হিলিয়াম একটি
আশ্চর্য গ্যাস। স্বভাবে খুবই নিষ্ক্রিয় – পারতপক্ষে কোন ধরনের মিথষ্ক্রিয়ার প্রতি কোন
আগ্রহ দেখায় না। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এটি নিরীহ নিষ্ক্রিয় গ্যাস। ঠান্ডা করতে করতে
এর তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে আরো ২৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নামিয়ে ফেলতে পারলে
এই গ্যাস তরল হয়ে যায়। তরল হিলিয়ামের তাপমাত্রা মাইনাস ২৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তরল হিলিয়াম
অনেক দরকারি কাজে লাগে – যা আমরা সাধারণত খেয়ালই করি না। এই যে এম-আর-আই মেশিন দিয়ে
রোগীর শরীরের ভেতরের ছবি দেখা হয় রোগনির্ণয় করার জন্য, সেই এম-আর-আই মেশিনের মূল কাজ
হয় শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের দ্বারা। এই ধরনের সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেটকে খুব ঠান্ডা
করে না রাখলে ভালো ফল পাওয়া যায় না। তরল হিলিয়াম এই কাজটি করে, অর্থাৎ এম-আর-আই মেশিনের
সুপারম্যাগনেটকে ঠান্ডা রাখে। আরেকটু ঠান্ডা করলে হিলিয়াম সুপারলিকুইড হয়ে যায়। সুপারলিকুইড
বা অতিতরল পদার্থের এমন একটা অবস্থা – যে অবস্থায় কোন ধরনের ফ্রিকশান ফোর্স বা ঘর্ষণ
বল কাজ করে না। অর্থাৎ তরলের আণবিক গতিতে কোন ধরনের বাধাই থাকে না। ফলে অতিতরলের কোন
ভিস্কোসিটি বা সান্দ্রতাও থাকে না। কোন গ্লাসে এই অতিতরল রাখলে – এই তরল নিজে নিজে
গ্লাসের ভেতর থেকে বের হয়ে আসবে। হিলিয়ামের যে এই অতিতরল হবার ক্ষমতা আছে তা আবিষ্কার
করেছিলেন রাশিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী পিয়ৎর কাপিৎজা। এই আবিষ্কার এবং নিম্ন-তাপমাত্রায়
পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য ১৯৭৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন কাপিৎজা।
পিয়ৎর কাপিৎজা’র
জন্ম ১৮৯৪ সালের ৮ জুলাই রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের কাছে ক্রোনস্টাডে। তাঁর বাবা
কর্নেল লিওনিড পেট্রোভিচ কাপিৎজা ছিলেন রাশিয়ান মিলিটারির ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর মা ওলগা
ইয়েরনিমোভনা ছিলেন রাশিয়ার বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক।
পিয়ৎর পেট্রোগার্ড
পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ১৯১৯ সালে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর সেখানেই
লেকচারার হিসেবে কাজ করেন ১৯২১ সাল পর্যন্ত। বিয়ে করে ঘরসংসারও শুরু করেছিলেন তিনি।
কিন্তু সেই সময় রাশিয়াতে বিপ্লব সংঘটিত হয়। বিপ্লবের অস্থির সময়ে তিনি তাঁর স্ত্রী
ও শিশুসন্তানের মৃত্যু হয়।
প্রচন্ড মন
খারাপ করে তিনি রাশিয়া থেকে চলে আসেন ইংল্যান্ডে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে এসে নোবেলবিজয়ী
বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের গবেষণা-সহকারি হিসেবে ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে কাজ শুরু
করেন। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের গবেষণা শুরু করেন তিনি। ১৯২৩ সালে তিনি পিএইচডি ড্রিগ্রি
পান। এর মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই তিনি ইংল্যান্ডের একজন প্রথম সারির পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে
রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পেয়ে যান ১৯২৯ সালে।
ক্যাভেন্ডিস
ল্যাবের ম্যাগনেটিক রিসার্চের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর মনোনীত হন তিনি। এই সময় তিনি
বৃহৎ স্কেলে হিলিয়াম তরল করার সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তরল হিলিয়ামের বিভিন্ন অজানা
ধর্ম আবিষ্কার করেন তিনি। ১৯৩০ সালে কেমব্রিজের রয়েল সোসাইটি মন্ড ল্যাবের ডিরেক্টর
মনোনীত হন তিনি। এই ল্যাবরেটরিটি তাঁর কাজের জন্যই তৈরি করা হয়েছিল রয়েল সোসাইটির টাকায়।
কাজ শুরু করার
আগে তাঁর আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করে আসার জন্য রাশিয়ায় গেলেন কাপিৎজা।
ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের পরাশক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। স্ট্যালিন তখন
সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তা। কাপিৎজা ইংল্যান্ডে এত ভালো গবেষণা করছেন সেই খবর সোভিয়েত
বিজ্ঞানীদের কাছে আছে। স্ট্যালিনের নির্দেশে কাপিৎজাকে সোভিয়েত ইউনিয়নে বন্দী করা হলো।
বাধ্য করা হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করতে। তাঁর জন্য উপযুক্ত কাজের
ব্যবস্থা করা হলো।
সোভিয়েত একাডেমি
অব সায়েন্সের অধীনে ইন্সটিটিউট অব ফিজিক্যাল প্রোবলেম-এর ডিরেক্টর পদে বসানো হলো কাপিৎজাকে।
ইংল্যান্ডে তাঁর ল্যাবের সব যন্ত্রপাতি মস্কোতে নিয়ে আসা হলো।
এই ইন্সটিটিউটেই
কাজ শুরু করলেন তিনি। এখানেই তিনি আবিষ্কার করলেন হিলিয়াম-৪ এর অতিতারল্য। মূলত এই
কাজের জন্যই তিনি ১৯৭৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সময় কাপিৎজা অক্সিজেন সম্পর্কিত গবেষণা শুরু করেন। কম সময়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে তরল
অক্সিজেন তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তিনি। যুদ্ধের সময় এই তরল অক্সিজেন সোভিয়েত ইউনিয়নের
অস্ত্র তৈরির কারখানায় ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়।
নিউক্লিয়ার
ফিজিক্সে গভীর দক্ষতা ছিল কাপিৎজার। সেই সময় নিউক্লিয়ার ফিশান আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। গোপনে
নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে আমেরিকানরা। জার্মানরা বোমা তৈরি করে ফেলেছে
এরকম একটা গুজব সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচারিত হয়ে গেছে। সোভিয়েত অধিপতি স্ট্যালিন কাপিৎজাকে
আদেশ দিলেন নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করার জন্য। কাপিৎজা জানতেন নিউক্লিয়ার বোমা কতটা ভয়ংকর
হতে পারে। বোমা তৈরির ব্যাপারে তিনি সরাসরি অস্বীকৃতি জানালেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নে
নেতার আদেশ অমান্য করা আর মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা সমান কথা। কিন্তু কাপিৎজাকে মেরে ফেলা
হলো না। তাঁকে ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে গৃহবন্দী করা হলো। ১৯৪৬ থেকে
১৯৫৫ পর্যন্ত গৃহবন্দী ছিলেন কাপিৎজা। ১৯৫৫ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর কাপিৎজা মুক্তি
পান এবং তাঁর ডিরেক্টরশিপও ফেরৎ পান। আমৃত্যু তিনি সোভিয়েত ইন্সটিটিউট অব ফিজিক্যাল
প্রোবলেম-এর ডিরেক্টর ছিলেন।
১৯২৭ সালে কাপিৎজা
বিয়ে করেছিলেন আলেকসিভ্না ক্রাইলোভাকে। তাঁদের দুই ছেলে সার্গেই এবং আন্দ্রেই।
১৯৫৫ সালে গৃহবন্দী
অবস্থা থেকে মুক্তি পেলেও ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে অন্য কোন দেশে
যাবার অনুমতি পাননি। ১৯৬৫ সালে তিনি ডেনিশ ইঞ্জিনিয়ারিং সোসাইটি তাঁকে নিলস বোর মেডেল
দিলে সেটা গ্রহণ করার জন্য ডেনমার্কে যাওয়ার বিশেষ অনুমতি দেয়া হয় তাঁকে। পরের বছর
ইংল্যান্ডের ইন্সটিটিউট অব ফিজিক্স তাঁকে রাদারফোর্ড মেডেল দিলে দীর্ঘ ৩২ বছর পর তিনি
ইংল্যান্ডে যাবার সুযোগ পান। তারপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বৈজ্ঞানিক ভ্রমণ করার ব্যাপারে
বাধা না থাকলেও প্রতিবারই প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য তাঁকে অনুমতি নিতে হতো সোভিয়েত সরকারের।
১৯৭৮ সালে তিনি নোবেল পুরষ্কার পান আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসনের সাথে। পেনজিয়াস
ও উইলসনের কাজের সাথে তাঁর কাজের কোন মিল ছিল না। পেনজিয়াস ও উইলসনকে নোবেল পুরষ্কারের
অর্ধেক টাকা দেয়া হয়েছে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশান আবিষ্কারের জন্য।
আর বাকি অর্ধেক দেয়া হয়েছে কাপিৎজাকে অতি-নিম্ন তাপমাত্রার হিলিয়ামের ধর্ম আবিষ্কারের
জন্য।
১৯৮৪ সালের
৮ এপ্রিল ৯০ বছর বয়সে মারা যান পিয়ৎর কাপিৎজা।
তথ্যসূত্র
·
Biographical
Encyclopedia of Scientists, Vol 4, World Book Inc, Chicago, 2003
·
Ioan
James, Remarkable Physicists from Galileo to Yukawa, Cambridge University
Press, Uk 2004.
No comments:
Post a Comment