১৬৮০ সালে স্যার আইজাক নিউটন যখন মহাকর্ষ বলের সূত্র দিলেন- বলা যায় তখন থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে সমন্বয় খোঁজার চেষ্টা শুরু হয়। মহাবিশ্বের সবকিছুই এক সূত্রে গাঁথা - এটা ভাবতে সবারই ভালো লাগে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের ঠিক কোন সূত্রে সবকিছু গাঁথা তা তো আমরা সঠিকভাবে জানি না। তবে জানার চেষ্টা চলছে সেই তখন থেকেই। প্রকৃতিতে বিদ্যমান বলগুলোর পারস্পরিক ঐক্যের সন্ধানে অবিরত কাজ করতে থাকেন অনেক বিজ্ঞানী।
১৮৩০ সালে অ্যাম্পিয়ার ও মাইকেল ফ্যারাডে বিদ্যুৎ ও চৌম্বক শক্তিকে একত্রিত করে ‘তড়িৎচৌম্বক’ এর ধারণা দেন। এরপর ১৮৬৬ সালে ম্যাক্সওয়েল প্রতিষ্ঠা করলেন ‘তড়িৎ-চৌম্বক বল’ এর সূত্রাবলী। মাইকেল ফ্যারাডেই প্রথম চেষ্টা করেছিলেন মহাকর্ষ বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের মধ্যে সমন্বয় সাধনের। কিন্তু তিনি সফল হননি।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষে নিউক্লিয়ার বল আবিষ্কৃত হয় এক্স-রে, তেজষ্ক্রিয়তা ইত্যাদি আবিষ্কারের পর। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উদ্ভবের পর পদার্থবিজ্ঞানে বিল্পব ঘটে গেলো। পারমাণবিক নিউক্লিয়াস আবিষ্কৃত হলো। পরমাণুর ইলেকট্রন এবং পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের প্রোটন ও নিউট্রন আবিষ্কৃত হলো। নিউক্লিয়ার তত্ত্ব থেকে সবল নিউক্লিয়ার বল (strong nuclear force) ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল (weak nuclear force) এবং তাদের ধর্ম সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞানীরা কিছু কার্যকরী মডেল দাঁড় করাতে পেরেছেন। নিউক্লিয়ার বল মহাকর্ষ বলের চেয়ে অনেক অনেক অনেক গুণ (প্রায় 10^40 গুণ) শক্তিশালী। কিন্তু তাদের ব্যাপ্তি খুব খুব খুব কম (10^-15 মিটার থেকে 10^-10 মিটার)। নিউক্লিয়াসের বাইরে এই বলের কোন অস্তিত্ব থাকে না। আর নিউক্লিয়াসের ব্যাস মাত্র 10^-15 মিটার, অর্থাৎ এক মিটারের এক কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ। এই নিউক্লিয়ার বল নিউক্লিয়াসের ভেতর প্রোটন ও নিউট্রনকে একসাথে বেঁধে রাখে।
১৯১৬ সালে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি আবিষ্কারের পর আলবার্ট আইনস্টাইন চেষ্টা শুরু করেছিলেন মহাকর্ষ বলের সাথে অন্যান্য বলগুলোর ঐক্য খুঁজতে। ১৯১৬ থেকে ১৯৫৫ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত চেষ্টা করেও আইনস্টাইন সফল হননি। ১৯৩০ সালে এনরিকো ফার্মি যখন চেষ্টা করেন দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে- তখন আবদুস সালামের বয়স মাত্র চার বছর। আবদুস সালাম ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭৪ সালের মধ্যে মৌলিক বলগুলোকে একীভূত করার কয়েকটি দুরুহ ধাপ অতিক্রম করতে সমর্থ হলেন। এই আবিষ্কারের জন্য তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন ১৯৭৯ সালে।
পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের বিটা ক্ষয় (beta emission) ঘটায় দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ায় (weak interaction) নিউক্লিয়াসের চার্জহীন নিউট্রন পজিটিভ চার্জযুক্ত প্রোটনে রূপান্তরিত হয় আর পরমাণুর চার্জের সাম্যতা রক্ষার জন্য নিউক্লিয়াসে একটা নেগেটিভ চার্জের ইলেকট্রন তৈরি হয়ে নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসে। চার্জহীন নিউট্রিনো নিউক্লিয়ার বলের আদানপ্রদান ঘটায়।
দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের কারণেই নক্ষত্রগুলোতে শক্তি উৎপন্ন হয়। আমাদের প্রাকৃতিক মূল উৎস যে সূর্য, সেই সূর্যের ভেতর যে হাইড্রোজেন আছে তা ডিউটেরিয়ামে রূপান্তরিত হয় দুর্বল পারমাণবিক মিথষ্ক্রিয়ার ফলে। সোলার এনার্জি বা সৌরশক্তির মূল উৎসই হলো দুর্বল পারমাণবিক বল। ১৯৩৪ সালে ইটালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি দুর্বল পারমাণবিক বলের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু নিউট্রিনোর ভূমিকা খুব একটা পরিষ্কার ছিল না।
১৯৫৬ সালে নিউট্রিনোর সিমেট্রি ব্রেকিং বা প্যারিটি ভায়োলেশান প্রমাণিত হবার পর দুর্বল পারমাণবিক বল ও তড়িৎচুম্বক বলের মধ্যে সমন্বয়ের একটা সঠিক সম্ভাবনার পথ পাওয়া গেলো। নিউট্রিনোর প্যারিটি ভায়োলেশানের ওপর গবেষণাপত্র লিখেও পাউলির হস্তক্ষেপে তা প্রকাশে অনেক দেরি করে ফেলেন আবদুস সালাম। ফলে প্যারিটি ভায়োলেশান আবিষ্কারের যথার্থ কৃতিত্ব দেয়া হয়নি আবদুস সালামকে। কিন্তু আবদুস সালাম হাল ছাড়েননি।
১৯৬০এর দশকে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের ওপর স্বতন্ত্রভাবে কাজ হয়েছে এম-আই-টি, হার্ভার্ড আর ইম্পেরিয়েল কলেজে। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইন্টারঅ্যাকশানের গেইজ ইনভেরিয়েন্ট তত্ত্বের সমন্বয়ে সাফল্য আসে এক দশকের মধ্যেই।
গেইজ ইনভেরিয়েন্ট তত্ত্ব প্রথম দিয়েছিলেন এমি নোইথার ১৯২০ এর দশকে। এই তত্ত্ব মতে প্রকৃতিতে যেখানেই সাম্যতা কাজ করে, সেখানে অবশ্যই সাম্যতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পদার্থ এবং শক্তির ধর্মের সংরক্ষণশীলতার নীতিও কার্যকর থাকে। যেমন, স্থান ও কালের সাম্যতা বজায় থাকলে শক্তি, ভরবেগ ও কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণশীলতার নীতি বজায় থাকে।
একটা উদাহরণ দিলে গেইজ সিমেট্রি বা গেইজ ইনভেরিয়েন্ট তত্ত্ব বুঝতে সুবিধে হবে। মনে করা যাক আমাকে একটা পাহাড়ে উঠতে হবে ভূমি থেকে যার উচ্চতা একশ' মিটার। যদি পাহাড়টা সিমেট্রিক হয় অর্থাৎ সবদিক একই রকম হয় তাহলে পাহাড়টিতে আমি যেদিক দিয়েই উঠি না কেন আমার সমান শক্তি খরচ হবে। সেই ক্ষেত্রে আমি পাহাড়ের কোন্ দিক দিয়ে উঠেছি তাতে মোট শক্তি খরচের কোন তারতম্য হবে না। এখন পাহাড়টির সিমেট্রি যদি নষ্ট হয় তাহলে শক্তি-ব্যয়ের সমতাও থাকবে না। এখানে পাহাড়ে ওঠার জন্য যে শক্তি খরচ হচ্ছে তা মাধ্যাকর্ষণ বলের সাথে সম্পর্কিত। উদাহরণটি গ্র্যাভিটেশান ফিল্ডের গেইজ সিমেট্রি।
আবদুস সালাম দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বল একত্রীকরণে গেইজ সিমেট্রি কাজে লাগালেন। এটা করতে গিয়ে আবদুস সালাম স্বতস্ফূর্ত সাম্যতাভঙ্গ বা স্পনটেনিয়াসলি ব্রোকেন সিমেট্রির অবতারণা করেন। স্বতস্ফূর্ত সাম্যতাভঙ্গের ব্যাপারটা অবশ্য আবদুস সালামের আবিষ্কার নয়। ১৯২৮ সালে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ফেরোম্যাগনেটিজমের ক্ষেত্রে এই স্বতস্ফূর্ত সাম্যতাভঙ্গের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছিলেন।
স্বাভাবিক অবস্থায় একটি চুম্বকের উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই মেরু থাকে। মেরুর ভিন্নতার কারণে চুম্বক সিমেট্রিক নয়। কিন্তু একটি দন্ডচুম্বককে গরম করতে থাকলে তার চুম্বকত্ব কমতে থাকে এবং একটা তাপমাত্রার পর আর কোন চুম্বকত্ব অবশিষ্ট থাকে না। তখন দন্ডচুম্বকটির দুটো মেরুর ধর্মই একই রকম। তখন কোন্টা উত্তর মেরু কোন্টা দক্ষিণ মেরু তা আলাদা করা যায় না। তার মানে ওটা তখন সিমেট্রিক। তারপর যদি তাপমাত্রা কমতে থাকে একটা সময়ে চুম্বকত্ব ফিরে আসে এবং সাথে সাথে তার সাম্যতা ভেঙে যায়। এরকম ব্যাপারকেই স্বতস্ফূর্ত সাম্যতাভঙ্গ বলা হয়।
১৯৬৭ সালে সালাম তাঁর তত্ত্ব ইম্পেরিয়েল কলেজের লেকচারে প্রকাশ করেন। সেই বছর ডিসেম্বরে স্টিভেন ওয়াইনবার্গের গবেষণাপত্র প্রথম চোখে পড়ে সালামের। সালাম দেখলেন ওয়াইনবার্গও তাঁর মতোই চিন্তা করেছেন। ওয়াইনবার্গ তাঁর গবেষণাপত্রে শুধু লেপটন সংক্রান্ত হিসেবই দেখিয়েছিলেন। আবদুস সালাম ভাবলেন আরো বিস্তৃত হিসেব করে তিনি গবেষণাপত্র লিখবেন। ১৯৬৮ সালে শ্যালডন গ্ল্যাশো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ধারণা দেন যে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল আর তড়িৎচুম্বক বলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এবং তাদেরকে একই সূত্রে বেঁধে ফেলা সম্ভব। স্টিভেন ওয়াইনবার্গ এবং আবদুস সালাম গ্ল্যাশোর ধারণার গাণিতিক সমীকরণ বের করেন।
দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বল মূলত একই রকম। কিন্তু তাদেরকে ভিন্ন মনে হয় কারণ দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের বিনিময় কণার ভর আছে, কিন্তু তড়িৎচৌম্বক বলের বিনিময় কণার ভর নেই। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই বল বিনিময় কণা হলো বোসন। তড়িৎচৌম্বক বলের ক্ষেত্রে বিনিময় কণা ফোটন যার স্থির ভর শূন্য। ফোটন আলোর বেগে চলে। দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের ক্ষেত্রে বিনিময় কণার ভর আছে। ফলে এই বোসনগুলোর বেগ দূরত্বের সাথে বদলে যায়।
দুর্বল নিউক্লিয়ার মিথষ্ক্রিয়ায় চার্জের পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ চার্জহীন নিউট্রন ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটন বা ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রনে পরিণত হয়। ফলে যে কারেন্ট পাওয়া যায় তাকে চার্জড কারেন্ট বলা যায়। অন্যদিকে তড়িৎচৌম্বক বলের ক্ষেত্রে চার্জের কোন পরিবর্তন ঘটে না। ফলে এক্ষেত্রে যে কারেন্ট পাওয়া যায় তাকে নিউট্রাল কারেন্ট বলা যায়।
ওয়াইনবার্গ ও সালামের তত্ত্ব প্রমাণ করে যে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হলো বিনিময় কণা বোসনের ভরে। তড়িৎচৌম্বক বলের ক্ষেত্রে বিনিময় কণা ফোটন ভরহীন, কিন্তু দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের ক্ষেত্রে বিনিময় কণা বোসনের ভর প্রোটনের ভরের প্রায় একশ' গুণ। দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের বোসনকে এ কারণে ভারী ফোটনও বলা হয়।
আবদুস সালাম ও স্টিভেন ওয়াইনবার্গ ধারণা দেন যে দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের ক্ষেত্রে নিউট্রাল কারেন্ট ও চার্জড-কারেন্ট দুটোই পাওয়া যেতে পারে। দুটো মিথষ্ক্রিয়ার বল বিনিময় কণাগুলোকে একই পরিবারভুক্ত করে নাম দেয়া হয় W+, W- এবং Z0 বোসন। +, - এবং ০ যথাক্রমে ধনাত্মক, ঋণাত্মক এবং নিউট্রাল চার্জড বোসন বোঝায়। তিনটাকে এক সাথে ইন্টারমিডিয়েট ভেক্টর বোসন বলা হয়। এই ভেক্টর বোসনগুলো নিউক্লিয়াসের ভেতরে খুবই ভারী। আর সেখানেই দুর্বল মিথষ্ক্রিয়া ঘটে। নিউক্লিয়াসের বাইরে ঘটে তড়িৎচৌম্বক মিথষ্ক্রিয়া।
১৯৬৮ সালের মে মাসে সুইডেনের গুটেনবার্গে 'নোবেল সিম্পোজিয়াম'এ আবদুস সালাম তাঁর 'ইলেকট্রো-উইক ফোর্স'এর বর্ণনা দেন। নোবেল ফাউন্ডেশান প্রতি বছর নোবেল সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে। অনেক নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী উপস্থিত থাকেন সেই সিম্পোজিয়ামে। সিম্পোজিয়ামে আবদুস সালামের বক্তৃতাকে কেউ খুব একটা গুরুত্ব দিলো না। কারণ অনেকে বুঝতেই পারেননি তিনি আসলে কী বলতে চাচ্ছিলেন। এমনকি সিম্পোজিয়ামের আয়োজক মারি গেল-মান তাঁর সমাপনী বক্তৃতায় সালামের প্রবন্ধের উল্লেখ পর্যন্ত করেননি।
কিন্তু পরীক্ষাগারে নিউট্রাল কারেন্ট আর ভারী বোসন পাওয়া গেলেই সালাম-ওয়াইনবার্গ-গ্ল্যাশোর তত্ত্ব প্রমাণিত হয়ে যাবে। আবদুস সালাম অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না তাঁকে। ১৯৭৩ সালে সার্নের পরীক্ষাগারে নিউক্লিয়াস ও নিউট্রিনোর মিথষ্ক্রিয়া ঘটিয়ে কোন ধরনের চার্জ বিনিময় ছাড়াই দুর্বল নিউক্লিয়ার মিথষ্ক্রিয়া ঘটানো সম্ভব হলো। নিউট্রাল কারেন্টের অস্তিত্ব প্রমাণিত হলো। ফার্মি ল্যাবেও একই ধরনের রেজাল্ট পাওয়া গেলো। প্রফেসর সালামের তত্ত্ব পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হলো। ১৯৭৮ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রন এক্সিলারেটরে (SLAC) ইলেট্রন ও ডিউটেরনের মিথষ্ক্রিয়া ঘটিয়েও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল এবং তড়িৎচালক বলের সমন্বয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৯ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় বিজ্ঞানী আবদুস সালাম, স্টিভেন ওয়াইনবার্গ ও শেলডন গ্ল্যাশোকে।
No comments:
Post a Comment