কোন মানুষের হাতে বা গলায় স্টেথোস্কোপ
দেখলেই আমরা বুঝে নিই যে মানুষটি ডাক্তার। স্টেথোস্কোপ যন্ত্রটা যতটা
ডাক্তার ও ডাক্তারির প্রতীক হয়ে উঠেছে, অন্যকোন চিকিৎসাযন্ত্র ততটা নয়। একেবারে সব
রোগের চিকিৎসাতেই যে স্টেথোস্কোপ লাগে তা নয়, কিন্তু স্টেথোস্কোপ ছাড়া ডাক্তারকে
কেমন যেন অসম্পূর্ণ মনে হয়। এই স্টেথোস্কোপ আসলে কী করে? এটা কানে লাগিয়ে
ডাক্তাররা রোগীর শরীরের শব্দ শোনেন। আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে বিভিন্ন
ধরনের শব্দ বের হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস, হাঁচি, কাশি, নাক-ডাকা কিংবা সশব্দে গন্ধবোমা
নির্গমনের কথা বাদ দিলেও আমাদের হৃৎপিন্ড যে শব্দ করে সেই শব্দ শুনে ডাক্তাররা
বুঝতে পারেন সেখানে কোন সমস্যা আছে কি না। মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ,
বিশেষ করে হৃৎপিন্ড এবং ফুসফুসের শব্দ পরিষ্কারভাবে শুনতে সাহায্য করে এই
স্টেথোস্কোপ।
শরীরের শব্দ শুনে রোগ নির্ণয়ের
ব্যাপারটাকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় অসকাল্টেশান (auscultation)। এই ব্যাপারটা হাজার বছরের পুরনো।
গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রিটাসের সময় থেকেই ডাক্তারটা রোগীর বুকে কান লাগিয়ে
হৃৎপিন্ডের শব্দ শুনে রোগ নির্ণয় করতেন। সতেরো শ পঞ্চাশ সালের দিকে ভিয়েনার এক
ডাক্তার লিওপোল্ড অয়েনব্রুগার শুরু করলেন আরেকটি নতুন পদ্ধতি। তিনি রোগীর বুকের
শব্দ শোনার পাশাপাশি বুকের বিভিন্ন জায়গায় টোকা মেরে সেই শব্দের প্রতিফলন শুনে
শুনে হৃৎপিন্ডের সমস্যা কতদূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে তা বুঝতে শুরু করলেন। লিওপোল্ডের
বাবার একটা পানশালা ছিল যেখানে প্রচুর মদ বিক্রি হতো। লিওপোল্ড দেখেছেন তাঁর বাবা
মদের পিঁপের গায়ে থাপ্পড় মেরে শব্দ শুনে বুঝে নিচ্ছেন পিঁপেয় কতটুকু মদ আছে।
ভরা-পাত্র আর খালি-পাত্রের শব্দ যে এক হয় না তা আমরা সবাই জানি। এই ব্যাপারটা
মানুষের শরীরের ব্যাপারেও খাটে। ভরা-পেটের শব্দ আর খালি-পেটের শব্দ এক হবে না।
পেটে গ্যাস জমলে যে ধরনের শব্দ হবে, পানি জমলে শব্দ হবে তার চেয়ে ভিন্ন। ফুসফুস
কিংবা হৃৎপিন্ডের স্বাভাবিক শব্দ ও অস্বাভাবিক শব্দ শুনে রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি সেই
তখন থেকেই ছিল। ডাক্তার রোগীর শরীরে কান লাগিয়ে সেই শব্দ শুনতেন।
১৮১৬ সালের একদিন প্যারিসের নেকার হাসপাতালের ডাক্তার রেনে লাইনেক বেশ বিপদে পড়ে গেলেন এক রোগীর হৃৎপিন্ডের শব্দ শুনতে গিয়ে। তখন ইওরোপে যক্ষা রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল অনেক বেশি। ডাক্তার রেনে লাইনেকের তরুণী রোগীর শারীরিক আয়তন বিশাল। তার বুকে কান লাগিয়ে যে শব্দ শোনা গেল তাতে রোগ-নির্ণয় করা গেলো না। ভালো করে কান লাগিয়ে শব্দ শোনারও কোন উপায় নেই। ফ্রান্সের মানুষ এমনিতেই নিয়মিত গোসল করে না। তার ওপর অসুস্থ হলে তো কথাই নেই। রোগীর গায়ের গন্ধে যেখানে কাছে যাওয়া যায় না, সেখানে বুকে কান লাগিয়ে ফুসফুসের শব্দ শোনা! কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না ডাক্তার লাইনেক।
পায়চারি করতে করতে হাসপাতালের বাগানের
বেঞ্চে গিয়ে বসলেন। হঠাৎ খেয়াল করলেন দুটো বাচ্চা ছেলে একটা লম্বা কাঠের দু'দিকে
কান লাগিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করছে। দু'জনের হাতে দুটো পিন। তারা পিন দিয়ে আঁচড়
কাটছে কাঠের গায়ে আর সেই আঁচড়ের শব্দ শুনছে কাঠের অন্যপ্রান্তে কান লাগিয়ে।
ডাক্তার লাইনেকের কাছে মুহূর্তেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। বাতাসে শব্দের বেগ ঘন্টায়
প্রায় ১,১৯৩ কিলোমিটার। পানিতে শব্দের বেগ ঘন্টায় প্রায় ৫,৩৮৫ কিলোমিটার। কিন্তু
কাঠের ভেতর দিয়ে শব্দ অনেক বেশি বেগে যেতে পারে। কাঠের মধ্য দিয়ে শব্দের বেগ
ঘন্টায় প্রায় ১৪,৪০০ কিলোমিটার। বাচ্চা ছেলেরা যেভাবে শব্দ শুনছে সেভাবেও তো রোগীর
বুকের শব্দ শোনা যায়। ডাক্তার লাইনেক দ্রুত ওয়ার্ডে এলেন। তাঁর হাতে একটা মেডিকেল
জার্নাল ছিল। সেটাকে গুটিয়ে একটা চোঙার মত করে একপ্রান্ত রোগীর বুকে ঠেকিয়ে অন্যপ্রান্তে
নিজের কান লাগালেন। অনেক স্পষ্ট এবং জোরালো শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই মুহূর্তটি ছিল
ডাক্তার রেনে লাইনেকের জন্য 'ইউরেকা' মুহূর্ত। জন্ম হলো স্টেথোস্কোপের।
ডাক্তার রেনে লাইনেক তাঁর আবিষ্কারের
নাম স্টেথোস্কোপ রেখেছেন গ্রিক শব্দ স্টেথোস এবং স্কোপেইন এর সমন্বয় করে। 'স্টেথোস' শব্দের অর্থ বক্ষ বা বুক, আর
'স্কোপেইন' শব্দের অর্থ হলো খুঁজে দেখা। ডাক্তার লাইনেকের তৈরি প্রথম
স্টেথোস্কোপটি ছিল ৩০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ এবং দুই সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের একটি
কাঠের সিলিন্ডার।
চিত্র: ডাক্তার রেনে লাইনেক রোগী দেখছেন তাঁর আবিষ্কৃত স্টেথোস্কোপ দিয়ে। (শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি) |
এরপর মাত্র সাত বছর বেঁচে ছিলেন ডাক্তার
লাইনেক। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর যক্ষা রোগীর চিকিৎসা করতে করতে এবং যক্ষা রোগ
নিয়ে গবেষণা করতে করতে নিজেই যক্ষা রোগের শিকার হলেন তিনি। ১৮২৬ সালে মাত্র ৪৫ বছর
বয়সে তিনি মারা যান।
লাইনেকের মৃত্যুর পর তাঁর স্টেথোস্কোপের
বিভিন্ন ধরনের বিবর্তন ঘটেছে। ১৮২৮ সালে সিলিন্ডারের একদিকে চোঙাকৃতি করা হলো যেন
রোগীর শরীর থেকে বেশি মাত্রার শব্দ সিলিন্ডারে প্রবেশ করানো যায়। আর অন্যদিকে কান
পাতার জন্য সিলিন্ডারকে সরু করা হলো যেন শব্দ কানের বাইরে না যায়, বা বাইরের
শব্দের সাথে মিশে না যায়। তখনো কিন্তু এক কানেই শব্দ শোনা যেতো। ১৮৪৩ সালে সিলিন্ডারের
এক প্রান্তে সীসার নল লাগিয়ে একই সাথে দুই কানে শব্দ শোনার ব্যবস্থা করা হলো। ১৮৫৫
সালে রাবারের প্রচলন ঘটার পর স্টেথোস্কোপের গঠনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ১৮৯৪ সালে
স্টেথোস্কোপে যুক্ত হয় শক্ত ধাতব ডায়াফ্রাম - যার নাম দেয়া হয় ফোনেন্ডোস্কোপ। ১৯২৬
সালে বস্টনের বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ হাওয়ার্ড স্প্র্যাগ স্টেথোস্কোপে যুক্ত করেন বেল ও
ডায়াফ্রাম যার মাধ্যমে ডাক্তার ইচ্ছে করলে কম কম্পাঙ্ক ও বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ
শুনতে পারেন। তারপর প্রায় তিরিশ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের
মধ্য দিয়ে আজকের স্টেথোস্কোপের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
চিত্র: স্টেথোস্কোপের বিভিন্ন অংশ |
ইতোমধ্যে আমাদের ডিজিটাল প্রযুক্তির
ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। সাউন্ড টেকনোলজি এখন পুরোটাই ডিজিটাল। সেক্ষেত্রে
স্টেথোস্কোপ-ও আস্তে আস্তে ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। হৃৎপিন্ড বা ফুসফুসের অতি কম
মাত্রার শব্দও এখন যন্ত্রের মাধ্যমে শোনা সম্ভব। শুধু তাই নয়, সেই শব্দকে রেকর্ড
করে রাখাও এখন সম্ভব হচ্ছে ডিজিটাল স্টেথোস্কোপের মাধ্যমে। এই ডিজিটাল স্টেথোস্কোপ
হৃদরোগে আক্রান্তদের রোগনির্ণয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। পৃথিবীর সব দেশেই
হৃদরোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। পৃথিবীতে প্রতি বছর যত রোগী মারা যায় তাদের শতকরা
৩১% হলো হৃদরোগী। হৃৎপিন্ডের সঠিক শব্দ শুনেই হৃদরোগের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব।
ডিজিটাল স্টেথোস্কোপ শব্দকে ইলেকট্রনিক সিগনালে রূপান্তর ঘটায়। তারপর সেই
ইলেকট্রনিক সিগনালকে যেভাবে খুশি সেভাবে প্রসেস করা যায়। সেই সিগনাল কম্পিউটারে
ট্রান্সফার করে রোগীর ফাইলে সংযুক্ত করা যায়। কোন ধরনের নয়েজ থাকলে তা ডিজিটাল
সিগনাল প্রসেসিং-এর মাধ্যমে বাদ দেয়া যায়।
ডিজিটাল স্টেথোস্কোপ |
ডিজিটাল স্টেথোস্কোপের চেস্ট পিসে
ডায়াফ্রাম ও বেলের সাথে সংযুক্ত থাকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মডিউল: ডাটা একুইজিশান বা তথ্য সংগ্রহ,
প্রি-প্রসেসিং এবং সিগনাল প্রসেসিং। ডাটা একুইজিশানের জন্য ছোট্ট মাইক্রোফোন এবং
সেন্সর ব্যবহার করা হয়। এরা শব্দ সংগ্রহ করে তা ডিজিটাল সিগনালে পরিবর্তন করে
প্রি-প্রসেসিং মডিউলে পাঠায়। প্রি-প্রসেসিং মডিউলে সিগনালে যদি কোন নয়েজ বা
অবাঞ্ছিত অংশ থাকে তা বের করে নেয়। তারপর সেই বিশুদ্ধ সিগনালকে পাঠানো হয় প্রসেসিং
মডিউলে। ব্লু-টুথ বা ওয়াই-ফাই এর মাধ্যমে এই সিগনাল পাঠানো যায়। সেখান থেকে সাউন্ড
ফাইল আকারে তা রেকর্ড করা হয়। ডাক্তার সেই ফাইল শুনে রোগ-নির্ণয় করতে পারেন।
সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য একই ফাইল বারবার শুনতে পারেন বা অনেকে মিলে শুনতে পারেন।
ভবিষ্যতে রোগনির্ণয়ে ডিজিটাল স্টেথোস্কোপ ব্যাপক ভূমিকা রাখবে তাতে কোন সন্দেহ
নেই।
___________
বিজ্ঞানচিন্তা জুন ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত
*** ডাক্তারের ছবিটি নেয়া হয়েছে https://www.publicdomainpictures.net/ থেকে। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স এর আওতায় এই ছবি কপিরাইটমুক্ত।
No comments:
Post a Comment