স্বপ্নলোকের চাবি – ৩৪
ইদানীং ঘনঘন লোডশেডিং হচ্ছে। সন্ধ্যা হবার সাথে সাথেই কারেন্ট
চলে গেছে। অন্ধকারে রুমের ভেতর বসেছিলাম কিছুক্ষণ। সেপ্টেম্বর মাস শেষ হতে চললো। বাইরের
বাতাস আরামদায়ক। কিন্তু জানালা দিয়ে বাতাসের চেয়েও বেশি ঢুকছে মশা।
কারেন্ট কখন আসে ঠিক নেই। হারিকেন জ্বালিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ
করে পড়ার টেবিলে বসলাম। বেশ কয়েকটি প্র্যাকটিক্যাল জমে গেছে, অথচ খাতা লেখা হয়নি। অনেকক্ষণ
সময় লাগে একেকটা প্র্যাকটিক্যাল রিপোর্ট তৈরি করতে। কিন্তু সবগুলি প্র্যাকটিক্যালের
রিপোর্টের জন্য মোট নম্বর আছে ১০। পুরো খাতা পড়ে নম্বর দিতে গেলে - একটা খাতা পড়তেই
তো একদিন লেগে যাবে। এতগুলি শিক্ষার্থীর খাতায় এত দ্রুত নম্বর স্যাররা কীভাবে দেন কে
জানে। আদৌ পড়ে দেখেন কি – কী লিখলাম? তবুও কত সিরিয়াসলি নির্ভুলভাবে প্র্যাকটিক্যাল
খাতা লিখি আমরা।
মনযোগ দিয়ে কাজ করতে শুরু করেছিলাম। ঠিক সেই সময়েই সেলিমভাই
এসে দরজায় ধাক্কা দিলেন। রুমে ঢুকেই আমার টেবিলের দিকে চোখ দিয়ে বললেন, “তুমি লেখাপড়া
করছিলে! ঠিক আছে। তুমি তোমার কাজ করো। আমি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি তোমার বিছানায়।“
তারপর থেকে অনেকক্ষণ ধরে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছেন সেলিমভাই।
পর্যায়ক্রমিক কাৎ-চিৎ করছেন আর সম্ভবত বোঝার চেষ্টা করছেন কোন্ অবস্থানে তুলনামূলকভাবে
বেশি আরাম। কিন্তু মনে হচ্ছে কিছুতেই কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না।
সেলিমভাইয়ের মোটাসোটা থলথলে শরীরের ভারে আমার ঠ্যাং-ভাঙা
খাট একটু পরপরই আর্তনাদ করছে। আমি খাটের পাশের পড়ার টেবিলে বসে প্র্যাকটিক্যাল খাতা
লেখার চেষ্টা করছি, কিন্তু মনযোগ দিতে পারছি না। শুধু আমি কেন, মহাভারতের লক্ষ্যভেদী
অর্জুনও এ অবস্থায় মনযোগ দিতে পারতেন বলে মনে হয় না। অর্জুন যখন দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর
সভায় মাছের চোখের দিকে লক্ষ্য স্থির করে তীর ছোঁড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন – সেই সময়
তাঁর কানের কাছে সেলিমভাই যেভাবে ক্যাঁত-কোঁত করছেন - এরকম শব্দ করলে অর্জুনের খবর
ছিল।
সেলিমভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় – কিছুটা কাকতালীয়, কিছুটা আয়োজিত।
কাকতালীয় – কারণ তিনি হল ছেড়ে এই বিল্ডিং-এ থাকতে এসেছেন। আরো নির্দিষ্টভাবে বললে বলা
চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এই বিল্ডিং-এ না এলে তাঁর সাথে আমার হয়তো কোনদিনই পরিচয় হতো
না। সেলিমভাই ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। শিবিরের হাতে প্রাণনাশের
সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় হল ছেড়ে এখানে এসে উঠেছেন। এখানেও যে তাঁর কোন বন্ধু আগে থেকে
ছিল তাও নয়। এই বিল্ডিং-এও তো শিবিরের কর্মী অনেক। কিন্তু খান সাহেবের বড় ছেলে খোকনভাই
যুবলীগের নেতা। খোকনভাই-ই সম্ভবত এখানে নিয়ে এসেছেন সেলিমভাইকে। আমার সাথে সেলিমভাইয়ের
পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন খোকনভাই। তারপর থেকে সেলিমভাই আমাকে বেশ স্নেহ করেন। তিনি আমাদের
কয় ব্যাচ সিনিয়র তা ঠিক জানি না। ছাত্রনেতাদেরকে কোন্ ব্যাচের তা জিজ্ঞেস করতে নেই।
কারণ তাঁরা তাঁদের ছাত্রজীবন যতটুকু পারা যায় দীর্ঘায়িত করতে পছন্দ করেন।
“তোমার বালিশের এই অবস্থা কেন? এর ভেতর কি তুলার সাথে পাথর
ঢুকিয়েছ?” – সেলিমভাই বিছানায় কাৎ হয়ে আমার শক্ত-পাতলা বালিশটাকে দুই ভাঁজ করে ঘাড়ের
নিচে দিতে দিতে প্রশ্ন করলেন।
এই জাতীয় প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে হয় না। আমি চুপ করে রইলাম।
বুঝতে পারছি – সেলিমভাই ছটফট করছেন অন্য কোন কারণে। বালিশ বা বিছানা মূল বিষয় নয়। পনেরো
আগস্টের পর থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও একটা শক্ত প্রতিরোধ
গড়ে উঠতে শুরু হয়েছে। ১৬ আগস্ট থেকে প্রায় এক সপ্তাহ বিশ্ববিদ্যালয় বাইরে থেকে অবরোধ
করে রেখেছিল ছাত্রলীগের কর্মীরা। সেই সময় প্রতিদিনই এক নম্বর গেট থেকে ফিরে এসেছি অনেক
আনন্দ নিয়ে। দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে রাখা কোন সমস্যার সমাধান নয়। তাতে
আমাদেরই ক্ষতি – তা আমরা বুঝি। কিন্তু শিবিরের গায়ের জোরে দখলদারিত্ব তো মেনে নেয়া
যায় না দিনের পর দিন।
প্রফেসর আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন ভাইস-চ্যান্সেলর হওয়ার
পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক করার অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি
ছাত্রলীগের নেতাদের সাথে মিটিং করে অবরোধ তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। শিবিরও কিছুটা
দমেছে কিংবা তাদের রণনীতি পরিবর্তন করেছে। ক্যাম্পাসে এখন শিবিরের বিরুদ্ধে সর্বদলীয়
ছাত্র ঐক্য গড়ে তোলার কাজ চলছে জোরেশোরে। সেলিমভাই সেসব নিয়ে খুবই ব্যস্ত আছেন। তার
ফাঁকে সামান্য কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে চাচ্ছেন – কিন্তু তা হচ্ছে না।
“তোমার কিন্তু পলিটিক্সে আরো অ্যাকটিভ হওয়া দরকার।“ – সেলিমভাই
শোয়া থেকে উঠে বসলেন।
তাঁর কথা শুনে আমি হেসে উঠলাম। আমি ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে
নই। কিন্তু তার ভেতর এখন যে নীতি কার্যকর আছে – তা আমার ভালো লাগে না। নীতিকেন্দ্রিক
রাজনীতি না হয়ে যদি নেতাকেন্দ্রিক রাজনীতি হয় – তাহলে ব্যক্তিপূজা শুরু হয়। আস্তে আস্তে
ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব দানা বাঁধে।
রাজনীতি কখনোই আমাকে আকর্ষণ করেনি তা বলবো না। কলেজে ভর্তি
হয়েছি যখন তখন তো সামরিক আইন চলছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতি তখন নিষিদ্ধ। তার ভেতরও যেটুকু
পারি কাজে যুক্ত হয়ে দেখেছি – নেতাদের ভেতর অনেক ভেজাল। আমি নিজে যে একেবারে ভেজালমুক্ত
মানুষ তা নয়। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় নেতা খাঁটি হলে ভেজাল কর্মী দিয়েও অনেক কিছু
করে ফেলা যায়। কিন্তু নেতা ভেজাল হলে খাঁটি কর্মী দিয়েও তেমন কিছু করা যায় না।
রাজনৈতিক নেতারা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না – এটাই সবচেয়ে
বাজে লাগে আমার। বিজ্ঞানে আইনস্টাইনের গবেষণারও সমালোচনা করা যায়। কিন্তু রাজনীতিতে
এরশাদের মতো ভন্ডের সমালোচনাও সহ্য করবেন না এরশাদের চেলা-চামুন্ডারা। সক্রিয় রাজনৈতিক
কর্মীদের যেভাবে একচোখা দলীয় আনুগত্য থাকতে হয় – তা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
“চাকসু ইলেকশান করবা?” – সেলিমভাই এমনভাবে বলছেন যেন ইসলামমিয়ার
দোকানে চা খেতে যাবো কি না জিজ্ঞেস করছেন।
“আমি? হাহাহা।“
“হাসি নয়। সিরিয়াসলি। আমাদের এবার নতুন মুখ দরকার। ঐক্যের
ব্যানারে শিবিরের বিরুদ্ধে সব নতুন মুখ দাঁড় করানো হবে।“
“আস্তে বলেন। ওরা শুনতে পাবে। শেষে আমার হাতের কব্জি – পায়ের
গোড়ালি কেটে নেবে।“
“কিসসু করতে পারবে না। দেখো না – কী অবস্থা হয় তাদের। কালকে
কিন্তু মিছিলে যাবা। বিশাল শোডাউন হবে কালকে। সেন্ট্রাল লিডাররা সবাই আসবে। আমাকে এখন
শহরে যেতে হবে।“
সেলিমভাই রুম থেকে বের হবার প্রায় সাথে সাথেই কারেন্ট চলে
এলো। প্র্যাকটিক্যাল খাতা লিখে ফেলা উচিত এবার।
আমাদের আগের ব্যাচের থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা জুলাইয়ের শেষে
শুরু হয়েছে। চলছে এখনো। তিন চার মাস লেগে যায় এক ইয়ারের পরীক্ষা শেষ করতে। রেজাল্ট
দিতে লাগে আরো ছয় মাস। আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট দিতে সময় লেগেছে ছয় মাসের বেশি।
কিছুদিন আগে আমরা মিছিল করেছি রেজাল্ট দেয়ার জন্য। সব ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা একই সাথে
নিতে হয় বুঝলাম, কিন্তু রেজাল্ট তো একই সাথে দিতে হয় না। অবশেষে রেজাল্ট দিয়েছে কয়েকদিন
আগে।
লেখাপড়ার প্রতি গা-ছাড়া ভাবটা আমার এখনো আছে, কিন্তু সেকেন্ড
ইয়ারের রেজাল্টের পর একটা নতুন ধরনের টেনশান সূক্ষ্মভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। যতই
এই টেনশানকে ঝেড়ে ফেলতে চাচ্ছি – সেটা আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই টেনশানটা আমার মাথার
ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে রিনা।
পরশুদিন প্র্যাকটিক্যাল ছিল না। দেড়টার ট্রেনে শহরে যাবার
সময় ভীড় ট্রেনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে তার সাথে। ক্লাসে কে কত নম্বর
পেয়েছে কীভাবে যেন খবর হয়ে যায়। সেকেন্ড ইয়ারে এবার সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে হারুন,
তার চেয়ে এক নম্বর কম পেয়ে সেকেন্ড হয়েছে মইনুল ইসলাম। সে ফার্স্ট ইয়ারের চেয়ে অনেক
বেশি ভালো করেছে সেকেন্ড ইয়ারে। আমি মইনের চেয়ে এক নম্বর কম পেয়ে এবারো থার্ড হয়েছি।
কিন্তু ফার্স্ট ইয়ার আর সেকেন্ড ইয়ার মিলিয়ে হারুন ফার্স্ট, আমি সেকেন্ড। রিনাও ফার্স্ট
ক্লাস নম্বর পেয়েছে আমি জানি, কিন্তু তার সঠিক নম্বর জানি না।
“দ্যাখ, নাটক থিয়েটার সিনেমা এসব হাবিজাবি করতে করতে এরকম
রেজাল্ট করেছিস। এগুলি বাদ দিয়ে আরো সিরিয়াস হলে কী করতে পারবি চিন্তা কর।“ – আমি শিল্পকলা
একাডেমিতে নাটকের রিহার্সালে যাচ্ছি জানার পর রিনা অনেকটা আমার দিদির মতো কথাবার্তা
বলতে শুরু করেছে।
রিনা সিনেমা-থিয়েটারকে হাবিজাবি জিনিস ভাবছে দেখে ভালো লাগলো
না। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারে প্রচুর সময় নষ্ট হচ্ছে তা সত্যি। গ্রুপ থিয়েটারে না গেলে
যে আমি খুব সিরিয়াসলি পড়তে বসে যাবো তা হয়তো নয়। কিন্তু অনেকটা সময় তো বেঁচে যাবে।
থার্ড ইয়ারে অনেকগুলি পেপার। পরিমাণগত দিক থেকে অনেক পড়াশোনা। ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড
ইয়ারের মতো উৎরে যাবার সম্ভাবনা খুব বেশি নেই।
গ্রুপ থিয়েটারে যাওয়া ছেড়ে দেবো কি দেবো না – দোলাচলে পড়ে
গেলাম। নতুন নাটকের রিহার্সাল শুরু হয়েছে। চন্দন সেনের ‘জ্ঞান বৃক্ষের ফল’। আমাকে একটা
ছোট্ট চরিত্র দেয়া হয়েছে। আমার চরিত্রটি হলো বাহকের। এক ধনী লোকের বাড়িতে একটা ঝাড়বাতি
কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। সব মিলিয়ে চার-পাঁচটি সংলাপ।
কিন্তু প্রথম সংলাপটি এরকম: আজ্ঞে, এটা কি বাগচী বাড়ি?
বেশ কায়দা করে থিয়েটারি ভঙ্গিতে সংলাপ বলতেই পরিচালক হায়দারভাই
ধমক দিয়ে উঠলেন – “চিঁ চিঁ করছো কেন?”
বেশ কয়েকবার বলার পরেও আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার গন্ডগোলটা
কোথায়। হায়দারভাই বিরক্ত হয়ে আমাকে লাথি মেরে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়ার পর আমাকে রক্ষা
করার জন্য এগিয়ে এলো মান্না সরকার। আমি তো খুশি হয়ে গেলাম। মান্না আমাকে উচ্চারণ শেখাতে
শুরু করলো।
আমি চী আর C উচ্চারণের যে পার্থক্য সেটা ধরতে পারছিলাম না।
বাগচীকে আমি উচ্চারণ করছিলাম বাগC। অবশ্য উচ্চারণকেও আমি ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারছিলাম
না – হয়ে যাচ্ছিলো উCCআরণ। মান্না বেশ উৎসাহ নিয়ে আমাকে শেখাতে শুরু করলো – ‘মঙ্গলবার
নয় – মোঙ্গলবার।‘
বেশ শিখলাম মোঙ্গলবার। কিন্তু ‘শনি-মঙ্গলবার’ বলতে গিয়ে বলে
ফেললাম ‘শোনি-মোঙ্গলবার’। হায়দারভাই আবার লাথি মারতে উদ্যত হলেন। গ্রুপ-থিয়েটারের এই
মজাটাই আমি উপভোগ করছিলাম অনেক বেশি। শুধুমাত্র লেখাপড়ার দোহাই দিয়ে কি এই মজা ছেড়ে
দেয়া যায়?
কিন্তু গ্রুপে একটা ঘটনা ঘটলো। নাটকের রিহার্সাল অনির্দিষ্টকালের
জন্য মুলতবি হয়ে গেল। আমাদের গ্রুপের হর্তাকর্তা আহমেদ ইকবাল হায়দার। খুবই ভালো অভিনেতা,
পরিচালক, সংগঠক। কিন্তু তিনি অনেকটাই ডিক্টেটর টাইপের মানুষ। এই নিয়ে পুরনো সিনিয়র
সদস্যদের সাথে মনোমালিন্য হলো। সেখান থেকে একদিন ঘটনা প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে
গেল। ব্যাপারটা আমার খুবই খারাপ লাগলো। গ্রুপ দুইভাগ হয়ে গেল। হায়দারভাই তাঁর অনুসারীদের
নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি ছেড়ে চলে গেলেন মুসলিম হলে। আরেকটা অংশ রয়ে গেল শিল্পকলা একাডেমিতে।
গ্রুপের প্রতি আমার উৎসাহ কমে গেল। তাতে সম্ভবত ভালোই হলো।
সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। দীর্ঘ তিন বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের
ক্যাম্পাসে শিবিরের বিরুদ্ধে এবং এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের একটি
বিশাল মিছিল ও সভা হলো ২৭ সেপ্টেম্বর। শিবির ছাড়া প্রায় সব ছাত্রছাত্রী স্বতস্ফূর্তভাবে
এই মিছিলে যোগ দিলো। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই এসেছিলেন। মোস্তাফিজুর
রহমান বাবুল, অসীম কুমার উকিল, জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু এঁরা সবাই এসেছিলেন। চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা হাসান মাহমুদ ও মোহাম্মদ সেলিম – আমাদের সেলিমভাই
সবকিছুর নেতৃত্ব দিলেন দেখে একটু গর্বও হলো। এতবড় নেতা সেলিমভাই – আমাকে ব্যক্তিগতভাবে
চেনেন এটা কি কম কথা? অবশ্য যদি কোনদিন ক্ষমতাশালী কেউ হয়ে যান – তখন নাও চিনতে পারেন।
ছাত্র ঐক্যের এত বড় সমাবেশের ফলে জামায়াত শিবিরের মধ্যে এক
ধরনের ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তারা আবার বিশ্ববিদ্যালয় অবরোধের ডাক দিলো। এই অবরোধ এড়ানোর
জন্যই হয়তো অক্টোবরের প্রথম দিন থেকেই বিশ দিনের জন্য শরৎকালীন ও দুর্গাপূজার ছুটি
ঘোষণা করা হলো।
ছুটির পর অক্টোবরের শেষে আবার ক্লাস শুরু হবার পর অনেকগুলি
টিউটোরিয়াল পরীক্ষা একের পর এক হয়ে গেল। কিন্তু ভুঁইয়াস্যার ঘোষণা করলেন – তিনি টিউটোরিয়ালের
ভাইভা নিবেন। আমার ভাইভা-ভীতি আছে। জানা প্রশ্নের উত্তরও আমি ঠিকমতো দিতে পারি না ভাইভাতে।
ইতোমধ্যে ভুঁইয়াস্যার ডিপার্টমেন্টে অনেককিছু শুরু করেছেন – যার উদ্দেশ্য কী ঠিক বোঝা
যাচ্ছে না। একদিন ক্লাসে বললেন – তিনি ফিজিক্যাল কোরান লিখছেন। আমাদের ফারুকের দার্শনিক
তর্ক করার বিদ্যা আছে। সে জিজ্ঞেস করে বসলো, “কোরান কি লেখা যায় স্যার?”
ভুঁইয়াস্যার খুবই বিরক্ত হলেন ফারুকের এই প্রশ্নে। তিনি মুখে
হাসি ধরে রাখতে চেষ্টা করলেও বোঝা যাচ্ছিলো যে রেগে গেছেন। তিনি বেশ রাগত স্বরেই বললেন
যে তিনি কোরান ও পদার্থবিজ্ঞানের সমন্বয়সাধন করে বই লিখছেন।
এরপর তিনি বললেন তাঁর লাইব্রেরি প্রকল্পে বই দান করতে। এই
লাইব্রেরি প্রকল্প কী? তিনি তাঁর অফিসে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি লাইব্রেরি তৈরি করছেন
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বই নিয়ে। আমাদের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি আছে। বিভাগীয় সেমিনার
লাইব্রেরি আছে। তার উপর এই পুরনো বইয়ের লাইব্রেরি কী কাজে লাগবে জানি না। কিন্তু ভাইভা
নেবেন – এবং সেখানে লাইব্রেরিতে বই দিয়েছি কি না জিজ্ঞেস করবেন এটা নিশ্চিত। ক্লাসের
সবাই স্যারকে দেয়ার জন্য বই সংগ্রহ করতে শুরু করলো।
সময় বাঁচানোর জন্য স্যার একই সাথে দু’জন দু’জন করে ভাইভা
নিতে শুরু করলেন তাঁর অফিসে। আমি আর প্রদীপনাথ গেলাম এক সাথে। দু’জনেই ভেতর করে দুটো
বই নিয়ে গিয়েছি। জিজ্ঞেস করলেই থলের ভেতর থেকে বের করে স্যারের হাতে ধরিয়ে দেবো।
স্যার ইদানীং শার্ট-প্যান্টের বদলে পাজামা-পাঞ্জাবী-টুপি
পরতে শুরু করেছেন। ক্লাসেই ঘোষণা দিয়েছেন তিনি আর পশ্চিমাদের পোশাক পরবেন না। আমাদের
দু’জনের নামই প্রদীপ শুনে খুব অবাক হলেন।
একটা প্রশ্ন করে দু’জনের উত্তরই শুনেন। এখন সমস্যা হচ্ছে
একই প্রশ্নের দু’রকম উত্তর তো হবে না। লিখলে হয়তো দু’রকম হবে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা
দু’জনই একই রকম উত্তর দিলাম। স্যার এবার বললেন, “আমার পড়ানো তোমাদের কেমন লাগে?”
এরকম প্রশ্নের উত্তরে কোন শিক্ষার্থীর পক্ষেই কি ভালো না
লাগলেও সত্যি কথা বলা সম্ভব? স্যারের পড়ানো বেশ ভালো। কিন্তু ক্লাসের মধ্যে ধর্মীয়
আলোচনার ব্যাপারটা কি খুবই দরকার? কিন্তু সেটা স্যারকে কি বলা যায়?
স্যার আবারো বললেন, “আমার ক্লাস কেমন লাগে, কী হলে আরো ভালো
হয় – এগুলি বলার সাথে তোমাদের ভাইভার নম্বরে কোন হেরফের হবে না।“
প্রদীপ নাথ বললো, “স্যার আপনার পড়ার বাইরের কথাগুলি মাঝে
মাঝে বুঝতে পারি না।“
স্যারের মুখ ক্রমশ গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, “কথা বুঝতে পারো
না মানে কী? আমি তো বাংলাতেই বলি – যদিও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছো তোমরা।“
বুঝলাম স্যার রেগে গেছেন। পড়ার বাইরের কথা বলতে কী বুঝিয়েছি
সেটা বলার কোন মানে হয় না আর। থলের ভেতর থেকে দুজনই বইগুলি বের করলাম একই সাথে। স্যারের
দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, “আপনার লাইব্রেরি প্রকল্পটা খুবই ভালো প্রকল্প স্যার।“
স্যারকে যে বই দেয়ার সাথে তেলও দেয়ার চেষ্টা করছি তা বুঝতে
না পারার কথা নয় স্যারের। তিনি আবারো বললেন, “বই দেয়ার সাথে কিন্তু তোমাদের মার্কের
কোন সম্পর্ক নেই।“
সম্পর্ক আছে কি নেই তা আমরা কোনদিন জানতে পারিনি। কারণ আমাদের
কোন টিউটোরিয়েলেরই মার্ক জানানো হয়নি, কিংবা কোন ফিডব্যাকও দেয়া হয়নি।
No comments:
Post a Comment