Saturday, 7 August 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৩২



স্বপ্নলোকের চাবি – ৩২

গত ক’দিন ধরে বিছানায় পড়ে পড়ে যেভাবে বই পড়ছি – সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা ঠিক হলে এতদিনে আমার মাছির মতো অনেকগুলি চোখ গজিয়ে যাবার কথা। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’ প্রবন্ধটি আমাদের উচ্চমাধ্যমিকের বাংলার সিলেবাসে ছিল। সিলেবাসের পড়ায় আনন্দের চেয়ে উৎকন্ঠা কাজ করে বেশি। ভালো লাগুক না লাগুক, পরীক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে পড়তে হলে পড়ার আনন্দটা কেমন যেন ফিকে হয়ে যায়। তাই উচ্চমাধ্যমিকের আগে ‘বই কেনা’ পড়ে যে অনুভূতি হয়েছিল – সম্প্রতি প্রবন্ধটি আবার পড়ে তার চেয়ে ভিন্ন ধরনের অনুভূতি হলো। আনাতোল ফ্রাঁসের কথাগুলিকে নতুন করে বুঝতে পারলাম। তিনি কী সুন্দর করে বলেছেন - আমার মনের চোখ বাড়ানো কমানো আমার নিজের হাতে। নতুন নতুন বই পড়লে নতুন নতুন চোখ খুলে যায় মনের ভেতর।আমারও মনের চোখ হয়তো খুলেছে কয়েকটা। কিন্তু এই কয়েকটাতেই ঝামেলা শুরু হয়ে গেছে। 

ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একই জিনিস ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ধরা দেয়। ধরা যাক – আদর্শের কথা। বিজ্ঞানে আদর্শ বলতে কিছু নির্দিষ্ট ব্যাপার বোঝায় যা পৃথিবীর সব জায়গাতে সব দৃষ্টিভঙ্গিতেই এক থাকে – আদর্শ গ্যাস, আদর্শ তাপমাত্রা ইত্যাদি। কিন্তু যখনই আদর্শ মানুষের কথা আসে – তখন একেক জনের চোখের সামনে একেক রকমের মানুষ এসে দাঁড়ায়। কিন্তু যে কোনো মানুষেরই কাজে-কর্মে ভুলভ্রান্তি থাকে, স্ববিরোধিতা থাকে। কাউকে আদর্শ মানতে হলে – তাঁর ভুলভ্রান্তিগুলি উপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু মনের চোখ যতই বাড়তে থাকে – এই ভুলভ্রান্তিগুলি এড়িয়ে যাওয়া ততই অসম্ভব হয়ে পড়ে।
 
রাজনৈতিক আদর্শের ব্যাপারে যতই দিন যাচ্ছে ততই কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছি। শ্রেণিবৈষম্যহীন শোষণহীন সমাজব্যবস্থা তৈরি করার সংগ্রামের কথা পড়তে পড়তে মনের ভেতর এক ধরনের ভালোলাগা তৈরি হয়। কিন্তু যখনই দেখি এই কঠিন সংগ্রামের পথে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগলেই দল বদল করছেন, রাতারাতি আদর্শ বদল করছেন – তখন কেমন যেন হতাশ লাগে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বেশ কিছু নেতার কাজকর্ম কাছ থেকে দেখে আমি হতাশ হয়ে পড়েছি। আর জাতীয় নেতৃত্বের কথা বাদই দিলাম। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মওদুদ আহমেদ এবং তাঁর আগের প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর রাজনৈতিক গতিবিধি লক্ষ্য করলেই তো বোঝা যায়। 

আর ধর্মকে হাতিয়ার করে যারা রাজনীতি করছে তাদের ভন্ডামীর কোন শেষ নেই। চট্টগ্রামের হাতেগোনা কয়েকটি কলেজ বাদে আর সবগুলিতে এখন তাদেরই দাপট। যখন যাকে খুশি মেরে-ধরে খুন করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ফেলেছে তারা। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হচ্ছে। এতে ছাত্রশিবির আরো ক্ষেপে উঠেছে। প্রত্যেকদিন মারপিট হচ্ছে কোথাও না কোথাও। আমাদের ইউনিভার্সিটির সবকিছুই এখন তাদের দখলে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হচ্ছে এখানেও। শোনা যাচ্ছে এবছরের শেষের দিকে চাকসু নির্বাচন হবে। দেখা যাক কী হয়। 

নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ‘ইস্পাত’ পড়লাম টানা দু’দিন ধরে। পড়তে পড়তে মনের ভেতর এক ধরনের ঝড় বয়ে যাবার অবস্থা হয়েছে। মানুষ যখন লড়াই করবার মতো একটা আদর্শ খুঁজে পায়, তখন সে যে কোনো কষ্ট সইবার বলিষ্ঠতা অর্জন করে। অস্ত্রভস্কি ব্যক্তিগতভাবে সেই আদর্শ খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে এধরনের একটি বই লেখা সম্ভব হয়েছে। কী সংগ্রামী জীবন তাঁর। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই বিপ্লবে যোগ দেন। আঠারো বছর বয়সে টাইফাস আর রিউম্যাটিজমে আক্রান্ত হয়ে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েন। বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি দূরশিক্ষণের মাধ্যমে পড়াশোনা করেন। কিন্তু ২৫ বছর বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান। এই অবস্থাতেই তিনি কয়েক বছরের কঠোর পরিশ্রমে লিখে ফেলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস – ইস্পাত। মাত্র ৩২ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। একটিমাত্র উপন্যাস লিখেই সাড়া ফেলে দিয়েছেন পৃথিবীতে। এই উপন্যাসটা পড়ে মনের ভেতর উদ্দীপনা জাগে – আবার কিছুটা সন্দেহও। কারণ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের পার্টির নির্দেশের বাইরে স্বাধীনভাবে কোনকিছু লেখা তো দূরের কথা, চিন্তা করারও সুযোগ নেই। পার্টির নির্দেশে সত্য কথা যেমন বলতে হয়, আবার তেমনি সত্য গোপনও করতে হয়। এখানেই আমার আপত্তি। 

ইস্পাত বইয়ের দুই খন্ডই আমাকে উপহার দিয়েছে বিপ্লব। খুবই জরাজীর্ণ অবস্থায় এই বই দুটো সে কোত্থেকে জোগাড় করেছে জানি না। আমি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আঁঠা লাগিয়ে সেগুলিকে ঠিক করেছি। আমার সব বইয়েরই প্রায় এরকমই হাল হয়েছে। রুমে আর্দ্রতা এত বেশি যে বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে ফাঙ্গাস জমে যাচ্ছে – আর মলাট আলগা হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য বইয়ের দোষ খুব একটা দেয়া যায় না। ঝকঝকে ছাপা শক্ত মলাটের বই আমার খুব বেশি নেই। কারণ একটা নতুন বইয়ের দাম দিয়ে আমি পাঁচটা পুরনো বই কিনে আনি। মুক্তধারা একই বইয়ের দুই ধরনের প্রিন্ট বের করে – নিউজপ্রিন্ট আর হোয়াইটপ্রিন্ট। কম টাকায় বেশি বই কেনার জন্য আমি নিউজপ্রিন্টের বই কিনি। সেগুলি আমার রুমের আর্দ্রতায় ফুলে-ফেঁপে ওঠে। জলসা সিনেমার সামনে ফুটপাতে, ওভারব্রিজের উপরে বই বিক্রি হয়। এগুলির প্রায় সবগুলিই ভারতীয় লেখকদের পাইরেটেট বই। লেখক জানেনও না যে তাদের বই কোথায় ছাপানো হচ্ছে, কোথায় বিক্রি হচ্ছে। আমারও এতে কিচ্ছু যায় আসে না। কোন বই পড়তে ইচ্ছে হলেই আমি কিনে নিয়ে আসছি ফুটপাত থেকে। মাত্র দশ টাকায় নীহাররঞ্জন গুপ্তের তিনটি উপন্যাস, শরৎচন্দ্রের পথের দাবী মাত্র পাঁচ টাকা। কিন্তু কিছু কিছু বই আমাকে অনেক দাম দিয়ে কিনতে হয়। সত্যজিৎ রায়, শংকর, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন বই বের হলে তা কারেন্ট বুক সেন্টার, কিংবা মিমি সুপার মার্কেটের লাইসিয়াম থেকে বইয়ের গায়ে যে দাম লেখা থাকে তার সাড়ে তিন গুণ দাম দিয়ে কিনতে হয়। আমার টিউশনির টাকাগুলি বেশ কাজে লাগে এখানে। 

টিউশনির কথায় মনে পড়লো। গত এক সপ্তাহ ধরে টিউশনিতেও যেতে পারছি না। মার্চ মাসের বেতনটাও নিয়ে আসা হয়নি। খান সাহেবের বাড়িতে আর যেতে হচ্ছে না। তাদের পরীক্ষা শেষ। এখলাস আমাকে আরেকটি টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছে। 

রমজানের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। ছুটির আগে আমাদের থার্ড ইয়ারের ক্লাস হয়েছে মাত্র দুই সপ্তাহ। এই দু’সপ্তাহের মধ্যে এক সপ্তাহ ক্লাসগুলি ঠিকমতো করেছি। কিন্তু ছুটি শুরু হবার কয়েকদিন আগে থেকে আর ক্যাম্পাসে যেতে পারিনি। যেতে না পারার কারণটা যতটা না কষ্টের – তার চেয়েও অপমানের। রাজনৈতিক গুন্ডাদের হাতে মার খেয়েছি – তেমন কোন কারণ ছাড়াই। 

রেজওয়ানা চৌধুরি বন্যার গান শুনতে গিয়েছিলাম সেন্ট প্লাসিডস স্কুলে। একটা ক্লাবের উদ্যোগে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান। রেজওয়ানা চৌধুরি ছাড়াও শামীম আরা নীপা আর শিবলি মোহাম্মদেরও আসার কথা ছিল। পঞ্চাশ টাকার টিকেট কিনেছিলাম আমি আর মুকিতভাই। বিকেলবেলা অনুষ্ঠান। সময় মতো গেলাম। সামনাসামনি বসে রেজওয়ানা চৌধুরীর গান শুনবো, শামীম আরা নীপা আর শিবলী মোহাম্মদের নাচ দেখবো প্রথমবারের মতো – অনেক উৎসাহ নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম খুবই বাজে ব্যবস্থাপনা। পঞ্চাশ টাকার টিকেটের সামনে বেশ কয়েকসারি এক শ টাকার টিকেটের চেয়ার। সস্তা ডেকোরেশান থেকে আনা কাঠের ফোল্ডিং চেয়ারগুলির অবস্থা নড়বড়ে। অনুষ্ঠান শুরুর পর জানা গেল শামীম আরা নীপা আর শিবলী মোহাম্মদ আসেননি -তাঁদের বদলে স্থানীয় কোন শিল্পী নাচবেন। সবকিছু মোটামুটি চলছিল ঠিকমতোই। রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে মেজাজ, এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে নৃত্যযোগ – সবই ঠিক ছিল। 

কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ দেখা গেল স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার তার দলবল নিয়ে হাজির। দলবলে যারা ছিল তারা সবাই স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। আমরা আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের সামনের সারির দর্শকরা তাদেরকে সরতে বলার পরেও তারা সরার কোন দরকার মনে করলো না। তাদের শারীরিক ভাষা ক্রমশই কদর্য হয়ে উঠতে শুরু করলো। 

আয়োজকদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। প্রচন্ড হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যেই তারা চিৎকার শুরু করলো – “গরম গান ধরেন আপা”, “প্যানপ্যানানি বন্ধ করেন।“ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। বাংলা সিনেমার হিরোদের মতো উঠে কয়েকজনকে ধরে পিটিয়ে হল থেকে বের করে দিতে পারলে শান্তি লাগতো। কিন্তু সিনেমা আর বাস্তব তো এক নয়। রেজওয়ানা চৌধুরি গান বন্ধ করে স্টেজে বসে রইলেন। হৈচৈ না থামলে তিনি গান করবেন না। 

পেশী আর মুদ্রার দাপটে সংস্কৃতিহীন রাজনীতিবিদ আর তাদের ভাড়াটে কর্মীদের হাতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অপমান বসে বসে কতক্ষণ দেখা যায়। দর্শকদের মধ্যে থেকে অনেকেই  “আপনারা পেয়েছেন কী এখানে?” “চুপ করে বসেন” ইত্যাদি মন্তব্য শুরু করলে আমরাও গলা মেলালাম। 

একটু পরেই ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেল। সম্ভবত তাদের দাবি – তাদের নেতাকে সামনের সারিতে বসতে দিতে হবে – নইলে অনুষ্ঠান করা যাবে না। আরো চেয়ার এনে সামনের সারির সামনে চেয়ার বসানোর জন্য যারা এতক্ষণ ধরে বসে আছেন সবাইকে তুলে এলোমেলো করে দেয়া হলো। কর্মীদের সবাই হলের ভেতর ছড়িয়ে পড়লো। ঠেলেঠুসে বসে গেল অন্যদের মাঝে। 

আবার গান শুরু হলো। হঠাৎ গানের মাঝখানে আমাদের পেছন দিক থেকে একজন চিৎকার করে উঠলো – “অ্যাই প্যানপ্যানানি বন্ধ গর্‌, ভাণ্ডারি গান ধর্‌।“

আমি আর মুকিতভাই একসাথে ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকালাম। বেশ মোটাসোটা জঙ্গি টাইপের এক যুবক। উগ্রমূর্তিতে বললো – “অই, কী চয়দ্দে? চৌখ গালি দিয়ম।“ 
“কেন, চোখ গালবেন কেন? ভাণ্ডারি গান শুনতে হলে মাইজভান্ডারে যান, এখানে নয়।“ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলে ফেলেছিলাম। কিন্তু এর জন্য যে কত মূল্য দিতে হবে তা তখন মনে আসেনি। 

তারপরের ঘটনা মোটেও সুখকর নয়। খুবই এলোমেলোভাবে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। রেজওয়ানা চৌধুরির পক্ষে আর ধৈর্য ধরে গান করা সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি আরেকটি গান গেয়েই মঞ্চ ত্যাগ করলেন। মঞ্চে উঠে নেচে নেচে কুমার বিশ্বজিতের গান গাইতে শুরু করলো কিছু ছেলে। আমরা বের হয়ে এলাম। 

একটা ভালো অনুষ্ঠানকে কীভাবে নষ্ট করে দেয়া যায় নষ্ট রাজনীতির ক্ষমতার দাপটে তা মুকিতভাইকে বলতে বলতে মাঠে নামতেই দেখলাম তিন চারজন ছেলে ঘিরে ধরলো আমাদের। ঝাপসা অন্ধকারে আমার চোখ গেলে দেয়ার হুমকিদাতা যুবকটির দিকে তাকাতেই সে আমার মুখ বরাবর ঘুষি চালিয়ে দিল। আমি যন্ত্রণায় দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললাম। একটার পর একটা লাথি কিল ঘুষি সমানে চললো কিছুক্ষণ চারপাশ থেকে। আমার চশমাটা প্রথম ঘুষিতেই ছিটকে পড়ে গিয়েছিল। 

“শুয়রর বাইচ্চা, ছুরি মারি ভারাল বাইর গরি ফেইল্লম তেরিমেরি গইল্লে।“ 
আমি কোন ধরনের তেড়িমেড়ি করলাম না। চুপচাপ মার খেলাম। তাই পাকস্থলীর বাইরে কিলঘুষি পড়লেও মোটামুটি অক্ষত থাকলো। মুকিতভাইয়ের পক্ষেও কিছু করা সম্ভব ছিল না। এতক্ষণ যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছিলেন, রবীন্দ্রনৃত্য দেখছিলেন – তাঁরা সবাই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমার মার খাওয়ার দৃশ্যটাও দেখলেন। আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীতশোনা ভদ্র মানুষ, কারো সাতে-পাঁচে থাকি না। চোখের সামনে কে মার খেলো তাতে আমাদের কী এসে যায়! শুধু শুধু প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনবো? 

যাই হোক, অল্পের উপর দিয়েই গেল। শার্টের বোতাম আর পকেট ছিঁড়ে গেছে। মুকিতভাই চশমাটা খুঁজে নিয়েছিলেন। একটা কাঁচ ভেঙে গেছে। বুঝতে পারছি চোখ-মুখ-কপাল ক্রমশ ফুলতে শুরু করেছে। মুকিতভাই দ্রুত রিকশায় তুলে নিউমার্কেটের কাছে এসে একটা ফার্মাসীতে নিয়ে এলেন। ফার্স্ট এইড বলতে চাকা-চাকা করে ফুলে উঠা জায়গা পরিষ্কার করে দেয়া, মুখের ভেতরেও কেটে কেছে কিছুটা – সেটা পরিষ্কার করা। আর কিছু ব্যথানাশক ট্যাবলেট সাথে নিয়ে তিন নম্বর বাসে চড়ে সোজা ফতেয়াবাদ। রাতের বেলা বলে এই মার-খেয়ে-ফুলে-ওঠা মুখ মোটামুটি কাউকে না দেখিয়েই রুমে এসে ঢুকেছি। 

বিছানায় শুতে গিয়ে বুঝলাম সারা শরীরেই ব্যথা। মনে হচ্ছে শরীরের প্রতি ইঞ্চিতে কিল-ঘুষি-লাথি চালিয়েছে তিন চারজনে মিলে। অপরিচিত মানুষের হাতে এই প্রথম মার খেলাম। এটাকে কি কোন আদর্শের কারণে মার খাওয়া বলা যাবে? জানি না। দুটো ভিন্ন ধরনের আদর্শের সংগ্রামে মার খাওয়ার মধ্যে গৌরব আছে।  আর এ ধরনের ঠুনকো কারণে মার খাওয়ার মধ্যে আছে লজ্জা। সে কারণেই চোখ-মুখ-কপালের মারের দাগ মিলিয়ে যাবার আগে ক্লাসে যেতে লজ্জা লাগছিল। ছুরি চালিয়ে দিলে কিংবা গুলি করে দিলে যে কী অবস্থা হতো!

রমজান শুরু হয়েছে এপ্রিলের সাত তারিখ থেকে। আজ বারো তারিখ। দু’দিন পর নববর্ষ। আগামীকাল বাড়িতে চলে যাবো। বাম চোখের নিচে এখনো কালো দাগ রয়ে গেছে। মার খাওয়ার কথা বাড়ির কাউকে বলা যাবে না। মুকিতভাই আজ সকালে বাড়িতে চলে গেছেন। আরো আগেই যাবার কথা ছিল, আমার জন্যে যেতে পারেননি। তিনি এ ক’দিন অনেক করেছেন আমার জন্য। 

একটু আগে হকার বিচিত্রা দিয়ে গেল। আজকের একটা আজাদীও নিয়েছি। সারাদেশের মানুষ এখন বিপুল উৎসাহে শারমিন রীমা হত্যাকান্ডের পুঙ্খানুপূঙ্খ বিবরণ পড়ছে। দশ তারিখ থেকে প্রতিদিনই মুনীর-খুকুর বিভিন্ন রকমের ছবি ছাপানো হচ্ছে পত্রিকাতে। বলা হচ্ছে খুকুর ভালোবাসার জন্যই মুনীর শারমিনকে খুন করেছে। এ কেমন ভালোবাসা! 

ঢাকার বিশিষ্ট চিকিৎসক মেহেরুন্নেসা ও ব্যবসায়ী আবুল কাশেমের ছেলে মুনীর হোসেনের সাথে শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক নিজামুদ্দিনের কন্যা শারমিন রীমার বিয়ে হয়েছিল মাত্র তিন মাস আগে। বিয়ের পরেই রীমা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর স্বামী মুনীর অন্য অনেক নারীতে আসক্ত। এজন্যে মুনীর বিয়ের পর থেকেই রীমার সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করেছিল। এপ্রিলের সাত তারিখ মুনীর ঢাকায় রীমাদের বাসায় গিয়ে রীমার মায়ের কাছে মাফ চেয়ে অনেকটা ভালো হয়ে যাবার অভিনয় করে রীমাকে নিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে চট্টগ্রামে বেড়াতে যায়। সেখান থেকে নয় তারিখ ঢাকায় ফেরার পথে গাড়িতেই ছুরি দিয়ে রীমাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে। তারপর তার মৃতদেহ নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে কাঁচপুর ব্রিজের কাছে ফেলে দিয়ে একা ঢাকায় চলে যায়। দশ তারিখ মুনীরকে গ্রেফতার করা হয়। জানা যায় তার প্রেমিকা হোসনে আরা খুকুর জন্যেই মুনীর তার স্ত্রীকে খুন করেছে। খুকুকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। গত পরশু থেকে সবপত্রিকাতেই মুনীর-খুকুর ঘনিষ্ঠ সব ছবি ছাপানো হচ্ছে। পরকীয়া প্রেমের নানারকম ব্যবচ্ছেদ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব কি আদৌ প্রেম? আদৌ ভালোবাসা? খুকুকে যদি ভালোই বাসতি – তাহলে রীমাকে বিয়ে করলি কেন? আর এটাতো অনেক দিন থেকে চলছিল। তাহলে মুনীরের মা-বাবার তো জানার কথা। সে কারণেই কি মুনীরের মা একপ্রকার তড়িঘড়ি করে রীমাকে ছেলের বউ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন! আর যে মুনীর তার স্ত্রীকে খুন করেছে – খুকু তাকে এরপরেও ভালোবাসতে পারবে? এরকম খুনীকে যে ভালোবাসবে – সে কি মানুষ? 

ভালোবাসার নামে মানুষ যেসব কান্ডকীর্তি করে তাতে যে ভালোবাসার অপমান করা হয় তা তারা বুঝতে পারে না। ভালোবাসার নামে দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করলে তা কি মেনে নেয়া যায়? আমাদের তপনদাও যে এরকম একটা চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করবেন তা আমি কখনোই ভাবিনি। অথচ সেটাই ঘটেছে তিন সপ্তাহ আগে। 

মার্চের ২৪ তারিখ সকালে সুমন এসে খবর দিলো তপনদা তার ক্লাস নাইনে পড়া ছাত্রীকে নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। এই টিউশনিটা সুমনই তপনদাকে দিয়েছিল। এত বড় একটা ষন্ডা লোক ক্লাস নাইনের একটা মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিস – লজ্জাও হলো না একটু! এরপর দু’দিন ধরে আমরা চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে চষে ফেললাম। এমন কোন বন্ধুবান্ধবের বাসা নেই যেখানে গিয়ে তপনদার খোঁজ করিনি। পুলিশে খবর দেয়া হয়। চার-পাঁচ দিন পর তপনদা আর মেয়েটিকে কুমিল্লার একটি হোটেল থেকে পাওয়া যায়। পুলিশ তপনদাকে গ্রেফতার করেছে নিশ্চয়। আমি আশা করবো তপনদার সাথে যেন আমার এ জীবনে আর দেখা না হয়। এদের কান্ড দেখলে মনে হয় সমরেশ মজুমদার ঠিক কথাই বলেছেন – ভালোবাসা একটা লোভেরই অন্যপিঠ। 


2 comments:

  1. মামা, তোমার এই পর্বের লেখাটা আমি বেশি ভালো লেগেছে। এনডিংটা বেশি সুন্দর হয়েছে। তবে তোমার ফেইসবুকে একজন কমেন্ট করেছে, তপনদার মানসিকতা জেনেটিক্যাল প্রবলেম- কথাটার সাথে একমত হতে পারছি না। সেখানে তোমার যুক্তিযুক্ত সুন্দর রিপ্লাইকে কেন জানি না মিস করেছি বলে মনে হয়েছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, তপনদার মানসিকতা জেনেটিক্যাল নয়। মন্তব্যকারী হয়তো অন্যকিছু বোঝাতে চেয়েছিলেন। ওটার জবাব দেয়ার সময় হাতে ছিল না বলে শুধু ধন্যবাদ দিয়েছি। পরে কোন একসময় লিখতে হবে। অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য এবং সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য।

      Delete

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts