে তাদের কাছ থেকে আমার এই ঠিকানা সংগ্রহ করে
এখানে এসেছেন।
আমি তো বিপদে পড়ে গেলাম। প্রাণেশদার সাথে আমার তেমন কোন অন্তরঙ্গতা
নেই। বরং তাঁর স্বভাব যতটুকু জানি – তাতে তিনি কিন্তু খুব সহজ মানুষ নন। প্রায় সাতফুট
লম্বা মানুষ। তাঁর দৈর্ঘ্য যত বেশি, প্রস্থ ততই কম। সুপারিগাছের মতো ফিগার। গায়ের রঙ
ফ্যাকাসে হলুদ। নেতা হবার ব্যাপারে তাঁর প্রবল আগ্রহ। তার জন্য দরকার হলে বল প্রয়োগ
করতেও প্রস্তুত তিনি। একবার কলেজের একটা অনুষ্ঠানে তাঁকে বক্তৃতা দিতে ডাকা হয়নি বলে
তিনি অনুষ্ঠান পণ্ড করতে চেয়েছিলেন। পরে তাঁকে আয়োজকরা বক্তৃতা করার জন্য মঞ্চে তুলে
দিয়ে শান্ত করে। আমি সেই অনুষ্ঠানে তাঁর এসব কাজ নিজের চোখে দেখেছি। এখন তাঁকে নোট
না দিলে আবার কী ঝামেলা করে বসেন। কিন্তু এসময় নোট দিলে যদি তিনি নোট ফেরত না দেন!
“তুমি নোটের জন্য চিন্তা করো না। আমি নিয়ে গিয়ে ফটোকপি করে
আবার এনে দেবো তোমাকে।“ – এই নিয়ে পাঁচ-ছয় বার বললেন তিনি এই কথা। আমি দেবো কিংবা দেবো
না কিছু বলিনি এখনো।
“কিন্তু কালকে থেকে তো বাস চলবে না। আপনি আসবেন কীভাবে?”
“ট্যাক্সি টেম্পু চলবে তো। সমস্যা হবে না।“
“আমি আপনাকে সব নোট একসাথে দিতে পারবো না। আমাকেও তো পড়তে
হবে।“
সব পেপারের কয়েকটা করে চ্যাপ্টার বগলদাবা করে আগামীকাল এসে
ফেরত দিয়ে যাবেন অঙ্গীকার করে জিরাফের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে খুশি মনে চলে গেলেন
প্রাণেশদা।
এরপর তিনদিন চলে যাবার পরেও যখন প্রাণেশদা এলেন না, বুঝতে
পারলাম – বড্ড ভুল করে ফেলেছি। এবার আমার নিজের নোটের জন্য অন্যের কাছে ধর্ণা দিতে
হবে।
No comments:
Post a Comment