স্বপ্নলোকের চাবি – ৩৮
ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ। চুপচাপ শুয়ে আছি চোখ বন্ধ করে। দিদি
অফিসে চলে গেল এইমাত্র। বের হবার আগে আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। চোখ না খুলেই
দেখতে পাচ্ছিলাম তার উদ্বিগ্ন মুখ। কপালে হাত দিয়ে জ্বরটা দেখে ইস্ করে একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে চাপাস্বরে বললো, “জ্বরটা এখনো কেন কমছে না!” তারপর দ্রুত বের হয়ে যাবার সময় ছেলের
উদ্দেশ্যে বলতে শুনলাম, “ছোটমামাকে একটুও বিরক্ত করবে না বাবা। লক্ষ্মী হয়ে থাকবে।“
মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী মানুষের বাসায় দিন শুরু হয় অনেক সকালে।
একই পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরিজীবী হলেও সংসারের কাজকর্ম সামলানোর ঝড়ঝাপটার
পুরোটাই যায় স্ত্রীর উপর দিয়ে। সবকিছু রেডি করে অফিসে যাওয়ার সময় হলে স্বামীকে ডেকে
তোলার দায়িত্বটাও স্ত্রীর উপর বর্তায়। ব্যতিক্রম হয়তো আছে, কিন্তু এখনো চোখে পড়েনি।
একটু পরেই বুঝতে পারলাম খাটে উঠে আমার মাথার কাছে এসে বসলো
একজন। ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে আমার চোখের পাতা খোলার চেষ্টা করছে। আমি চোখ খুলতেই মুখের
কাছে ঝুঁকেপড়া ছোট্টমুখে একগাল হাসি।
“ছোতমামা, তুমি কি আমাকে চিন?”
গতকাল থেকে সে যখনই সুযোগ পাচ্ছে এই প্রশ্নটা করেই যাচ্ছে।
তার কাকুরা নাকি বলেছে আমি সবকিছু ভুলে গেছি, আমি এখন কিছুই জানি না, কাউকেই চিনি না।
এই ব্যাপারটা সত্য কি না বোঝার চেষ্টা করছে সে। গতকাল থেকে অনেকবার তার প্রশ্নের উত্তর
দিতে হয়েছে। আজ সকালে আবারো শুরু হলো।
আমি গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কে?”
“আমি পত্তয়”
তিন বছর চার মাস হলো তার – এখনো ‘প্রত্যয়’ বলতে পারে না।
মদন টাইপের কিছু একটা সোজা নাম রাখলে ভালো হতো। আমি তার একটা ডাকনামও দিয়েছিলাম - বৃত্ত।
কিন্তু সবার মুখে সেটা হয়ে গেল ভিত্য। তবু ভালো যে ভৃত্য বলে ডাকা শুরু করেনি। এখন
সবাই তাকে বাবু বলে ডাকে। কিন্তু নাম জিজ্ঞেস করলে সে কখনো নিজের নাম বাবু বলে না।
“পত্তয় কে? আমি তো পত্তয়কে চিনি না।“
“আমি আমি – আমি পত্তয়। তুমি আমার ছোতমামা। তুমি আমাকে মিমি
এনে দাও।“
তার হাত নিশপিশ করছে আমার মাথায় হাত দেয়ার জন্য। কাঁধে উঠে
দুই হাতে আমার মাথার চুল টানা তার অভ্যাস। চুল ছোট করে রাখলে তার আরো মজা। ছোট ছোট
আঙুলে মাটি থেকে ঘাস তোলার মতো করে চুল টানে তখন। কিন্তু এখন মাথায় পুরো ব্যান্ডেজের
কারণে তার প্রিয় কাজ সে করতে পারছে না।
“তোমাকে কে মেরেছে ছোতমামা?”
এই প্রশ্নটাও তার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে তার কাকুরা। তারা নাকি
বলেছে কারা যেন আমাকে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলেছে।
“আমাকে কেউ মারেনি। পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি।“
আমার উত্তরে সে খুশি হলো না। মনে হচ্ছে আমাকে কেউ ধোলাই দিয়েছে
বললে সে খুব খুশি হতো। আনন্দের ব্যাপারটা চিরকালই আপেক্ষিক।
“বাবু, আসো - খেতে হবে” – বলতে বলতে রুমে ঢুকলো স্মৃতিবৌদি।
আমি জেগে উঠেছি দেখে দুখিদুখি মুখে জিজ্ঞেস করলো, “আঁরে চিনর্ নে?”
স্মৃতিবৌদি আমার মাসতুতো দাদার বউ। বৌদি হবার আগে দূরসম্পর্কের
দিদি ছিল। সে জিজ্ঞেস করছে আমি তাকে চিনতে পারছি কি না। স্মৃতিবৌদিরও ধারণা আমার স্মৃতি
নষ্ট হয়ে গেছে! কাল রাতে সে বাড়ি থেকে এসেছে আমাকে দেখতে। এসেই যা করেছে সেটা মনে করে
আমার হাসি পেয়ে গেল। কিন্তু হাসলাম না। স্মৃতিভ্রংশ হয়ে যাবার ধারণাটা আমার কাছে বেশ
মজাই লাগছে। তাছাড়া মাথায় প্রচন্ড ব্যথার কারণে ভালো করে হা করতে পারছি না, কথাই বলতে
পারছি না, হাসবো কি।
আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্মৃতিবৌদি হয়তো ধরেই নিয়েছে
যে আমি তাকে চিনতে পারছি না। সে প্রত্যয়কে টেনে নিয়ে গেল খাওয়ানোর জন্য। এই খাওয়ানোর
পালা চলবে কমপক্ষে তিন ঘন্টা।
আজ কত তারিখ? মনে করতে পারছি না। সত্যি সত্যি কি স্মৃতি নষ্ট
হয়ে গেল নাকি? ছোটবেলায় দেখা আসামী সিনেমার কথা মনে পড়ছে। সিনেমার শুরুতে মাথায় লাঠির
বাড়ি খেয়ে রাজ্জাক সব ভুলে যায়। সিনেমার শেষের দিকে আবার মাথায় বাড়ি। সব স্মৃতি ব্যাক
টু দ্য ব্রেইন। আমারও সেরকম হলে তো ঝামেলা হয়ে যাবে। একবার যা হয়েছে তা আবার হলে বাঁচার
সম্ভাবনা থাকবে না।
মনে মনে হিসেব করে দেখলাম – ২২মে এখানে এসেছি। আজ জুন মাসের
৬ তারিখ। ১৬ দিন চলে গেছে একটা লাইনও পড়িনি। আর ২০ দিন পরেই আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা।
অথচ এখনো ঠিকমতো মাথা তুলে বসতেও পারছি না। জোর করে উঠে বসলাম। অ্যান্টিবায়োটিক খাবার
সময় হয়েছে। আমাকে দ্রুত সুস্থ হয়ে যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার মেসের রুমে ফিরে
গিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে।
পরীক্ষার জন্য জোরেশোরে প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম মে মাসের
২০ তারিখ থেকে। ২০ তারিখ রিলেটিভিটির লাস্ট টিউটোরিয়াল ছিল। ওটা শেষ করে সেদিন থেকেই
পড়তে বসেছিলাম। আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার ফার্স্ট ডেট দিয়েছিল মার্চে। ওটা এমনিতেই
পিছিয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারিতে চাকসু নির্বাচন হলো। ছাত্রশিবিরের ভরাডুবি হবার পর আশা করেছিলাম
সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য শুধুমাত্র নির্বাচনী ঐক্য নয়, সত্যিকারের ঐক্যবদ্ধভাবে ক্যাম্পাসে
প্রগতির পরিবেশ তৈরি করবে, স্বাধীনতার পক্ষশক্তির উত্থান ঘটবে। কিন্তু আশাভঙ্গ হতে
বেশিদিন লাগেনি।
রমজান শুরু হবার আগে মার্চের শেষের দিকে চাকসুর অভিষেক অনুষ্ঠান
হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। বিশাল আয়োজন। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। তবুও ছাত্রছাত্রীদের
উচ্ছ্বাসের অন্ত ছিল না। কাদেরী কিবরিয়া, ফাতেমা-তুজ-জোহরা, ফকির আলমগীর আর ডাকসুর
সাংস্কৃতিক দল এসেছিল। অনেক রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলেছিল। কিন্তু এত আয়োজনের মধ্যেও
ছাত্রলীগ আর ছাত্রদলের মধ্যে মারামারি লেগে যাবার উপক্রম হয়েছে। নির্বাচনে যেতার পরই
ছাত্রঐক্যের বারোটা বেজে গেছে তা বুঝে গেছে সবাই। তবুও গত চার বছর ধরে ক্যাম্পাসে যে
সাংস্কৃতিক খরা চলছে – তা থেকে মুক্তির জন্যই সব শিক্ষার্থী জোটকে ভোট দিয়েছে। কিন্তু
নেতারা এখনই নিজেদের স্বার্থ নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিয়েছে। এতে শিবিরেরই লাভ হচ্ছে।
নির্বাচনে পরাজিত হয়েও তারাই এখনো সবগুলি হল দখল করে রেখেছে।
আমাদের পরীক্ষার আরেকটা তারিখ দেয়া হয়েছিল মে মাসের আট তারিখ।
সেটা পেছানোর জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে। প্রফেসর আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন সাধারণত
পরীক্ষা পেছানোর পক্ষপাতী নন। কিন্তু হয়তো পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ অফিস কোন কারণে মে মাসে
পরীক্ষা নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাই পরীক্ষা পিছিয়ে ২৭ জুন নতুন তারিখ দেয়া হলো।
এই তারিখ আর পেছানোর সম্ভাবনা নেই। পরীক্ষার রুটিনও দিয়ে দিয়েছে। ২৭ জুন ফার্স্ট পেপার
পরীক্ষা হবার পর কোরবানের বন্ধ আছে। সেকেন্ড পেপার পরীক্ষা ১৭ জুলাই।
এপ্রিল মাস পুরোটা রমজানের ছুটিতে গেছে। পড়ালেখা হচ্ছে না
বলে টেনশান করেছি সত্য, কিন্তু পড়াশোনা করিনি। বইপত্র ক্লাসনোট সব গুছিয়ে নিয়ে পড়তে
পড়তে নিজের নোট তৈরি করছিলাম। দু’দিন বেশ ভালোই চললো। সারাদিনের মধ্যে সন্ধ্যাবেলা
ঘন্টাখানেক মুকিতভাইয়ের সাথে গল্প করি। তিনিই আমার রুমে আসেন। দুজনে বের হয়ে একটু রাস্তায়
হেঁটে আসি। আসার সময় ইসলাম সওদাগরের রেস্টুরেন্ট থেকে টিফিন কিনে নিয়ে আসি, রুমে এসে
গল্প করতে করতে খাই। রাতে টিভি দেখাও কমিয়ে দিয়েছি। অনেক সিরিয়াস হয়েছি ভেবে মনে মনে
কিছুটা আত্মতৃপ্তিও পেতে শুরু করেছিলাম।
কিন্তু বাইশ তারিখ সন্ধ্যায় একটু ঝামেলা হয়ে গেল। বাইরে থেকে
দরজা খুলে রুমে ঢুকলাম। আমার পেছনে মুকিতভাই। হেঁটে আসার ফলে বেশ গরম লাগছিলো। আমার
টেবিলফ্যানটা টেবিল থেকে সরিয়ে খাটের দিকে
করে দেয়ার জন্য হাতে নিতেই কী হলো বুঝার আগেই দেখা গেলো আমি শূন্যে উঠে আছড়ে পড়েছি
ফ্লোরে। আর মুকিতভাই হতভম্ব হয়ে আমাকে ওঠাচ্ছেন।
উঠে দাঁড়াতেই দেখা গেলো আমার মাথার পেছন থেকে ফিনকি দিয়ে
রক্ত বের হচ্ছে। হাত দিয়ে চেপে ধরে বোঝার চেষ্টা করলাম কী হলো। টেবিলফ্যানটার পুরো
বডি স্টিলের। ওটা কোন কারণে শর্টসার্কিট হয়ে গিয়েছিল। পায়ে স্যান্ডেল না থাকলে কী হতো
জানি না। আছড়ে না পড়লে মৃত্যু হতো। আর আছড়ে পড়েছি খাটের পায়ের নিচে যে ইট ছিল সেই ইটের
উপর। একটা ইটের কোণা ঢুকে গেছে মাথার পেছনদিকে। ওখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে গলগল করে।
হাত ভিজে গেছে রক্তে। দড়ি থেকে গামছা টেনে নিয়ে জোরে মাথা টিপে ধরলাম।
মুকিতভাই ঘেমে ভিজে গেছেন একেবারে। মনে হচ্ছে তাঁর ফর্সামুখ
রক্তশূন্য হয়ে গেছে। ফ্যানের প্লাগ লাগিয়ে তিনিই সুইচ অন করেছিলেন বলে নিজেকে অপরাধী
মনে করছেন। তিনি হায় হায় করছেন। কিন্তু এটা হায় হায় করার সময় নয়। ড্রয়ার খুলে টাকা
যা ছিল সব নিয়ে বের হলাম।
রিকশা করে চৌধুরিহাটে এসে ডাক্তার শাহাদাত হোসেনের চেম্বারে
গেলাম। ফতেয়াবাদ কলেজের গেটের সামনে তাঁর চেম্বার। তিনি আমাদের ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল
সেন্টারের ডাক্তার। সন্ধ্যায় চৌধুরিহাটে চেম্বার করেন। আমরা যখন গেলাম তখন তিনি চেম্বারে
নেই। আরো কয়েকজন রোগী অপেক্ষা করছেন। পাশাপাশি চেয়ারে বসে মুকিতভাই আমার মাথায় গামছা
চেপে ধরে আছেন আমার হাতের উপর দিয়ে। গামছা ভিজে গেছে। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না এখনো। তার
মানে ইটের কোণা অনেকদূর ঢুকেছে।
ডাক্তার কতক্ষণে আসবেন জানি না। চেম্বারে সহকারী যিনি আছেন
– তিনি বললেন ডাক্তার নিজের বাড়িতে গেছেন একটু কাজে। চলে আসবেন। ডাক্তারের বাড়ি কতদূর
তা তো জানি না। এমন সময় কারেন্ট চলে গেলো।
এই কারেন্টের জন্যই প্রাণটা যেতে বসেছিল একটু আগে। পদার্থবিজ্ঞানের
ছাত্র হিসেবে জানি যে সামান্য বৈদ্যুতিক শকেই মানুষের মৃত্যু হতে পারে। আমাদের হৃৎপিন্ডের
যে অবিরাম সংকোচন-প্রসারণ চলছে তার জন্য খুব সামান্যই কারেন্ট লাগে – মাত্র কয়েক মিলি
অ্যাম্পিয়ার। কিন্তু এসি কারেন্ট যদি হৃৎপিন্ডের ভেতর দিয়ে যায় – তাহলে সংকোচন-প্রসারণ
চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর আগেও আমি দু’বার বড় ধরনের বৈদ্যুতিক শক খেয়েছি। দু’বারই
মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছি। একবার চিটাগং কলেজের রেডবিল্ডিং-এ তিনদিন ধরে কারেন্ট ছিল
না। বাইরে সবখানে কারেন্ট আছে, সেই বিল্ডিং-এর দোতলাতেও আছে, অথচ তিন তলায় নেই। কৌতূহলী
হয়ে সব তার চেক করতে করতে ইউরেকা – একটা চিকন তার পেয়ে গেলাম। ওটা লাগাতে গিয়েই প্রচন্ড
ধাক্কা। আরেকবারও আমার হোস্টেলের রুমে। হোস্টেলে বৈদ্যুতিক সংযোগের যে কী খোলামেলা
এলোমেলো অবস্থা তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না কেউ।
অন্ধকারে বসে থাকতে থাকতে মুকিতভাই নিচুস্বরে বললেন, “না
দেখে সুইচ দেয়া উচিত হয়নি আমার।“
“ওটা আমি দিলেও হতো। দুর্ঘটনা তো ঘটতেই পারে।“
ঘন্টাখানেক পর ডাক্তার এলেন, কিন্তু কারেন্ট এলো না। মোমবাতির
আলোতে ডাক্তার কীভাবে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করলেন, সেলাই করলেন আমি জানি না। অনেকক্ষণ
লাগলো। ওষুধপত্র নিয়ে রিকশা করে ফিরে আসার সময় ঠিক করলাম দিদির বাসায় চলে যাবো। এখানে
থাকলে মুকিতভাই অহেতুক ব্যস্ত হবেন। নিজেকে অপরাধী ভাববেন আর আমাকে আমার মতো থাকতে
দেবেন না।
রুমে ঢুকে দ্রুত কিছু বইপত্র আর জামাকাপড় নিয়ে বের হয়ে পড়লাম।
মুকিতভাই কিছুতেই আমাকে একা আসতে দিলেন না। একেবারে দিদির বাসায় আমাকে ঢুকিয়ে দিয়ে
তবে চলে গেলেন। বাসায় একটু বসলেনও না। বসার সময়ও ছিল না। তাঁকে আবার ছরারকুলে ফিরতে
হবে।
রাত তখন প্রায় এগারোটা। দিদিরা খেতে বসেছিল। আমাকে এ অবস্থায়
দেখে কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেল। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার আগেই আমি সবার সামনে সংক্ষেপে
বলে দিলাম কী হয়েছে।
আমার ঘুম পাচ্ছিলো। তারপর আর কিছু মনে নেই। পরদিন ঘুম ভাঙলো
অনেক দেরিতে। দেখলাম দিদি বসে আছে আমার বিছানার পাশে। অফিসে যায়নি। আমার সারাশরীর ব্যথা।
হাঁটুতে আর কনুইতে প্রচন্ড ব্যথা। ফ্লোরে যে আছাড় খেয়ে পড়েছিলাম তখন লেগেছে। মাথার
দিকে নজর দিতে গিয়ে অন্য দিকের ব্যথা বুঝতে পারিনি। ব্যথায় জ্বর-টর এলো। তিন-চারদিন
পর সবকিছু গা-সহা হয়ে গেলো। পরীক্ষার কথা মনে পড়লো। খাতাপত্র খুলে বসলাম। কিন্তু পড়তে
গেলেই মাথায়, কপালে, চোখে প্রচন্ড ব্যথা লাগে, সবকিছু ঝাপসা হয়ে যায়। আমি কি অন্ধ হয়ে
যাচ্ছি নাকি? আমার কেন যেন নার্ভাস লাগতে থাকে।
মুকিতভাই আর এখলাস এলো আমাকে দেখতে। এখলাস মজার মজার কথা
বলে আমাকে হাসাতে চেষ্টা করলো। অন্যসময় হলে তার এসব কথায় আমি ঘরফাটানো হাসি দিতাম।
কিন্তু এখন হাসতে গেলেই মাথায় টান পড়ে। দিদিদের বাসার উপরের তলায় রীতারা থাকে। রীতা
আমার চিটাগং কলেজের বন্ধু। একদিন সে এলো। তারপরের দিন টিপু আর মিনি এলো। অজিত এলো কয়েকদিন
পর। প্রদীপ নাথ আর বিপ্লব এসে দেখে গেলো। আমার বন্ধুদের আনাগোনা ভালো লাগছে। কিন্তু
প্রত্যেকেরই তো পরীক্ষা। আমার নিজের পরীক্ষার কী হবে চিন্তা করলেই চোখে অন্ধকার দেখছি।
চোখে ব্যথা লাগলেও করার কিছু নেই। জোর করে একটু আধটু পড়ালেখার
চেষ্টা করছি। এখন সব সাবজেক্ট পড়ার আর সময় নেই। ফার্স্ট পেপারের প্রস্তুতি নিই এখন।
পরে কোরবানের ছুটিতে অন্য সাবজেক্ট পড়তে হবে। মেসে আমার রুমে ফিরে যাওয়া দরকার। কিন্তু
দিদি কিছুতেই ফিরতে দিচ্ছে না। ডাক্তার শাহাদাতের কাছে গেলাম একদিন ফলো-আপ করার জন্য।
সাথে গেলো আমার এক ভাগনে বিশু। ডাক্তার ব্যান্ডেজ খুলে কিছুটা চিন্তিত মুখে বললেন এখনো
ক্ষতস্থান শুকায়নি। আবার ব্যান্ডেজ করে দিলেন। বিশুসহ রুমে এসে অপটিক্সের বইপত্র নিয়ে
চলে এলাম।
সেদিন রাতে এলো প্রচন্ড জ্বর। সমানে ওষুধপত্র খাওয়ার পরেও
জ্বর কমছে না। ডাক্তার শাহাদাতের উপর আমার আস্থা থাকলেও আমার দিদির আস্থা রইলো না।
গতকাল বিকেলে সে আমাকে নিয়ে গেলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সার্জারির প্রফেসর ফারুকের
কাছে। মেডিকেল কলেজের আবাসিক এলাকায় নিজের বাসায় তিনি রোগী দেখেন।
ডাক্তার ফারুক আমার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে দিলেন। আবার নতুন
করে ছুরিকাঁচি সুঁইসুতা নিয়ে অনেককিছু করলেন। আমি প্যাসেন্ট-বেডে উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে
কেবলি ভাবছিলাম – আমার পরীক্ষার আর মাত্র ২১ দিন আছে।
মাথায় আবার ব্যান্ডেজ করে দিলেন। প্রেসক্রিপশান লেখার সময়
আমার দিদি আর ডাক্তারের মধ্যে কথোপকথনের কিছু অংশ এরকম –
“তার ফাইনাল পরীক্ষা জুনের ২৭ তারিখ থেকে। সে কি পরীক্ষা
দিতে পারবে?”
“জীবনের চেয়ে পরীক্ষা বড়? জীবন বাঁচলে কত পরীক্ষা দিতে পারবে।“
– দেখলাম ডাক্তারের কথা শুনে আমার দিদির মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য-ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কোনরকমে
সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “সিরিয়াস কিছু হয়েছে?”
“এখনো বলা যাচ্ছে না। মাথার পেছন দিকে তো, অনেক ব্যাপারস্যাপার
আছে সেদিকে। হেড ইনজুরি দেখে অনেকসময় বলা যায় না ব্রেইন ইনজুরি কি না। ব্রেইন স্ক্যান
করলে জানা যাবে। আপাতত দেখেন কয়েকদিন।“
“ব্রেইন ইনজুরি …” – দিদি কী প্রশ্ন করবে বুঝতে পারছে না।
“আশা করি ব্রেইন ইনজুরি হয়নি। মাঝে মাঝে টেস্ট করে দেখবেন
– মেমোরি লস হচ্ছে কি না।“
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হবার পর থেকেই শুরু হয়ে গেছে
আমার মেমোরি টেস্ট। রিকশা অলিয়ঁজ ফ্রসেস পার হয়ে আরেকটু সামনে আসতেই দিদি প্রশ্ন করলো,
“সামনের মোড়টার নাম কী বলতো?” তার বাসার গেট দিয়ে ঢোকার সময় জিজ্ঞেস করলো, “আমাদের
বাসা কোন্ তলায়?” “সাত আর আট যোগ করলে কত হয়?”– তার কান্ড দেখে আমার হাসি পাচ্ছে।
বাসায় এসে আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। দিদি কাকে কী বলেছে জানি
না। বাসার তিন বছরের শিশুটা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “ছোতমামা, তুমি আমাকে চিন?” মেমোরি
টেস্ট এমনভাবে শুরু হলো যে ইচ্ছে করছিলো এমন ভাব করি যেন সবকিছু ভুলে গেছি। কিন্তু
দিদি যেভাবে টেনশান করছে – তাকে আর কষ্ট দিতে ইচ্ছে করলো না।
বিশু ভাগনে আমার সাথে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। সে পুরো ঘটনা
জানেও না কীভাবে কী হয়েছে। কিন্তু সে তার মামার বাড়ি – অর্থাৎ আমার মাসির বাড়িতে গিয়ে
সবাইকে অনেক ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলেছে আমার মাথার খারাপ অবস্থা। আর তারা বুঝেছে আমার মাথা-খারাপ
অবস্থা। সোজা বাংলায় বাংলা সিনেমার মতো – মাথায় বাড়ির পরে মাথা খারাপ।
স্মৃতিবৌদি কাল সন্ধ্যায় এসেই হয়তো দিদিকে এই প্রশ্ন করেছে।
দিদি কী বলেছে আমি শুনতে পাইনি। স্মৃতিবৌদির কথা কানে গেলো, “অ বুক! এব্বেরে বেগিন
পঅরাই ফেলাইয়ে নে? বেগিন? ছাবগরি?”
সবকিছু ভুলে গেলে কী হতো জানি না। ডাক্তার ফারুকের চিকিৎসায়
কাজ দিলো। পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে আমার জ্বর নেমে গেল। পাঁচ দিনের মাথায় আবার গেলাম।
ব্যান্ডেজের সাইজ ছোট হয়ে গেল। আরো পাঁচদিন পর সেলুনে গিয়ে মাথা কামিয়ে ফেললাম। দিদির
সাথে অনেক বোঝাপড়া করে, খারাপ লাগলেই আবার তার বাসায় চলে যাবো এসব বলে মেসে এলাম পরীক্ষার
মাত্র এক সপ্তাহ আগে।
পরীক্ষার জন্য এতদিন টেনশান করছিলাম – রেজাল্ট ভালো হবে কি হবে না এই ভেবে। সেই টেনশান এখন বিলাসিতার পর্যায়ে চলে গেছে। আমার জন্য এখন সুস্থ শরীরে পরীক্ষাটা দিতে পারাটাই বড় কথা।
এ পর্বটা অন্যরকম সুন্দর ছিল। তোমার অসাধারণ লেখার হাত যেন পুরো ঘটনাকে আমার সামনে জীবন্ত করে তুলেছে। সত্যিই সহ্য করার ক্ষমতা তোমার অসম্ভব।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ অনন্যা।
Delete