সন্ধ্যে সাতটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত একটানা পড়ে ফেললাম মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি’। দু’শ সত্তর পৃষ্ঠার বই – পড়তে চার ঘন্টা সময় লাগলো। অনেকে অনেক দ্রুত পড়তে পারেন, কিন্তু আমার বেশ সময় লাগে। টান টান উত্তেজনাময় থ্রিলার না হলে আরো কতঘন্টা লাগতো জানি না।
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এখন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পরিচিত নাম – তাঁর থ্রিলারের কারণে। এবং সম্প্রতি এই বইয়ের ধারাবাহিক চলচিত্ররূপের কারণে।
ব্যতিক্রমধর্মী নামের কারণেও এই বইটি পাঠকের মন কেড়েছে প্রকাশিত হবার পর পরই। ২০১৫ সালের বইমেলায় প্রথম প্রকাশিত হবার পর নাম শুনেছিলাম এই বইটির। নাম শুনে শুরুতে মনে হয়েছিল কবিতার বই। ইদানীং তো কবিতার বইয়ের কত বিচিত্র নাম হয়। রবীন্দ্রনাথের নাম জড়িয়ে থ্রিলার – নিঃসন্দেহে অনন্য – এর আগে এরকম হয়নি আর। বইটি পড়বার সুযোগ হয়নি এতদিন। ইদানীং অনেকগুলি বাংলা বইয়ের ওয়েবসাইট আছে – যেখানে বাংলা বইয়ের স্ক্যানকপি আপলোড করা হয়। এসব বই ডাউনলোড করে পড়ার ক্ষেত্রে কপিরাইট লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না তা মনে থাকে না। বই পড়ার ক্ষেত্রেও মনে হয় প্রেমের মতোই ‘ন্যায় অন্যায় জানি নে জানি নে জানি নে।‘
গল্পের শুরুটা হয় সুস্বাদু খাদ্যের গন্ধের ভেতর দিয়ে। ঢাকা থেকে অনেক দূরে সুন্দরপুর মফস্বল শহরে হাইওয়ের পাশে রেস্টুরেন্টের নাম ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি’। কাহিনির শুরুতেই রেস্টুরেন্টের পরিবেশ এবং খাদ্যের বর্ণনার মধ্য দিয়ে সূক্ষ্মভাবে তৈরি হতে থাকে রহস্যের জাল। তখনো বোঝা যায় না মূল চরিত্র কে। খাদ্যের মেনু থেকে বার বার উঠে আসে – একটি নাম মুশকান। প্রথম অধ্যায়ের আগে মুখবন্ধের শেষের দিকে আমরা নিশ্চিন্ত হই রেস্টুরেন্টের মালিক মুশকান জুবেরিকে ঘিরেই ঘটতে থাকবে ঘটনা।
ঢাকা থেকে বিশেষ মিশন নিয়ে যিনি আসেন এবং স্থানীয় থানার ইনফরমার আতর আলীর সাথে যার উদ্দেশ্যমূলক সখ্য গড়ে ওঠে – আমরা জানতে পারি তিনি মহাকাল পত্রিকার সাংবাদিক নুরে ছফা। অনেকগুলি অধ্যায় এবং ঘটনার পরেই শুধু আমরা জানতে পারি নুরে ছফা সাংবাদিক নন – গোয়েন্দা সংস্থার লোক।
প্রচলিত থ্রিলারে যেমন একজন কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকেন – যিনি শুরু থেকেই সবকিছুর কেন্দ্রে এসে বসে থাকেন, খুব বাহাদুরি দেখাতে থাকেন আর পাঠকও আশা করতে থাকেন সবশেষে তিনিই জয়ী হবেন, রহস্যভেদ করবেন – আমাদের নুরে ছফাকে সেরকম বাহাদুর মনে হয় না। এতে রহস্য আরো জমতে থাকে। পাঠক পরিচিত হতে থাকে অন্যান্য চরিত্রের সাথে। গুড়ের চা বিক্রেতা রহমান মিয়া, গোরখোদক ফালু, এস আই আনোয়ার, এস পি মনোয়ার, স্থানীয় এমপি আবদুল্লাহ। ঘটনাগুলি এমনভাবে ঘটে, এমন পটভূমিতে ঘটে – আমাদের মনেই থাকে না যে আমরা একটা কাল্পনিক রহস্য গল্প পড়ছি।
গল্পের ফাঁকে ফাঁকে আমরা সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতাও নতুন করে জানতে পারি। সাগর-রুনি দম্পতির নাম না নিলেও আমরা বুঝতে পারি কোন্ সাংবাদিক দম্পতির হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে দেয়া হচ্ছে না – বলা হচ্ছে। স্থানীয় এমপি-রা ক্ষমতার দাপটে কী করেন, থানা-পুলিশ এমন কি পুলিশের সামান্য ইনফরমারও যে বাংলাদেশে কী পরিমাণ দাপট দেখায় – তা বুঝতে পারি তাদের চরিত্রের ভেতর দিয়ে – অথচ মূল রহস্য থেকে একটুও দূরে না সরে।
জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আরেক জমিদার অলোকনাথ বসুর পরিচয় এবং বন্ধুতাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় – আমাদের মনে হতে থাকে অলোকনাথ বসু নামে কেউ একজন সত্যিই ছিলেন কোন এক সময় -যার বাড়িতে এখন মুশকান জুবেরি থাকেন – যিনি সম্পর্কে অলোকনাথ বসুর নাতবৌ। মাস্টার রমাকান্তকামারকেও মনে হয় ইতিহাসের অংশ।
গোয়েন্দা নুরে ছফা যে ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে মুশকান জুবেরির সন্ধান পান – তা অভিনব। এই রেস্টুরেন্টে খেতে এসে একের পর এক পাঁচ জন তরুণ উধাও হয়ে গেছে। তারা কোথায় গেল! কী রহস্য তাদের অন্তর্ধানের!
১৯৭২ সালের অক্টোবরে ল্যাটিন আমেরিকার যে বিমান দুর্ঘটনার পরবর্তী ঘটনাকে কেন্দ্র করে মূল রহস্য ঘনীভূত হয় – যদিও বাস্তব ঘটনাটি ছিল উরুগুয়ের এয়ারফোর্সের একটি প্লেন এবং যাত্রীরা ছিল রাগবি টীমের সদস্য – লেখক খুবই বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে সেই সময়ের ২৫ বছর বয়সী ডাক্তার মুশকান সোহেলীর সেই প্লেনে ভ্রমণ এবং দুর্ঘটনার এবং পরের ঘটনার একজন করে তোলেন। রহস্য এখানে এসে কেন্দ্রীভূত হয় – মুশকানের বর্তমান বয়স সত্তরের উপর হবার কথা থাকলেও কেন তাকে তিরিশ বছরের তরুণীর মতো লাগে এখনো?
পাঠকদের মধ্যে যারা থমাস হ্যারিসের সৃষ্ট চরিত্র হ্যানিবল লেকটার সম্পর্কে জানেন – তাঁরা জানেন হ্যানিবল লেকটার নরমাংসভোজনকে কীভাবে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সিরিয়াল কিলার হ্যানিবল লেকটার – জ্যান্ত অবস্থায় মানুষের ব্রেন স্লাইস করে কেটে নিয়ে রান্না করে যার ব্রেন তাকেই খাইয়েছে এমন বর্ণনাও আছে থমাস হ্যারিসের বইতে। মুশকান জুবেরির ভেতর হ্যানিবল লেকটারের খুব সামান্য একটু ছায়া দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। এখানেই লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের নিজস্বতা আলোকিত হয়ে ওঠে। অবশ্য শেষের অধ্যায়ে মুশকান যেভাবে পালিয়ে যান – তার সাথে হ্যানিবল লেকটারের পালানোর মিলটা একটু বেশিই ছিল।
পাঠককে উত্তেজনার টানে টেনে রাখার ক্ষমতা যে লেখকের যত বেশি – থ্রিলারের ক্ষেত্রে তিনি ততই সফল। এই বইতে সেই টান শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই আছে।
খুব আনন্দ পেলাম এই থ্রিলার পড়ে।
এখন এর দ্বিতীয় পর্ব ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি’ পড়তে হবে।
মামা, এই বইটির অনলাইন পিডিএফ (যদি তোমার কাছে থাকে) কি আমি পেতে পারি?
ReplyDeleteঅবশ্যই।
Delete