রান্না করার মাধ্যম হিসেবে মাইক্রোওয়েভ ওভেনের জনপ্রিয়তা দিনে দিনে বাড়ছে। বিমান, জাহাজ, কিংবা ট্রেনের কিচেন, বড় বড় রেস্টুরেন্ট তো বটেই - এখনকার যে কোন আধুনিক রান্নাঘরেও জায়গা করে নিয়েছে মাইক্রোওয়েভ ওভেন। প্রতিবছর প্রায় তিন কোটি নতুন মাইক্রোওয়েভ ওভেন বিক্রি হয় পৃথিবীজুড়ে মানুষের খাবার রান্না করার জন্য। অথচ যে মানুষটি এই মাইক্রোওয়েভ ওভেন উদ্ভাবন করেছিলেন - সেই পারসি স্পেনসারের ছোটবেলায় খাবার জুটতো না। মা-বাবা আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না তাঁর। এতিমখানায় কেটেছে শৈশব। তাঁর কথায় আসার আগে মাইক্রোওভেন সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলে নেয়া যাক।
মাত্র কয়েক মিনিটেই রান্না হয়ে যায় মাইক্রোওভেনে। রান্না করা খাবার গরম করতে সময় লাগে মাত্র কয়েক সেকেন্ড। এই ওভেনে আগুন জ্বালাতে হয় না, গ্যাস লাগে না, এমনকি খাবার বা পানীয় গরম হলেও মাইক্রোওয়েভ ওভেনটি গরম হয় না। স্বাভাবিক ভোল্টেজের বিদ্যুৎ সরবরাহ ছাড়া আর কিছুই লাগে না এই ওভেনের। তাহলে রান্না করার মূল যে তাপশক্তি - সেটা আসছে কোত্থেকে? সেটা আসছে মাইক্রোওয়েভ থেকে। মাইক্রোওয়েভ হলো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বা তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের অংশ। টেলিভিশন সম্প্রচার, র্যাডার (RaDaR - Radio Detection and Ranging) যোগাযোগ, মোবাইল ফোন ইত্যাদি সব আধুনিক প্রযুক্তির যোগাযোগে মাধ্যম হিসেবে যে তরঙ্গ ব্যবহার করা হয় সেটা হলো মাইক্রোওয়েভ। একটু অবাক হবার মতো লাগছে না ব্যাপারটা? কোথায় মোবাইল ফোন, র্যাডার, কিংবা টেলিভিশন, আর কোথায় রান্না করার মেশিন।
আসলে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের ব্যাপারটাই অবাক হওয়ার মতো। মহাবিশ্বের নক্ষত্রগুলো থেকে যে শক্তি বেরিয়ে আসে তা তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ আকারে আসে। তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ প্রবাহের জন্য কোন মাধ্যমের দরকার হয় না। এই তরঙ্গের বর্ণালীর খুব ছোট একটা অংশ আমরা দেখতে পাই - সেটা হলো আলো। দৃশ্যমান আলোর বাইরে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের বিশাল বিস্তৃতির কোন অংশই আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না।
অনেক লম্বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বেতার তরঙ্গ থেকে শুরু করে অনেক ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এক্স-রে কিংবা গামা-রে পর্যন্ত তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের বিস্তৃতি। তরঙ্গের শক্তি ও তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যের সম্পর্ক পরস্পর বিপরীতানুপাতিক। অর্থাৎ একটির মান বাড়লে অন্যটির মান কমে যায়। তরঙ্গদৈর্ঘ্য আর কম্পাঙ্কও একে অপরের বিপ্রতীপ। অর্থাৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি হলে কম্পাঙ্ক কম হয় এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হলে কম্পাঙ্ক বেশি হয়। যে তরঙ্গের কম্পাঙ্ক যত বেশি তাদের শক্তিও তত বেশি। দৃশ্যমান আলোর কম্পাঙ্কের চেয়ে বেশি কম্পাঙ্কের তরঙ্গ এত বেশি শক্তিশালী যে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এদের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। এক্স-রে, গামা-রে ইত্যাদি খুবই উচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ। বেতার তরঙ্গ দৃশ্যমান আলোর চেয়ে অনেক কম শক্তিশালী এবং এদের কম্পাঙ্কও অনেক কম। তাই এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বড়। বেতার তরঙ্গ জ্যোতির্বিদ্যায় খুব কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়। কারণ দৃশ্যমান আলো যেখানে মেঘ বা ধূলিকণা ভেদ করে যেতে পারে না সেখানে বেতার তরঙ্গ সহজেই সবকিছু ভেদ করে চলে যেতে পারে। রেডিও, টেলিভিশন, র্যাডার, মোবাইল ফোন ইত্যাদি প্রযুক্তিতে সিগনাল পাঠানোর মাধ্যম হলো বেতার তরঙ্গ। ৩০০ মেগাহার্টজ থেকে ৩০০ গিগাহার্টজ পর্যন্ত কম্পাঙ্গের বেতার তরঙ্গকে মাইক্রোওয়েভ বলা হয়। এদের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য ১ মিটার থেকে ১ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
বেতার তরঙ্গ কাজে লাগিয়ে র্যাডার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট ওয়াটসন-ওয়াট ১৯৩৫ সালে - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছে খবর আসে যে জার্মানির নাৎসি বিজ্ঞানীরা বেতার তরঙ্গ থেকে এমন মারণ-রশ্মি বা ডেথ-রে তৈরি করেছে যেগুলো দিয়ে যে কোন বিমান ভূ-পাতিত করে ফেলা যায়। ব্রিটিশ মিলিটারিরা খুব ভয় পেয়ে গেলো। তাদের এয়ার ডিফেন্স সায়েন্টিফিক কমিটির চেয়ারম্যান দেখা করলেন ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির প্রধান বিজ্ঞানী রবার্ট ওয়াটসন-ওয়াটের সাথে। জিজ্ঞেস করলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের পক্ষে ডেথ-রে তৈরি করা সম্ভব কি না। পুরো ব্যাপারটা শুনে বিজ্ঞানী ওয়াটসন-ওয়াট বুঝতে পারলেন যে যুদ্ধকালীন সময়ে বিপক্ষের মনোবল কমিয়ে দেয়ার জন্য অনেক রকমের গুজব তৈরি করা হয়। ডেথ-রে'র ব্যাপারটাও সায়েন্স ফিকশান থেকে ধার করা একটা অসম্ভব ধারণা। কারণ বেতার তরঙ্গ থেকে বিমান বিধ্বস্ত করার মত শক্তি তৈরি করা সম্ভব নয়। তার মানে জার্মানরা ডেথ-রে তৈরি করেনি। বিজ্ঞানী ওয়াটসন-ওয়াট গবেষণা করে দেখলেন যে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে শত্রুপক্ষের বিমানের গতিপথ শনাক্ত করা সম্ভব।
বেতার তরঙ্গ তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের অংশ। শূন্য মাধ্যমে এর গতিবেগ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। বায়ুমন্ডলে এই গতিবেগ কিছুটা কমে গেলেও তা সবচেয়ে গতিশীল বিমানের চেয়েও অনেক বেশি গতিশীল। বেতার তরঙ্গ ধাতব পদার্থের ভেতর দিয়ে যেতে পারে না। ধাতব পদার্থের গায়ে লেগে তা ফিরে আসে বা প্রতিফলিত হয়। কিন্তু অধাতব পদার্থ যেমন কাচ বা প্লাস্টিকের ভেতর দিয়ে সহজে চলে যেতে পারে। কিন্তু যাবার সময় তার শক্তির কিছুটা শোষিত হয়ে যায়। কী পরিমাণ শক্তি শোষিত হবে তা কোন্ পদার্থের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তার উপর নির্ভর করে। কোন উৎস থেকে বেতার তরঙ্গ পাঠালে তা যদি কোন বিমানের গায়ে লেগে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে, তবে যেতে আসতে যে সময় নেবে সেই সময়ের হিসেব এবং বেতার তরঙ্গের গতির হিসেব থেকে বিমানটির দূরত্ব এবং কী বেগে অগ্রসর হচ্ছে তা জানা সম্ভব। ব্রিটিশরা এই প্রযুক্তির নাম দিয়েছিল Radio Direction Finding বা RDF। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা ব্রিটিশদের মিত্রপক্ষ হিসেবে আমেরিকান মিলিটারিরাও এই প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে। আমেরিকানরা এর নাম দেয় Radio Detection and Ranging বা RADAR।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেকগুলো র্যাডার স্টেশন স্থাপন করা হয়েছিল। র্যাডারের জন্য যে মাইক্রোওয়েভ লাগে তা তৈরি করা হচ্ছিল মাল্টি ক্যাভিটি-ম্যাগনেট্রন থেকে। এই মাল্টি ক্যাভিটি-ম্যাগনেট্রন উদ্ভাবন করেছিলেন সোভিয়েত পদার্থবিজ্ঞানী আলেক্সেরেভ এবং মালিয়ারফ র্যাডার উদ্ভাবনের পরের বছর ১৯৩৬ সালে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সাবমেরিনের পেরিস্কোপ কোথায় আছে খুঁজে বের করার জন্য আমেরিকান নৌবাহিনীর র্যাডার টেকনিশিয়ান টিমে কাজ করছিলেন পারসি স্পেনসার। একদিন র্যাডারের ম্যাগনেট্রন নিয়ে কাজ করার সময় হঠাৎ খেয়াল করে দেখলেন যে তাঁর পকেটে রাখা চকলেট গলতে শুরু করেছে। অথচ রুমের তাপমাত্রা খুব কম। তাহলে কি মাইক্রোওয়েভ থেকে তাপ তৈরি হচ্ছে! ম্যাগনেট্রনের সামনে ভুট্টার প্যাকেট রাখার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভুট্টার খই ফুটতে শুরু করলো। একটা ডিম রাখার পর দেখা গেলো ডিমটা বোমার মত বিস্ফোরিত হয়ে গেলো। তার মানে মাইক্রোওয়েভ দিয়ে রান্না করা সম্ভব। মাইক্রোওয়েভ ওভেনের পরিকল্পনা মাথায় এলো পারসি স্পেনসারের।
স্পেনসারের শৈশব কেটেছে অনাহারে অর্ধাহারে আমেরিকার মেইন রাজ্যের একটি এতিমখানায়। লেখাপড়া তেমন কিছুই করতে পারেননি। ১২ বছর বয়সে কাজ নিতে হয়েছে একটি কারখানায়। কয়েক বছর পর যোগ দিলেন আমেরিকান নৌবাহিনীতে। সেখানে তিনি ওয়ার্কশপে টেকনিক্যাল কিছু কাজ শেখার সুযোগ পান। সেখান থেকে তিনি টেকনিশিয়ান হিসেবে যোগ দেন আমেরিকান ডিফেন্সের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও ইলেকট্রনিক্স তৈরির প্রধান কোম্পানি রেথিয়নে। রেথিয়ন কোম্পানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর জন্য র্যাডার স্থাপন করেছে। মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ধারণা ও পরিকল্পনা পারসি স্পেনসারের। কিন্তু তিনি যেহেতু রেথিয়ন কোম্পানির সামান্য কর্মচারি, ১৯৪৫ সালে মাইক্রোওয়েভ ওভেন উদ্ভাবনের প্যাটেন্ট পেলো রেথিয়ন কোম্পানি। ১৯৪৭ সালে পৃথিবীর প্রথম মাইক্রোওয়েভ ওভেন বাজারে এলো - যার উচ্চতা ছিল সাড়ে পাঁচ ফুট, আর ওজন ৩৪০ কেজি; নাম ছিল র্যাডারেঞ্জ। ৩০০০ ওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ লাগতো এর জন্য।
মাইক্রোওয়েভ ওভেন তাপ উৎপন্ন করে কীভাবে? মূলত ধাতব বাক্সের ভেতর থাকে ম্যাগনেট্রন। সেখান থেকে মাইক্রোওয়েভ উৎপন্ন হয়। সেই মাইক্রোওয়েভ কাচ, কাগজ, প্লাস্টিক, চিনামাটি ইত্যাদি সহজে ভেদ করে যায়। খাবারের মধ্যে যে পানি থাকে সেই পানির অণুগুলো মাইক্রোওয়েভ শোষণ করে মাইক্রোওয়েভের কম্পাঙ্ক সমান কম্পাঙ্কে কাঁপতে শুরু করে। ওভেনে ব্যবহৃত মাইক্রোওয়েভের কম্পাঙ্ক ২.৪৫ গিগাহার্টজ পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ পানির অণুগুলো সেকেন্ডে ২৪৫ কোটি বার কাঁপে। একটা অণু যখন কাঁপে তখন তার ঘর্ষণে চারপাশের অণুগুলোও কাঁপতে থাকে এবং শক্তি একটি থেকে অন্যটিতে ছড়িয়ে যায়। এভাবেই একটি অণুর সাথে অন্য অণুর প্রচন্ড ঘর্ষণের ফলে প্রচন্ড তাপের উৎপত্তি হয়। যদি খাবারের মধ্যে কোন পানির অণু না থাকে - তাহলে মাইক্রোওভেন তা সহজে গরম করতে পারে না।
গত ৭২ বছরে অনেক উন্নত হয়েছে মাইক্রোওয়েভ ওভেন। একদিকে এর শক্তি বেড়েছে, ব্যবহার বেড়েছে, অন্যদিকে এর আয়তন কমেছে, ওজন কমেছে, দামও কমেছে। ২০১১ সালে অতিক্ষুদ্র আকারের মাইক্রোওভেন মঙ্গল গ্রহে পাঠানো হয়েছে কিউরিসিটি মিশনে - যেখানে মঙ্গল গ্রহের মাটির নমুনা প্রায় ১০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত উত্তপ্ত করে তার বর্ণালী বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে সেখানে আসলে কী কী আছে।
No comments:
Post a Comment