প্রফেসর আটিলা ক্রাজনাহোর্কে ও তাঁর সহকারী। |
মহাবিশ্বের সবগুলো ঘটনার বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ ব্যাখ্যা করা যায় চারটি মৌলিক বলের মাধ্যমে। এই চারটি মৌলিক বল হলো স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স বা সবল নিউক্লিয়ার বল, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স বা তড়িৎচুম্বক বল, উইক-নিউক্লিয়ার ফোর্স বা দুর্বল নিউক্লিয়ার বল, এবং গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ বল। এই চার ধরনের বলকে মৌলিক বল বলা হয় কারণ অন্যান্য যে কোন ধরনের বল আসলে এই চারটি বলের মধ্য থেকেই উদ্ভুত। বিগ ব্যাং-এর আগে প্রকৃতির সবগুলো বল একসাথে মিলেমিশে ছিল। বিগ-ব্যাং এর পর মহাবিশ্ব যতই প্রসারিত হয়েছে এই বলগুলো আস্তে আস্তে আলাদা হয়ে নিজস্ব রূপ ধারণ করেছে। বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানীরা - আইনস্টাইন থেকে শুরু করে স্টিফেন হকিং পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন সবগুলো মৌলিক বলের একটা সমন্বিত তত্ত্ব - 'গ্রান্ড ইউনিফিকেশান থিওরি' অথবা 'থিওরি অব এভরিথিং' প্রতিষ্ঠা করার জন্য। বিজ্ঞানী আবদুস সালাম, শেলডন গ্লাশো, এবং স্টিভেন ওয়াইনবার্গ দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচুম্বক বলের সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু সবল নিউক্লিয়ার বল ও মহাকর্ষ বলের সমন্বয় ঘটানো এখনো সম্ভব হয়নি। একবিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানীরা একদিকে এই সমন্বিত বল খুঁজে পাবার চেষ্টা করছেন, আবার অন্যদিকে আরো একটি নতুন মৌলিক বলের সন্ধান পাবার সম্ভাবনাও দেখছেন। গত মাসের শেষের দিকে এই পঞ্চম মৌলিক বলের সম্ভাবনার ব্যাপারে বিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানীরা খুবই আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।
সবচেয়ে কম দূরত্বের মধ্যে কাজ করে সবল নিউক্লিয়ার বল। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতরের প্রোটন ও নিউট্রনকে একসাথে ধরে রাখে এই বল। প্রোটন ও নিউট্রন কোয়ার্ক দ্বারা গঠিত। প্রোটনের আছে দুইটি আপ-কোয়ার্ক এবং একটি ডাউন-কোয়ার্ক। আর নিউট্রনের আছে একটি আপ-কোয়ার্ক এবং দুইটি ডাউন কোয়ার্ক। আপ-কোয়ার্কের চার্জ হলো +২/৩ এবং ডাউন-কোয়ার্কের চার্জ হলো -১/৩। সুতরাং প্রোটনের চার্জ দাঁড়ায় +২/৩ + ২/৩ - ১/৩ = +১ এবং নিউট্রনের চার্জ দাঁড়ায় +২/৩ -১/৩ - ১/৩ = ০। নিউক্লিয়াসের ভিতর সব প্রোটন যেহেতু একই ধরনের ধনাত্মক চার্জ বহন করে, কুলম্বের সূত্র অনুসারে একটি প্রোটন আরেকটি প্রোটনকে বিকর্ষণ করার কথা। কিন্তু নিউক্লিয়াসের ভেতর প্রোটন ও নিউট্রনগুলো এত কাছাকাছি থাকে যে তাদের ভেতর কাজ করে সবল নিউক্লিয়ার বল - যা নিউক্লিয়াসের ভেতর যা আছে সবকিছুকেই প্রচন্ড বলে একটির সাথে অন্যটিকে আকর্ষণ করে রাখে। সবল নিউক্লিয়ার বলের সর্বোচ্চ সীমা হলো মাত্র ১ ফেমটোমিটার বা ১০-১৫ মিটার। এর বাইরে সবল নিউক্লিয়ার বল কাজ করে না। এর বাইরে গেলে অন্যান্য মৌলিক বলের নিয়ম কার্যকর হয়। প্রাবল্যের দিক থেকে তুলনামূলকভাবে সবল নিউক্লিয়ার বল হলো সবচেয়ে প্রবল বল।
সবল নিউক্লিয়ার বলের ১৩৭ ভাগের একভাগ প্রাবল্যসম্পন্ন বল হলো তড়িৎচুম্বক বল। চার্জিত কণাগুলোর মধ্যে এই বল কাজ করে। এই বলের নির্দিষ্ট কোন সীমা নেই। একটি চার্জিত কণা থেকে অন্য চার্জিত কণার দূরত্ব যত বাড়ে এই বলের পরিমাণ দূরত্বের বর্গের বিপরীত অনুপাতে কমতে থাকে। সমধর্মী চার্জ পরস্পর বিকর্ষণ করে, কিন্তু বিপরীতধর্মী চার্জ পরস্পর আকর্ষণ করে। ইলেকট্রন ও প্রোটনের মধ্যে যে আকর্ষণ বল - তা হলো তড়িৎচুম্বক বল, আবার একটি ইলেকট্রন আরেকটি ইলেকট্রনকে যে বলে বিকর্ষণ করে তাও তড়িৎচুম্বক বল।
দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের সর্বোচ্চ প্রাবল্য সবল নিউক্লিয়ার বলের প্রাবল্যের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ প্রক্রিয়ায় পরমাণুর নিউক্লিয়াসের যে পরিবর্তন ঘটে তার জন্য দায়ী এই দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। কিছু কিছু তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াসের একটি নিউট্রন - একটি প্রোটন, একটি ইলেকট্রন ও একটি এন্টি-নিউট্রনে পরিণত হয় দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের কারণে। এধরনের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়াকে বিটা-মাইনাস বিকিরণ বলে। আবার এই বলের কারণেই ঘটে বিটা-প্লাস বিকিরণ যেখানে নিউক্লিয়াসের একটি প্রোটন রূপান্তরিত হয় একটি নিউট্রন ও একটি পজিট্রনে।
মৌলিক বলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম প্রাবল্যের বল হলো মহাকর্ষ বল। মহাকর্ষ বলের প্রাবল্য সবল নিউক্লিয়ার বলের দশ হাজার কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ (১০^-৩৯)। চারটি মৌলিক বলের প্রথম তিনটির সাথে মহাকর্ষ বলের প্রধান পার্থক্য হলো এই বলের আদান-প্রদানের জন্য যে বোসনকে দায়ী বলে ভাবা হচ্ছে সেই বোসন কণা গ্রাভিটনের অস্তিত্ব এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু অন্য তিনটি মৌলিক বলের বোসন কণার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন সবল নিউক্লিয়ার বল বহনকারী বোসন কণা গ্লুয়ন, তড়িৎচুম্বক বল বহনকারী বোসন কণা ফোটন, এবং দুর্বল নিউক্লিয়ার বল বহনকারী W+, W- এবং Z বোসন কণা। সবগুলো মৌলিক বল একত্রীকরণে এখনো সবচেয়ে বড় বাধা হলো মহাকর্ষ বলের ব্যতিক্রমধর্মিতা।
এর মধ্যেই সম্প্রতি পঞ্চম মৌলিক বল আবিষ্কারের একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। হাঙ্গেরির অ্যাটমিক ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার রিসার্চের গবেষক আটিলা ক্রাজনাহোর্কে (Attila Krasznahorkay) ও তাঁর গবেষক দল অনেক বছর ধরে কাজ করছেন নিউক্লিয়ার আইসোটোপ নিয়ে। ২০১৬ সালে বেরিলিয়াম-৮ আইসোটোপের বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তাঁরা একটি অজানা কণার সন্ধান লাভ করেন। বেরিলিয়াম-৮ ক্ষয় হয়ে দুটি হিলিয়াম-৪ নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। এই ক্ষয় হবার সময় ইলেকট্রন ও পজিট্রন নির্গত হয়। কণা-পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুযায়ী ইলেকট্রন ও পজিট্রন যে কৌণিক দিকে নির্গত হবার কথা, বেরিলিয়াম-৮ এর বেলায় তার ব্যতিক্রম ঘটতে দেখা গেছে। বেরিলিয়াম-৮ এর বেলায় দেখা গেছে ইলেকট্রন ও পজিট্রন পরস্পর ১৩৫ ডিগ্রি কোণে নির্গত হচ্ছে। প্রচলিত পদার্থবিজ্ঞানের কোন সূত্র দিয়েই এর সঠিক কোন কারণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছে না। ২০১৬ সালে ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারে তাঁদের গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়। ধারণা করা হচ্ছে যে একটি নতুন মৌলিক বল এর জন্য দায়ী। একটি নতুন বোসন কণা এক্স-১৭ এই নতুন মৌলিক বল বহন করছে। এই অজানা কণার ভর হিসেব করে দেখা গেছে ১৭ মেগা-ইলেকট্রনভোল্টের সমান যা ইলেকট্রনের ভরের ৩৩ গুণ। (একটি ইলেকট্রনের ভরকে শক্তিতে রূপান্তরিত করলে ৫১১ কিলো-ইলেকট্রনভোল্ট শক্তি পাওয়া যায়।) এই ভরের কারণেই আপাতত এর নাম রাখা হয়েছে এক্স-১৭। সম্প্রতি তাঁরা হিলিয়াম-৪ পরমাণুর নিউক্লিয়াসের বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েও বেরিলিয়াম-৮ এর বিকিরণের অনুরূপ ফলাফল পর্যবেক্ষণ করেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী জনাথন ফেং এবং দল বেরিলিয়াম-৮ এর ব্যতিক্রমী ফলাফলের কারণ অনুসন্ধান করতে শুরু করেছেন। তাঁর মতে এই এক্স-১৭ হতে পারে পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থ বা কৃষ্ণ-বস্তুর মধ্যে সংযোগ। মনে হচ্ছে এক্স-১৭ শুধুমাত্র নিউট্রনের উপর কার্যকর, প্রোটনের উপর এর কোন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নেই। নইলে এটা শনাক্ত করতে এত সমস্যা হতো না। সেজন্যই এই বলকে প্রোটন-বিদ্বেষী বলও বলা হচ্ছে।
ইতালির পজিট্রন এনাইহিলিশান ইনটু ডার্ক ম্যাটার এক্সপেরিমেন্ট গ্রুপ এক্স-১৭ বোসন খুঁজতে শুরু করেছে। এই গ্রুপের বিজ্ঞানীরা ২০২১ সালের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরীক্ষণ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বিজ্ঞানীরা যতই আশাবাদী হোন - পঞ্চম মৌলিক বলের অস্তিত্বের ব্যাপারে এখনো যথেষ্ট প্রমাণ হাতে আসেনি। তবে আগামী বছরগুলোতে পদার্থবিজ্ঞানে নতুন বিপ্লব ঘটে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। ধারণা করা হচ্ছে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অনেক সূত্র আবার নতুন করে লিখতে হবে।
No comments:
Post a Comment