Monday, 26 July 2021

কাশেমভাই - দাদাভাই

 কাশেমভাই -দাদাভাই


কাশেমভাইয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা কোন্‌দিন হয়েছিল তার দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন সবই মনে আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার তাঁর সাথে শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল – সেদিনের কথাও মনে আছে। মাঝখানের অনেকগুলি বছরের অনেকগুলি দিন আলাদা আলাদাভাবে মনে করার উপায় নেই। কাশেমভাইয়ের সাথে শাহীন কলেজে একসাথে কাজ করেছি সাড়ে চার বছরেরও বেশি। পুরনো লাল বিল্ডিং-এ তাঁর সাথে ডেস্ক শেয়ার করেছি প্রায় তিন বছর। তারপর নতুন বিল্ডিং-এ আরো দেড় বছর মানুষটিকে দেখেছি কাছ থেকে, কাজ থেকে।

আমরা সবাই জানি – কাজের জায়গায় কত বিচিত্র রকমের মানুষ থাকে। তাঁদের প্রত্যেকের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে – যেগুলি দিয়ে তাদেরকে আলাদা করা যায়। অনেক সময় আমরা তাদের বৈশিষ্ট্যগুলির কারণে তাদেরকে ঈর্ষা করি, আবার বৈশিষ্ট্যভেদে অনেক সময় বিরক্ত হই। গতকাল কাশেমভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পাবার পর থেকে অনেকক্ষণ ধরে মনে মনে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম – কাশেমভাইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য কোন্‌টি।

কাশেমভাইয়ের যেদিকটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে তা হলো শাহীন কলেজ কর্তৃপক্ষের বহুবিধ চাপাচাপির মধ্যেও একেবারে প্রতিক্রিয়াহীন থাকা। কত ন্যায্য-অন্যায্য কারণে আমাদের অনেকের মাথা গরম হয়ে গেছে, আমরা কমনরুমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছি, অনেক সময় ছাত্রছাত্রীদের কাছেও আমাদের মানসিক অস্থিরতা চাপা থাকেনি। মানসিক চাপে আমাদের শারীরিক ভাষাও বদলে গেছে অনেকসময়। আমাদের হাঁটার গতি বেড়েছে, কিংবা ডাস্টারের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে – অথবা নিদেনপক্ষে অ্যাডজাস্টমেন্ট খাতা আছড়ে ফেলেছি। কিন্তু কাশেমভাইকে কোনদিন মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে দেখিনি। শুরুতে ভেবেছিলাম তিনি সংসারে বাস করা সন্ন্যাসী টাইপের মানুষ। কিন্তু ক্রমে জেনেছি তিনি ঘোরতর সংসারী মানুষ। মানুষের যেসব স্বাভাবিক স্বার্থচিন্তা থাকে – তার কোনটা থেকেই তিনি মুক্ত ছিলেন না। তাহলে কোন্‌ জাদুবলে কলেজের সব চাপ তিনি উপেক্ষা করে সদাস্থির থাকতে পেরেছিলেন?

কমনরুমে আমরা কত কিছু নিয়ে, কত কাউকে নিয়ে কতরকমের মন্তব্য করেছি। কাশেমভাই সেসব মন্তব্য চলাকালীন আরাম করে পান চিবিয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর গভীর মমতা ছিল তার প্রমাণ পেয়েছি অনেক সময়। ক্লাসের ভালো, কিংবা ধনী, কিংবা প্রভাবশালী, কিংবা গন্ডগোলে শিক্ষার্থীদের প্রতি অনেক শিক্ষকেরই ধনাত্মক-ঋণাত্মক কোন না কোন রকমের পক্ষপাতিত্ব থাকে। কিন্তু দুর্বল শিক্ষার্থীদের প্রতি মমতা দেখানোর মতো ধৈর্য অনেক শিক্ষকের থাকে না। কাশেমভাইয়ের মধ্যে আমি সেই মমতা দেখেছিলাম। তাঁর শিক্ষার্থীরাই ভালো বলতে পারবে তারা তাদের কাশেমস্যারকে মনে রাখলে কেন মনে রাখবে। আমি আমার জ্যেষ্ঠ সহকর্মী কাশেমভাইকে মনে রাখবো তাঁর কিছুতেই-কিছু-যায়-আসে-না স্বভাবের জন্য। কলেজে তিনি অনেক সিনিয়র ছিলেন – কিন্তু কখনোই সেটা জাহির করেননি। ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রভাবশালী শিক্ষকদের বলয়ে তিনি কোনদিনই ঢুকতে চেষ্টা করেননি।

কাশেমভাইয়ের সাথে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছিল ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে – ঢাকা ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টে। আমাদের আরেকজন সহকর্মী আলী হায়দারভাই কানাডা থেকে ঢাকায় এসে কানেক্টিং ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমিও বাড়িতে যাচ্ছিলাম। কাশেমভাই আলী হায়দারভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। আমার সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। কাশেমভাই তখন অবসর নিয়েছেন। আমার সাথে প্রায় এক যুগ পরে দেখা হলেও চিনতে পারলেন, বুকে টেনে নিলেন। মানুষকে আপন করে নেয়ার এই গুণের কারণে আপনাকে মিস করবো কাশেমভাই – আমাদের দাদাভাই।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts