আমি তখন ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পোস্টডক করছিলাম। আমেরিকার জীবন খুব একটা ভালো লাগছিলো না। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলি তখন সবেমাত্র অনলাইনে আসা শুরু করেছে। সেগুলিই খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তাম দেশের খবর জানার জন্য। মাতৃভূমির বাইরে অন্য যে কোন দেশেই যাই না কেন, থাকি না কেন - দেশ থেকে খুব বেশি দূরে যাবার উপায় থাকে না। সেই সময়ের প্রতিক্রিয়াগুলি খুঁজে পেলাম অনেকদিন পর।
৩ সেপ্টেম্বর ২০০৪
গত সপ্তাহে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সভায় গ্রেনেড হামলা হয়েছে। এ নিয়ে বেশ রাজনীতি হচ্ছে এখন বাংলাদেশে। সংবাদপত্র পড়লাম। গতকালের প্রথম আলো পড়লাম। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এখন তদন্তে গেছে বাংলাদেশে।
১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট দিনাজপুরের কোতোয়ালি থানার গোলাপবাগ রামনগর গ্রামের এমাজউদ্দিনের কিশোরী কন্যা ইয়াসমিন আক্তার ঢাকা থেকে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবার সময় দিনাজপুরের দশমাইল নামক স্থানে বাস থেকে নামার পরে পুলিশের এএসআই মইনুল হক, কনস্টেবল আবদুস সাত্তার ও ভ্যানচালক অমৃতলাল বর্মন এগিয়ে আসে। বাড়িতে পৌঁছে দেবে বলে গাড়িতে তোলে ইয়াসমিনকে। তিনজনে মিলে তাকে ধর্ষণ করার পর খুন করে। ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট তারিখে এই তিনজনের ফাঁসির আদেশ হয়। গত পরশু এই তিনজনের মধ্যে দুইজনের ফাঁসি হয়ে গেছে। অমৃতলাল এখনো বেঁচে আছে। সে নাকি প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমার আবেদন করেছে।
আমাদের দেশের খবরগুলি একজন সুস্থ মানুষকে পড়তে দিলে সে অসুস্থ হয়ে যাবে। আমরা হজম করছি কীভাবে? অনেক সময় দেখা যায় খাবার খেতে খেতেও পড়ছি এইসমস্ত খবর। খাদ্যের স্বাদও বদলে যাচ্ছে না। আমরা কি সুস্থ আছি? জীবাণুর আক্রমণ রেগুলার হতে হতে আমাদের সহ্যশক্তি বেড়ে গেছে। এই সহনশীল মানুষ কারা? আমরা যারা ভদ্রলোক নামক কিছু ক্লীব আছি - যারা ভালো ভালো কথা বলতে চেষ্টা করি, কিন্তু সমস্ত অন্যায় সহ্য করি। আমাদের এরকম সহনশীলতার কোন দরকার ছিল কি?
প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার আরেকটি ছোট খবর এরকম: জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের জঙ্গলে এক গৃহবধূকে দেলোয়ার হোসেন ও লিটন মিয়া নামে দুইজন পুরুষ ধর্ষণ করার পর স্পাইনাল কর্ড কেটে দেয়, পায়ের রগ কেটে দেয়, গলা কেটে দেয়। গৃহবধূটি মরে না গিয়ে শরীরে পচন নিয়েও অপেক্ষা করেছে সাহায্যের। পুলিশ এসেছে। কারা ধর্ষণ করেছে জানা গেছে। কিন্তু তাদের কিছু হয়নি এখনো। ঐ পুরুষেরা তাদের পুরুষ শরীর নিয়ে পুরুষত্ব জাহির করে চলেছে। আমি নিজেও পুরুষ। আমার কিন্তু একটুও লজ্জা হচ্ছে না এজন্য। আমি কি সুস্থ আছি?
নওগাঁর মান্দা উপজেলার কাঁশোপাড়া গ্রামে বখাটে যুবকদের অত্যাচারে স্কুলশিক্ষিকা সেলিনা আক্তার আত্মহত্যা করেছেন। বখাটেরা আনন্দে আছে। তাদের পুরুষত্বের অস্ত্রে শান দিচ্ছে অন্য কোন সেলিনাকে টার্গেট করার জন্য। হোক না শিক্ষিকা, হোক না মন্ত্রী, মেয়ে তো! আমাদের দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দুই পার্টির দুই প্রধান হলেন মহিলা, নারী। তারপরও আমাদের দেশে নারীর উপর এত অত্যাচার কেন?
সেলিনার আত্মহত্যা বিষয়ে সম্পাদকীয় লিখেছে প্রথম আলো। এরকম ঘটনায় প্রথম আলোতে আমিও একবার চিঠি লিখেছিলাম। এখন আর লিখি না। কারণ? কারণ মনে হচ্ছে আমি নিজেকে জাহির করার জন্যই লিখেছিলাম। কোন সামাজিক পরিবর্তনের আশায় নয়। কারণ পত্রিকায় চিঠি লিখে সামাজিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হলে সমাজ কত আগেই সোজা হয়ে যেতো।
আমি নিজেও কত কিছু মেনে নিতে বাধ্য হই। আমার যে কোন ক্ষমতা নেই তা আমি জানি। সেলিনার উপর আমার রাগ হচ্ছে। রাগ হচ্ছে সিমির উপরও। রাগ আছে রহিমার উপরও। কারণ - মরেই যাবে সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছো, মেরেও তো মরতে পারতে। তাতে অন্তত কিছু কুকুর তো কমতো। সরি, কুকুর বলা ঠিক হয়নি। কুকুরের সম্মান তাদের প্রাপ্য নয়। কুকুররা টিজ করে না। কুকুরের সাধ্য নেই কোন কুকুরিকে ধর্ষণ করার। পারস্পরিক সম্মতিতেই পশুদের শারীরিক সম্পর্ক হয় বলে আমার ধারণা।
No comments:
Post a Comment