বুদ্ধদেব গুহর
ভ্রমণ সমগ্রর তৃতীয় বই পঞ্চম প্রবাস। এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮০ সালের অক্টোবরে।
সত্তরের দশকের শেষভাগে লেখক আফ্রিকা ভ্রমণে গিয়েছিলেন। এই বইটি সেই ভ্রমণের বর্ণনা।
ভারত মহাসাগরের
ছোট্ট একটি দ্বীপরাষ্ট্র সেশেল্স (Seychelles). ১১৫টি ছোটবড় দ্বীপ নিয়ে এই স্বাধীন
রাষ্ট্রটি। সবচেয়ে বড় দ্বীপ ভিক্টোরিয়া – মাত্র ১৮ মাইল লম্বা ৩ মাইল চওড়া। এখানেই
দেশটির রাজধানী। আফ্রিকা থেকে মাত্র ১৫০০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত এই দেশ। মাত্র
এক লক্ষ মানুষ নিয়ে আফ্রিকার সবচেয়ে ছোট দেশ সেশেল্স।
ভারত থেকে সরাসরি
কোন ফ্লাইট নেই। লেখক গিয়েছিলেন মরিশাস থেকে।
সেশেল্স-এ
প্রচুর ভারতীয় ব্যবসা করেন। সামুদ্রিক মাছ, প্রচুর নারকেল, আর পর্যটন এই দেশের প্রধান
আয়ের উৎস।
সেশেল্স-এ
দু’দিন থেকে পূর্ব আফ্রিকার তানজানিয়ায় মূল ভ্রমণ লেখকের।
আফ্রিকায় এটা
লেখকের প্রথম ভ্রমণ। চাঁদের পাহাড়ের দেশ, রবীন্দ্রনাথের আফ্রিকা কবিতার দেশ। কর্পোরেট
কাজের সূত্রে গিয়েছিলেন। তাঁরাই সবকিছু ব্যবস্থা করে রেখেছিল। কাজ সেরে আফ্রিকার জঙ্গলে
কয়েক সপ্তাহ কাটানোর এলাহি ব্যবস্থা- গাড়ি, গাইড এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিকতা সবকিছু।
লেখক যখন ভ্রমণ
করছিলেন – সেই সময় তাঞ্জানিয়া ছিল কমিউনিস্ট দেশ। সবাই তখন কমরেড। অন্যকোন রাজনৈতিক
পার্টি সেখানে ছিল না। [১৯৯২ সালে সংবিধান পরিবর্তন করে বহুদলীয় ব্যবস্থার অনুমোদন
দেয়া হয়।]
ডার-এস-সালামে
দু’দিনের কনফারেন্স সেরে কেনিয়ার রাইবোবিতে একদিনের কনফারেন্স।
ডার-এস-সালাম
থেকে গেছেন তানজানিয়ায়। কিলিম্যানজারো এয়ারপোর্টে নেমেই চলেছেন ন্যাশনাল পার্কে পশুপাখির
সঙ্গে থাকতে। সারাপৃথিবীর পর্যটকরা এই করতেই আসেন তানজানিয়ায়, আফ্রিকায়।
এয়ারপোর্ট থেকে
২৯ মাইল দূরে আরুশাতে যাবেন লেখক। ট্যাক্সিতে উঠলেন আরো দু’জন পরিচিত ভারতীয় ভদ্রলোক
মিস্টার মেহেতা ও মিস্টার প্যাটেলের সঙ্গে। পথে ট্যাক্সির টায়ার ফেটে যায়।
আরুশা দার্জিলিং-এর
মতো ছোট্ট সুন্দর শহর। ট্যুরের ব্যবস্থা আগেই করা ছিল। অপারেটর হোটেলে এসে দেখা করে
গেল। কর্পোরেট ম্যানেজার দীনুভাই আর হুইট্লি সাহেব সব রকমের আরামের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
হোটেল, গাড়ি, ড্রাইভার, গাইড এবং রাতে শীত দূর করার জন্য ‘মিশরের সাপের মতো কালো চকচকে
একটি হিলহিলে তরুণী’। লেখক অবশ্য অন্য সব সুবিধা নিলেও তরুণীর সুবিধা নেননি। তিনি দাবি
করেছেন, “যে মানুষ প্রকৃতি নামক আদিক, নরম, রূপসী এক চন্ডী নারীর প্রেমে তেমন করে পড়েছে
তার কালো অথবা সাদা, কোনো মানবীকেই প্রয়োজন হয় না যখন সে তার পরম প্রেমিকার কাছে থাকে।
এমন সুন্দরী, বৈচিত্র্যময়ী এমন স্নিগ্ধ অথচ উষ্ণ নারী পৃথিবীতে আর কে আছে? যার চোখ
আছে, কান আছে, যার সমস্তি ইন্দ্রিয় সজাগ; সেই শুধু জানে প্রকৃতিকে প্রেমিকা করার আনন্দ
কী এবং কতখানি” [পৃষ্ঠা ১৮৬]
লেখকের জন্য
একটা গাড়ি, আর ড্রাইভার কাম গাইড কিলালাকে নিয়ে বের হয়ে পড়লেন সেরিঙ্গিটি ন্যাশনাল
পার্কের উদ্দেশ্যে। পথের মধ্যে শত শত বন্য জন্তু – মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ জমি। সেখানে
চরছে বুনো মোষ হাজার হাজার।
জঙ্গলের ভেতর
হোটেল। প্রথম রাত কাটলো গোরংগোরোর ক্র্যাটার লজে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মৃত আগ্নেয়গিরি
গোরংগোরো। এখানে মাসাইদের বাস। আফ্রিকার মাসাই উপজাতিদের নিয়ে আরো বই লিখেছেন বুদ্ধদেব
গুহ। ড্রাইভার ও গাইড কিলালার সাথে কিছুটা অন্তরঙ্গতার সম্পর্কও তৈরি হয় লেখকের।
গোরংগোরা হোটেল
থেকে পরদিন নতুন ড্রাইভার ও নতুন ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ি। নতুন ড্রাইভারের নাম ডিক্সন।
লেখক ক্যামেরায়
ছবি তুলতে দক্ষ নন। ভালো ক্যামেরাও সাথে ছিল না। তিনি লিখছেন, “আমি নিজে কোনো দিনও
ক্যামেরাতে বিশ্বাস করিনি। অবশ্য আমি জানি যে, এমন আহাম্মকের মতো কথা বললে এযুগে সবাই
হাসবেন, যে যুগে মানুষের চোখেরই বিকল্প হয়েছে ক্যামেরা।“ [পৃষ্ঠা ১৯৫] [লেখক এই কথাগুলি
লিখেছিলেন সেই ১৯৮০ সালে যখন ফিল্ম ক্যামেরাও মানুষের হাতে হাতে ছিল না। এখন কী বলেন
আমি জানি না।]
ক্যামেরায় ছবি
তুলতে গিয়ে বিপত্তি। ক্যামেরায় রিল ভরতে গিয়ে ক্যামেরা নষ্ট হয়ে যাওয়া। পরে এক জার্মান
পর্যটকের সাহায্য নিতে গিয়ে তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা এবং তাদের কাহিনিও এই ভ্রমণকাহিনির
একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হয়ে ওঠে।
প্রচুর চিতা,
সিংহ ঘুরে বেড়াচ্ছে বনের ভেতর। শিকার করছে। এর মধ্যেই গাড়ির ভেতর থেকে পশু দেখা, পাখি
দেখা। পথে হাতির পাল পড়ে। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয় এসব পশুদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে।
জার্মান এক
ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক এসেছেন স্ত্রী ও শ্যালিকাকে নিয়ে। তিনি লেখকের ক্যামেরা ঠিক করে
দিলেন। এভাবেই পরিচয়। লেখক মুখ দেখে ভবিষ্যত বলতে পারেন জেনে এবং ভারতীয় জেনে ভদ্রলোক
এবং তার শ্যালিকা দুজনই আলাদাভাবে তাঁর সাথে কথা বলেন। লেখক হয়তো মনস্তত্ত্ব জানেন।
তিনি শ্যালিকাকে বলে দেন – তাঁর ভগ্নিপতিকে নিজের প্রেমের বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিতে।
ভদ্রলোককেও আলাদা করে বললেন। প্রেম ভালোবাসার অনেক গল্প উপন্যাস লিখেছেন লেখক। তাতে
তাঁর অনেক মনস্তত্ত্ব জানা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি জার্মান ভদ্রলোকের ব্যক্তিগত
ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্কের টানাপোড়েন ঠিক করে দিলেন এক সন্ধ্যায় কিছুক্ষণের দার্শনিক
কথাবার্তা বলেই।
লেখক নারীদের
সম্পর্কে এমন কিছু লিখেছেন – যা বিভিন্নভাবে বিতর্কিত। যেমন, “মেয়েদের মতো
নরখাদক জানোয়ার ভগবান আর দুটি বানাননি। ধীরে ধীরে, অতি ধীরে তাকে সরিয়ে দাও। দুধ খেলে
শরীরে বল হয়, কিন্তু রাবডি খেলে বদহজম হয়। হালকা ভালোলাগা, ভালোবাসা, মানে ভালোলাগাটা
হচ্ছে দুধ, কিন্তু মোহ, অবৈধ-প্রেম এসব হচ্ছে রাবড়ি।“ [পৃষ্ঠা ২০৯]
জার্মান ইঞ্জিনিয়ারকে
পরামর্শ দেয়ার সময় বলছেন, “ভালোবাসার অনেক রকম আছে। একসঙ্গে দুজন নারীকে যে ভালোবাসা
যায় কাউকেই কিছুমাত্র না ঠকিয়ে, এটা আমরা পুরুষরা বিলক্ষণ বুঝি। কিন্তু মেয়েরা বোঝে
না। দে ক্যান শেয়ার এনিথিং ইন দ্য ওয়ার্ল্ড, বাট নট দেয়ার হাজব্যান্ডস। নট বাই এনি
মিন্স। তোমার স্ত্রীর দিকটা তোমার বোঝা উচিত। একটা সম্পর্ক ভেঙে দেওয়া খুব সোজা, কিন্তু
যে নতুন সম্পর্কের আশায় পুরোনো সম্পর্ক ভাঙছ, তাও যে একদিন ভাঙবে না তা জানছ কী করে?”
[পৃষ্ঠা ২১০]
আবার কিলালার
গাড়িতে যাত্রা। বনের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে লেখকের উপলব্ধি, “ভারি ভালো লাগছে। কাজ নেই,
ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে দিন বাঁধা নেই, সওয়াল নেই, জবাব নেই; সভ্যতার অন্যতম অভিশাপ টেলিফোন
নেই…”[পৃ ২১২]। সেই ১৯৮০ সালে যদি টেলিফোন সভ্যতার অন্যতম অভিশাপ হয়ে থাকে, আজকের টেলিফোন
সিস্টেমকে কী বলবেন লেখক!!
আফ্রিকার প্রবাসী
ভারতীয়দের সম্পর্কে খুব একটা উচ্চ ধারণা পোষণ করেননি লেখক। তিনি বলেছেন, “প্রচুর টাকা
রোজগার করে, উঁচু ভল্যুমে হিন্দি ফিল্ম-এর গান শুনে, চুড়মুর, ঢোকলা এবং একগাদা চিনি
ও দুধ-দেওয়া চা খেয়ে, বিয়ার পান করে পোলে পোলে জীবন কাটিয়ে দেন এঁরা।“ [পৃ ২১৫]
সেরেঙ্গেটি
ন্যাশনাল পার্কে মারাত্মক সেৎসি মাছি আছে। এগুলির কামড়ে মানুষের ইয়েলো ফিভার হয়। আফ্রিকায়
যাবার সময় অনেক রকমের প্রতিষেধক ইঞ্জেকশান নিয়ে যাবার দরকার হয়। সেৎসি মাছি এবং তাদের
আক্রমণ সম্পর্কেও অনেক ঘটনা ঘটে এই ভ্রমণে।
সেরেঙ্গেটির
জন্তু জানোয়ার দেখতে দেখতে যে হোটেলে রাতে ছিলেন সেখানেই উঠেছিলেন পথে পরিচিত জার্মান
ভদ্রলোক। তাঁর শালি লাইলাক লেখকের পরামর্শ
পাবার পর থেকে লেখকের ভক্ত হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন প্রেমেই পড়ে যাচ্ছে। হোটেল থেকে
রাতে বের হওয়া নিষেধ। কারণ হোটেলের কাছেও ভয়ানক জন্তু জানোয়ার চলে আসে। কিন্তু লেখক
লাইলাককে সাথে নিয়ে গভীর রাতে বের হয়ে পড়ে। সেখানে তারা একসাথে জন্তু দেখে, প্রকৃতি
দেখে, পাশাপাশি বসে মদ খায়, আর সিংহের পাল্লায় পড়ে। লেখকের শিকারের অভিজ্ঞতা আছে। কেবলমাত্র
টর্চের আলো ফেলে সিংহের পালকে সম্মোহিত করে ফেলেন তিনি। লাইলাক তো প্রেমে হাবুডুবু
খেতে থাকে। কিন্তু আমাদের লেখক মহামতি ভীষ্মের মতো লাইলাকের সাথে রাত যাপনের আহ্বান
প্রত্যাখ্যান করেন।
সেরেঙ্গেটি
ন্যাশনাল পার্কে রাতের বেলা গাড়ির টায়ার নষ্ট হয়ে যায়। এক্সট্রাটাও নষ্ট। অন্য কোন
গাড়ি সেই রাতে যাবার কথা নয়। রাতের অন্ধকারে প্রচন্ড ঠান্ডায় হাতির পাল এসে গাড়ি ঝাঁকিয়ে
চলে যায়। লেখক এখানে লিখছেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। [ইওরোপ ভ্রমণের সময় বলেছিলেন তাঁর
ঈশ্বর মন্দিরে থাকে না। তিনি মন্দিরে যান না। আমি ভেবেছিলাম তিনি যুক্তিবাদী।] এখানে
তিনি ভাগ্যবাদী। কপালে যা থাকবে তাই হবে টাইপ। নিজে এত বছর ধরে গাড়ী চালালেও গাড়ির
কাজকর্ম সম্পর্কে কিছুই জানেন না। কোনদিন টায়ার বদলাননি এবং বদলাতে সাহায্য করতেও রাজি
নন।
রাতে সেই জার্মান
ললনা লাইলাক গার্ড নিয়ে গিয়ে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন লেখক এবং তার ড্রাইভারকে।
ভ্রমণকাহিনি
শুধু ভ্রমণের কাহিনি হয়ে থাকে না। ইতিহাস থাকে সেখানে, মানুষ থাকে, মানুষের সংস্কৃতি
থাকে। তাই এর পাঠে লেখকের সাথে পাঠকেরও ভ্রমণ হয়ে যায়।
এই বইয়ের কিছু
ভালো লাগা লাইন:
যা পছন্দের
তাকে কখনও বেশিদিন কাছে রাখতে নেই। সে অপছন্দেরই হয়ে পড়ে তাতে। [পৃ ২৪৯]
যখন সময় থাকে,
তখন চোখের নীরব ভাষায়, মুখে কিছু না বলেও অনেক কথাই বোঝানো যায়; আর যখন থাকে না, তখন
চিৎকার করলেও কেউ কিছুই শুনতে পায় না। [পৃ ২৫০]
এক জীবনে কতটুকুই
বা জানা যায়? অনেকই বাকি থাকে। সব সময়েই সেই বাকি থাকার মানে শূন্যতা নয়। [পৃ ২৫৮]
কী মানুষ, কী
পশু, সকলেই অথরিটিকে ভয় পায়, এবং মানে। আমাদের সকলের মধ্যেই মাথা নিচু করার, চোখ-রাঙানি
মেনে নেবার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে। যদিও সেটা লজ্জাকর। এই বাবদে মানুষ পশুর সঙ্গে
একাসনে বসেছে চিরকাল। [পৃ ২৬১]
ভ্রমণ সমগ্র
১ – প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার দে’জ পাবলিশিং থেকে ২০১৬ সালে।
No comments:
Post a Comment