স্বপ্নলোকের চাবি – ৩৩
ভি-আই-পি মুভমেন্টের দোহাই দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তা আটকে রাখার পর হঠাৎ খুলে দিলে বাস-ট্রাক-টেক্সি-রিক্সা সব যেরকম একসাথে ছুটতে গিয়ে প্রচন্ড জ্যাম লাগিয়ে দেয় -রমজানের ছুটি শেষে ইউনিভার্সিটি খোলার পর আমাদের অবস্থাও হলো সেরকম।
সেকেন্ড ইয়ারের চারটি সাবসিডিয়ারি পরীক্ষার সবগুলি একটার পর একটা হয়ে গেল। সাবসিডিয়ারি বিষয়ের কোন নম্বর অনার্সের নম্বরের সাথে যোগ হয় না বলে এই বিষয়গুলিকে আমি খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু পরীক্ষা দিতে গিয়ে মনে হলো টিচাররাও খুব একটা গুরুত্ব দেন না এসব বিষয়ের প্রতি।
গণিতের থার্ড পেপার পরীক্ষায় বারোটি প্রশ্ন থেকে আমাদের ছয়টি প্রশ্নের উত্তর লেখার কথা। কিন্তু দেখা গেলো প্রশ্নে ছাপানো আছে ‘Answer any THREE questions.’
পরীক্ষা হচ্ছিলো সায়েন্স ফ্যাকাল্টির চার তলায় পরিসংখ্যানের বড় লেকচার রুমে। পরিসংখ্যানের লস্করস্যার আমাদের পাহারা দিচ্ছিলেন। তিন ঘন্টায় মাত্র তিনটি প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে? অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য লস্করস্যারকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, “যতটা ইচ্ছা ততটা প্রশ্নের উত্তর দাও, কিন্তু কোন লাভ নেই। পাবে তো শূন্য।“
আমি যে শূন্য পাবো সে ব্যাপারে লস্করস্যার কী করে এত নিশ্চিত হলেন জানি না। হতাশ হয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বসে পড়ছি দেখে স্যার বললেন, “পরীক্ষার ফুলমার্কস দেখো – তিনটা শূন্য।“
তাই তো, প্রশ্নে ছাপানো হয়েছে “Full Marks – 000” । এতক্ষণ আমার চোখে পড়েনি। পরিসংখ্যানবিদরা শকুনের চোখ দিয়ে সংখ্যা দেখেন – কথাটা তাহলে মিথ্যা নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে ছাপানো প্রশ্নে এরকম ভুল কীভাবে হতে পারে? কিন্তু স্যারদের দেখে মনে হচ্ছে এতে কারো কিছু যায় আসে না।
পরিসংখ্যানের দুটো তত্ত্বীয় পরীক্ষার পর আবার দু’দিন প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা। সুলতান আহমদস্যার আমাদের পরিসংখ্যান প্র্যাকটিক্যাল করিয়েছিলেন অনেকগুলি। দুপুর দুটো থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত একটানা। তিনি ক্যালকুলেটারকে বলতেন ‘মেশিন’। ‘তোমাদের মেশিন বের করো’ – বললেই আমাদের হাসি পেতো – কিন্তু হাসা সম্ভব ছিল না। সুলতান আহমদ স্যার খুবই রাগী টাইপের স্যার। টি-টেস্ট, কাই-স্কোয়ার টেস্ট ইত্যাদি অনেক ধরনের গাণিতিক টেস্ট তিনি আমাদের করিয়েছিলেন। দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়ার কারণে এগুলিকে আমার খুব বিরক্তিকর লাগতো।
পরীক্ষা হয়ে যাবার পর মনে হলো হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচলাম। প্র্যাকটিক্যালের ভাইভা নিতে এসেছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের শাহাদাত স্যার। মণীন্দ্রস্যারের রুমে ভাইভা হলো। যে প্রশ্নগুলি করা হলো – বেশিরভাগ প্রশ্নেরই উওর আমার জানা ছিল। কিন্তু ঠিকমতো উত্তর দিতে পারলাম না। ভাইভা দিতে গেলে এই সমস্যা আমার সবসময় হয়।
এর মধ্যেই থার্ড ইয়ারের আটটি পেপারের সবগুলি ক্লাস চলতে শুরু করলো। এতগুলি পেপারের ভেতর কোন কোন পেপার আবার একাধিক শিক্ষক মিলে পড়াচ্ছেন।
ইলেকট্রনিক্সে আহমদ হোসেনস্যার সার্কিট আর ইলেকট্রন টিউব শেষ করার পর সেমিকন্ডাক্টর পড়াতে এলেন শংকরস্যার। লম্বা-পাতলা শংকরলাল সাহাস্যারকে ভর্তি হবার পর থেকেই ডিপার্টমেন্টে দেখছি। কিন্তু তিনি এতদিন ছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মানুষ। ১৯৮৮তে ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছেন শিক্ষক হিসেবে। ইলেকট্রনিক্সে অগাধ জ্ঞান তাঁর তা তাঁর পড়ানোর পদ্ধতি থেকেই বোঝা যায়। খুবই চমৎকার পড়ান তিনি। কিন্তু সেমিকন্ডাক্টর ফিজিক্সের সাথে যে অ্যাটমিক ব্যান্ড থিওরি জড়িত – সেই থিওরি ঠিকমতো পড়িনি বলে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে আমার। কিন্তু যীশু বেশ ভালোভাবেই বুঝে যাচ্ছে সবকিছু। শংকরস্যার বোল্টনের বইয়ের কথা বললে – যীশু উৎসাহ ধরে রাখতে না পেরে ক্লাসের মধ্যেই চেঁচিয়ে উঠলো – “স্যার বইটি আমার আছে। সবগুলি ভল্যুম আছে।“ যীশু শংকরস্যারের প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠলো, আর আমরা যীশুকে ইলেকট্রনিক্সের গুরু মানতে শুরু করলাম।
ফার্স্ট ইয়ার বা সেকেন্ড ইয়ারে আমরা হামিদা বানু ম্যাডামের কোন ক্লাস পাইনি। এবার সামান্য একটু সুযোগ হলো তাঁর ক্লাস করার। সলিড স্টেট ফিজিক্সের কয়েকটা ক্লাস নিলেন হামিদা বানু ম্যাডাম। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ আরো হাজার রকমের কমিটি এবং অন্যান্য কাজে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন তিনি। তাই তাঁর ক্লাস নিয়মিত হয় না। কিন্তু যেদিন তিনি ক্লাস নিতে আসেন – সেদিন খুব চমৎকারভাবে পড়ান।
একদিন নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের ক্লাস নিতে এলেন আমাদের নতুন ম্যাডাম শাহীন ম্যাডাম। শাহীন ম্যাডাম খুবই হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষ। সদ্য পাস করে জয়েন করেছেন বলেই হয়তো এখনো এত হাসিখুশি আছেন। ডিপার্টমেন্টের আর কোন স্যার-ম্যাডামকে ক্লাসে খুব একটা হাসতে দেখা যায় না। শাহীন ম্যাডামের ক্লাসটা খুব ভালো লেগেছিল। কিন্তু তিনি একটা ক্লাসের পর আর আসেননি আমাদের ক্লাসে। কী জানি - হয়তো উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে চলে গেছেন।
থার্ড ইয়ারে একশ নম্বরের প্র্যাকটিক্যাল আছে। পুরো দুইটি থিওরি পেপারের সমান নম্বর প্র্যাকটিক্যালে। দুই দিন ধরে ছয় ঘন্টা করে মোট বারো ঘন্টার প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিতে হবে। তাই ক্লাস ফাঁকি দিলেও প্র্যাকটিক্যালে ফাঁকি খুব একটা কেউ দিচ্ছে না।
থার্ড ইয়ারের প্র্যাকটিক্যাল রুমের ভেতর ছোট ছোট আরো কিছু রুম আছে। লাইটের পরীক্ষার জন্য আছে ডার্করুম। যথারীতি আমরা সেকেন্ড ইয়ারের মতোই প্র্যাকটিক্যাল গ্রুপ তৈরি করলাম। কিন্তু থার্ড ইয়ারে যন্ত্রপাতির পরিমাণ কিছুটা কম বলে প্র্যাকটিক্যাল গ্রুপের সাইজ কিছুটা বড় করতে হলো। আমাদের গ্রুপের নতুন সদস্য হলেন জ্ঞানদা।
যীশুর মুখে প্রথমদিন ‘জ্ঞানদা’ শুনে মনে করেছিলাম হলুদ রঙের ঢোলা হাফশার্ট আর ভারী পুরু চশমার এই বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোকের নাম জ্ঞানদারঞ্জন বা জ্ঞানদাচরণ এরকম কিছু একটা হবে। ঠাকুরবাড়ির পর এই নাম এই যুগেও যে কেউ কেউ রাখে তা দেখে কিছুটা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়েছিলাম তার দিকে। কিন্তু অচিরেই জানতে পারলাম তার প্রকৃত নাম জ্ঞানদা নয়। যখন তখন জ্ঞান দেন বলেই তার নাম রাখা হয়েছে জ্ঞানদা। তার আসল নাম যে কী – তা গ্রুপের কেউ বলতে পারলো না। আর জ্ঞানদাকে জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। তিনি জ্ঞানদা হয়েই রইলেন আমাদের কাছে। এবং মজার ব্যাপার হলো তাঁকে জ্ঞানদা বলে ডাকলে তিনি গম্ভীরভাবে সাড়াও দেন।
জ্ঞানদা আমাদের কত বছরের সিনিয়র ঠিক জানি না। এমনও হতে পারে যে তাঁর ব্যাচের কেউ কেউ আমাদের শিক্ষকও হয়ে গেছেন। এরকম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। শিবিরের কয়েকজন উঁচু পর্যায়ের নেতা এবার থার্ড ইয়ারে এসেছেন – যাদের আগে কখনো দেখিনি। ক্লাসরুমের বাইরে গম্ভীরভাবে হাঁটতে দেখলে তাদেরকেও শিক্ষক বলে মনে হতে পারে।
জ্ঞানদার জ্ঞান দেবার ঠেলায় প্র্যাকটিক্যাল করা প্রায় লাটে ওঠার অবস্থা আমাদের। লাইটের প্র্যাকটিক্যালে স্পেকট্রোমিটারের সাহায্যে তরল পদার্থের রিফ্রাক্টিভ ইনডেক্স বের করা খুব ঝামেলার ব্যাপার। ডার্করুমের লাইট অফ না করলে স্পেকট্রোমিটারের ভেতর দিয়ে বর্নালীর তেমন কিছুই দেখা যায় না। জ্ঞানদা একটু পরপর লাইট অন করে দেন। বলেন, “বেশিক্ষণ অন্ধকারে বর্ণালী দেখলে চোখের ক্ষতি হয়।“ এরপর আমরা কীভাবে দেখি, চোখের রড এবং কোন্ কোষ কীভাবে কাজ করে ইত্যাদি সম্পর্কে দীর্ঘ লেকচার দিতে শুরু করেন।
তাঁর চোখের চশমার পাওয়ার অনেক। নিজের চোখের কথাই হয়তো বলছেন। কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল করতে না পারলে তো পাস করতে পারব না। সিনিয়র বলে কিছুটা ভদ্রতাও দেখাতে হচ্ছে।
প্র্যাকটিক্যালে আমাদের সর্দার হলো যীশু। ইন্সট্রুমেন্ট সেট করে ‘ওকে’ বলার দায়িত্ব তার। এরপর আমরা রিডিং নিই। কিন্তু জ্ঞানদার কারণে যীশু ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না।
সাইদ সুমন খুব ভদ্রলোক। বিরক্তি চেপে রাখতে পারে। কিন্তু আহসান হাবীব দীপক আর অর্পণ দাসের পক্ষে ভদ্রতা রক্ষা করা খুব একটা সম্ভব হয় না। জ্ঞানদার উপর রেগে যায় তারা। কিন্তু তাতেও জ্ঞানদা দমেন না। জ্ঞান দিতে দিতে স্পেকট্রোমিটারের সামনে রাখা প্রিজমটি হাতে তুলে নিয়ে বলতে শুরু করেন নিউটন কীভাবে এই প্রিজমের সাহায্যে আলোর বর্ণালী দেখেছিলেন সেই অনেক বছর আগে। আমরা জ্ঞানদার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকি।
কেশবতী কন্যা বললে যেমন চুল সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় – সেরকম জ্ঞানদার হাতকে বলা যায় কেশবান হস্ত। জ্ঞানদার কেশবান হস্তের পীড়ন থেকে প্রিজম উদ্ধারের উপায় খোঁজার চেষ্টা করতেই আমাদের সময় চলে যায়, প্র্যাকটিক্যাল করা আর হয় না সেদিন।
থার্ড ইয়ারের প্র্যাকটিক্যাল করানোর জন্য বা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য কোন স্যার আসেন না। সবগুলি প্র্যাকটিক্যালই অনেকটা ‘এসো নিজে করি’ পদ্ধতিতে করতে হচ্ছে। ইলেকট্রনিক্সের প্র্যাকটিক্যালে সবচেয়ে ঝামেলায় পড়ে গেলাম রেজিস্ট্যান্সের কালার কোডিং পড়তে গিয়ে। একেক রঙের একেক মান। কালো ০, বাদামী ১, লাল ২ এভাবে বিভিন্ন রঙের জন্য বিভিন্ন মান। রেজিস্টরের গায়ে আঁকা বিভিন্ন রঙের দাগ দেখে হিসেব করে বের করতে হয় রেজিস্ট্যান্সের মান। তারপর সঠিক মানের রেজিস্ট্যান্স ব্যবহার করতে হয় সার্কিটে। রেজিস্ট্যান্সের মান ভুল হলে শর্ট-সার্কিট হয়ে সব বরবাদ হয়ে যাবে। এই রঙ গুলির মান মুখস্থ করতে হবে। পরীক্ষার সময় কালার-কোড টেবিল দেখতে দেয়া হবে না। আইনস্টাইন নাকি বলেছিলেন যা কিছু বইতে পাওয়া যায় – তা মুখস্থ করার দরকার নেই, যখন লাগে তখন বই দেখে নিলেই হবে। আমাদের শিক্ষকদের হাতে পড়লে আইনস্টাইনকেও এই কালার-কোড মুখস্থ করতে হতো।
এরকম অনেককিছুই ধারাবাহিকভাবে মুখস্থ করতে হয়েছে আমাদের। উচ্চমাধ্যমিকের প্রাণিবিজ্ঞানে ব্যাঙের মস্তিষ্কের দশটি স্নায়ুতন্ত্রের নাম মুখস্থ করার কৌশল শিখিয়েছিলেন আমাদের শহীদুল্লাহ স্যার। এখনো তা মনে আছে – “On Occasion Of Theatre The Most Attractive Faces Are Greatly Valued” – Olfactory, Optic, Oculomotor, Trochlear, Trigeminal, Abducens, Facial, Auditory, Glossopharyngeal, Vagus.
এখানেও দশটি কালার-কোড মনে রাখার একটা উপায় বের করলাম। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা পড়ার কিছু উপকারিতা তো আছেই। একটা বইতে গাড়ির নম্বর মনে রাখার পদ্ধতি ছিল এরকম: পাতিচান – পাঁচ তিন চার নয়; সাদুপান – সাত দুই পাঁচ নয় ইত্যাদি। এভাবেই একটা লাইন দাঁড় করানো গেলো: BB ROY Good Boy Very Good Wife – Black, Brown, Red, Orange, Yellow, Green, Blue, Violet, Grey, White. সবগুলি রঙ মানের ক্রমানুসারে সাজিয়ে দেয়া হলো। গ্রুপের সবার খুব পছন্দ হলো এটা।
কালার-কোড মনে রাখা এখন আর কোন সমস্যা নয়। কিন্তু আসল সমস্যা দেখা দিল আমার।
রেজিস্ট্যান্সের কালার-কোড দেখতে গিয়ে বুঝতে পারলাম আমি কালার-ব্লাইন্ড। প্রধান রঙগুলি বেশ দূরে দূরে থাকলে আমি চিনতে পারি। কিন্তু যখন লাল দাগের পাশে সবুজ দাগ থাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না কোন্টি লাল আর কোন্টি সবুজ। জাতীয় পতাকার রঙেই সমস্যা হচ্ছে আমার? কিন্তু পতাকা দেখলে তো বুঝতে পারছি কোন্টা লাল, কোন্টা সবুজ। সেটা অনেক বড় বলেই চিনতে পারছি।
ব্রাউন আর গ্রিনের মধ্যেও পার্থক্য বুঝতে পারছি না। অথচ বুঝতে না পারলে মারাত্মক ঝামেলা হতে পারে। ব্রাউনের মান ১, আর গ্রিনের মান ৫। রেজিস্টরে ব্রাউনের পাশে গ্রিন থাকলে রেজিস্ট্যান্স হবে ১০০ কিলোওহম, কিন্তু গ্রিনের পাশে ব্রাউন থাকলে রেজিস্ট্যান্স হবে মাত্র ৫০ ওহম। প্র্যাকটিক্যালের সময় তো বন্ধুরা মান দেখে দিচ্ছে। পরীক্ষার সময় আমার কী অবস্থা হবে?
এধরনের সমস্যা মনে হয় কিছুটা ছোঁয়াচে। এতক্ষণ সবাই বেশ ভালোভাবেই কালার দেখতে পাচ্ছিলো। আমার সমস্যার কথা বলার পর তারাও বর্ণবিভ্রাটে ভুগতে শুরু করলো।
জ্ঞানদার জ্ঞান দান এখনো অব্যাহত আছে। তিনি বললেন, “রঙ চেনার ব্যাপারে মেয়েদের জুড়ি নেই। তাদের সাহায্য লাও।“ লাও তো বটে – কিন্তু সাহায্যপ্রার্থী হয়ে কে যাবে তাদের কাছে?
আমাদের ক্লাসের মেয়েরা আলাদা ল্যাব-গ্রুপ করেছে। এখন মনে হচ্ছে রেজিস্ট্যান্সের কালার-কোড পড়ার জন্য প্রত্যেক গ্রুপে একজন করে মেয়ে থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তাদের বয়েই গেছে আমাদের রঙ পড়ে দেয়ার জন্য।
আশেপাশের কোন টেবিলেই কোন মেয়েকে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত সবাই ডার্করুমে লাইটের এক্সপেরিমেন্ট করছে। প্রদীপনাথকে বললাম – ‘যা রাখীকে ডেকে নিয়ে আয়।‘ যীশু এতক্ষণ গভীর মনযোগ দিয়ে রেডিও ট্রান্সমিটারের সার্কিট ডায়াগ্রাম পর্যবেক্ষণ করছিল। রাখীর নাম শুনে হঠাৎ খরগোশের মতো কান খাড়া করে ফিরে তাকালো। আহা, নামের কী মাহাত্ম্য! কিন্তু যীশুকে হতাশ করে দিয়ে প্রদীপ নাথ বললো, “না, আমি যাবো না। গেলেই রাখী ভাববে টাকা চাইতে গেছি।“
টাকার ব্যাপারটা ঘটেছিল মাস দেড়েক আগে। কোরবানের ছুটিরও আগে। সেদিন যীশু আসেনি – তার বড়ভাইয়ের বিয়ের আয়োজন চলছিল তখন। প্র্যাকটিক্যাল ছিল না। ক্লাস শেষে এক নম্বর গেটে গিয়ে বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হবার সময় রাখীর ডাকে থামলাম। একটা স্ন্যাক্সের দোকানের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছে সে। ইদানীং সে ক্লাস করে দ্রুত বাসায় চলে যায়। বাসায় তার ছোট্ট মেয়েকে রেখে ক্লাস করতে আসতে হয় তাকে। ক্লাসের পরেই যথাসম্ভব দ্রুত বাসায় চলে যেতে হয়। তার বন্ধুরা কোনদিন সাথে থাকে, কোনদিন কেউ সাথে না থাকলে একাই চলে যায় বাসে চড়ে। ট্রেনে গেলে যে ঘন্টাখানেক সময় বেশি লাগবে সেই সময়টা সে বাঁচাতে চায় তার মেয়ের জন্য। আজ একা দাঁড়িয়ে আছে সে।
“এসো, কিছু খাও।“ রাখী বললো।
খাদ্যদ্রব্য কেউ সাধলে ‘না’ বলার ভদ্রতা আমার নেই।
এখানে সবচেয়ে বেশি চলে ‘বাটার-বন’ নামক একটি বস্তু। চ্যাপ্টা মিষ্টি রুটির মাঝখানে কিছু ক্রিম দেয়া। কোকাকোলা সহযোগে এই বস্তুটি খাওয়া হলো। রাখীর আগেই প্রদীপ নাথ তার পকেট থেকে টাকা বের করলো। রাখী কিছুতেই প্রদীপ নাথকে টাকা দিতে দেবে না। কারণ সেই আমাদের ডেকেছে। রাখী তার কাঁধের বড় ব্যাগ থেকে একটা ছোট-ব্যাগ বের করলো। সেই ছোট-ব্যাগের ভেতর থেকে আরেকটি ছোটব্যাগ বের করে সেখান থেকে একটা কড়কড়ে পাঁচ শ টাকার নোট বের করে দোকানদারের দিকে এগিয়ে দিতেই দোকানদার মাথাটা তালপাতার পাখার মতো দুপাশে দুলিয়ে বললো – ‘ভাংতি নাই আপা, ভাংতি দেন।‘
রাখী সরল-মানুষ। আমাদের ডেকে খাওয়ানোর রহস্য ফাঁস করে দিলো। বললো, “কী বলেন ভাংতি নাই। টাকা ভাঙানোর জন্যই তো খেলাম আপনার এখানে। দেখেন হবে হবে।“
দোকানদার তাঁর ক্যাশবাক্স খুলে দেখালেন। সেখানে সব মিলিয়ে একশ টাকাও নেই। এত কম বিক্রি করে এরা চলে কীভাবে?
রাখী হায় হায় করছে – হায় আমি বাসভাড়া কীভাবে দেবো? আমার তো কোন ভাংতি টাকা নেই। প্রদীপ নাথের হাতে ভাংতি টাকা আছে। সে খাবারের দাম মিটিয়ে দিলো। রাখীকে আরো বিশ টাকা দিলো বাসভাড়া ইত্যাদির জন্য। রাখী টাকাটা নিতে রাজি হলো শুধুমাত্র এই শর্তে যে পরের বার দেখা হলেই সে খাবারের বিলসহ পুরো টাকাটা ফেরত দেবে।
এরমধ্যে সম্ভবত রাখীর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। প্রদীপ নাথ তাই ভাবছে – রাখীকে ডাকতে গেলে রাখী কী ভাবতে পারে। আমরা অন্যে কী ভাবতে পারে এসব ভেবেই অনেক সময় নষ্ট করি। আমি কোন কিছু না ভেবেই বের হলাম। সামনে যাকে পাই তাকেই ডেকে নিয়ে আসবো কালার-কোড পড়ার জন্য।
পাশাপাশি তিনটি ডার্করুম আছে। একটাতে দেখলাম হাফিজ, প্রেমাংকর, ইকবাল, কবীর এরা কাজ করছে। পাশেরটাতে উঁকি দিতে গিয়ে রিনার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। ডার্করুমে তারা লাইট জ্বালিয়ে কাজ করছে। হাত তুলে ডাকলাম তাকে।
সে খুবই গম্ভীর একটা ভাব নিয়ে ডার্করুম থেকে বের হয়ে এলো। আমি কিছুটা ভনিতা করবো ভাবছিলাম, কিন্তু কী বলবো কিছুই মাথায় এলো না। বললাম, “প্লিজ, একটু আমাদের টেবিলে আসো। তোমার হেল্প দরকার। তোমার হেল্প ছাড়া আমরা প্র্যাকটিক্যাল করতে পারছি না।“
আমি খুবই শুদ্ধভাষায় যথাসম্ভব মোলায়েমভাবে তাকে বললাম কথাগুলি। আর সে আমাকে অবাক করে দিয়ে চট্টগ্রামের খাঁটি আঞ্চলিক ভাষায় বললো, “ভাইল্ দদ্দে কিইল্লা? কী অইয়ে?”
আমার ধারণা ছিল আমার সাথে সে কোনোদিন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলবে না। আমি সারাক্ষণ কেন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি এটা নিয়েও তার আপত্তি ছিল সেকেন্ড ইয়ারে। কিন্তু আজ কী হলো তার!
“তুই না বলেছিলি আমার সাথে কোনোদিন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলবি না?”
“আমার যা খুশি তাই বলবো, তোর কী?”
রিনা এত রেগে আছে কেন বুঝতে পারছি না।
রেজিস্ট্যান্সের ব্রাউন আর গ্রিনের দ্বন্দ্ব কয়েক সেকেন্ডেই মিটিয়ে দিলো রিনা। রঙ নিশ্চিত হয়ে রেজিস্ট্যান্সের মান হিসেব করতে করতে প্রদীপ নাথ বিড় বিড় করছে – “বিবি রয় গুড বয় ভেরি গুড ওয়াইফ।“
“কী বললি?” – রিনার প্রশ্নে হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে গেল প্রদীপ নাথ।
“আমি রিনা রায় গুড বয় বলি নাই, বলেছি বিবি রয় গুড বয়। ভেরি গুড ওয়াইফ তোকে বলি নাই।“
রিনা আর কোন প্রশ্ন করার আগেই প্রদীপ নাথ বিবি রয় গুড বয়ের আদ্যোপান্ত ব্যাখ্যা করতে শুরু করলো।
দিনগুলি দ্রুত চলে যাচ্ছে। কিন্তু সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট এখনো দিচ্ছে না। রেজাল্ট দিতে আরো কয় মাস লাগে জানি না। আমাদের পরীক্ষা জানুয়ারির শেষে শুরু হয়ে মার্চের প্রথম সপ্তাহে শেষ হয়েছে। এখন আগস্ট চলছে। ছয় মাসেও একটা পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়া যায় না!
সারাদেশে এরশাদের স্বৈরশাসন অবসানের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক কাজকর্ম চলছে। কিন্তু এরশাদ সরকার যেভাবে পারে বিরোধীদলের কাজকর্ম দমন করছে। ১০ আগস্ট শেখ হাসিনার বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে। আবার ভালোমানুষের মতো এই হামলার নিন্দাও করেছে। একসময়ের বাম রাজনীতি করতেন এমন অনেক মানুষ এখন এরশাদের সরকারে আছে। আগস্টের ১২ তারিখ মওদুদ আহমদকে বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে। কাজী জাফর হয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল সব শক্তির একজোট হবার লক্ষ্যে কিছু কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু শিবির ক্যাম্পাসে প্রগতিশীল কোন কিছুই ঘটতে দিচ্ছে না। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার চতুর্দশবার্ষিকী স্মরণে ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান করার ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ। শিবির ১৫ তারিখ সকালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব গেট বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তাতেও ছাত্রলীগের কর্মীরা দমে না গিয়ে ইউনিভার্সিটির ট্রেনস্টেশনের সামনের চত্বরে ছোট্ট একটা প্রতিবাদসভা করার পর মিছিল বের করতেই শিবিরের ক্যাডাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে মিছিলের উপর। ছাত্রলীগের কর্মীরা মার খেয়ে পালিয়ে এসে আবার জড়ো হয় মদন হাটে। ঘোষণা করা হয় সর্বাত্মক শক্তি দিয়ে শিবির-প্রতিরোধের। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের ডাক দেয় ছাত্রলীগ। মনে হচ্ছে এবার কিছুটা হলেও সফল হবে তারা।
No comments:
Post a Comment